২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বৃষ্টি, কবিতা এবং ফজল শাহাবুদ্দীন

-

সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি অফিসের বারান্দায় বসে দূরে নারকেল গাছের ডালে একটি ভেজা কাকের অহেতুক পাতার ফাঁকে নিজেকে আড়াল করার দৃশ্য দেখছিলাম আর গরম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। এমন সময় অফিসের পিওন এসে জানাল নিচে কেউ গাড়িতে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। একটু বিরক্ত হয়েই আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বারান্দা থেকে নিচের পার্কিং দেখা যায়। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম আরো দুটো গাড়ির সাথে পার্কিংয়ে ফজল ভাইয়ের গাড়িটাও। ফজল ভাই মানে ফজল শাহাবুদ্দীন। পঞ্চাশের প্রবল কবি। চমকে উঠলাম। এই বৃষ্টিতে কেউ বাসা থেকে বের হয়! নিচে নেমে এলাম। উনি আমাকে দেখে গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। আমি এক দৌড়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। এরই মধ্যে অজস্র বৃষ্টির চুমু লেগে গেছে আমার শরীরে। আমি চুল থেকে জলের ছোঁয়াগুলো মুছে ফেলতে হাত তুলতেই ফজল ভাই এগিয়ে দিলেন একটা তোয়ালে। এটা তার গাড়িতেই থাকে। বললেন, সব মুছে ফেল। ঝেড়ে-টেড়ে নাও। ড্রাইভারকে বললেন, চলো। ফজল ভাইয়ের এ আচরণের সাথে আমি মোটামুটি অভ্যস্ত। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়? তিনি ধমকের সুরে বললেন, বইসা থাকো মিয়া। কবিতা লিখবা আর বৃষ্টিতে ভিজবানাÑএইটা কি হয়? আমি চুপ। গাড়ি গেট ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। দেখলাম, বৃষ্টি ঝরে পড়ছে মাধবীলতায়, ফুটন্ত বেলির শরীরে আর রজনীগন্ধায়।
গাড়ি চলছে। শহর পেরিয়ে আমরা চিটাগাং রোডে। ফজল ভাই বললেন, তোমার মোবাইলে গান আছে না? বললাম, আছে তো। তিনি একটু ক্ষেপে গেলেন। বললেন, ছাড়ছো না কেন? আমি খুঁজে খুঁজে সেই গানটা ছাড়লাম, এমনি বরষা ছিল সেদিন/শিয়রে প্রদীপ ছিল মলিন/তব হাতে ছিল অলস বীন/মনে কি পড়ে প্রিয়। হঠাৎ গাড়ির মধ্যে নেমে এলো এক গভীর নিস্তব্ধতা। সব চুপচাপ। ফজল ভাই বাইরে তাকিয়ে আছেন। চারদিকে বৃষ্টি-বৃষ্টি। সামনের বিশ হাত দূরের জিনিসটাও অস্পষ্ট। আমি গভীরভাবে তাকিয়ে দেখলাম, ফজল ভাইয়ের চোখের কোন চিকচিক করছে। গানটা থেমে গেল একসময়। কিন্তু নির্জনতা ভাঙল না। আমরা চুপচাপ। কেউ কথা বলছি না। বৃষ্টি ভেঙে এগিয়ে চলছে গাড়ি।
সব কথা কি সবার মনে পড়ে? ফজল ভাইয়ের অস্পষ্ট উচ্চারণে ভেঙে গেল নীরবতা। আমি বললাম, না ফজল ভাই। সব কথা সবাই মনে রাখে না। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর আবার হারিয়ে গেলেন বাইরে, বৃষ্টিতে বর্ষায়, দূরে কোথাও।
ফজল ভাইয়ের কথায় হঠাৎ চমক ভাঙল, এই ড্রাইভার ডানে যাও। ডানে গাড়ি ঘুরে একটু এগোতেই তিনি বললেন, থামো। গাড়ি থামল। তাকিয়ে দেখলাম, একটি রেস্তোরাঁ। নাম বিসমিল্লাহ। ফজল ভাই ড্রাইভারকে বললেন, ছাতা ধরো। ছাতা মাথায় নিয়ে তিনি নেমে গেলেন। আমি তার পিছু পিছু। দোকানে ঢুকে তিনি দেখলেন আমি এসে গেছি এবং যথারীতি বৃষ্টিতে ভিজে। তিনি ধমকে উঠলেন, মিয়া মানুষ হবা না। একটু সবুর করতে পারলা না। আবার ভিজলা। এবার আমি হেসে ফেললাম এবং পকেটে থাকা টিস্যু দিয়ে মাথার পানি মুছতে লাগলাম।
তাকে দেখে হোটেলের তিনটি বয়ই এসে জড়ো হলো। স্যার কি খাইবেন? ফজল ভাই বললেন, পরাটা ভাইজা দে। সাথে ডাবল ডিমের ওমলেট। একটু থেমে বললেন, হাঁসের ডিম দিস, বেশি কইরা পেঁয়াজ দিয়া ভাজবি। আমার চোখ তো ছানাবড়া। বলে কী! ডাবল ডিম তাও আবার হাঁসের। তিনি আমার অবস্থা দেখে হেসে ফেললেন। বললেন, আরে মিয়া যত দিন বাঁচবা মন ভইরা খাইয়া যাবা। আরতো জীবন নাই। একজীবনে যা মন চায় তাই কইরা যাও। আমি আবারো হাসলাম। ডিম দিয়ে পরাটা খেতে খেতে ফজল ভাই অর্ডার দিলেন গরুর গোশত এবং মুরগি কারির। ধোঁয়া ওঠা গরুর গোশতের ঝোলের মধ্যে পরাটা ডুবাতে ডুবাতে বললেন, এই হোটেলটার গরু খুব ভালো। একটা মুসলমান মুসলমান গন্ধ আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, বিহারি নাকি? তিনি বললেন, না। তবে রান্নাটা ওদের মতো।
খেতে খেতে তিনি বললেন, জানো মিয়া, আমাদের কবিতা একদিন এই গোশতের মতো ছিল, এখন কেমন যেন পাঠাপাঠা গন্ধ। জিজ্ঞেস করলাম, সেটা কি রকম? তিনি বললেন, আঁশহীন লেবড়া চেবড়া। আমার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, বুঝলা না। আমি মাথা নাড়াতেই বলে উঠলেন, কবিতার শব্দচয়ন, গন্ধবর্ণ বিন্যাসে সেই তেজী ভাব, নিরেট বুনন আর নেই। সত্তরের যে ভাটা, তা এখনো চলছে। তবে এরই মধ্যে কেউ কেউ খুব ভালো কবিতা নিয়ে বের হয়ে আসছে কিন্তু তাদের সংখ্যা বেশি না। আমরা পঞ্চাশে ২৫-২৬ জন কবি ছিলাম। তুমি কাউকেই ফেলতে পারবা না। সেই তুলনায় ষাট অনেক পেছনে।
বললাম, তা সত্য। তবে সত্তর তো বেশ ঝাঁজালো। তিনি বললেন, হয়তো বা। তবে যুদ্ধ আর সংগ্রামের একটা প্রভাব সত্তরে ছিল এইটা তো স্বীকার করবা। বললাম, হ্যাঁ তা করি। তিনি বললেন, একারণেই সত্তর কিছুটা তেজী। তোমাদের আশিতে সেই তেজ নেই। তবে তোমরা কিছু নতুন কাজ শুরু করছো, এইটা ভালো।
জিজ্ঞেস করলাম, এরপর? তিনি মুচকি হাসলেন। বললেন, জীবন তো জোয়ার-ভাটার মতো। কবিতাকে এর থেকে বাদ দিবা কেমনে। এখন তরুণরা অবশ্য ভালো লেখার চেষ্টা করে। সবচেয়ে বড়ো কথা, ওরা পড়ে। তুমি যতই পড়বা ততই সমৃদ্ধ হবা। আমি তরুণদের নিয়া খুব আশাবাদী।
আমি মাথা নাড়লাম। তিনি বললেন, কি মিয়া বিশ্বাস হচ্ছে না। বললাম, কেন হবে না? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ফজল ভাই রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলকে নিয়ে অনেকেই পাল্টাপাল্টি কথা বলে। আমার কথা শেষ না হতেই তিনি বেশ রাগতস্বরেই বললেন, রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই। আর নজরুল সেতো ধ্রুবতারা। দুই জ্যোতিতেই আমাদের কবিতা পূর্ণ এবং আলোকিত। এই দুইজনারে যারা তুলনা করে তারা মূর্খ। জানতে চাইলাম, জীবনানন্দ কিংবা মাইকেল সম্পর্কে আপনার ধারণা কি? মৃদু হেসে তিনি বললেন, মাইকেলই প্রকৃত আধুনিক কবিতার জনক। আর জীবনানন্দ কবিতার একটা শান্ত স্থির জীবনবোধ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এরা দু’জন আলাদা ভুবনের বাসিন্দা। কারো সাথে কারো তুলনা চলে না। তোমরা জীবনানন্দকে আধুনিক কবিতার জনক বলো, আমি মনে করি, এই আধুনিকতার স্রষ্টা মাইকেল। তোমাদের সাথে এইটাই পার্থক্য আমার।
বললাম, ফররুখকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেনÑ উত্তরে গম্ভীর হয়ে গেলেন তিনি। মনে হলো, খুব দূর থেকে ধীরে ধীরে বলছেনÑ একাকী সিন্দবাদ এই মানুষটাকে আমার ইকবাল, কায়কোবাদ কিংবা রুমির সাথে তুলনা করতে ইচ্ছে করে। এত বড় কবির মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি। মূর্খেরা ইসলামী রেনেসাঁর কবি বানিয়ে তাকে ব্রাকেট করে দিলো।
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, অনুচ্চারিত মাইকেল, ফররুখ আর জসীমউদ্দীনকে আমাদের নতুন করে মূল্যায়ন করা উচিত। তাদের পাঠ করলে এক অনাস্বাদিত ভুবন আবিষ্কৃত হবে। বলতে বলতে তিনি তখন আবৃত্তি করা শুরু করেছেন, সতত হে নদ তুমি পড়ো মোর মনে’।
আমি তাকিয়ে থাকলাম। বাইরে বৃষ্টি তখন কমে এসেছে বাড়ছে গাড়ির ভিড়। আবৃত্তি থামিয়ে তিনি হঠাৎ চিৎকার করে বয়স্ক বয়টাকে ডাকলেন। বললেন, ওই মিয়া বিল দাও। গুনে গুনে বিলের টাকা পরিশোধ করে উঠে দাঁড়ালেন। দরজার সামনে এসে আবার ফিরে গেলেন। তিনটা বয়কেই কাছে ডাকলেন। একশো টাকার তিনটা নোট তুলে দিলেন এক এক করে ওদের হাতে। তারপর ছাতি আনতে না বলেই ছুটে উঠে গেলেন গাড়িতে। আমিও তার পিছু পিছু। না, এবার বেশি ভিজলাম না। গাড়ি ছুটল ঢাকার পথে। চারপাশে বৃষ্টির ক্ষত। জল উড়িয়ে উড়িয়ে আমরা ছুটছি। বৃষ্টির পর প্রকৃতি কত শান্ত, কত স্বচ্ছ হয়ে যায়।
দেখতে দেখতে চিটাগাং রোড পার হয়ে গাড়ি এসে পৌঁছল সায়েদাবাদ। বেশ যানজট। জিজ্ঞেস করলাম, ফজল ভাই, সমসাময়িকদের নিয়ে কিছু বলুন না। কাত হয়ে আমার দিকে তাকালেন তিনি। চোখ দুটো কেমন যেন আড়ষ্ট, ঘোলা ঘোলা। আমি কিছুটা বিব্রত। তিনি বললেন, এখন তো শামসুর আর মাহমুদের লড়াই। আমি, শহীদ কিংবা সৈয়দ হক কেউই ওদের কাছাকাছি নেই। কে প্রথম তা বলার আমি কে? কে কবি আর কে কবি নয়, তার বিচার তো মহাকালের হাতে। তিনি বললেন, যাকে পাঠক ধরে রাখবে, রবীন্দ্রনাথের মতো শতবর্ষের পরেও যিনি পাঠে থাকবেন তিনিই তো সেরা। সেই পর্যন্ত আমি বাঁচবো না, তুমিও না। ওইসব নিয়া ভাইবা কোনো লাভ নাই মিয়া। তুমি কি করলা সেইটা ভাবো। বড় নয়, টিকে থাকার লড়াই করো। টিকে থাকতে থাকতে একসময় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবা। বলেই, একটা নিশ্বাস ফেললেন তিনি। বললেন, আর একটা গান ছাড়ো। আমি বাজালাম, ‘ও দূরকে মুসাফির, হামকো ভি সাথ লে লে, হাম র্যাহে গ্যায়ে একেলে’। গান শুনতে শুনতে আমরা কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম। গাড়ি কখন এসে পৌঁছল বেইলি রোডে টেরই পেলাম না। নামার সময় তিনি শুধু বললেন, গানটা শুনিয়ে মনটা খুব খারাপ করে দিলা মিয়া। বলেই মুখটা ফিরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। তিনি কি কান্না গোপন করলেন বুঝতে পারলাম না। গাড়িটা বেরিয়ে গেল চোখের সামনে গেট দিয়ে। এই জিজ্ঞাসার উত্তর আমি আজো পাইনি। সেদিন সত্যিই কি তিনি কেঁদেছিলেন? হ

 

 


আরো সংবাদ



premium cement