২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রুবাইয়াৎ-ই সৈয়দ আজিজ

-

‘রুবাই’ শব্দটি ফারসি ভাষার এক বচন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ‘রুবাইয়াৎ’ হচ্ছে বহুবচন। রুবাই হচ্ছে মূলত চতুষ্পদী কবিতা, চার চরণের মধ্যে একটিমাত্র ভাবকে হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করা। প্রেম, দ্রোহ, আনন্দ, বিষাদ, মানব হৃদয়ের আশা, আকাক্সক্ষার প্রতিফলনের চিত্র অঙ্কিত হয় রুবাইয়াতের ছত্রে ছত্রে। আশাবাদ, নৈরাশ্যবাদ, সুফিবাদ, মরমিবাদ, দেহবাদ, নিয়তিবাদ এবং দর্শন তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে রুবাইয়াতের চরণে। রুবাইয়াতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলোÑ প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ ছত্রে থাকে অন্ত্যমিল আর তৃতীয় ছত্রে থাকে অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে অন্যান্য চরণের ব্যতিক্রম। রুবাইয়াতের সাথে চীনা চতুষ্পদী কবিতা, জাপানি হাইকু, মালয়ি পাণ্ডমের সাদৃশ্য পেয়েছেন অনেক পণ্ডিতজন। রুবাই ফারসি সাহিত্যকে শুধু সমৃদ্ধই করেনি, পৃথিবীতে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা দিয়েছে। ফারসি সাহিত্যের কাব্যকে প্রধানত চারটি শ্রেণীতে বিভাজন করা হয়। যথাÑ ১. কাচ্চিদা (রঙ্গ বা ব্যঙ্গ কাব্য), ২. গজল (প্রেমগীত), ৩. মসনবি (দীর্ঘ কাব্যগাথা), ৪. রুবাই বা রুবাইয়াৎ।
রুবাইয়াৎ কাব্যের উত্থান ঘটেছে ইরানের বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়ামের হাত ধরে। তার পুরো নাম গিয়াস উদ্দিন ইবনে আল ফাতাহ ওমর ইবনে ইব্রাহীম আল খৈয়াম। ওমর খৈয়াম কবি ছাড়াও জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ এবং দার্শনিক হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করেছেন নিজস্ব প্রতিভায়।
অনেক পণ্ডিতজন মনে করেনÑ তিনি রুবাইয়াৎ লিখেছেন নিতান্ত খেলার ছলে কিংবা আবেগী উচ্ছ্বাসে। সেলজুক বংশীয় স¤্রাট মালিক শাহের তিনি ছিলেন রাজ জ্যোতিষ। তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মালিক শাহের পিতার প্রধান উজির নিজাম উল মুলক। ওমর খৈয়ামের জন্ম ইরানের খোরাসানের নিশাপুর শহরে। সম্ভবত ১০২১-২২ কিংবা ১০৪৮ খ্রিষ্টাব্দে। ওমর খৈয়াম অর্থাৎ পদবি হচ্ছে খৈয়াম যার ব্যুৎপত্তি খৈয়াম যার শাব্দিক অর্থ ‘তাঁবু নির্মাতা’। কবি নিজেই নিজের পদবি নিয়ে উপহাস করতে মোটেই বিচলিত হননি। উপহাস করতে গিয়ে লিখেনÑ
‘জ্ঞানের তাঁবু সেলাই করে খৈয়াম গেল বুড়ো হয়ে
ছিঁড়ে গেছে সূত্র এবার দিন কাটে তার দুঃখ সয়ে
ভাগ্যকাঁচি কাটল তারে হয়েছে সে পণ্য আজি
বিক্রিওয়ালা হাঁকছে লহ একটি গানের বিনিময়ে।’

ওমর খৈয়াম মতান্তরে ওমর খাইয়াম আরো আটজন গণিতবিদের সহায়তায় একটি পঞ্জিকা প্রণয়ন করেন, যার নাম (স¤্রাটের নামানুসারে) জালালি সন নামকরণ করা হয়। তিনি গণিতশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্রের ওপর বহু গ্রন্থের প্রণেতা। পরবর্তীতে ওমর খৈয়াম ক্যালেন্ডারও তৈরি করেন। জীবদ্দশায় ওমর খৈয়াম কবি হিসেবে তেমন একটা জনপ্রিয়তা না পেলেও দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ এবং বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করেছেন। বিজ্ঞান, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থগুলোর বেশির ভাগ আরবি ভাষায় তিনি রচনা করেছেন। সামান্য কিছু ছোট গ্রন্থ এবং ইবনে সিনার লেখার অনুবাদ কেবল ফারসি ভাষায় লিখেছেন।
অমর খৈয়ামকে বিভিন্ন সময় ইমাম-এ খোরাসান, আল্লামা-এ-জামান, ইজ্জাতুল হক ইত্যাদি নামে ডাকা হতো। তার সম্পর্কে এসব বর্ণনামূলক ঘটনা প্রথম লিখেছেন তার শিষ্য নিজাম আরুজি ‘চাহার মাকালা’ নামক গ্রন্থে।
ওমর খৈয়ামকে নিশাপুরে নিজ জন্মভূমির মাটিতে কবরস্থ করা হয়। কবর ফলকের ওপর তার একটি রুবাইয়াৎ লেখা রয়েছে, যার বাংলা অনুবাদটি এমনÑ
‘রে মন জামানা যখন তোমাকে দুঃখ দেবে
এবং প্রাণ পাখিও দেহ পিঞ্জর ছেড়ে যে কোনো মুহূর্তে পাখা মেলতে পারে
তখন এই সবুজের উপর দু’টি দিন স্বস্তিতে কাটাও
তোমার সমাধির উপর সবুজ ঘাস গজাবার পূর্বে।’
ওমর খৈয়াম প্রেমিক হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত বিখ্যাত। বুখারায় পড়াশোনার সময় একই সঙ্গে দুই তরুণীর সঙ্গে প্রেম করতেন। একজন রুবাই আরেকজন রুবাইয়াৎ। রুবাই ছিলেন গড়নের দিক থেকে মাঝারি আর রুবাইয়াৎ ছিলেন দীর্ঘাঙ্গী। দু’জনই জানতেন ওমর খৈয়াম দু’জনকে এক সঙ্গে ভালোবাসতেন। ওমর খৈয়ামের গজলে মুগ্ধ হয়ে রুবাই এবং রুবাইয়াৎ দু’জনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একত্রে তারা বিয়ে করবে। পরবর্তীতে ওমর খৈয়াম দুর্বিপাকে তুরস্কে চলে এলে দু’জনের একজনকেও বিয়ে করা সম্ভব হয়নি। অন্য নারীকে তিনি বিয়ে করেন কিন্তু মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত রুবাই এবং রুবাইয়াৎকে নিয়ে লিখেছেন অমর গাথা।
উল্লিখিত আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রুবাইয়াতের জনক হচ্ছেন ওমর খৈয়াম। কাজেই রুবাইয়াৎ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তিনি হয়ে ওঠেন মূল প্রতিপাদ্য। ওমর খৈয়াম যেহেতু ফরাসি ভাষায় রুবাই বা রুবাইয়াৎ রচনা করেছেন, কাজেই যুক্তিসঙ্গতভাবে বাংলা ভাষায় যারা রুবাইয়াতের অনুবাদ করেছেন তারাও প্রাসঙ্গিক। ফারসি ভাষা থেকে সরাসরি রুবাইয়াতের প্রথম অনুবাদ করেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। কাজী নজরুল ইসলামের অনুবাদকৃত ওমর খৈয়ামের বিখ্যাত একটি রুবাইয়াৎ নি¤œরূপÑ
‘এক সোরাহী সুরা দিও, একটু রুটির ছিলকে আর
প্রিয়া সাকী তাহার সাথে একখানি বই কবিতার
জীর্ণ আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সাথ
এই যদি পাই চাইব নাকো তখৎ আমি শাহানশার।’
এছাড়াও ফারসি ভাষায় লেখা রুবাইয়াৎ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেনÑ এ ই নিকোলাস, ই এইচ হুইনফিল্ড, এ জে আরবেরি, জন পেইন, হেরন অ্যালেন এডওয়ার্ড ফিড জেরাল্ড প্রমুখ।
ইংরেজি অনুবাদকৃত রুবাইয়াৎ পুনরায় বাংলায় অনুবাদ করেছেন কান্তি বাবু এবং আবু জাফরসহ আরো অনেকে। কিন্তু কান্তি বাবু রুবাইয়াতের মূল ছন্দে না লিখে প্রথম-দ্বিতীয় এবং তৃতীয়-চতুর্থ চরণের সাথে অন্ত্যমিল দেখিয়েছেন। মূল ভাব ঠিক থাকলেও একটি রুবাইয়াৎকে ভেঙে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। তবে উল্লেখ্য বিষয় হলো অনুবাদের ক্ষেত্রে মূল ভাবটাই মুখ্য, ভাষা গৌণ বলে পণ্ডিতজনদের অভিমত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি হলো ‘কবিতা এক ভাষা থেকে অন্য ভাষার প্যাঁচে ফেলে দেওয়া কঠিন, কারণ কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ভাষা নয়, গতি’।
রুবাইয়াৎ সম্পর্কে সামান্য আলোচনার হেতু হলোÑ ড. সৈয়দ আজিজের রুবাইয়াৎ গ্রন্থের উপক্রমণিকা লেখা, কাজেই রুবাই সম্পর্কে ক্ষুদ্রতম ধারণা নিয়ে আলোচনার মূল বিষয়ে প্রবেশ করা প্রাসঙ্গিক বলে আমার বিশ্বাস।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ এ অন্যধারা পাবলিকেশন্স ড. সৈয়দ আজিজের রুবাইয়াৎ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছে। কিছু দিন আগে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করায় এখনো সাহিত্য ভাবনার চৈতন্য তার মাথার মগজে ঘুরপাক খাওয়ার উৎকর্ষতার ফসল হচ্ছে আলোচিত এই গ্রন্থ। প্রকাশক হিসেবে পাণ্ডুলিপিটি পড়েছি। রুবাইয়াতের ব্যাকরণ-প্রকরণ ঠিক রেখে হৃদয়গ্রাহী ছন্দ, অন্ত্যমিলের দ্যোতনায়, কাব্যিক শব্দ বিন্যাসে অর্থবহ উপায়ে মস্তিস্ক নিংড়ানো ভাবাবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন জুতসই বয়ানে। এখানে ড. সৈয়দ আজিজ মুন্সিয়ানার পরিচয় দেখিয়েছেন।
ড. সৈয়দ আজিজ যেহেতু প্রখর চিন্তাশীল, বিশ্ব সাহিত্য ভাণ্ডার সম্পর্কে পঠন-পাঠনে ঋদ্ধ কাব্যের কারুকার্য সম্পর্কে যতœশীল, নান্দনিকতার প্রজ্বলনে আলোকিত প্রাণ। কাজেই চিন্তা, চেতনা, ভাবের গভীরতা একটু গভীরেই হওয়া স্বাভাবিক। কবিতার শৈল্পিক গুণ বিচারে সে নিজেই নিজের উদাহরণ। মানবিক মূল্যবোধ, সুফিবাদ ও মরমীয় সাধক তিনি।
ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ নিয়ে যেমন মতান্তরের বা মতাদর্শের শেষ নেই। ‘মিরাসিদুল ইবাদ’ গ্রন্থে নাজমুদ্দীন রাজীব বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে বিরূপ মন্তব্য করতে গিয়ে বলেনÑ
‘ওমর খৈয়াম একজন অসুখী দার্শনিক, নাস্তিক ও জড়বাদী মানুষ। তার রুবাই রচনার মূল প্রেরণা এসেছে অন্ধ কবি আবুল আলা থেকে বলে গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। কোথাও কবি চরম আশাবাদে উজ্জ্বল, আবার নৈরাশ্যবাদে বিবর্ণ। কখনো কবি অদৃষ্টবাদে উৎকণ্ঠিত আবার কখনো তিনি আজ্ঞেয়বাদে বিব্রত। ওমর খৈয়াম সুফিদের মরমিবাদ প্রচার করতে চেয়েছেন নাকি এপিকিউরিয়াম দর্শন অনুসারে দেহবাদের পক্ষে ওকালতি করেছেন। নাকি দার্শনিক জেনোর মতানুসারে সুখ-দুঃখে নিরাসক্তি সবন্ধেই তার পক্ষপাতিত্ব। ওমর খৈয়ামের একটি রুবাইয়াৎ ঠিক এ রকম। যথাÑ
‘পিয়ে নাও সুরা এই বেলা সখা, ঘুমাবার দিন অনেক পাবে
মৃত্তিকার নিচে দরদী বান্ধব প্রেয়সী যেথায়, কেহ না যাবে।
বলো না কাহারে বলো নাকো এই অতীব গোপন সত্য সার
যে ফুল নেশায় পড়েছে ঝরিয়া, সে নাহি কখনো ফুটিবে আর।’

গ্রিক বিজ্ঞানে ওমর খৈয়ামের ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য, এ কথা বলেছেনÑ ইবনুল কিফতির লেখা ‘তারিখুল হুকামা’ কাব্যগ্রন্থে। কিফতির মতে তার পরবর্তী সময়ের সুফিরা তার রুবাইগুলোর কেবল বাহ্যিক অর্থেই তুষ্ট ছিলেন কিন্তু এর অন্তর্নিহিত অর্থ ছিল ধর্মগুরুদের প্রতি সমালোচনা। তাকে অনেকে পারস্যের ভলতেয়ার বলে অবিহিত করেছেন।

ড. সৈয়দ আজিজের রুবাইয়াৎ পাঠ করে বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে বিরূপ মন্তব্য করা যেতে পারে কিন্তু অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তার একটি গ্রন্থে দুইশত রুবাইয়াৎ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
প্রতিটি রুবাইয়ের অর্থ আলাদা ভাবের দ্যোতনা। সুখপাঠ্য হিসেবে পাঠক আনন্দে উদ্বেলিত হবেন বলে আমার বিশ্বাস। আমিও ওমর খৈয়ামের রুবাইয়ের প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে বেশ কিছু রুবাই লিখেছি, যার মধ্য থেকে একটি লেখা এ আলোচনায় পাঠকের উদ্দেশে তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক বলে প্রতিভাত হচ্ছে। যথাÑ
‘দুইয়ে দুইয়ে চলছে খেলা নিরবধি
দুইয়ের স্রোতে একই ধারায় বইছে নদী
দেহের ভিটা উথলে উঠে ভাঙছে শুধু
মুক্তি হবে যুক্তি এসে কাঁদায় যদি।’
ড. সৈয়দ আজিজের কাব্য দর্শন পাঠকের তৃষিত হৃদয়ে শীতল পরশ বইয়ে দেবে। নিঃসন্দেহে বলা যায় কাব্যবিচারে গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যকেই শুধু অলঙ্কৃত করবে না, বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করবে সেই প্রত্যাশা করছি। হ


আরো সংবাদ



premium cement