২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কেউ ভোলে না কেউ ভোলে

-

[পূর্ব প্রকাশের পর]

অনেক রকম অজুহাত দেখিয়েও পার পেলাম না। হারমোনিয়াম এল। ছেলেকে দোতলা থেকে ডেকে নামানো হলো। ছেলে নজরুল সঙ্গীত শিখছে। গান শুরু করল। এবারও রংপুরের মতোই অবাক হলাম। ছেলেটা তো চমৎকার গান করে! গলাটা বেশ তৈরি। গান শোনার পালা শেষ হলো। বিদায় নেওয়ার সময়। আবু হেনাকে বললাম, কাল সকালে গাড়ি পাঠিয়ে দেব। তোমার ছেলের অডিশন নেব। আবু হেনা বেশ খুশি হলো। পরের দিন গাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। সঙ্গে পাঠালাম আবুল হায়াতকে। ভ্রাতুস্পুত্রকে নিয়ে এল আবুল হায়াত। অডিশন হলো। পাস করল। সেদিনের সেই ছেলেটি আজ একজন প্রতিষ্ঠিত নজরুল সঙ্গীত শিল্পী। বিদেশেও প্রশিক্ষণ নিয়েছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে। তাঁর নাম সুজিত মোস্তফা। আবার ফিরে আসি সেকালের ঢাকা বেতারের স্মৃতিতে। তখন বেতারে অনুষ্ঠান প্রচারের একটা নীতি ছিল। মোট অনুষ্ঠানের ষাট ভাগ সঙ্গীত, বাদবাকি চল্লিশ ভাগ খবর, নাটক, কথিকা এবং অন্যান্য ‘স্পোকেন ওয়ার্ড প্রোগ্রাম’। সঙ্গীত শিল্পীদের তিন অধিবেশনে সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে গান গাইতে হতো। সকাল, দুপুর আর সন্ধ্যা-রাত্রি তিন বেলা অনুষ্ঠান প্রচার হতো। ফলে একেকজন শিল্পীকে সব ধরনের গান গাইতে হতো। রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল-গীতি, পল্লীগীতি, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রগীতি, গজল, গীত সব ধরনের গান তিন অধিবেশনেই প্রচার হতো। তখন শিল্পীর সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত। ফলে তিন অধিবেশনে মিলে একজন শিল্পীকে প্রায় পঞ্চাশ মিনিট গানের জন্যে বরাদ্দ করা হতো। একই শিল্পীকে তাই সকালে গাইতে হতো রবীন্দ্র কিংবা নজরুল, দুপুরে গজল বা দ্বিজেন্দ্র-গীতি, রাতে অতুলপ্রসাদ বা রজনীকান্তের গান।
বেতারে তখন মহিলা শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন জাহানারা আহসান, লায়লা আর্জুমান্দ বানু, হুসনা বানু খান, আফসারী খানম, খালেদা ফ্যান্সী খানম, মাহবুবা রহমান, কুসুম হক, শামসুন্নাহার করিম, নীরু শামসুন্নাহার, রওশন আরা মাসুদ, ফেরদৌসী বেগম, ফরিদা ইয়াসমীন, ফওজিয়া ইয়াসমীন, আরতী ধর, ইসমত আরা, আঞ্জুমান আরা বেগম, আর পুরুষ শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন বেদারউদ্দিন আহমেদ, আবদুল হালিম চৌধুরী, আবদুল লতিফ, সোহরাব হোসেন, সুধীন দাস, আবদুল আলীম, খালিদ হোসেন, আনোয়ারা উদ্দিন খান, কাজী আনোয়ার হোসেন, নাজমুল হুদা, সৈয়দ আবদুল হাদী প্রমুখ। এঁদের প্রায় সবাইকে কোনো কোনো অধিবেশনে নজরুল গীতি পরিবেশন করতে হতো।
শিল্পী ফিরোজা বেগমের কথাই আগে বলি। তিনি ষাটের মাঝামাঝি কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছেন। কিন্তু রেডিওতে অনুষ্ঠান করতে পারছেন না। রেডিও পাকিস্তানের হেড কোয়াটার্স থেকে ক্লিয়ারেন্স লাগবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও লাগবে। একদিন আঞ্চলিক পরিচালকের কক্ষে গিয়েছি। তখন সৈয়দ জিল্লুর রহমান ঢাকা বেতার কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক। তাঁকে বেশ অস্থির মনে হচ্ছে। তিনি ইশারায় আসন গ্রহণ করতে বললেন। বারবার তাকাচ্ছেন টেবিলে রক্ষিত টেলিফোন সেটের দিকে। অনেকগুলো অপেক্ষমাণ সময় কেটে গেল। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠতেই তিনি ত্বরিতগতিতে সেট তুলে কানে নিলেন। ওপাশ থেকে কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝতে পারলেন রেডিওর মহাপরিচালক কথা বলছেন। তিনি তখন ফিরোজা বেগমের কথা বললেন। নজরুল-গীতির একজন বড় শিল্পী। মহাপরিচালকের অনুমোদন না পেলে তাঁকে অনুষ্ঠান প্রচার করতে দেওয়া যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ সময় গেল। সহাস্যে টেলিফোন রেখে বললেন, অনুমোদন পাওয়া গেছে। সুতরাং ফিরোজা বেগমের আর অনুষ্ঠান প্রচারে বাধা নেই। ফিরোজা বেগম তখন থেকে নিয়মিত বেতার অনুষ্ঠানে নজরুল গীতি প্রচার শুরু করেন।
ফেরদৌসী বেগম, পরে রহমান, তখনকার দিনের খুব জনপ্রিয় শিল্পী। আধুনিক, পল্লী, উচ্চাঙ্গ আর নজরুলগীতি নিয়মিত প্রচার করেন। ওদিকে ছায়াছবিতে নেপথ্যে কণ্ঠ দেন। সব ধরনের গানই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিবেশন করেন। তখনকার দিনে টেলিভিশন স্থাপিত হয়নি। শিল্পকলা একাডেমিরও অস্তিত্ব ছিল না। রাষ্ট্রীয় যে কোনো অনুষ্ঠানে রেডিওতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হতো। বিদেশী রাষ্ট্রনায়ক বা প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ ছিল ফেরদৌসী বেগমের গান। বিশেষ করে পল্লীগীতি। আর সেই পল্লীগীতি নজরুল ইসলামের। তিনি যখন স্টেজে উঠে তাঁর স্বভাবজাত দরাজ কণ্ঠে সুর তুলতেন ‘পদ্মার ঢেউরে মোর শূন্য হৃদয়’ তখন সারা মিলনায়তনে ঝঙ্কার তুলত।
আরতী ধরকে নিয়ে একবার মহা মুশকিলে পড়া গেল। বেতারে কণ্ঠ শিল্পীদের অনুষ্ঠানের আগে সং ডিটেইলস জমা দিতে হতো। গানের বাণী পরীক্ষা করার জন্যে। একবার আরতী ধর নজরুল গীতির সং ডিটেইলস’ জমা দিলেন। গানের বাণীতে ‘শ্যামের কথা রয়েছে। ও ধরনের গান রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচার করা যেত না। তাঁকে গান পরিবর্তন করে দিতে অনুরোধ করা হলে তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্যে সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফ-উজ-জামান খানের শরণাপন্ন হলাম। মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত তিনি বলে দিলেন। আরতী ধরও গান গাইতে পারবেন। তাঁর জন্যে বাধা নেই। কারণটা কানে কানে বলে দিলেন। আমিও স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। গান প্রচার হয়ে গেল। আরতী ধর গান গাইলেন।
কাজী আনোয়ার হোসেন তখন বেশ জনপ্রিয় শিল্পী। আধুনিক গান প্রচার করেন। কিন্তু আমাদের অনুষ্ঠান পরিকল্পনার স্বার্থে তাকে মাঝে মাঝে নজরুল গীতির অনুষ্ঠান দেওয়া হতো। তিনি সং ডিটেইলস জমা দিতেন। দেখা গেল প্রতি মাসেই তিনি অনুষ্ঠানের জন্যে একই গান জমা দিয়েছেন। তাঁকে একবার গান বদলাতে অনুরোধ করা হলো। তিনি সাফ জবাব দিলেন, বদলাতে পারবেন না। কারণ তিনি ঐ দুটো গান ছাড়া আর কোনো গান জানেন না। অগত্যা এভাবেই তাঁর নজরুল গীতি প্রচার করতে হতো। দুটো গানই ঘুরেফিরে বারবার।
শিল্পীরা, আগেই বলেছি, গানের বাণী জমা দিতেন। আমরাও দেখে শুনে প্রচারের জন্যে পাশ করে দিতাম। তবে দেখা যেত, সব শিল্পীরা সীমিত সংখ্যক নজরুল কিংবা রবীন্দ্রনাথের গানই ঘুরেফিরে প্রচার করছেন। নতুন গান খুব বেশি গাইতেন না। তাঁর কারণ বাণীর সমস্যা, পূজা, দেব-দেবীর কথা বলা যেত, ফলে আমাদেরও কিছু বলার থাকত নাÑ এভাবেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত চলে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বিজয় অর্জিত হলো বাংলাদেশ। স্বাধীন হলো। নজরুলগীতি এবং রবীন্দ্র সঙ্গীত বন্ধনের অর্গল থেকে মুক্তি পেল। হ


আরো সংবাদ



premium cement