২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
শ্রুতি ও স্মৃতির সোনালি শিখা

যেমন দেখেছি তাঁকে

-

পঁয়তাল্লিশ.
[শেষ পর্ব]
বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে পৌঁছাল আল মাহমুদের দেহবাহী গাড়িটি। গোটা বায়তুল মোকাররম এলাকা তখন লোকে লোকারণ্য। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে গাড়িটি খুব ধীরে প্রবেশ করল পবিত্র এ মসজিদের উত্তর গেটে। জাতীয় এ মসজিদের উত্তর গেট দক্ষিণ গেট এবং পূর্বচত্বর পুরোটাই ভরে গেছে মানুষের সমাগমে। সবার মুখে এক ধরনের বেদনার ছাপ। শোকের রেখাগুলো ফুটে আছে মুখের সর্বত্র। কারো কারো চোখে বিস্ময় কৌতূহলÑ এক নজর আল মাহমুদকে দেখার। মৃত্যুর পরে কেমন দাঁড়াল কবির অবয়ব। কেমন হলো তাঁর চেহারার চিত্র। যে কবি কবিতার ভেতর দিয়ে এঁকেছেন মানুষের জীবন। চিত্রিত করেছেন জীবনের স্বপ্ন ও বিশ্বাসের বিভা। সেই কবির মুখে এখন কি চিত্র আঁকা। যেন এমনি জিজ্ঞাসা মানুষের চোখে। গাড়ি যখনই উত্তর গেটে এলো মুহূর্তে গাড়ি ঘিরে হলো মানুষের জমাট। দেখার সুযোগ এই মুহূর্তে মিলবে না, এটি জানা কথা। হলে কী হবে? আশা, যদি দেখা যায় একটিবার। সেই মর্মে স্রোতের মতো মানুষ ছুটে এলো গাড়ির দিকে। বিস্ময়ে দেখি অনেকে গাড়িটি ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ গাড়ির বডিতে হাত রাখার চেষ্টায় গলদঘর্ম। এভাবে আল মাহমুদের শেষ যাত্রার সাক্ষী এবং স্মৃতি হয়ে থাকার প্রচেষ্টায় পদক্ষেপ নিচ্ছিল মানুষ।
হাজার হাজার জনতার মধ্যে বেশির ভাগই ছিল তরুণ জুবা এবং ছাত্র। তুলনায় মুরব্বিদের চেয়ে অনেক বেশি। এটিও একটি অবাক করার মতো ঘটনা। একজন বৃদ্ধ আল মাহমুদকে ভালোবাসার আনন্দ দিয়েছেন বেশি তরুণরা। যেমন জীবিত আল মাহমুদকে, তেমনি মৃত্যুর পরও। তাঁর কবিতার অনুসারীও বেশি তরুণ-তরুণী।
জনারণ্য ঠেলে খুব ধীরে গাড়িটি উত্তর গেটের চত্বরে এসে দাঁড়াল। জনসমুদ্রের মাঝখানে তখন গাড়িটি। যে যে টুকু পারেন গাড়ির কাছে থাকতে চাইছেন। একটু দূরে যারা যতটা সম্ভব কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মানুষের ঠাসাঠাসি এতটাই ঘন পেছন থেকে সামনে এগিয়ে আসা অথবা সামনে থেকে সহজে পেছনে যাওয়ার সুযোগ খুব সহজ ছিল না। তবু চেষ্টা কি থেমে থাকে? যে যার মতো মানুষ ঠেলে সামনে এগোবার চেষ্টা করতে থাকল।
বায়তুল মোকাররমে জানাজার নামাজের জন্য লাশ রাখার একটি নির্দিষ্ট স্থান আছে। স্থানটি দক্ষিণ গেটের নিকটবর্তী। মসজিদের দক্ষিণ পূর্ব কর্নারের একটি জায়গা।
উত্তর গেট থেকে মসজিদের ভেতর দিয়ে আল মাহমুদের লাশটি নিতে হবে লাশ রাখার সেই নির্দিষ্ট স্থানে। অথচ গোটা মসজিদের কোথাও সামান্য জায়গাও ফাঁকা নেই। এমন অবস্থায় খাটিয়া কাঁধে তুলে এগিয়ে যাওয়া কঠিন বটে। তার ওপর মানুষের কৌতূহল তোÑ জোয়ারের মতো।
কিন্তু অবস্থা যা হোক, আমাদের যেতেই হবে নির্দিষ্ট স্থানে। নিয়ে যেতে হবে খাটিয়ায় শুয়ে থাকা আল মাহমুদের নিথর দেহটি। জোহরের জামাত শুরু হওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। দ্রুত কাজ করতে হবে আমাদের। গাড়ির দরজা খোলা হলো। যথারীতি খাটিয়াটি বের করা হলো আদবের সাথে। খাটিয়া ধরার লোকও হয়ে গেল অনেক। কিন্তু কতজন আর ধরতে পারে। যে যেটুকু ছুয়ে দিতে সক্ষম সেটুকু ধরে এগোতে থাকল সামনে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপারÑ এ সময় লোকেরা সামনে এগিয়ে আসার চেষ্টা করলেন না। বরং নিজেরা পথ ছেড়ে খাটিয়া যাওয়ার ব্যবস্থাটি এগিয়ে দিচ্ছিল। খাটিয়ার যাত্রার সামনে কয়েকজন পথ ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করছে লোকদের। লোকেরা সরে যাচ্ছে। আর জনসমুদ্রের ভেতর লাশবাহী খাটিয়ার সমান একটি পথ এগিয়ে চলল। সেই সাথে এগিয়ে চলল একটি সরু দীর্ঘ মিছিল। মৌন এ মিছিলে সবার ঠোঁট নড়ছিল। দোয়া-দরুদ পড়ছিল প্রতিটি ঠোঁট। যেতে যেতে একটি জায়গায় থেমে গেল মৌন মিছিলটি। থেমে গেল সেই স্থানে যেখানে জানাজার নামাজের জন্য রাখা স্থানটি। নামিয়ে রাখা হলো আল মাহমুদের দেহধারী খাটিয়াটি।
এর মধ্যেই শোনা যাচ্ছে মোয়াজ্জিনের কণ্ঠ। একামত দিচ্ছেন তিনি। কাতারবদ্ধ হয়ে গেলেন উপস্থিত হাজার হাজার মুসল্লি। যদিও কাতারবদ্ধ হতে বেগ পেতে হয়েছে কোথাও কোথাও। সেটি হলো কাতারে দাঁড়ানো মানুষ সব কাতারে ধরছিল না। নামাজের পর যেহেতু জানাজা। জানাজায় সামনে থাকার ইচ্ছে থেকে অনেকে কাতারেও সামনে জায়গা নিতে ভীষণ চেষ্টা করছিলেন। ফলে কাতারে যে সংখ্যক মুসল্লি দাঁড়ানোর জায়গাÑ তার অতিরিক্ত দাঁড়িয়ে গেলেন। বেশ ঠাসাঠাসির সাথে আদায় করতে হলো জোহরের নামাজ। সালাম ফিরিয়ে ইমাম সাহেব ঘোষণা দিলেন জানাজার নামাজ আছে। এমন ঘোষণায় বেজে উঠল আরো বিষণœতার সুর। আরো নীরবতা চেপে বসল সমস্ত মসজিদজুড়ে। জানাজার নামাজ শুরুর আগে কিছু কথা বলতে হয়। বলা হয় সবার ক্ষেত্রেই। কিন্তু ইনি তো একজন কবি। একজন বিখ্যাত মানুষের দেহ। এই দেহ সামনে রেখে কথা বলার বিষয়টি সহজ তো নয়। কঠিনই বটে। এমন কঠিন দায়িত্বটিই পালন করতে হলো আমাকে। মাইক্রোফোন হাতে তুলে যখন উল্টো দিকে ঘুরে মুসল্লিদের মুখোমুখি দাঁড়ালাম। দেখলাম সামনে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত খ্যাতিমান অনেক মুখ দাঁড়িয়ে আছেন। এদের কেউ কেউ বেশ অসুস্থও ছিলেন। আমি আমার সাধ্যমতো দু’চার কথা বললাম। বিশাল জনসমুদ্র একেবারেই নীরব এক আঙ্গিনায় পরিণত হলো। মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ ছিল না সেখানে। আমি যা বলেছি মনে হলো, আমার মনে আকস্মিক উদয় হয়েছে কথাগুলো। একটির পর একটি বাক্য যেন জমা হতে লাগল আমার মনের ভেতর। আর তাই একে একে উঠে এলো মুখের ভাষায়। এ অনুভূতি কেন হলো জানি না আমি। কিন্তু এমন অনুভূতির ঢেউ আমাকে কথার সমুদ্রে ভাসাতে থাকল। আমি বললাম তার সবই। আমার কথা শেষে হওয়ার পর আহ্বান করলাম সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিশিষ্টব্যক্তিত্ব বিচারপতি মুহাম্মদ আবদুর রউফকে। তিনি সংক্ষেপে দু’চারটি কথা বললেন। তারপর উচ্চৈঃস্বরে উপস্থিত জনসমুদ্রে প্রশ্ন করলেনÑ কবি আল মাহমুদ কেমন লোক ছিলেন? জনসমুদ্র থেকে সঙ্গে সঙ্গে শব্দের তরঙ্গ ধ্বনিত হলো ভালো লোক ছিলেন। আবার জিজ্ঞেস করলেনÑ আল মাহমুদ কেমন লোক ছিলেন। উত্তরে আবার সমস্বরে আওয়াজÑ তিনি ভালো লোক ছিলেন। এভাবে আরো একবার জিজ্ঞেস করলেন। একই জবাবে কেঁপে উঠল হাজারও জনতার কণ্ঠস্বর। শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসীকে আহ্বান করলাম। তিনিও সংক্ষেপে কথা বললেন।
নিয়ম অনুযায়ী পরিবারের পক্ষ থেকে একজনকে দেনা-পাওনা, দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলতে হয়। কিন্তু সময়টি এমন ছিল মাইকে ঘোষণা দিয়েও আশপাশে তাঁর পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। সত্যিকারার্থে মানুষের ঢলে কে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছে এবং সেখানেই নামাজ আদায় করে অপেক্ষা করছে তার হদিস ছিলো না। ফলে আল মাহমুদের ছেলেরা ঠেলাঠেলিতে কে কোথায় দাঁড়িয়েছে এ সময়টায় তার খবর পাওয়া যায়নি। যে কারণে পরিবারের পক্ষ থেকে আমিই ঘোষণাটি দিয়েছি। বলেছি কবি আল মাহমুদের কাছে কেউ যদি কোনো টাকা পয়সা পেয়ে থাকেন তাঁর পরিবারের কাছে জানাবেন। তাঁরা এর যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেবেন। এছাড়া তাঁর ব্যবহার অথবা আচরণে অথবা অন্য কোনো কারণে যদি কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন, দয়া করে মাফ করে দেবেন।
ঘোষণা শেষ হলেই আল মাহমুদের মুখটি এক নজর দেখার তৃষ্ণায় উন্মুখ হয়ে উঠলেন অনেকেই। খাটিয়ায় উন্মুক্ত করা হলো তাঁর মুখ। একদম জ্যোতির্ময় মুখটি। পরিতৃপ্ত। যেন সন্তুষ্টির আলো ছড়িয়ে আছে সারা মুখে। ঠোঁটে পরিতৃপ্তির ঈষৎ হাসির রেখা। মনে হয় আনন্দচিত্তে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন। গভীর ঘুমের প্রশান্তির ছটা গোটা মুখে জড়িয়ে আছে। যারই চোখ উড়ে যাচ্ছে তাঁর মুখের ওপর মনের অজান্তেই উচ্চারণ করছেনÑ আল হামদুলিল্লাহ। এভাবেই একজন কবি চিরবিদায় মুহূর্তেও কুড়িয়ে নিলেন মানুষের অন্তরাত্মার অজস্র নিখাদ ভালোবাসা। একজন কবির জন্য এমন ভালোবাসার স্রোত কে দেখেছে কবে। আত্মীয়-অনাত্মীয় কিংবা কাছে দূরের বলে কথা নয়, বরং সব সম্পর্কের ঊর্ধ্বে যেন এক অসামান্য সম্পর্কের সেতুটি উঁচিয়ে উঠল। এক অনন্য প্রবাহের ভেতর আমরা ডুবে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ। এই প্রবাহের ধারা বেশি দূর চলতে দেয়া যায়নি। যায়নি কারণ মানুষের তীব্র গতি প্রচণ্ড রূপ নিলো। কোনোভাবেই মানুষের স্রোত শৃঙ্খলার ভেতর আনা যাচ্ছিল না। ফলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হলো আমাদের। সিদ্ধান্তটি হলোÑ দেখার পর্বটির ইতি টানতে হবে। নইলে যেকোনো সময় মানুষের চাপ এসে পড়বে খাটিয়ার ওপর। তখন আল মাহমুদের দেহ চাপা পড়ে যাবে মানুষের উপচানো ঢেউয়ের প্রচণ্ডতায়। দ্রুত তাঁর খোলা মুখটি কফিন জড়িয়ে নেয়া হলো। চারপাশে একরকম মানব দেয়াল গড়ে খাটিয়াটি তোলা হলো ওপরে। ভিড়ের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল খাটিয়া মিছিল। মসজিদের উত্তর গেটে। যেখানে রাখা আছে গাড়িটি।
এখানেও একনজর দেখার পিপাসায় লোকেরা উন্মুখ। গাড়িতেই কিছুক্ষণের জন্য খোলা হলো মুখের কাফন। চিরকালের নিশ্চিন্ত নিদ্রায় শায়িত কবিকে দেখে দেখে চলে যাচ্ছে মানুষের চোখ। শোকাহত বাক্যে নিজের বেদনার কথা প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।
এই ফাঁকে পরামর্শ চলছিলÑ বায়তুল মোকাররম থেকে সরাসরি ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে যাবে নাকি বাসায় আবার নেয়া হবে। দুপক্ষেই যুক্তি ছিল। শেষতক সিদ্ধান্ত হলো একবার বাসায় নেয়া হবে। সেখান থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশে রওনা হবে। তাই হলো। বাসার নিচে গাড়িটি রেখে যে যার মতো প্রস্তুতি নিয়ে রওনা হলো বি-বাড়িয়ার উদ্দেশে। আল মাহমুদের পরিবার আত্মীয়স্বজন সঙ্গী হলেন অনেকেই। বায়তুল মোকাররম থেকে বাসার দিকে চলে গেলো গাড়িটি। গাড়ি চলে যাওয়ার পর আবৃত্তি শিল্পী নাসিম আহমেদ, কবি জামসেদ ওয়াজেদ এবং আমিÑ আমরা তিনজন বসলাম উত্তর গেটের কাছে একটি রেস্টুরেন্টে। তিনজনের কেউ যেতে পারছি না ব্রাহ্মণবাড়িয়া। অফিসিয়াল সমস্যার কারণেই মূলত আমাদের যাওয়া হয়ে ওঠেনি। রেস্টুরেন্টে বসার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। কারণটি হলোÑ আল মাহমুদ নাগরিক শোকসভার বিষয়ে আলোচনা। সেই আলোচনাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম নাগরিক শোকসভা হবে। হবে জাতীয় জাদুঘর বড় মিলনায়তনে।
সিদ্ধান্ত নিয়েই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়েছি আমরা। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই অনুষ্ঠিত হয়েছে আল মাহমুদ নাগরিক শোকসভা। নাগরিক শোকসভার আহ্বায়ক ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী। প্রধান সমন্বয়ক কবি জাকির আবু জাফর। অনুষ্ঠানটি জাতীয় জাদুঘরের বড় মিলনায়তনেই হয়েছিল। প্রধান অতিথি ছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। সভাপতি প্রফেসর মাহমুদ শাহ কোরেশী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কবি আসাদ চৌধুরী। অতিথি ছিলেন বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ, ড. আবদুল মঈন খান, শিল্পী মোস্তাফা জামান আব্বাসী, কবি আল মুজাহিদী।
আল মাহমুদের দেহবাহী গাড়িটি ছুটল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে। সেদিন রাস্তায় ছিল গাড়ি-ঘোড়ার বিশাল জমাট। ফলে পথে পথে জ্যাম আর জ্যাম। ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছাতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ অতিরিক্ত সময় লেগেছে। রাত প্রায় ১১টা জেজে গেল। পৌঁছালেন আল মাহমুদ। আজীবন যেমন করে পৌঁছাতেন, আজ তেমন করে নয়। আজ তিনি নিথর। নিস্তব্ধ। চিরনিঝুমতার গভীরে ঘুমন্ত এক আল মাহমুদ। তাঁর সবই আছে। শুধু বুকের ঘরে নিঃশ্বাসটি নেই। সামান্য বাতাস। সেই বুকের গভীরে আসা পাওয়া করে মাত্র। সেইটুকুই নেই। নেই বলেই তিনি আজ পাথরের মতো নির্বিকার।
পরদিন ১০টায় নামাজে জানাজা। নিয়াজ মোহাম্মদ স্কুলসংলগ্ন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠই জানাজার স্থান। আকাশের অবস্থা খুব ভালো ছিল না। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। এমন আবহাওয়ায়ও হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হলেন কলেজ মাঠে। এলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক। সম্মান জানানো হলো জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এমন ভেজা আবহাওয়ায় এত মানুষের উপস্থিতি অনেককেই অবাক করেছে বটে।
এটি ছিল তৃতীয় জানাজা। জানাজার নামাজ শেষ হলো। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো মেড়োইল কবরস্থানে। যেটি আল মাহমুদের পারিবারিক কবরস্থান হিসেবে পরিচিত। মায়ের পাশেই তাঁর কবরটি খোদাই করা হলো। বৃষ্টির প্রকোপ তখন বেড়ে গেছে অনেকটা। এর ভেতরই তাঁকে রাখা হলো কবরে। মিন হা খালকনাকুম ওয়া ফিহা নুঈদুকুম ওয়ামিন হা নুখরিজুকুম তা-রাতান উখরা। শব্দগুলো বৃষ্টির শব্দের সাথে যেন মিশে গেল। ভিজে গেলো বৃষ্টির ঘোরে।
যেদিন জন্মেছিলেন আল মাহমুদ সেদিনও ছিল বর্ষণভরা রাত। তুমুল বর্ষণের রাতেই জন্ম হলো যে কবির বিস্ময়করভাবে পৃথিবী থেকে চিরবিদায়ের মুহূর্তেও ছিলো বর্ষণ। এমন বর্ষণেই তাকে শুইয়ে দেয়া হলো কবরে। এটি কাকতালীয়? মোটেই না। এটিই তাঁর ললাট লিখন। বর্ষণে সিক্ত হয়ে সমাহিত হলেন তিনি। মুঠি মুঠি দিতে দিতে যখন উঁচু হয়ে উঠল মাটিÑ আহা কত চোখ থেকে কত অশ্রু ঝরছিল তখন। বৃষ্টি ধুয়ে কবরের মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছিলো অশ্রুগুলো। বুকের ওপর স্তূপ হলো মাটির শরীর। সেই মাটিই যেন বলছিলÑ বিদায় হে মানুষ। বিদায় হে পৃথিবী। বিদায়। চিরদিনের তরে বিদায়। এমন বিদায়ের কথাই লিখেছিলেন আল মাহমুদ তাঁর একটি কবিতায় কবিতাটির নামÑ স্মৃতির মেঘলাভোরে
কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালোমন্দ যা ঘটুক, মেনে নেবো: এ আমার ঈদ।
ফেলে যাচ্ছি খড়কুটো, পরিধেয়, আহার, মৈথুন
নিরুপায় কিছু নাম, কিছু স্মৃতি, কিংবা কিছু নয়;
অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে জমে আছে শোকের লেগুন;
কার হাত ভাঙে চুড়ি? কে ফোঁপায়? পৃথিবী, নিশ্চয়।
স্মৃতির মেঘলাভোরে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক,
অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায়?
কেন দোলে হৃদপিণ্ড, আমার কি ভয়ের অসুখ?
নাকি সেই শিহরণ পুলকিত মাস্তুল দোলায়!
আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার
যদি হয় ভোরবেলা স্বপ্নাচ্ছন্ন শুভ শুক্রবার।

কবরের ওপর এ কবিতাটিই লিখে দেয়া হলো। জিয়ারতকারীদের চোখ আটকে যাচ্ছে এ কবিতার শরীরে। তিনি আর কখনো কথা বলবেন না। কথা বলবে তাঁর কবিতা।
আল মাহমুদ নেই এ কথা ভাবতেই কেমন যেন করে বুক। কেমন যেন বেদনাবিধুর এক স্মৃতিকাতরতা মনকে বিষাদগ্রস্ত করে। আনমনা হয়ে ওঠে মন। মাটির গভীরে তাঁর শুয়ে থাকার দৃশ্যটি ভেসে ওঠে মনের চোখে। কল্পনায় মন চলে যায় কবরতলায়। কী করেন তিনি। কেমন আছেন! কী তাঁর অনুভব! আমার এসব কল্পনা পেয়েছে ভাষা যে ভাষা রূপ নিলো একটি কবিতায়। কবিতাটির নাম দাঁড়িয়েছেÑ

চিরনিদ্রার বিছানা

সেই ঘরটির দিগন্ত দু’সিনা থেকে কতদূূর কবি
পাশ ফিরলেই কি ছোঁয়া যায় তার সীমানা
কতটা আকাশজুড়ে তোমার ঘরের ছাদ
উত্তরে দক্ষিণে কতটা প্রশস্ত আয়তন
যতটা পরিধি ততটা জুড়েই কি অন্ধকার!

সেই ঠিকানাটি সব মানুষের কপালেই তো লেখা
সামান্য সময়পর্দা আড়াল রাখে শুধু
গলায় ঝুলছে তারই বিপন্ন নোটিশ
যেখানে এখন তোমার একান্ত বিশ্রামের বাড়ি
চিরনিদ্রার এক নিঃসঙ্গ কুটির
কেবল অন্ধকার কেবল নৈঃশব্দ
কেবলি স্তব্ধতার বরযখ
যতদিন না হবে মানুষের হাশর

তোমার বুকের জমাটমাটি থেকে গজে ওঠা ঘাস
কী যে লকলকে
শিরে ফোটে জলফুল-
শীতের শহর থেকে যখন ঘনায় কুয়াশার ঝাঁক
তোমার পাঁজর ঘেঁষে উত্থিত বৃক্ষের ডালে
কোনো শ্যামা শালিক অথবা বুলবুল
কিংবা হঠাৎ কোনো দোয়েলের শিস
এসব পাখি কি জানে -শুধু সাড়ে তিন হাত নিচে
তুমি এক কবির চিরনিদ্রার বিছানা

যখন বর্ষণ ঝমঝম বৃষ্টির -
তোমার বিছানাটি ভিজে ওঠে কবি!
মেঘের শরীর ঠেলে রোদ এলে-
এক টুকরো রোদও কি পৌঁছে তোমার ঘরের কোণে!

জীবন তোমাকে নিয়ে গেছে সেই জীবনের কাছে
যেখানে জীবন শুধু অনন্তত জীবনের যাত্রী
যেখানে মৃত্যুরও মৃত্যু ঘটে যায়! হ

 


আরো সংবাদ



premium cement