২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চিরনিদ্রায় শায়িত কবির উদ্দেশে

-

ষাটের অন্যতম কবি-কথাসাহিত্যিক মুশারারফ করিম গত ১১ জানুয়ারি তাঁর অগণন অনুসারী, আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। তাঁর এ বিদায় আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে যে শূন্যতার সৃষ্টি করবে তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তবুও বাস্তবতাকে মেনে বলতেই হয়, বিদায় হে স্বপ্ন সারথী, চির বিদায়। তুমি ‘সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে এসে তাঁর ইচ্ছাতেই ফিরে গেছো তাঁরই আশ্রয়ে।’ রাত সাড়ে ১০টা থেকেই কবির আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব-গুণগ্রাহী আর অনুগামীরা এসে এসে শেষ বারের মতো কবিকে দেখে ফিরে যাচ্ছেন। রাত বাড়ছে, শৈত্যপ্রবাহের প্রতাপ বাড়ছে; শব দেহের পাশ থেকে ভিড় কমে যাচ্ছে; রাত গভীর হলো। শীতে যখন সবাই প্রায় পলাতক; তখনো কবি একাকী শীত উপেক্ষা করে শবাধারে শুয়ে। প্রাণস্পন্দনহীন শরীরে শীতের প্রভাব নেই, তাই? কখনো কখনো কবি একা হয়ে যাচ্ছেন নিজের সাথে; তার পরও দু-চার জোড়া ঘুমে ঢুলু চোখ লক্ষ রাখছে কবির কফিনের দিকে; অবিবেচক কোনো ইতরপ্রাণী যদি কবিকে স্পর্শ করে সে-ও এক ভয়। না, কোনো ইতরপ্রাণী আসেনি কবির কফিনের কাছে; কেবল সারা রাতজুড়ে শীত এসেছিল আর কুয়াশারা তাঁকে জাপটে ধরে ছিল। কবির একজন অনুসারী অতন্দ্র চোখে মাঝে মধ্যে কবির মুখের ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে দেখে নিতে চাইছে, কবির আরো কিছু কথা বাকি রয়ে গেল কি না? কবির চোখ সামান্য ফাঁক হয়ে আছে, ঠোঁটে মৃদু হাসি যেন বলছে, ‘কবিকে চেনা অতই সহজ! কোন বাটখারায় তুলে ওজন করতে চাও তোমরা কবিকে? তোমাদের বাটখারার শরীর সুস্থ আছে তো? দেখো, তোমার বাটখারা দুর্বল হলে কিন্তু ছিঁড়ে পড়বে। অতঃপর দোষী করবে কবিকেই। তোমরা তো কেবল কবির পঙ্ক্তি ব্যবচ্ছেদ করতে চাও নিজের অসুস্থ চিন্তায়। একজন কবিকে কবির উচ্চতায় রেখে যদি বিবেচনার সাধ্য তোমার না থাকে, তবে কেন কবির মূল্যায়ন করতে আসো বাপু?’ কবির কথা শুনতে শুনতে তার অতন্দ্র চোখে হঠাৎ তন্দ্রা নেমে আসে। গা ঝাড়া দিয়ে এবার কবিকে নিয়ে ভাবে। কবির নাম মুশাররাফ করিম।
মুশাররাফ করিমের জন্ম ১৯৪৬ সালের ৯ জানুয়ারি ময়মনসিংহে; কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু কিশোর উপন্যাস, গল্প ও উপন্যাস। কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যেÑ ‘পাথরের সাথে কথা’, ‘অন্য এক আদিবাসে’, ‘সে নয় সুন্দরী শিরিন’, ‘কোথায় সেই দীর্ঘ দেবদারু’, ‘নিবেদনের গন্ধঢালা’, ‘অন্তরের ব্যাকুল ব্যাধি’, ‘কে আছে, কেউ কি আছে’, ‘বিরিশিরি গীতিকা’, ‘যদি একবর্ণও মিথ্যে বলি’, ‘বর্তমানে আছি একাকী, বান্ধবহীন’, ‘কোন গাছ নেই নিকট সন্নিধানে’, ‘সকল বাড়ি তোমার জন্যে আকুল’, ‘বিরিশিরি, তোমার লাবণ্যে’, ‘রমণীর সৌন্দর্যের থেকেও আরও দুর্নিবার’, ‘সুদূর সুন্দরে’, ‘অরণ্যের সেরেনাদ’ ‘তপতী সিরিজ’, ‘কী কবে কহ’, ‘উলঙ্গ তামাশা’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ও ‘কবিতা সমগ্র’। ময়মনসিংহের কাব্যাঙ্গনে মুশাররাফ করিম সয়ম্ভু এবং সর্বব্যাপী হলেও বাংলাদেশের কাব্যাঙ্গনে প্রায় নিঃশব্দ; যে কারণে মুশাররাফ করিম প্রথমত এবং প্রধানত কবি হলেও বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান তিনি শিশুসাহিত্যে। বেশ কিছু কিশোর উপন্যাস লিখলেও কবিতায় বিস্তৃতি তাঁর বহুদূর; বিশেষত একই বছর তাঁর সাথে যিনি কবিতার জন্য পুরস্কার প্রাপ্ত হন তাঁর তুলনায় তো বটেই। মুশাররাফ করিমের কবিতায় সমাজ সচেতনতা এবং রাজনীতিমনষ্কতা প্রধান উপজীব্য। মুশাররাফ করিমের কবিতায় যেমন গ্রামীণ জীবনের কাদামাখা শব্দের সফল ব্যবহার দেখি, তেমনি তাঁর কবিতায় বিষয় হয়ে উঠে আসে যেকোনো সাধারণ অনুষঙ্গ। ‘নিকারী মারে খেছ’ ॥ ‘হাঙ্গামা-হুজ্জুতের চেয়ে শান্তি মিছিল’ ॥ ‘দেখবে মুহূর্তে সব লণ্ডভণ্ড, মিসমার’ ॥ ‘হিজড়ের সাথে নিতম্ব দুলিয়ে করে উলুম্বুস নৃত্য’ ॥ ‘অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিল দুধভরা তার মা’র দুটি বুনি’ ॥ ‘হাতে হউলের পোনা ঝুলিয়ে যখন ফেরে সে ঘরে’ ॥ ‘দস্তার কড়াই ভরে সিদ্ধ হোক রূপশালী ধান;/ ঢেঁকির পাড় থেমে গেলে ভাতে উঠুক বলক/ বাতাস ভরে যাক সালুনের গন্ধে।’॥ ‘গণ্ডগ্রামের আলাভোলা কিশোর/সে বেঁধেছিলো কোমরে কার্তুজ;/মালকোচা দিয়ে দাঁড়িয়েছিলো প্রকাশ্যে’ ॥ লোকশব্দের এমন যুৎসই প্রয়োগ যে কোন পাঠককে চমকিত করে।
মুশাররাফ করিমের কবিতার কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে যায় তাঁর সমাজ সচেতনতার কথা মনে মনে আওড়ে নেয় কবির কবিতাÑ
ঢোল-পিঁপড়ের ডিমে কুকিস বিস্কুট ভেঙ্গে
ফেলে মনোলোভা টোপ,
বিশুদ্ধ বাতাস ভারী হয় সুগন্ধি চারাতে,
আহলাদে নাচতে নাচতে ছুঠে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে
রূপালী শরীর।
ফাৎনায় পড়ে টানÑনিপুণ নিকারী মারে খেছ
কানকোর পাশে বাঁকানো বড়শি গিঁথে
ধরা পড়ে নির্দোষ রোহিত।

এই দেশ মৎস্য ভোগীর, এখানে সারা বছর মাছ ধরা চলে,
যদি বিনোদ বিহারী চলে যায় কাতলের লাশ হাতে
শের মামুদ সেখানে এসে ছিপ ফেলে বসে।

সাগর দীঘির মাছেরা এমন কাণ্ডই দেখে আসছে চিরকাল।

(সাগর দীঘির মাছেরা ॥ অন্য এক আদিবাসে)
শরীর শিউড়ে ওঠে শীতে; জানুয়ারির এই শৈত্যপ্রবাহে মনে পড়ে যায় কবির শীতে কী ভয় ছিলো! অথচ খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছেন কবি; কবির শীতের কথা ভেবে তখনই হয়তো নির্ঘুম রাতে অন্য এক কবি লিখছেন কবি উদ্দেশে শীত কাতরতার পঙ্ক্তিমালাÑ
শীতে ভয় ছিল, আর শীতল জলেও খুব। ভয় নিয়ে তামাশা করার প্রবণতা ছিলো, শীতে যেনো জলাতঙ্ক, পরিযায়ী পাখি উড়ে এসে ঝিলে দিতো ডুব। আর তুমি পাশে বসে পানকৌড়ির ডুব সাঁতার ভেবে হয়ে যেতে চুপ!
আমাদেরও কিছুটা শীতকাতরতা আছে, তাই নানা অজুহাতে-ছল-চাতুরিতে আত্মরক্ষা করে পলাতক হই, বুকে রাখি স্বদেশী সঙ্গীত; এই শৈত্যপ্রবাহের রাতে খোলা আকশের নিচে তোমায় একাকী রেখে চলে আসায় কী নিষ্ঠুরতা, তা ভেবে অবাক হই, বুক ভেঙে যেতে চায়, শীতে তোমার কতটা ভীতি আমি জানি। তবুও না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছো উপেক্ষা করে শীত।
অতঃপর সারারাত কুয়াশার সাথে তোমার কী কথা হবে জানবে না পৃথিবীর কেউ; এবং এসব অপ্রকাশিত কথামালায় কারো কোন দিন হবে না কবিতা লেখা; যেমন কুয়াশা ঝরারও থাকে কিছু অব্যক্ত নিরীহ রেখা।
যখন নগরী শীতের তীব্রতা ভেবে ভীত, আর তুমি ভয়ের খোলশ ভেঙে শীত গায়ে মেখে পড়ে রইলে আঙিনায় খোলা আকাশের নিচে; তোমার এ স্পর্ধা কে শুনেছে কবে নিজের বিপক্ষে কখনো কখনো মানুষের সটান দাঁড়াতে হবে, সমুদ্রের মুখোমুখি দাঁড়ালে যেমন জাগে প্রত্যয় সী-বীচে।
তুমি আমাদের কাব্য-পথিকৃৎ, তোমার কাছে শিখেছি কবিতার পথে হাঁটা, এবার কি শীত ভেঙে হাঁটাও শেখালে নিজে হাঁর কৌশলে ? অতঃপর জানা হবে একই পথের পথিক হবার অপেক্ষায় কে কোথায় আছে মৃত্যুর সত্যকে ভুলে থাকিবার খেলাচ্ছলে।
(শীতকাতর কবির জন্য এলিজি ॥ ১১ জানুয়ারি ২০২০)
পূর্বাকাশ রাঙা হয়ে ক্রমশ আলো ফুটছে; এবার কী রোদ উঠবে? না-কি কুয়াশার অচ্ছাদনে লুকিয়ে থাকবে শৈত্যপ্রবাহের দাপটের কাছে সূর্যটা? ক্লান্ত চোখে সে দেখতে পায় কবির অসংখ্য অনুসারীর কোন কোন চোখে সূর্যের আভা। কিছু পরে সে বিস্মিত চোখে দেখতে পায়, কবির লাশ জানাজার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে খাটিয়ায়; জানাজায় যাওয়ার আগে কবির লাশ নেয়া হলো তাঁরই হাতে গড়া সংগঠন-আঙিনায় সতীর্থ আর তাঁর জনপদের সংস্কৃতজনদের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। সেখানে বেশ বড় জমায়েত। সবাই কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন। কেউ কেউ ফুল নিয়ে কেউ আবার খালি হাতে শেষবারের মতো কবিকে দেখতে। সেখানে চলল ছবি তোলার হিড়িক, যারা ফুল আনেনি তারাও অন্যের ফুলে ভাগ বসালো ছবি হয়ে থাকার জন্য; কখনো যাদের দেখা যায়নি, কখনো যারা কবির রোগশয্যায় কবিকে একবার সমবেদনা জানাতেও যায়নি তাদেরও তখন কী ব্যস্ততা! অনাহূত হয়ে আসা দুর্বৃত্তও তখন আয়োজনের সামনে আসতে চায় প্রচারের আলো ছুঁতে। কবির স্বপ্নগুলো পদদলিত করা কেউ কেউ পৃথিবীকে জানাতে ব্যস্ত নিজের উপস্থিতি। অতঃপর সংগঠনের বিশৃঙ্খল শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে পুনর্যাত্রা অন্তিম আয়োজনÑ জানাজায়। আঙিনার বৃক্ষরাজি তখন কবিকে পাতা নাড়িয়ে শেষবারের মতো বিদায় সম্ভাষণ জানায়। সূর্য তখন কুয়াশা ভেঙে ঝলমল করে ওঠে, আর শুষে নেয় কবির শরীর থেকে সমস্ত শীতকাতরতা; আর কবির অনুসারীদের চোখ থেকে সরে যেতে থাকে বিভ্রান্তি পর্দা।


আরো সংবাদ



premium cement
তামাক পণ্যে সুনির্দিষ্ট করারোপের দাবিতে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে ২৫ সংসদ সদস্যের চিঠি প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনীতে মহিষের আক্রমণে বাবা-ছেলেসহ আহত ৪ গফরগাঁওয়ে গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার তীব্র মাত্রায় হিংস্র হয়ে উঠেছে সরকার : মির্জা ফখরুল মিরসরাইয়ে মৃত্যুর ১৫ দিন পর ব্যাংক কর্মকর্তার কবর থেকে লাশ উত্তোলন দেশে দেড় হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং, দুর্ভোগে মানুষ রংপুরে মহানবী সা:-কে নিয়ে কটূক্তি করায় ছাত্রলীগ কর্মী গ্রেফতার বাড়ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি, অনলাইনে ক্লাস চালুর চিন্তা বিশ্বের অন্যতম স্মার্ট হজ ব্যবস্থাপনা হবে বাংলাদেশে : ধর্মমন্ত্রী সিলেটে ৪৪ লাখ টাকার ভারতীয় চিনিসহ গ্রেফতার ৪ অবৈধ সম্পদ : এস কে সিনহার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ২৬ জুন

সকল