২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঢাবি চারুকলা অনুষদের বার্ষিক প্রদর্শনী

বিচিত্র শিল্পমেলা
-

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক শিল্পকর্মের প্রদর্শনী ২০১৯ শুরু হয় ১৬ অক্টোবর। শেষ হয় ৮ ডিসেম্বর। এই সময়কালের মধ্যে ১৬ থেকে ২১ অক্টোবর গ্রাফিক ডিজাইন, ৩০ অক্টোবর থেকে ৫ নভেম্বর প্রাচ্যকলা, ৭ থেকে ১২ নভেম্বর অঙ্কন ও চিত্রায়ণ, ১৪ থেকে ১৯ নভেম্বর ভাস্কর্য এবং ৪ থেকে ৮ ডিসেম্বর মৃৎশিল্প বিভাগের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রিন্টমেকিং এবং কারুশিল্প বিভাগের ক্যাটালগে প্রদর্শনীর শুরু এবং শেষ তারিখ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রিন্টমেকিং বিভাগের প্রদর্শনী ২৩ অক্টোবর শুরু হয়ে ২৮ অক্টোবর এবং কারুশিল্প বিভাগের ২৮ নভেম্বর শুরু হয়ে ৩ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। প্রদর্শনীর এসব ক্যাটালগে পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের শিল্পকর্মের চিত্র স্থান পেয়েছে। এসব চিত্র দর্শনেও যে কেউ শিল্পের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন এবং একই সাথে মূল্যায়নও করতে সক্ষম হবেন। যদিও মূল শিল্পকর্ম থেকে প্রেসে ছাপানো ওসব চিত্রের কিছুটা হলেও পার্থক্য রয়েছে।
প্রদর্শনী শুরুর ধারাক্রম অনুসারে প্রথমেই গ্রাফিকস ডিজাইন বিভাগের প্রসঙ্গ এসে যায়। গ্রাফিকস ডিজাইন বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ক্যাটালগটি নির্মল এবং সার্বিকভাবে পরিচ্ছন্ন। লাল এবং সোনালি রঙের সমন্বয়ে ছাপানো কভারটি বাহুল্যবর্জিত ও দৃষ্টিনন্দন রূপ ধারণ করেছে। গুরুত্বের দিক থেকে বিবেচনা করলে গ্রাফিকস ডিজাইন বিভাগের যে দায়িত্ব সেই দায়িত্ব সফলভাবেই পালন করতে সক্ষম হয়েছে। ক্যাটালগের শুরুতেই গ্রাফিকস ডিজাইন বিভাগের খ্যাতিমান অধ্যাপক সমরজিৎ রায় চৌধুরী ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। প্রদর্শনীর আদর্শ উদ্দেশ্য এবং নবীন-প্রবীণ শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে প্রদর্শনীর গুরুত্বের কথা তুলে ধরেছেন। যা ক্যাটালগকে সমৃদ্ধ করেছে। সমৃদ্ধ করেছে হাফটোন এবং ড্রপআউট হাফটোন পদ্ধতিতে প্রকাশ করা বিভাগের চিত্র এবং কমার্শিয়াল আর্ট থেকে গ্রাফিক ডিজাইনের ব্যাখ্যা। এ ছাড়া বিভিন্ন বর্ণের বিরামচিহ্নের পাতাগুলো এবং বিগত বছরের পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পীদের সচিত্র প্রতিবেদন ক্যাটালগকে বিশিষ্ট মর্যাদা দান করেছে। সেই সাথে বিগত বছরের পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী এবং তাদের শিল্পকর্মের সাথে এবারের পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী ও তাদের শিল্পকর্মের তুলনামূলক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। যেমনÑ আবু কুবাইদ বিন রশিদ গত বছর পেয়েছে বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। এবার পেয়েছে পরীক্ষামূলক শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। মো: তারিক বিন আকরাম গত বছর (বিএফএ প্রথম বর্ষ) এবং এ বছর পেয়েছে ক্লাস বেস্ট অ্যাওয়ার্ড। গত বছরের তুলনায় আকরামের এবারের শিল্পকর্ম আরো বেশি সফল মনে হয়েছে। মো: রাসেল রানা গেল বছর ক্লাস বেস্ট অ্যাওয়ার্ড এবং এবারে কামরুল হাসান মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। প্রদর্শনীর শিল্পকর্মগুলো পরিচ্ছন্ন ও মানসম্পন্ন। তবে ক্যাটালগে প্রকাশিত শিল্পকর্মগুলোর শিরোনাম, মাধ্যম এবং আকৃতির উল্লেখ না থাকা স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। আর এ কারণে প্রাচ্যকলা বিভাগের প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়েছে ৩০ অক্টোবর এবং শেষ হয়েছে ৫ নভেম্বর। বিভাগের পক্ষ থেকে একটি সুন্দর ক্যাটালগ ছাপা হয়েছে। তবে কভারের অলঙ্করণে প্রাচ্যকলার অন্তর্নিহিত রূপটি প্রকাশ পেলে ক্যাটালগ আরো দৃষ্টিনন্দন এবং অর্থবহ হতে পারত। ক্যাটালগের শুরুতে অধ্যাপক (অব:) আব্দুস সাত্তার প্রাচ্যকলা এবং অন্যান্য ধারার শিল্পকর্মের পার্থক্য স্পষ্ট করেছেন এবং প্রাচ্যধারার শিল্পের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। ফলে প্রাচ্যধারার শিল্পকর্মের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। এই স্পষ্টকরণের আলোকেই বিভাগের প্রদর্শিত শিল্পকর্মগুলোকে বিবেচনা করতে হবে। বিবেচনা করতে হবে শিক্ষার্থীরা কতটা স্বার্থকভাবে প্রাচ্যধারার চর্চা করতে পারছে। প্রদর্শনীতে সব কর্মই প্রাচ্যধারার দাবি পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে, এ কথা বলা যাবে না।
কারণ কিছু শিল্পকর্মের পাশ্চাত্যের প্রভাব প্রকট। তবে বেশ কিছু চিত্রকর্ম প্রাচ্যধারার দাবি পূরণে অনেকটাই সফল, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেমন শ্রেষ্ঠ মাধ্যম পুরস্কারপ্রাপ্ত হাবিবা আসলামের কম্পোজিশন নামক বৃক্ষকাণ্ডের চিত্র, এ কে এম গোলাম উল্লা নিশানের এ টেল অব টু টেরিটোরিস, মারিয়া মীমের কম্পোজিশন, সুকৃতি আদিত্যের ফ্লাওয়ার, তাসমিয়া নওশাবার কম্পোজিশন, শিখন বিশ্বাসের কম্পোজিশন নামক চিত্রকর্মগুলো।
প্রাচ্য চিত্রচর্চার ক্ষেত্রে বিষয় নির্বাচন, বিষয়ের উপস্থাপন, বিষয়গুলোর মধ্যে ঐক্য স্থাপন, বিন্যাস, বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণে রহস্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আনয়ন এবং প্রাচ্যধারার দাবি পূরণে সচেতন থাকা আবশ্যক। এ সব বিষয়ের অনেক কিছুই প্রতিফলিত হাবিবা আসলামের চিত্রে। বৃক্ষকাণ্ডের বিভাজিত অংশগুলো, দীর্ঘাকৃতির লতানো স্বভাবের শিকড়গুলো এবং আলোছায়ার রহস্যপূর্ণ ব্যবহার চিত্রকে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন করেছে। এ কে এম গোলাম উল্লা নিশানের চিত্রটিও দ্বিদেশীয় অভিব্যক্তির সফল প্রকাশের মাধ্যমে প্রাচ্যচিত্রের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। মারিয়া মীম তার কম্পোজিশন চিত্রের প্রতি যে অতি সংবেদনশীল এবং যতœবান ছিল, তা স্পষ্ট হয়েছে বিষয় উপস্থাপন এবং বিন্যাসের মাধ্যমে। মীমের চিত্রে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সফল সংমিশ্রণ ঘটেছে, যা বর্তমান সময়ের দাবি। প্রাচ্যধারার চর্চাকারী সব শিক্ষার্থীর স্মরণে রাখা প্রয়োজন, একাডেমিক শিক্ষার আওতায় শিক্ষার্থীরা যত বেশি প্রাচ্যমুখী হবে, ততই মঙ্গল।
চারুকলা অনুষদের বিভাগগুলোর মধ্যে অঞ্চল ও চিত্রায়ন বিভাগ অধিক জনপ্রিয়। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই এই বিভাগে ভর্তির জন্য আবেদন করে থাকে। একসময় মেধা তালিকার শীর্ষে অবস্থানকারীরাই এই বিভাগে ভর্তি হতো। এখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে এই বিভাগ। আগে যখন একত্রে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হতো, তখন প্রদর্শনীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতো এই বিভাগের প্রদর্শিত শিল্পকর্মগুলো। দর্শনীয় বিষয় হিসেবেও গুরুত্ব পেত বিভাগের চিত্রকর্মগুলো। এই বিভাগের এবারের প্রদর্শনী ৭ থেকে ১২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রদর্শনীর ক্যাটালগ কলেবরে বৃদ্ধি পেলেও দর্শনীয় রূপধারণে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ বিভাগটি যতটা জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ, ততটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারেনি ক্যাটালগ। সবচেয়ে দৃষ্টিকটু লেগেছে ক্যাটালগের কভারের নিচের অংশের সাদাটে প্যানেল। এই অংশটুকু পরিহার করতে পারলে ক্যাটালগ কিছুটা হলেও দর্শনীয় হতে পারত। তবে কভারের দীনতার অনেকখানি ঘাটতি পূরণ করেছে। শ্রদ্ধাঞ্জলির পাতাটি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং বিভাগের প্রয়াত শিক্ষক শিল্পী কাজী আবদুল বাসেতকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে। শিল্পী কাজী আবদুুল বাসেতের জীবনী প্রকাশও ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
বরাবরের মতো এবারো বিভাগের সুন্দরতম কাজগুলোর সমন্বয়েই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। শ্রেষ্ঠ মাধ্যম পুরস্কারপ্রাপ্ত পেন্সিল ও কলমে আঁকা পিনাক রঞ্জন সরকারের স্টিল লাইফ, শহীদ শাহনেওয়াজ স্মৃতি পুরস্কারপ্রাপ্ত তানভির মালেকের ক্লোজআপ স্টাডি, রাকিন নওয়ারের দেলোয়ার হোসেইন স্মৃতি পুরস্কারপ্রাপ্ত পেন্সিলে আঁকা ক্লোজআপ স্টাডি, বিষয় নির্বাচন, বিষয়ের বিন্যাস, উপস্থাপন কৌশল, বিষয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অংশগুলোকে গুরুত্বের সাথে দৃষ্টিসীমায় আনা, সর্বোপরি আলোছায়ার অর্থপূর্ণ ব্যবহারে প্রাণবন্ত রূপ ধারণ করেছে। মোড়ার বুনন, লণ্ঠনের কাঠামো, রশি, জুতার ফিতা, ব্রাশ, মোটরসাইকেল, সাইকেলের চাকা কোনো কিছুতেই অবহেলার কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। দক্ষ হাতের স্পর্শে সবই জীবন্ত রূপ লাভ করেছে। পুরস্কারপ্রাপ্ত রঙিন চিত্রের মধ্যে মো: হেলাল হোসেনের সিটিস্কেপ, মো: রওশন হাবিবের বড়বাড়ি সৃষ্টির ক্ষেত্রেও মুনশিয়ানার ছাপ স্পষ্ট। প্রদর্শনীতে বেশ কিছু ধর্মীয় চিত্রও স্থান পেয়েছে। এটাও ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। সাধারণত বাংলাদেশে ধর্মীয় চিত্রচর্চার রেওয়াজ নেই বললেই চলে। আনোয়ারুল হক স্মৃতিপুরস্কারপ্রাপ্ত জয়ন্ত মণ্ডলের ইনার পাওয়ার অব ওম্যান ইন দিস টাইম, উগিয়েন সেরিং ডোয়া এর আনটাইটেল্ড, সুতপা করের তারা ধর্মীয় চিত্রের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগের পরেই ভাস্কর্য বিভাগ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। তবে এ বিভাগ কোনো ক্যাটালগ প্রকাশ করেনি। দুই পাতার একটি পাতলা ফোল্ডার করা হয়েছে। যাকে অবহেলার চূড়ান্ত রূপ বলা যায়। তা ছাড়া এতে বিভাগের প্রদর্শিত শিল্পকর্মের কোনো চিত্রও নেই। যেগুলো সম্পর্কে মন্তব্য করা যায়।
চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগটি স্বল্প সময়ে অবিশ্বাস্যভাবে উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। ছাপচিত্রের পথপ্রদর্শক মহান দুই শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ এবং মোহাম্মদ কিবরিয়া বিভাগকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এ বিভাগে কিছু দিন কাজ করার। উভয়ের সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছি। গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ পেয়েছি উভয়ের কাছ থেকে। কাছ থেকে দেখেছি মোহাম্মদ কিবরিয়াকে কাজ করতে। কিভাবে এচিং প্লেটে রঙ লাগাতে হয়, কিভাবে পরিষ্কার করতে হয় এবং কিভাবেইবা প্রিন্ট নিতে হয় সবই শিখেছি তার কাছে। ছাপচিত্র সাবসিডিয়ারি বিষয় থাকায় আমি এ দুর্লভ সুযোগ পেয়েছি। দেখেছি ছোট্ট এক প্রেসে কিভাবে তিনি কষ্ট করে কাগজে ছাপ তুলতেন। সেই ছোট্ট প্রেসের জায়গায় এখন বড় প্রেস যেমন এসেছে, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে সুযোগ-সুবিধাও। এই সুযোগ-সুবিধার কারণেই শিক্ষার্থীরা এখন স্বাধীনভাবে, সুন্দরভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করতে পারছে। আর এসব কাজের মাধ্যমে দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বিচরণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। এমনই কিছু কাজের সমন্বয়ে আয়োজন করা হয়েছে বার্ষিক প্রদর্শনীর। প্রদর্শনী উপলক্ষে বাহুল্যবর্জিত পরিচ্ছন্ন একটি ক্যাটালগ প্রকাশ করা হয়েছে। যার শীর্ষদেশে মহান শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে। ক্যাটালগের অভ্যন্তরে প্রথম পাতায় শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ ও মোহাম্মদ কিবরিয়াকে। ক্যাটালগটি সংক্ষিপ্ত হওয়ায় সব বিষয়কে একাধারে সাজিয়ে শেষ করা হয়েছে। বিরতিহীনভাবে বিষয় উপস্থাপনার কারণে নান্দনিক রসের ব্যাঘাত ঘটেছে। তবে পুরস্কারপ্রাপ্ত মো: শাহেদ হোসেইনের রঙিন কাঠ খোদাই চিত্র দিস ইজ আই অ্যান্ড ইনার রিয়েলিটি, শ্রেষ্ঠ মাধ্যম পুরস্কারপ্রাপ্ত কাঠ খোদাই চিত্র গ্র্যান্ড মা (শিল্পী রাকিব আলম শান্ত), সুমায়া সানজিনের এচিং মাধ্যমের স্টিল লাইফ, নুসরাত জাহানের লিথো মাধ্যমের ল্যান্ডস্কেপ-১ চিত্রগুলো নান্দনিক রসের অভাব অনেকটাই পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। শ্রেষ্ঠ মাধ্যম পুরস্কারপ্রাপ্ত জলরঙে আঁকা কামরুন নাহার মীমের স্টিল লাইফ, সাঈদা আক্তার শান্তার নেয়ারবাই ফ্লোরা এবং সৈকত আহমেদের ল্যান্ডস্কেপ প্রশংসার দাবিদার। প্রশংসার দাবিদার এস এম ওয়াসিক উদ্দিন চৌধুরীর ইন্ট্যাগ্লিয় মাধ্যমের স্টিল লাইফও।
চারুকলা অনুষদের প্রতিষ্ঠাতা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং শিল্পী জুনাবুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কারুশিল্পী বিভাগের ক্যাটালগের যাত্রা শুরু। ক্যাটালগের পাতা উল্টালেই দৃষ্টি পড়বে শ্রদ্ধাঞ্জলি শব্দটির ওপর। এর নিচেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী জুনাবুল ইসলামের চিত্র। চিত্র দুটি ছাপা হয়েছে পাশাপাশি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে সবাই যতটা চেনেন-জানেন, জুনাবুল ইসলামকে ততটা জানেন না। শিল্পী জুনাবুল ইসলামের সহধর্মিণী রোকেয়া ইসলাম ক্যাটালগে ছাপা তার বাণীতে শিল্পী সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য প্রকাশ করেছেন। আমি যখন প্রি-ডিগ্রি শেষ করে প্রাচ্যকলা বিভাগে ভর্তি হয়েছি (১৯৬৭-৬৮), তখন অন্যান্য বিষয়ের সাথে বাটিকের কাজ করতাম। যদিও বাটিক আমার বিষয় ছিল না। তৎকালে চারুকলা কলেজে বাটিক শিক্ষার কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। নিজের ইচ্ছাতেই নিজে নিজে বাটিকের কাজ করছিলাম। একসময় বাটিকের একটি চিত্র ফ্রেম করে দোতলার অফিসসংলগ্ন শিক্ষকদের আর্ট গ্যালারিতে দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখেছিলাম। এই বাটিক চিত্রের সূত্র ধরেই শিল্পী জুনাবুল ইসলামের সাথে পরিচয়। তিনি আমার ক্লাসে এসে বললেন, তোমার বাটিকের কাজ দেখলাম, খুব সুন্দর হয়েছে। আরো কাজ করো। তিনি এভাবেই আমাকে উৎসাহ দিতেন তখন। এভাবে কথা হতে হতে জানলাম তাকে চারুকলা অনুষদে কারুশিল্প বিভাগ খোলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এও জানলাম, তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছোট ভাই। তাকে যখন কারুশিল্প বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়, তখন বিভাগটির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ফলে আমার ক্লাসরুমের সামনে গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের কক্ষে তার বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফলে আমার বাটিকচর্চার কারণে এবং আমার পাশেই অবস্থান করার কারণে তার সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। কারুশিল্প বিভাগের ক্যাটালগে তার চিত্র দেখে তাকে স্মরণ করার সুযোগ পেলাম। ক্যাটালগটি সাদাসিধে হলেও পরিচ্ছন্ন মনে হয়েছে।
উপরের আলোচনায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, কারুশিল্প বিভাগের বয়স বেশি নয়। কিন্তু বয়সের তুলনায় সবদিক থেকেই উন্নয়ন ঘটেছে যথেষ্ট। শিল্পের ইতিহাসে কারুশিল্পকে বলা হয় অপ্রধান শিল্প। কারুশিল্পের ব্যবহারিক দিকটির কথা বিবেচনা করেই এ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কারুশিল্প বিভাগের কাজে মেজর আর্ট বা প্রধান শিল্পের রূপ দেয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। বিভাগের সৃষ্ট শিল্পকর্মগুলো দেখলেই স্পষ্ট হবে যে, দর্শনীয় কিংবা উপভোগ্য দিক থাকলেও এসব শিল্পকর্মের ব্যবহারিক দিক নেই বললেই চলে। শ্রেষ্ঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত সরব চন্দ্র রায়ের উঠ কার্ভিং, রুবায়েত-ই-শারমিনের সেন্টার টেবল (ক্রিয়েটিভ ক্রাফট অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত), শিল্পী আবদুস শাকুর শাহ শ্রেষ্ঠ মাধ্যম পুরস্কারপ্রাপ্ত জেসিয়া ইসলামের এপ্লিক, রাইসা মান্নানের ট্যাপেস্ট্রি মাধ্যমের প্রতীক্ষা কিংবা মুমতাহিনা বিনতে সুলতানের সরাচিত্র এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
চারুকলা অনুষদের বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী শেষ হয়েছে ৮ ডিসেম্বর ২০১৯। শেষ প্রদর্শনী ছিল মৃৎশিল্প বিভাগের। মৃৎশিল্প বিভাগের ক্যাটালগে দেশের খ্যাতিমান শিল্পী অধ্যাপক আবুল হাশেম খান মৃৎশিল্প বিষয়ে সংক্ষিপ্ত অথচ গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। মৃৎশিল্পের ক্যাটালগে হাশেম খানের উপস্থিতি এবং বক্তব্য প্রদান অনেকের কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। কিন্তু অস্বাভাবিক নয় মোটেও। শিল্পী হিসেবে তো তিনি যেকোনো বিভাগের শিল্প বিষয়েই বক্তব্য দিতে পারেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। নাড়ির টানেই তিনি এ বিভাগের শিল্পকর্ম সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন। কারণ তিনি মৃৎশিল্প বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। বিখ্যাত শিল্পী মরণচাঁদ পাল এবং শিল্পী গোপেশ মালাকর তার সহপাঠী ছিলেন। যে কথা বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান দেবাশীষ পাল শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখ করেছেন। অধ্যাপক হাশেম খান যথার্থই বলেছেন, বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের সুখ্যাতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে গেছে। মৃৎশিল্প এবং কারুশিল্পের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। কারণ উভয় শিল্পেরই ব্যবহারিক দিক রয়েছে। কিন্তু মৃৎশিল্পের শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক দিককে উপেক্ষা করে শৈল্পিক দিককে প্রাধান্য দিয়ে মৃৎশিল্পের চর্চা করে চলেছে। নিরীক্ষাধর্মী শ্রেষ্ঠ শিল্পের জন্য পুরস্কারপ্রাপ্ত নেচার অ্যান্ড লাইফ (জোথিকা ভৌমিক), মৃৎশিল্প মাধ্যমের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত হালিমা আকতারের ফ্লাওয়ার সেপ ফ্রুট সেট, মনির শিল্পী মীর মোস্তফা আলী স্মৃতি পুরস্কারপ্রাপ্ত অনুরক্তি, শারমিন আকতার শিমুর শিল্পী কোচিতাকিতা স্মৃতি পুরস্কারপ্রাপ্ত এনডিভরসহ প্রদর্শিত প্রায় সব শিল্পেই যে ব্যবহারিক দিককে উপেক্ষা করে শিল্পরূপ দানের চেষ্টা করা হয়েছে, তারই দৃষ্টান্ত বহন করছে। অভিধানে অনুভূতি বলে একটি শব্দ আছে। যার অর্থ সুখ কিংবা দুঃখের বিষয়গুলো উপলব্ধি করা। শিল্পের এমন অনেক বিষয় থাকে, শিল্পী যেগুলোকে বিশেষ কৌশলে এমনভাবে প্রকাশ করেন, যার মধ্য দিয়ে এই সুখ কিংবা দুঃখের বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমনি একটি শিল্পের জন্ম দিয়েছে আঁখি পুরি। আঁখি তার এই শিল্পের নাম দিয়েছে ইউনাইটেড সোসাইটি। অর্থাৎ একতাবদ্ধ সমাজ। এখানে সমাজ একটি ট্রে বা পাত্র। যার ওপর সাজানো রয়েছে বেশ কিছু ফলমূল। যার বেশির ভাগই ব্যঞ্জনে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ মানুষের খাদ্যে ব্যবহৃত হয়। যেমনÑ বেগুন, শসা, মুলা, বিট ইত্যাদি। এ জাতীয় ফলমূলের যে আত্মত্যাগ মানবজাতির জন্য, অকাতরে আনন্দে যে তারা নিজেদের বিলিয়ে দেয় সেই অনুভূতির বিষয়টিই শিল্পী প্রকাশ করেছে তার শিল্পের মাধ্যমে। মানবসেবায় উৎস্বর্গীকৃত এসব ফলমূল যে আনন্দিত, সেই বিষয়টি সার্থকভাবে শিল্পী ফুটিয়ে তুলেছে প্রত্যেকটির ওপর সংযোজিত মুখের হাসি এবং চোখের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে। শিল্পী আঁখি পুরির ঠিক বিপরীত অনুভূতি ব্যক্ত করেছে শিল্পী সৌরভ চন্দ্র বর্মণ তার শিল্প দ্য ভিকটিম অব এক্সপ্লয়টেশনের মাধ্যমে। অর্থাৎ সমাজে যারা বঞ্চিত, শোষিত, অত্যাচারিত, নিগৃহীত তাদের মানসিক যন্ত্রণার বিষয়টি শিল্পী সার্থকভাবে প্রকাশ করেছে। এখানে একজনের ঠোঁট দুটো সেলাই করা, যাতে সে কোনো কথা বলতে না পারে। কোনো অভিযোগ করতে না পারে। আরেকজনের মাথায় অত্যাচারির বা শোষণকারীর কালো হাত এমনভাবে খামচে ধরেছে যে তার দুটো আঙুল চোখের মধ্যে প্রবেশ করেছে। ফলে অসহনীয় যন্ত্রণায় ভিকটিম বা অত্যাচারিতের মুখ বিকৃত হয়ে গেছে। চোখ এবং মুখের যন্ত্রণাকাতর অনুভূতি কষ্টের মাত্রাকে প্রকাশ করছে। অভিনন্দন শিল্পীদ্বয়কে, তাদের শিল্পে শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটানোর জন্য। হৃদয়স্পর্শী অনুভূতি প্রকাশকারী শিল্পকর্ম উপহার দেয়ার জন্য। পরিচ্ছন্ন সুন্দর ক্যাটালগে সুন্দর সুকুমারী শিল্পকর্ম প্রকাশ করার জন্য।
ক্যাটালগের কভারে বিভাগীয় বিষয়ভিত্তিক সঙ্কেত কিংবা প্রতীকী উপস্থাপনহীনতা, পুরস্কারের সংখ্যা ও সমন্বয়হীনতা, সাবেক অধ্যক্ষ শিল্পী সৈয়দ শফিকুল হোসেন, একাত্তরের শহীদ কর্মচারী নোনা মিঞাসহ অন্যদের স্মরণ না করা অনুষদের বার্ষিক প্রদর্শনীর দুর্বল দিক মনে হয়েছে। কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ভবিষ্যতে দৃষ্টি দেবেন আশা করছি।


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র গরমের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অন্যতম দায়ী : মির্জা আব্বাস সৈয়দপুরে জামায়াতের উদ্যোগে সালাতুল ইসতিসকার নামাজ আদায় জিম্বাবুয়ে সিরিজের শুরুতে না থাকার কারণ জানালেন সাকিব ঝালকাঠিতে গ্রাম আদালত কার্যক্রম পরিদর্শনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল চুয়াডাঙ্গায় বাতাসে আগুনের হল্কা : গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ বৃষ্টির নামাজ আদায়ের নিয়ম আজও স্বর্ণের দাম ভরিতে ৬৩০ টাকা কমেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২৮ এপ্রিল খুলে দেয়ার প্রস্তুতি, ক্লাস চলবে শনিবারও মিরসরাইয়ে জুস খাইয়ে অজ্ঞান করে লুট, মূল হোতা গ্রেফতার বৃষ্টি কামনায় ঈশ্বরগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীর ইসতিসকার নামাজ আদায় কুবিতে আল্টিমেটামের পর ভিসির কার্যালয়ে তালা ঝুলাল শিক্ষক সমিতি

সকল