১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সাহিত্যে আধুনিকতা

-

প্রতিটি মানুষ আনন্দপ্রিয়। আর আনন্দ মননচর্চারই একটি রূপ। নিরানন্দ থেকে মানুষ রক্ষা পায় আনন্দের মিলনভূমি তৈরি করতে পারলেই। আনন্দের মিলনভূমি তৈরি হয় সাহিত্যে। সাহিত্য শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত দিক দিয়ে প্রকৃতি-প্রত্যয়ের পার্থক্যে দু’টি অর্থ বহন করে। প্রথমটি মিলন, সমন্ধ। দ্বিতীয়টি, সম্যক হিত সাধনকারী উপাদান। এই দু’টি অর্থকে এক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে প্রকৃত সাহিত্য তাকেই বোঝায়, যা মানব সমাজের চিন্তাধারা, আদর্শ, মানবমনের সুকুমারবৃত্তি, অনুভূতি ও সংস্কৃতি-শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশমান হয়ে ধরণীর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মানবকূলকে একে অন্যের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে একটি চূড়ান্ত মঙ্গলে উপনীত করে। আসলে হিতের সাথে বর্তমান যা তাই সাহিত্য; যা মানুষের মনের অন্ধকার দূর করে। যা সময়ের ধারক আর মনোবাসনার বাহক মূলত তাই সাহিত্য।
প্রচলিত অর্থে কাব্য, নাটক, উপন্যাস, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি সাহিত্যের আওতায়। সাহিত্য একটি শিল্পবিশেষ যার ক্ষেত্র মানবজাতি ও মানবসমাজ। মানবসমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ভাবনা ও সংস্কৃতি পরিস্ফূটিত হয়ে ওঠে সাহিত্যের মাধ্যমে। সাহিত্য আমাদের নিয়ে যায় মনুষত্বের আলোকিত জগতে। কোনো মালিন্য সাহিত্যকে স্পর্শ করতে পারে না। সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠার পাঠ নিয়ত ধ্বনিত হয় সাহিত্যে। মানুষ নিজেকে শ্রীমণ্ডিত করার উদ্দেশ্যেই আনন্দের সন্ধান করে। আর মানবজীবনের সর্বাঙ্গীন আনন্দের বিকাশ ঘটে একমাত্র সাহিত্যে। সমাজের সবাইকে একত্রিত করার মধ্যেও যে পরম আনন্দ, সেটিও এই সাহিত্যে।
আমাদের মননচর্চার অন্যতম বাহন সাহিত্য। সাহিত্য সমাজজীবনের দর্পণ। সাহিত্য হচ্ছে জীবনের সমালোচনা। মানুষের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা নিয়েই সৃষ্টি হয় সাহিত্য। জীবনতো বারবার পড়া উপন্যাসের পাতা। অতএব, জীবনকে বাদ দিয়ে সাহিত্য হয় কিভাবে? মনীষী ইমারসন বলেছেন, ‘সাহিত্য হচ্ছে দেশ ও জাতির মানসের প্রতিফলন।’ এ বিষয়ে বিশদভাবে ব্রিয়েল বলেন, ‘আনন্দ দিতে, মানুষের জীবনবোঝা কমাতে, তাদের দুঃখ-বেদনা, তাদের পাপ, তাদের নিশ্চুপ গৃহের মাঝে, তাদের বিফল আশা ও তাদের বিষাদময় ভবিষ্যৎ থেকে মুক্তি দিতেই সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে।’
যে সমাজের সাহিত্য যত উন্নত ও আধুনিক, বোঝা যাবে সে সমাজেও তত উন্নত। আধুনিক মানুষেরা সাহিত্যের সোপান বেয়েই আপন সত্তার স্বরূপ সন্ধান করে। সাহিত্য সেতুবন্ধ রচনা করে বিশ্বের সব মানুষের মনের সাথে। সাহিত্য কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। প্রবহমান নদীর জলধারায় অধিকার রয়েছে যেমন দেশ-কাল-গোত্র নির্বিশেষে সবার; তেমনি সাহিত্যের রূপ-রস ভোগ করার অধিকার সব মানুষের। কালের গণ্ডি পেরিয়ে সাহিত্যের ধারা বয়ে চলে সম্মুখপানে। সাহিত্যে ফুটে ওঠে সমাজের চিত্র। সাহিত্যের ওপর প্রভাববিস্তার করে সমাজ ও কালের ধারা। সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের গতিধারা ঘুরিয়ে দেয়া সম্ভব। বিভ্রান্ত পৃথিবীকে সঠিক পথের দিশা দেখাতে সাহিত্যের প্রভাব ও দায়িত্ব অপরিসীম। আর সাহিত্য সৃষ্টি করে সমাজের মানুষ তার বুদ্ধি ও প্রতিভা দিয়ে। বুদ্ধিই হলো সব কাজের মূল। বুদ্ধির আলো দিয়ে মানুষ নিজেকে চিনে নিতে পারে। প্রতিভা ও বুদ্ধি দিয়েই সব কিছু পরিচালনা করে থাকে মানুষ।
মানুষ চিরকাল আত্মরক্ষা ও সুখের সন্ধান করে। বুদ্ধির আলোক দিয়ে সে সংক্ষিপ্ত উপায়ে সুখলাভ করতে চায় এবং এই চাওয়াটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক। বুদ্ধির ভিত্তির ওপর মানুষের নীতিবোধ প্রতিষ্ঠিত এবং এর উৎস ব্যক্তিগত সুখের আবহ থেকে। যার অর্থ ঐচ্ছিক সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য। ব্যক্তি মানুষের জীবনের লক্ষ্য একটাই, উপভোগ। সে উপভোগ পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের উপভোগ। মানুষ মনে করে, অন্যের ক্ষতি না করে অনায়াসে অর্জিত ঐশ্বর্য উপভোগ করায় কোনো দোষ নেই। উপভোগ জায়েজ এই কারণে যে, ভোগের দ্রব্যের প্রতি মানুষের প্রলোভন রয়েছে। ভোগ বৈধ। আল্লাহ আমাকে সুখি হতে বলেছেন এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। আমি যা উপভোগ করব তা হবে বস্তুনিষ্ঠ, অন্যকে অসুখি করে নয়। ফলে মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে জীবনমুখী। তলস্টয়, বার্নাড শ’ প্রমুখ সাহিত্যিকেরা মনে করেন, মানুষের জীবনই সাহিত্যের মূল কথা। সব মানুষই চায় আনন্দলোকের অংশ ভোগ করতে। কেউ দুঃখ ভোগ করতে চায় না। প্রকৃতিও প্রতিটি মানুষকে সুখি হওয়ার অধিকার দিয়েছে। সুখ একটি বল, সে যতক্ষণ গড়িয়ে যায় ততক্ষণ আমরা তার পেছনে পেছনে ছুটি। যে মুহূর্তে বলটি থেমে যায়, আমরা তখন তাকে পা দিয়ে ঠেলে দেই পরবর্তী সুখের আশায়।
সুখ নিহিত রয়েছে মানুষের জীবনযাপনের মধ্যে। প্রকৃতির সব বস্তু মানুষের উপভোগের সামগ্রী।
মানুষের সত্তায় সুখ মিশে আছে; দুঃখ একটি দুর্ঘটনা মাত্র। মানুষের উপভোগের জন্য ভোগের বস্তু রয়েছে সর্বত্র। প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় বর্ণের মধ্যে, মধুর ধ্বনির মধ্যে, সুস্বাদু খাদ্যের মধ্যে, মানবিক অস্তিত্বের মধ্যেই রয়েছে অপরিমেয় সুখ। পৃথিবীতে ইন্দ্রিয়জ সুখ উপলব্ধি করা ছাড়া মানুষের তেমন কিছু করার নেই। অর্থাৎ মানুষের একমাত্র কামনা স্বচ্ছল জীবনযাপন, সুস্বাস্থ্য, ভোগবস্তু আহরণ, পরকালে শান্তি ইত্যাদি। আর মানবজীবনের এই সব বিষয় নাড়াচাড়া করতে গিয়ে সাহিত্যিকেরা তাদের বুদ্ধি ও প্রতিভা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন অমর সাহিত্য।
সাহিত্য-শিল্পে দেখা দিয়েছে নতুনের হাওয়াÑ আধুনিকতা।
আধুনিকতা একমাত্রিক কোনো বিষয় নয়, এটি বিচিত্রমাত্রিক একটি অনুষঙ্গ। এটি সমকালীনতাও নয়, যদিও সমকালীনতার সাথে এর যোগ আছে; যুক্ততা আছে। সমকালকে স্পর্শ করে তাকেই আবার অতিক্রম করে গেছে আধুনিকতা। সমকালকে স্পর্শ করে, অঙ্গীকার করে, আলিঙ্গন করে যার উন্মেষ ও বিকাশ তা-ই আধুনিকতা। বর্তমানে নতুন সাহিত্যাদর্শ গড়ে উঠেছে। বিশ্বকে ব্যক্তিগতভাবে না দেখে মুক্তভাবে দেখাই আধুনিক সাহিত্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই সাহিত্যাদর্শের মূলকথা হলো নিজেকে আবিষ্কার এবং সেই সাথে বিশ্বের সাথে একাকার করা। এই সাহিত্যে আছে সামাজিক তথা বিশ্ব দর্শন, আছে ব্যক্তিগত তথা মুক্ত চিন্তার প্রতিফলন। আধুনিক সাহিত্যে মানুষের প্রতিভার সাথে নতুন শব্দচয়ন ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশের উদ্ভব ঘটেছে। প্রতিভার অর্থ সহজাতবৃত্তি, স্বর্গীয় আনন্দ, স্বর্গীয় স্ফূলিঙ্গ, অলৌকিক শক্তি, স্বর্গীয় দান ইত্যাদি। বর্তমানে এর সাথে উদ্ভব ঘটেছে ‘ব্যক্তিত্ব’ শব্দটির। ব্যক্তিত্ব এমন একটি ফেনার কণিকা যা উদ্ভাসিত হয়ে প্রতিটি মানুষকে তার ব্যক্তিসত্তার একটি অংশ ফিরিয়ে দেয়। ব্যক্তিসত্তা আলোড়িত হয় তীক্ষè উপলব্ধি দিয়ে। ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এই অভিধা সাহিত্য-শিল্পে স্পষ্ট। স্থিতিশীলতার বদলে মানুষ চাইছে অস্থির যৌবনময় জীবনের চাঞ্চল্য। যে জীবন প্রাণময়, গতিময়, টগবগেÑ এ রকম একটা মানবচেতনা অর্থময় করে তুলেছে সমকালীন সাহিত্যিকেরা। তাদের বাচনভঙ্গিতে রয়েছে নতুনত্বের প্রকাশ। এক স্তর থেকে আরেক স্তরে মানবচৈতন্যের আবেগে উদ্দামতার সমকালীন উত্তরণ ঘটেছে। উত্তাল আবেগেই রয়েছে সৃষ্টির বীজ, এই বীজের অভাবে সৃষ্টি দুরূহ।
সৃষ্টিকর্ম সাধিত হয় উদ্দীপ্ত চৈতন্যের প্রখর উপলব্ধিতে। এই চৈতন্য ছাড়া কোনো মহৎ সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। চৈতন্যে প্রেম ও আলোড়নে সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক বিষয়বস্তুর গভীরে প্রবেশ করে তার মর্ম উপলব্ধি করতে পারেন। আধুনিক সাহিত্যিকেরা চেতনার এই উজ্জ্বল মুহূর্ত আঁকতে পারেন। সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকের কাজ সৃষ্টি। তিনি কখনো অনুকৃতি বা অনুকরণ করেন না। তার মস্তিষ্কে নতুন নতুন চিন্তার উদ্ভব হয়। সৃষ্টিই তার একমাত্র লক্ষ্য। প্রজ্ঞার আলোকে উদ্দীপ্ত হয়ে মেতে থাকেন সৃষ্টির নেশায়। এই কারণে সাহিত্যের ব্যাখা-বিশ্লেষণ-নিরূপণ-পর্যবেক্ষণ-নিরীক্ষণ সবকিছুই নির্ভর করে মরমী আলোকের ওপর। বিশেষ করে আধুনিক বা সমকালীন সাহিত্যে। সমকালীন সাহিত্যে যে বিষয়বস্তু আসে তা সাহিত্যিকের চারপাশ ও নিজস্বতার বহির্প্রকাশ। এই বহির্প্রকাশ যেমনি অভিনব, তেমনি চিরন্তন ও আধুনিক।


আরো সংবাদ



premium cement