২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রক্তে আঁকা মানচিত্র

-

কুয়াশা মাড়িয়ে পড়িমরি করে বেশ কিছু পথ হেঁটে চলা। ঘুটঘুটে আঁধারে থেকে থেকে বিকট শব্দে ভেসে আসে গুলির আওয়াজ। কখনো গগনবিদারী মরণ চিৎকার। রোজিনা হাঁফিয়ে ওঠে। তার কোলে তিন বছরের ছোট্ট মেয়ে শামীমা। শামীম নামটা নিজের নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছে। চাকরির সুবাদে গ্রাম ছেড়ে দুই বছর আগে ঢাকা শহরে আসা। এখন কী করবে, কোথায় যাবে বুঝে উঠতে পারে না! রোজিনা বেগম একটু পরপর শুধু বলছে, আর কতদূর! শামীম বউয়ের কথায় কর্ণপাত করে না। বাঁচতে হবে। হঠাৎ অন্ধকার গলিমুখে গাড়ি দেখে চমকে ওঠে। তিনটি দেহ একসাথে থমকে দাঁড়ায়। গাড়ির হেড লাইটের তীব্র আলোয় সামনে কিছু দেখা যায় না। তারপর বিকট শব্দে করে কেঁপে ওঠে আকাশ বাতাস। গুড়ুম। কয়েকবার। শামীমাকে বুকে নিয়েই শামীমের গায়ের ওপর আছড়ে পড়ে রোজিনা। শামীম নিজেকে সামলে রাখতে পারেন না। তিনটি দেহ একসাথে রাস্তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। রোজিনা তাকে জাপটে ধরায় পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে মাথায় পিচঢালা রাস্তার তীব্র আঘাতে মাথাটা ঘুরে ওঠে। ব্যথার কামড়। ঘটনার আকস্মিকতায় শামীম এতটা হতবিহ্বল একটু শব্দ করে না। বুকের ওপর রোজিনার চাপা কান্না, গোঙানির আওয়াজ। একটু বাদেই থরথর করে কেঁপে ওঠে গোটা দেহ। তারপর নিথর। শামীমা থেমে গেছে প্রথম চিতকারে। শামীমের আর কিছু মনে নেই। ভোরের আলো তেজ বাড়িয়ে যখন মাথার উপর ঠিক সে সময় চোখ মেলে তাকায় শামীম। রাজারবাগ থেকে অদূরে একটা গলিমুখে পড়ে আছে তিনটি দেহ। লোকজন ভিতু চোখে তাকিয়ে দ্রুত বিদায় নিচ্ছে। ক্লান্ত দুটো চোখে রাজ্যের অসাড়তা। তবু চেয়ে দেখে তার রোজিনা রক্তে গোসল। শিশু শামীমা বুক ফেড়ে লাল রক্তে রাজপথে যেন এঁকে গিয়েছে একটি বাংলাদেশ। ক্লান্তি, মৃত্যু ভয়? শামীমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় জনমের মতো। সন্তানের রক্তে ভেজা রাজপথে সে শুয়ে থাকবে! লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঢাকাতেই যোগ দেয় মুক্তিফৌজ হিসেবে। তারপর বিহারে টানা তিন মাস ট্রেনিং। ট্রেনিং চলাকালে বাবা-মাকে একটা চিঠি লিখেছিল। অল্প কথায়Ñ ‘তোমার ছেলে ভালো আছে। রোজিনা আর শামীমা! ওরা হয়তো ভালো মন্দের জায়গা পেরিয়ে আলোকিত। দোয়া করো, যদি কোনা দিন দেখা হয় সেটা যেন হয় হায়েনার বিষাক্ত ছোবল মুক্ত স্বাধীন এক দেশে।’ চিঠি পেয়েছে কিনা জানা সম্ভব হয়নি।
ট্রেনিং শেষে যুদ্ধ করতে হয় মুক্তিবাহিনীর রাতইল সাবহেড কোয়ার্টার ক্যাম্পে। সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রায় ষাট সদস্য। তাদের সাথে দিনে দিনে যোগ হতে থাকে গ্রামের অসংখ্য যুবক। রাতের অন্ধকারে গ্রামে গ্রামে চলতে থাকে প্রশিক্ষণ। কেউ সরাসরি, কেউ সহযোগিতায়।
পড়ন্ত বিকাল। আগস্ট মাসের শেষ দিকে রাতইল, ফলসি, ওড়াকান্দি গ্রামের খাল-বিলে পানিতে টইটুম্বুর। ছোট ছোট বাশের সাঁকো। একটু উঁচু জমিতে পানির ভেতর মাথা উঁচিয়ে সবুজ গাছপালা, ফসল জানান দেয় আমি আছি এখনো। শামীম সামান্য অবসর পেলেই সবুজের টানে বেরিয়ে পড়ে। অবশ্য ঘুরতে বেরিয়ে যে লাভ হয় না তা নয়। অনেক তথ্য জানা যায়। ঘরের ভেতর শত্রু থাকে। সে শত্রু বড় ধ্বংস ডেকে আনে অনেক সময়। মেঠোপথে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছু পথ পেরিয়ে এসেছে। অদূরে মধুমতী নদী। বড় বড় ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। একটা মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনজন পুরুষ শক্ত হাতে সামনে পেছনে, হাত-পা ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা তার সাধ্যানুযায়ী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। শামীম কাছাকাছি এগিয়ে যেতেই একজন লাল চোখে প্রশ্ন করে, কী চাই?
শামীম সেদিকে কর্ণপাত না করে বলে, বাহ মেয়েটা তো খুব সুন্দরী। এই বালিকা কী নাম তোমার?
মেয়েটা শামীমের মুখের ওপর থুথু ছিটিয়ে বলে, মরে যাব তবু তোদের কাছে হার মানব না জেনে রাখিস।
শামীম মুচকি হেসে বলে, সে আর পারবে না সুন্দরী। আমাদের একেকজন বস মানে একেকটা হাতি। মোষ-ছাগলও আছে। আপাতত ছাগলের পাল্লাতেই তোমার অবস্থা কাহিল, এরপর মোষ তারপর হাতি।
শামীমের কথা শুনে তিনজনের একজন খুশি বলে মনে হয়। বলে, ইঞ্জিনিয়ার কোরের ছাগীগির খান ওকে পছন্দ করেছেন। এইডাও তো হের কপাল।
শামীম চোখমুখ বড়সড় করে কৃত্রিম কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, হায় হায় বলেন কী! স্যারের অবশ্য চয়েস আছে বটে।
- মাইয়াডারে কেমনে বুঝাই কন?
- বোঝানোর দরকার কী! স্যারে বলছে, টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান ক্যাম্পে। কোন ক্যাম্প যেন?
- ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস স্টেশন ক্যাম্প।
- সে তো বহুদূর। আজকের রাত না হয় ছগলের জিম্মাদারিতে থাক। সন্ধ্যা নেমেছে।
এবার তিনজনের চোখ জ্বলজ্বল করে। আরেকজন বলে, আমাদের গোপন অস্থায়ী ক্যাম্প বেশি দূরে নয়।
- সেখানেই নিয়ে যান। তেজ কিছুটা কমিয়ে তারপর স্যারের কাছে পাঠালে ভালো হবে।
- তাইলে চলো, আপাতত তাপস বাবুর ফেলা বাড়ি নিয়ে যাই।
শামীম মিনতিপূর্ণ আবেদন জানায়, আমাকে কি সাথে নেয়া যাবে বস। বোঝেনই তো...
এতক্ষণ চুপ করে থাকা লোকটা সম্ভবত তিনজন গ্রুপের লিডার। খেঁকিয়ে ওঠে বলে, এই ব্যাটা তোমারে চিনি না, তার পরও আমরা না হয় মাইন্যা নিলাম বাকি দশ বারজন কি মানবে! যা ভাগ।
শামীম ভাগার অপেক্ষাতেই ছিল। দ্রুত ক্যাম্পে ফিরে কমান্ডারের নির্দেশে সাতজনের গ্রুপ নিয়ে তাপস বাবুর ফেলা বাড়ির দিকে ছোটে।
সাতজন ছিল। নেশায় মাতাল শয়তানগুলোকে মারতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। বেশ কিছু ভালো অস্ত্র পাওয়া যায়।
মেয়েটাকে উদ্ধারের পর শামীম সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ঠিকানা বলুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
মেয়েটা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে বলে, আপনি?
- হু, আমি। মুখে থুথু দেবেন?
- দুঃখিত। আমি বুঝতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করুন।
ফারহানা গ্রামের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আবদুল লতিফের একমাত্র কন্যা। রাতইল ক্যাম্প থেকে ওদের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। পরিচয়ের পর থেকে মাঝে মাঝেই শামীমের সাথে দেখা করতে আসে। নভেম্বরের শেষের দিকে ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস স্টেশনে ঘাঁটি গাড়া পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিফৌজ দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শামীমের নেতৃত্বে মধুমতী নদী তীরের পাক হানাদারদের স্পিডবোটগুলো গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। তারপর শুরু হয় তীব্র যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা বুক চেতিয়ে যুদ্ধ করে। সামনে পেছনে থেকে থেকে একেকটা আর্তনাদের সাথে লাশ হয় একেকজন বীর। চোখের সামনে মৃত্যু দেখেও তবু পিছু হটবার পাত্র নয় কেউ। শামীম বীরদর্পে যুদ্ধ চালায়। শত্রু সেনার হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে তারা পিছু হটতে শুরু করে। দাবড়িয়ে মারা যাকে বলে, সেই কাজটিই করছিল শামীম ও তার সহযোদ্ধারা। হঠাৎ করেই ডান হাত গুলিতে বিদ্ধ হয়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে। শামীম থামার পাত্র নয়। রক্ত দিয়েই তো আঁকতে হবে একটি মানচিত্র। গুলিবিদ্ধ হাত নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে কখন যে জ্ঞান হারায় টের পায় না। যখন চোখ মেলে তাকায়, দেখে সহযোদ্ধারা উদ্বিগ্ন চোখে তার দিকে ঝুঁকে আছে। ফারহানা, সেও আছে। তার চোখ দুটো ভারী। শামীম অবাক হয়ে দেখে সে ক্যাম্পে নেই। পরিচ্ছন্ন একটা কক্ষ। সুন্দর করে সাজানো, পরিপাটি। কাতর গলায় প্রশ্ন করে, আমি কোথায়?
ফারহানা এগিয়ে আসে, আমাদের বাড়িতে শামীম।
কমান্ডার মুখে হাসি নিয়ে বলে, দু’দিন চেতনা ছিল না বীর। দেশটা স্বাধীন হয়েছে।
শামীমের মুখে খুশির ঝিলিক। রক্ত বৃথা যায়নি তবে। কমান্ডার সাহেব আবার বলেন, তুমি ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম করো। আমরা আবার আসব।
-হু।
শীতের রাত। শামীম দরজা খুলে বের হয়। নির্জন রাতে একা একা ঘুটঘুটে অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুটো মুখ। রোজিনা, শামীমা। ছবির মতো বুকের ভেতর থেকে জানান দেয় তারাও আছে। ডুকরে কেঁদে ওঠে। বুকের ভেতর জমাট বাঁধা ব্যথা, রক্তে আঁকা স্বাধীন বাংলাদেশের গল্পটা আজ সে কার কাছে বলবে!
আলতো স্পর্শে পেছন ফিরে তাকায়। ফারহানা! চাঁদের আলোয় স্পষ্ট তার মায়াবী দুটো চোখ। তার চোখেও অশ্রু, তুমি কাদছ?
- হু।
দুই হাতে নিজের চোখ মুছে ফারহানা বলে, আজ যে আমাদের চরম খুশির দিন। কাঁদবে না। বিজয়ের দিনে কাঁদতে নেই। আমরাই তো সেই জাতি যারা বুকের তাজা রক্তে এঁকেছি দেশের মানচিত্র। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement
কুলাউড়ায় জঙ্গল থেকে তরুণীর লাশ উদ্ধার ঈদগাঁওতে মাদককারবারি গ্রেফতার শিক্ষায় ব্যাঘাত : ফেসবুক-টিকটক-ইনস্টাগ্রাম-স্ন্যাপচ্যাটের বিরুদ্ধে ২৯০ কোটি ডলারের মামলা আমতলীতে কিশোরীকে অপহরণ শেষে গণধর্ষণ, গ্রেফতার ৩ মহানবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে লালমোহনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ক্রিমিয়া সাগরে বিধ্বস্ত হলো রুশ সামরিক বিমান জর্ডান আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশী বিচারক এবারের আইপিএলে কমলা ও বেগুনি টুপির লড়াইয়ে কারা সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে গেছে : রিজভী রাশিয়ার ৯৯টি ক্ষেপণাস্ত্রের ৮৪টি ভূপাতিত করেছে ইউক্রেন আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর

সকল