২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

শ্রুতি ও স্মৃতির সোনালি শিখা

যেমন দেখেছি তাঁকে
-

ঊনচল্লিশ.

কবিজীবনের সেতু দাঁড়িয়ে থাকে তার লেখালেখির আনন্দের ওপর। লিখে যে উৎসব উদযাপন করেন তিনি, তাই তাকে জাগিয়ে রাখে জীবনের দিকে। তিনি জেগে থাকেন, জাগিয়ে রাখেন এবং রাখার স্বপ্ন বোনেন। লিখতে পারা, লিখে যাওয়াই কবিজীবনের সার্থকতা। যেখাবেই হোক তাকে লিখে যেতে হয়।
আল মাহমুদ ডিকটেশনের মাধ্যমে সেই অসাধ্য সাধন করার কাজটিই করছিলেন। তার আত্মজীবনী বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ শেষ হলো। পূর্ণতা পেল তার আত্মজীবনী। যেভাবে বেড়ে উঠি গন্থে যে পর্যন্ত জীবন কাহিনী তার পর থেকে বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ। এটি লেখা ও ধারাবাহিকে ছাপা শেষ হলো। বই হলো এটি। প্রকাশক একুশে প্রকাশনী। আরো পরে একই মলাটে হলো দু’টি বই। যেভাবে বেড়ে উঠি এবং বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ। দু’টি বইয়ের মিলিত নাম হলো কবির মুখ। প্রকাশ করেছে আদর্শ প্রকাশনী।
ধারাবাহিক আত্মজীবনী শেষ। পাঠকদের পক্ষ থেকে কেউ কেউ দাবি তুললেন আল মাহমুদের আরেকটি ধারাবাহিকের। পাঠক যেন ধারাবাহিক পড়ে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। শুক্রবার এলেই পত্রিকা খুলে আগেই সাহিত্য পাতা। সাহিত্য পাতায় ধারাবাহিক আত্মজীবনী। গোগ্রাসে গিলে এক টানে পৌঁছে যেতেন শেষ পর্যন্ত। এমন অনেক পাঠক ছিলেন, যারা শুধু এ লেখাটির জন্য নয়া দিগন্ত ক্রয় করতেন। সংগ্রহে রাখতেন। নানা দিক থেকে এ লেখার প্রতিক্রিয়া আসত জোয়ারের মতো। তরুণ থেকে বৃদ্ধ প্রায় সব শ্রেণীর পাঠক লেখাটি তুলে নিতেন বুকের কাছে। এক পর্ব পড়ে অপেক্ষা পরের পর্বের। এভাবে অপেক্ষার পর অপেক্ষা। অপেক্ষা শেষে আরো অপেক্ষা। এভাবে এক অপেক্ষা শেষ না হতে আরেক অপেক্ষার শুরু। এমন টান টান পাঠাকর্ষণের প্রেরণায় লিখে গেলেন তিনি। ফলে শেষ হওয়ার পর পাঠক ধারাবাহিকের ঘোর ভেঙে যাওয়ার কষ্ট অনুভব করলেন। অন্য কোনো ধারাবাহিকের ঘোরে তারা নিজেদের সেঁধিয়ে দিতে চাইলেন। বিষয়টি বললাম আল মাহমুদকে। শুনে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। যেন তিনি তার লেখার আনন্দের দিকটি নিজেই অনুভব করার চেষ্টা করছেন কিংবা কল্পনায় দেখছেন পাঠকের তৃষ্ণার অনুভূতি। আকস্মিক বললেনÑ তুমিই বলো কী লিখব আমি। জিজ্ঞাসাটি করে সাথে সাথে বললেনÑ একটি উপন্যাস লিখতে পারি। শুনেই আনন্দিত আমি। আমার মনের ভেতর এমন কথার বীজই লুকায়িত। উপন্যাস ছাড়া ধারাবাহিক আর কী-ই বা করা যায়! সাহিত্য বিষয়ক গদ্য টানা যায়। কিন্তু সব ধরনের পাঠক তাতে মন দেবে না। অনেকে দিলেও মন ভরবে না। এক শ্রেণীর পাঠক, যারা সাহিত্যবোধসম্পন্ন তাদের খোরাক হয়তো হবে। কিন্তু যারা কাহিনী পড়ার তীব্র আকাক্সক্ষা রাখেন, যারা কাহিনীর জীবনকে নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখতে চান তারা তো তৃষ্ণার্ত থেকেই যাবেন।
আনন্দের সাথে বললাম, বেশ ভালো প্রস্তাব মাহমুদ ভাই। আপনার পাঠকরা খুব খুশি হবে। গল্পই পড়তে চায় পাঠক, সে গল্প যদি দীর্ঘ কাহিনী হয়ে ওঠে; নিশ্চয়ই আনন্দিত হবে তারা।
কবে থেকে শুরু হবে মাহমুদ ভাই?
একটু দম নিয়ে বললেনÑ আজকের দিনটি ভাবতে দাও। উপন্যাসের একটি প্লট আমার মাথায় ঘুরছে ক’দিন ধরে। একটু চিন্তাটা গুছিয়ে নিই। কাল থেকেই লেখা শুরু করব। বেশ ভালো কথা। তাই হোকÑ বললাম আমি। তার পর যথারীতি আড্ডা। আড্ডা শেষে বিদায় নিচ্ছি। দরজায় দাঁড়িয়ে মাহমুদ ভাই। হাত মিলিয়ে যখন লিফটের দিকে ঘুরব তখনই বললেনÑ উপন্যাসটির নাম হবে ‘মোহনীর জীবন ঝঙ্কার’। শুনেই ভালো লাগল খুব। বললামÑ চমৎকার নাম মাহমুদ ভাই। তা হলে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র একজন নারী।
বললেনÑ নারী। তবে সংগ্রামী। জীবনের সাথে, সমাজের সাথে কিভাবে লড়াই করে বাঁচতে হয়। বেঁচে থাকতে হয় তারই আখ্যান থাকবে উপন্যাসটিতে। আশা করি, তোমার ভালো লাগবে। ভালো লাগবে পাঠকদেরও। লিফটে নামতে নামতে এবং নেমে কিছু দূর হাঁটতে হাঁটতে কানের কাছে বাজছিল নামটিÑ মোহিনীর জীবন ঝঙ্কার।
শুরু হলো আল মাহমুদের নতুন ধারাবাহিক মোহিনীর জীবন ঝঙ্কার। প্রতি সপ্তাহে পাঠকদের আবার অপেক্ষার পালা। আবার পিপাসাক্রান্ত পাঠককুলের দৃষ্টি সাহিত্য পাতায়। প্রতি শুক্রবার পাঠকের হাতে মোহনীর জীবন ঝঙ্কার।
নানাবিধ ব্যস্ততা এবং কাজের ঝামেলায় আমি আর ডিকটেশন নিতে সমর্থ হচ্ছিলাম না। পারছিলাম না নিয়ম করে গুলশানের বাসায় পৌঁছতে। বিষয়টি খানিকটা চিন্তায় ফেলল আমাকে। লেখা তো চালিয়ে নিতেই হবে। পত্রিকার যেমন প্রয়োজন। তেমনি আল মাহমুদকে জাগিয়ে রাখা, সজীব ও সচল রাখার বিষয়। লেখালেখি না হলে সহসা অসুস্থতা ঘিরে ধরবে তাকে। সুতরাং বিকল্প ব্যবস্থা করতেই হবে। বিকল্প তো একটিই, আমি না পারলে কাউকে পাঠানো।
কাউকে পাঠানো সমস্যা নয়। কারণ একঝাঁক তরুণ লেখিয়ের আমার সাথে নিত্যযোগাযোগ। তাদের যে কাউকে বললেই খুশিতে ডগমগ হয়ে ছুটবে আল মাহমুদের দিকে। কিন্তু মাহমুদ ভাই এটাকে কিভাবে নেবেন, এটিই আমার চিন্তা।
একদিন লেখা শেষ করে চা খাচ্ছি। খেতে খেতে এ কথা সে কথা নানা কথার খই। এক ফাঁকে বিষয়টি তুললাম। আমার সমস্যার কথাটি বললাম। জিজ্ঞেস করলাম অন্য কাউকে ডিকটেশন দিতে সমস্যা আছে কি না। চুপ হয়ে গেলেন তিনি। খানিকটা উদাস চোখে জানালার দিকে চাইলেন।
হাতে ধরা চার কাপটি রাখলেন টেবিলে। খানিকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আমার মনে হলো, বুকে জমে ওঠা দুঃখগুলো শ্বাসের সাথে বের করে দিলেন। ধীরে বললেনÑ না, অন্য কারো সাথে লিখতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। হয়তো এমন করে আড্ডা হবে না। না হোক। লেখা তো হবে। কিন্তু তুমি মাঝে মধ্যে আমাকে দেখতে এসো ভাই। এমন দরদমাখা কণ্ঠে কথাটি বললেন; আমি আবেগতাড়িত হয়ে গেলাম। বললামÑ মাহমুদ ভাই, পারলে নিত্য আসতাম আমি। তবু সপ্তাহে একাধিক দিন দেখা হবে আমাদের। যেন আশ্বস্ত হলেন তিনি। বললেনÑ তুমি এলে ভালো লাগবে আমার।
শাহজালাল নামে এক তরুণ কবিকে পাঠালাম ডিকটেশন নিতে। পাঠালাম নানা রকম বিষয়-আশয় বুঝিয়ে-সুঝিয়ে। যেন এমন কোনো আচরণ না করে, যার জন্য আল মাহমুদ লেখার বিষয়ে বেঁকে বসেন। বেশ কিছুটা জড়তা নিয়েই তরুণটি উপস্থিত হলো আল মাহমুদের সামনে। লিখল। এভাবে এক দিন, দুই দিন, তিন দিন। এরপর বেশ ফুরফুরে ভঙ্গিতে যাওয়া-আসা শুরু শাহজালালের। ভীষণ মুগ্ধ আল মাহমুদের প্রতি। মাহমুদ ভাই তাকে সহজ করে নিয়েছিলেন। ফলে তার মনে যে একজন বড় কবির উচ্চতার দুর্লঙ্ঘ পর্বত ছিল, সেটি সহসা সমতল হয়ে উঠল। অবশ্য বেশি দিন ডিকটেশন নিতে পারেনি ও। চাকরি হয়ে গেলে তাকে চলে যেতে হয় অন্যত্র।
এরপর পাঠাই রাফিক হারিরি নামক আরেক তরুণ লেখিয়েকে। রাফিক হারিরি মূলত কথাকার। গল্পের হাত চমৎকার। অনুবাদেও বেশ দক্ষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি সাহিত্যে লেখাপড়া। আরব জাহানের সাহিত্য সম্বন্ধে তার ছিল সম্যক ধারণা। আল মাহমুদের কাছে খুব সহজে নিজেকে পরিচিত করে তুলল ও এক রকম বন্ধুত্বের সম্পর্ক হলো হারিরির সাথে। আরবি সাহিত্যের বিভিন্ন দিক বিনিময় করেছেন মাহমুদ ভাইয়ের সাথে। এভাবে হারিরি আল মাহমুদের প্রিয় তরুণদের একজন হয়ে উঠল। বর্তমান সময়ে রাফিক হারিরি আমাদের দেশে অনুবাদ সাহিত্যে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে।
কিছু দিন লিখে হারিরিও চাকরি নিয়ে চলে গেল। এরপর এনামুল খান নামে একজন তরুণ কবি। তাকে পাঠালাম ডিকটেশন নিতে। এনামুল খুব মেধাবী মুখ। ব্যবহার বেশ অমায়িক। সদা হাসিখুশি এক প্রাণবন্ত তরুণ। আল মাহমুদকে পেয়ে আরো বেড়ে গেল তার হাসির মাত্রা। ভীষণ মুগ্ধতা আল মাহমুদকে ঘিরে। এক সময় বিসিএস নিশ্চিত করে চাকরিতে ঢুকে গেল সে। এখন বেশ ভালো একটি জায়গায় তার অবস্থান।
এরপর এলো আবিদ আজম। খুব কম বয়স। চোখে মুখে নানা জিজ্ঞাসার উত্তাপ। এ প্রশ্ন সে প্রশ্ন। জানার আগ্রহ বেশ। ডান বাম মধ্যপন্থী নিয়ে প্রশ্ন ছিলো অবিরল। আবিদকে পাঠালাম আল মাহমুদের কাছে। ফোনে বললামÑ মাহমুদ ভাই এনামুলও চলে গেছে চাকরিতে। এবার আবিদ আজম নামে এক তরুণ ছড়াকার পাঠাচ্ছি। আশা করি, ডিকটেশন নিতে পারবে বেশ কিছু দিন। মাহমুদ ভাই ফোনে বেশ হাসলেন। হেসেই বললেনÑ আমার কাছে যাকে পাঠাও তারই চাকরি হয়ে যায়! আমি কি তবে তরুণ কবিদের চাকরির সৌভাগ্য! এমন কথায় আমিও হাসলাম খুব। বললামÑ তাই তো দেখছি মাহমুদ ভাই। তাহলে তো এমন একজনকে পাঠানো দরকার যে বহুদিন চাকরি খুঁজে ক্লান্ত, অথচ হচ্ছে না। তবে তার আগে যাক আবিদ আজম। আবারো হাসলেন মাহমুদ ভাই। আমিও হেসে রাখলাম ফোন। তারপর শুরু হলো আবিদ আজমের যাত্রা। আল মাহমুদের কাছে পৌঁছাল সে। ডিকটেশন নিতে নিতে আল মাহমুদের হৃদয়ে জায়গা করে নিলো আবিদ।
মাহমুদ ভাইও ওকে নিজের ছেলের মতোই আদর-স্নেহ করেছেন। ধীরে ধীরে আবিদ আল মাহমুদের আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। কিছুটা বন্ধুত্ব, কিছুটা সন্তানতুল্য স্নেহের সম্পর্ক মিলিয়ে আবিদ হয়ে ওঠে আল মাহমুদের কাছের মানুষ। কারণে-অকারণে আল মাহমুদের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করল আবিদ। থাকল এবং সেই থেকে আল মাহমুদের মৃত্যু পর্যন্ত। এর মধ্যে অনেকেই এলো। গেল। কিন্তু আবিদ দাঁড়িয়ে থাকল মাহমুদ ভাইয়ের পাশে। কোনো কোনো অনুষ্ঠানে আনা-নেয়া, অসুস্থতায় খবরাখবর দেয়া-নেয়া এবং জন্মদিনের সংবাদ মিডিয়ায় পৌঁছানোর কাজগুলো আবিদ করেছে। মৃত্যুর সংবাদটিও তার মাধ্যমেই পৌঁছেছে অনেক জায়গায়। সর্বশেষ হাসপাতালে থাকা অবস্থায় প্রায় প্রতিদিনই উপস্থিত হওয়ার চেষ্টা করেছে ও। মৃত্যুর পর শহীদ মিনার, বাংলা একাডেমি ও প্রেস ক্লাবে লাশ নেয়া-না নেয়া, জানাজার নামাজ এবং কবরস্থ করার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। আবিদ একজন মিডিয়া কর্মী। ছড়াকার। তরুণদের মধ্যে বিচরণশীল মুখ। একটি সার্বজনীন অঙ্গীকার আছে ওর ভেতর। আল মাহমুদের প্রতি তার ভালোবাসা গভীর ও শ্রদ্ধাপূর্ণ। আল মাহমুদকে নানাভাবে ধারণ করার চেষ্টা করে ও।
দীর্ঘ সময় আবিদ আজম ডিকটেশন নিলো। লেখাপড়ার ব্যস্ততা এবং মিডিয়ায় চাকরি হয়ে গেলে ডিকটেশনের কাজে সময় হচ্ছিল না আর। ফের বদল হলো মুখ। এবার পাঠালাম সাইফ মাহদীকে। তরুণ ছড়াকার, কবি। ভীষণ প্রাণবন্ত এক তরুণ। মুখে উজ্জ্বল হাসি টেনে মুখোমুখি হয় মানুষের। মনখোলা এ তরুণটিও আল মাহমুদের বেশ প্রিয় হয়ে উঠল। যেমন চমৎকার হাসি, তেমনি হাতের লেখা ছিল সুন্দর। অনেক লেখার ডিকটেশন নিয়েছে সে। মাহদী বেশ পরিশ্রমী, আন্তরিক ও কর্মঠ। খুব সহজে মানুষের আপন হয়ে ওঠার গুণ আছে ওর এবং সব কিছু সহজে গ্রহণ করার প্রবণতা ওকে প্রিয় করে তোলে সবার কাছে।
এসব লেখা শুধু সাহিত্য পাতার জন্য ছিল না। নয়া দিগন্তের উপসম্পাদকীয় পাতায় প্রতি সপ্তাহে ছাপা হতো একটি কলাম। হতো ‘দশ দিগন্তে উড়াল’ নামে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশেষ দিবসে বিশেষ সংখ্যার লেখা ছিল। নতুন বছর, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, ঈদ সংখ্যা ও ঈদ ম্যাগাজিন। একই সাথে আমাদের মাসিক ম্যাগাজিন অন্য দিগন্ত। এসব দিনে বিশেষ সংখ্যায় লেখার তাড়ায় লিখেছেন আল মাহমুদ। প্রতিটি ঈদ ম্যাগাজিনে উপন্যাস লিখেছেন তিনি। সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক উপন্যাস এবং লেখা ডিকটেশন নিয়েছে যে ক’জন সাইফ মাহদী তাদের অন্যতম। বর্তমানে টেক ডেকোর নামে একটি আইটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানও। [চলবে]


আরো সংবাদ



premium cement