২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

নারীবাদী নন, নারীমুক্তির পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া

-

‘মুসলমান বালিকাদের প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে কোরান শিক্ষাদান করা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন। আপনারা কেহ মনে করিবেন না যে, প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কোরান শিক্ষা দিতে বলিয়া আমি গোঁড়ামীর পরিচয় দিলাম। তাহা নহে, আমি গোঁড়ামী হইতে বহু দূরে। প্রকৃত কথা এই যে, প্রাথমিক শিক্ষা বলিতে যাহা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয়, সে সমস্ত ব্যবস্থাই কোরানে পাওয়া যায়।’Ñবেগম রোকেয়া।
যে যুগে কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে বাঙালি মুসলমানরা মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করত, সেই অন্ধকার যুগে বেগম রোকেয়া পর্দার অন্তরালে থেকেই নারীশিক্ষা বিস্তারে প্রয়াসী হন এবং মুসলমান মেয়েদের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের পথ সুগম করেন। উনিশ শতকের শেষদিকে সময়টা ছিল যুগপৎ হিন্দু ও মুসলমান নারীদের জন্য অন্ধকার যুগ। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়েদের কঠোর পর্দা মেনে চলতে হতো। বিনা প্রয়োজনে মেয়েদের বাড়ির বাইরে যাওয়া ছিল নিষিদ্ধ। তাদের লেখাপড়া করার তেমন সুযোগ ছিল না, কেবল ঘরের কাজকর্ম শেখানো হতো। তারা নিজ গৃহে বা স্থানীয় মক্তবে আরবি, ফারসি শিখত। হিন্দু নারীরাও ছিল শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত।
ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের শৃঙ্খলা থেকে নারীকে মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেছেন যে কয়েকজন নারী, তাদের মাঝে প্রথম সারির একজন হলেন নারী জাগরণের পথিকৃৎ মহীয়সী বেগম রোকেয়া। বহুমাত্রিকতায় অনন্য বেগম রোকেয়া একাধারে দার্শনিক, লেখক, সমাজসংস্কারক, নারীশিক্ষায় পথিকৃৎ, নারীমুক্তি আন্দোলনের পথপ্রদর্শক। বিশ শতকের একেবারে প্রথম দিকে আবির্ভূত বহুমুখী রোকেয়া সারা জীবন নারীমুক্তি ও অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করেছেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সেবক বেগম রোকেয়া আজীবন কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন কিন্তু প্রগতিশীলতা ও আধুনিকতার নামে ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধের আদর্শ ও ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেননি।
বাঙালি মুসলিম সমাজে রোকেয়াই সর্বপ্রথম শিক্ষা বিস্তারকে নারীমুক্তি ও প্রগতির বৃহত্তর অভিযাত্রার সাথে যুক্ত করেন। তার সমাজভাবনা মূলত নারীমুক্তি ভাবনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। বাঙালি মুসলিম সমাজে নারীর প্রতি যে নিষ্ঠুরতা ও অবিচার তারই বিরুদ্ধে ছিল রোকেয়ার আপসহীন সংগ্রাম। আর এ সামাজিক উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে তিনি শিক্ষাকেই প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘শিক্ষাবিস্তারই এই সব অত্যাচার নিবারণের একমাত্র মহৌষধ।’ শিক্ষা বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন, যা নারীদের মধ্যে তাদের আপন অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বোধ জাগাবে।
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। তখন চলছিল নারী শিক্ষা, নারী অধিকারের প্রতিকূলের সময়। আর ১০ জন মুসলমান মেয়ের মতো বেগম রোকেয়াও মুসলিম পারিবারিক নিয়মে বেড়ে উঠছিলেন। পিতা জহীরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। ছয় ভাইবোনের মাঝে রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা, আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায়।
রোকেয়ার পূর্বপুরুষগণ মুঘল আমলে উচ্চ সামরিক এবং বিচার বিভাগীয় পদে নিয়োজিত ছিলেন। তৎকালীন মুসলিম সমাজব্যবস্থা অনুসারে রোকেয়া ও তার বোনদের বাইরে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়নি, তাদের ঘরে আরবি ও উর্দু শেখানো হয়। বেগম রোকেয়ার পরিবারে পর্দা প্রথার এতই কড়াকড়ি ছিল যে, আত্মীয় পুরুষ তো দূরের কথা বহিরাগত মহিলাদের সামনেও পরিবারের মেয়েদের পর্দা করতে হতো।
একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে পারেননি রোকেয়া। বিভিন্ন বিষয়ে জানার জন্য বেগম রোকেয়ার আগ্রহ ছিল প্রবল। পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সাথে কলকাতায় বসবাস করার সময় একজন মেম শিক্ষয়িত্রীর কাছে তিনি কিছু দিন লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সমাজ ও আত্মীয়স্বজনদের ভ্রƒকুটির জন্য তাও বন্ধ করে দিতে হয়। তবু রোকেয়া দমে যাননি। বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের ও বড় বোন করিমুননেসার হাতে শৈশবকালে বেগম রোকেয়ার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের আধুনিক মনস্ক ছিলেন। বেগম রোকেয়াকে লেখাপড়ায় উৎসাহ, প্রেরণা ও সহযোগিতা করেন। লেখাপড়ায় তার আগ্রহ দেখে বড় বোন করিমুননেসা এবং বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের সহযোগিতায় তিনি বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকেন।
১৮৯৮ সালে ১৮ বছর বয়সে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় বিহার রাজ্যের ভাগলপুরের অধিবাসী বিপতœীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে। রোকেয়ার প্রকৃত নাম ‘রোকেয়া খাতুন’ এবং বৈবাহিক সূত্রে নাম ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’। সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি ছিলেন সমাজ সচেতন, প্রগতিশীল ও সংস্কারমুক্ত মানুষ। তার সাহচর্যে এসেই রোকেয়ার লেখাপড়ার উন্মেষ ঘটে। স্বামীর কাছ থেকে তিনি ইংরেজি ও উর্দু শিক্ষা লাভ করেন। সমাজ মনস্ক রোকেয়ার স্বামী সবসময় নারীশিক্ষার কথা বলতেন। নারীদের শিক্ষার উন্নতির জন্য তিনি স্ত্রীকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন এবং স্ত্রী রোকেয়াকে তার সম্পত্তির ট্রাস্টি করে যান। ১৯০২ সালে পিপাসা নামে একটি বাংলা গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্য জগতে পদার্পণ করেন।
বেগম রোকেয়ার দাম্পত্য জীবন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, ৩ মে ১৯০৯ সাখাওয়াত হোসেন ইন্তেকাল করেন। স্বামীর মৃত্যু তার জীবনে সাময়িক বিপর্যয় ঘটালেও অকালবৈধব্য তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। এর আগে তাদের দু’টি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে অকালেই মারা যায়। অসীম মনোবল সম্পন্ন এই নারী শোককে শক্তিতে পরিণত করে নারীশিক্ষার বিস্তার ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তার স্বামীর ভাগলপুরে একটি মুসলিম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা ছিল। ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরের তদানীন্তন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ শাহ আবদুল মালেকের সরকারি বাসভবন ‘গোলকুঠি’তে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’-এর যাত্রা শুরু। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধসহ আরো নানা প্রতিকূলতার কারণে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর স্কুলটি কলকাতায় স্থানান্তর করা হয়। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে ১৩ নম্বর ওয়ালীউল্লাহ লেনের ভাড়াবাড়িতে নতুন করে চালু করেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’।
সমাজসেবার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে নারীদের অধিকার নিয়ে মত তৈরির চেষ্টা করেছেন। মিসেস আর এস হোসেন নামে সেকালের বিখ্যাত পত্রপত্রিকায় তিনি অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস ও নারীদের জন্য সমাজ সচেতনতামূলক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। বেগম রোকেয়া প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাসের মধ্য দিয়ে নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গ সমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা ঝঁষঃধহধ'ং উৎবধস। যার অনূদিত রূপের নাম সুলতানার স্বপ্ন। এটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক ধরা হয়। তার অন্যান্য গ্রন্থগুলো হল : পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর, নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী ইত্যাদি পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়। তার প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন। তার রচনা দিয়ে তিনি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন, শিক্ষা আর পছন্দানুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারী মুক্তি আসবে না... তা বলেছেন। হ


আরো সংবাদ



premium cement