২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আব্বু

-

শেষবারের মতো আব্বু যখন দেশে ফিরছিলেন, তাকে রিসিভ করতে বিমানবন্দরে যাই। আমরা তিন ভাইবোন বাহির পথে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করছিলাম আব্বুর জন্য। তার জন্য আমাদের এ প্রতীক্ষা শেষ প্রতীক্ষা। আব্বু তার প্রবাস জীবনের লম্বা একটা অধ্যায় পরিসমাপ্তি করে একেবারে দেশে ফিরছেন। আমাদের চোখেমুখে তখন শৈশবের আকুলতা। একে একে মানুষ যখন বেরিয়ে আসছেন আমরা মনে করি এই বুঝি আব্বু বেরোচ্ছেন। পরে দেখি না, সে অন্য কেউ। আব্বু বের হচ্ছেন না। আম্মু বলতেন, তোদের আব্বু দুনিয়ার বোকা। সব সময় পিছে থাকে। দেখবে সবার শেষে সে বের হবে। প্রতিবার আম্মু আমাদের নিয়ে এলেও আজ তিনি আসেননি। আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন।
আব্বু বিদেশ থাকার সুবাধে এই বিমানবন্দরের সাথে সেই শুরুবেলা থেকে পরিচিত। আম্মুর সাথে এসে গাড়ি থেকে নেমে শুরু হতো আমাদের দৌড়াদৌড়ি। বিমানবন্দরে এই জায়গাকে মনে করতাম আমাদের বাড়ির উঠোন। আম্মু শিমুকে কোলে নিয়ে আমাদের সামলাতে হিমশিম খেতেন। বলতেন, না, তোদের নিয়ে আর পারি না। আর কোনো দিনও তোদের সাথে নিয়ে আসব না। বিমান ল্যান্ড করার পর আম্মু আমাদের আগলে রেখে বাহির পথে দাঁড়াতেন আব্বুর প্রতীক্ষায়। আব্বু বের হয়ে আবেগ উত্তেজিত সোচ্ছ্বাসে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরতেন। কোলে নিয়ে চুমুর পর চুমু খেতেন।
সেই কত বছর আগে আব্বুর বিদেশ যাওয়া। আমাদের জন্মেরও আগে। তারপর কেমনে কেমনে এতটা বছর পার হয়ে গেল। তাকে এমন করে একটা জীবন স্ত্রী-সন্তান থেকে দূরে প্রবাসে পার করে দিতে হবে তা হয়তো আব্বুও ভাবেননি। কিন্তু সময়ে সময়ে প্রয়োজন আরো প্রকট হয়ে উঠল। ছেলেমেয়ে জন্ম নেয়ায় এবং বড় হওয়ায় তার দায় আরো বেড়ে গেল। সেই দায়ে তাকে বিদেশ খাটতেই হয়। আব্বু ছিলেন পরিবারের একমাত্র গাড়ি। যে গাড়ি থেমে গেলে থেমে যায় সংসারের চাকা। হানা দেয় অভাব আর হাহাকার। অভাব আর প্রয়োজনের সাথে একাই লড়াই চালিয়ে যেতে হয় আব্বুকে।
দু-তিন বছর পরপর তিনি দেশে আসতেন। আসার পর বাড়িঘরের কাজ, আত্মীয়স্বজনদের খোঁজ, আমাদের নিয়ে ঘোরাঘুরিÑ এসব করতে করতে চোখের পলকে দুই মাস পার হয়ে যেত। তাকে আবার ছুটতে হতো টিকিটের জন্য। আব্বু যাওয়ার সময় আম্মু কাতর হয়ে পড়তেন। বলতেন, আর দু’টা দিন থাকলে হতো না? আব্বু বলতেন, সেটা তো চাই কিন্তু সুযোগটা যে নেই। পরের কাজ করি বুঝো তো...। আব্বুর বুক থেকে নিরুপায় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসত। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে তাদের মানুষ করতে হবে। একটা জায়গায় নিয়ে দাঁড় করাতে হবে। আব্বুর মাথায় কত চিন্তা। যাওয়ার কালে আব্বুর চোখ অশ্রুতে ভরে উঠত। আর আম্মু আমাদের লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল মুছতেন। তার পর আমাদের নিয়ে ব্যস্ত থেকে স্বামীর দূরত্ব আর একাকিত্ব ঘোচাতেন।
আব্বু বিদেশ ছিলেন আমাদের কী ভরসা! আমাদের জন্য জামা কাপড় খেলনা থেকে নিয়ে তেল, সাবান, ক্রিম কত কিছু পাঠাতেন। আব্বুর দেয়া জামা গায়ে দিয়ে আমরা গ্রামের পথে ঈদের আনন্দে ছুটতাম। আব্বু আমাদের কাছে টাকার গাছ। আমরা শুধু সে গাছটাকে ধরে নাড়াতাম। টাকা কিভাবে আসে সে ভাবনা আমাদের ছিল না। কিন্তু টাকা আমরা চাই। আব্বু বিদেশ থাকেন বলে আমাদের রমজান আছে, ঈদ আছে, কোরবানি আছে। আব্বু বিদেশ আছেন বলে আমাদের পয়লা বৈশাখ আছে, মেলায় ঘোরার আনন্দ আছে। আমরা ভালো জামা গায়ে বেরোতে পারি। বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারি। আমরা যে ভালো স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করছি, শহরে ঠাঁই নিয়ে মাসে মাসে বেতন, টিউশন ফি, হোস্টেল ফিসহ যত খরচ সবইতো আব্বু বিদেশ আছেন বলেই। চাইলেই পাই, না চাইলেই পাই। কিভাবে দেবেন সে ভাবনা আব্বুর। মাস শেষে যেভাবে হোক তাকে দিতেই হয়। কেননা তিনিতো আব্বু!
দু-তিন বছর পরপর দেশে ফিরলে আব্বুর সাথে বিমানবন্দরেই আমাদের পয়লা সাক্ষাৎ হতো। এই বিমানবন্দরে নেমে আব্বু আমাদের কখনো পেয়েছেন কোলের শিশু। কখনো হাঁটতে দৌড়াতে পারা শিশু, কখনো সদ্য পা রাখা কৈশোরে, কৈশোর থেকে তারুণ্যে এভাবে। আর আজ আমরা প্রাপ্ত বয়সের পরিণত। তাই হয়তো আব্বু আমাদের আগের মতো কোলে নিয়ে আদর করতে পারেননি। সেই জোরটাও আর আব্বুর মাঝে নেই। আমাদের বুকে টেনে নিলেন। শিমুকে জড়িয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। শিমু তার একমাত্র মেয়ে। তাও সবার ছোট। মেয়ের প্রতি বাবার সহজাত স্নেহ বেশিই হয়ে থাকে। অথচ আব্বু তার এই মেয়েটাকে খুব একটা কোলেও নিতে পারেননি। দু’মাসের জন্য এসে আবার প্রবাসে চলে যেতে হয়েছে তাকে। এত আদরের মেয়েটাকে সময় দিতে পারলেন না মোটেও। চোখের আড়ালে নিজের দূরত্বে সে বড় হয়ে গেল। বাড়িতে একেবারেই যখন আসছেন তাকে কাছে ধরে রাখতে পারছেন না। মেয়েটা চলে যাচ্ছে অন্যের ঘরে।
আব্বু আরো আগে দেশে ফেরার কথা থাকলেও শিমুর বিয়ের জন্য কিছুটা পিছিয়েছেন। বাড়িতে প্রথম বিয়ে তাও একমাত্র মেয়ের। আব্বু সাধ্যের মধ্যে কোনো কমতি রাখতে চান না। একটা বিয়ের আয়োজনে টাকা পয়সার ব্যাপার-স্যাপার আছে। তিনি আব্বু, তাকে সব কিছু বিন্যস্ত করে আসতে হয়। আব্বু প্রাণবন্ত হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করলেও ক’দিনে আমার বুঝতে পারি আব্বু আর আগের মতো নেই। এই আব্বু আর সেই আব্বুর মাঝে কত তফাৎ যেন। হঠাৎ করে যেন আব্বুর বয়সটা বেড়ে গেল। শরীরটাও ভেঙে গেছে। মাথার তালুতে দৃশ্যমান হয়েছে টাক। চুল পেকে গেছে অনেকটা। চোখে মুখে ক্লান্ত শ্রান্ত ছাপ। অথচ আব্বু এমন ছিলেন না। আব্বু ছিলেন কত ইয়ং, কত স্মার্ট আর সুদর্শন। অন্য কারো সাথে আমাদের আব্বুর তুলনা হয় না। আমাদের আব্বু ছিলেন আব্বুর মতোই সুন্দর সুদর্শন এক প্রাণবন্ত পুরুষ। সে জৌলুস আজ যেন নেই। মানুষটা তার জীবনের পুরো কলস ঢেলে দিয়েছেন শুধু আমাদের সুখ শান্তির গোড়ায়। তেমনি আম্মুও। দু’জন মানুষই ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ ভেবে নিজেদের নিঃশেষ করেছেন তিলে তিলে। এখন স্বামী-স্ত্রী একত্রিত হলেও তাদের নেই সেই সময়, সেই আবেগ আর উচ্ছ্বাস।
একদিন আম্মু বললেন, তোদের আব্বুর কী হাল হয়েছে দেখছিস না। খাওয়া দাওয়া তো করতেই পারে না। রোগে একেবারে খেয়ে ফেলছে কিছু বলছেন না। মাঝে মাঝে কোথা থেকে কী সব বনাজি ওষুধ এনে খাচ্ছে বুঝি না। সারা জীবনটা এমন করে গেল, নিজের প্রতি কোনো খেয়াল নেই। তাকে ভালো একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার।
সেদিন আম্মু সাথে যাওয়ার কথা থাকলেও সকালে একদল মেহমান এসে বাড়িতে হাজির। শেষে আব্বুর সাথে আমাকেই পাঠিয়ে দিলেন ভালো ডাক্তার দেখাতে।
তখন বিকেলের নরম রোদ এসে আব্বুর পিঠে পড়ছিল। উঠোন পেরিয়ে জমিনের রাজ আইলের ওপর আব্বু চুপচাপ বসে আছেন। আমি আব্বুর দিকে চেয়ে চেয়ে চুপি চুপি গিয়ে তার পাশে দাঁড়াই। আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেন, বসো বাবা। তার পর আব্বুর সাথে অনেকক্ষণ গল্প হয়। তিনি আমার লেখাপড়ার খোঁজ নিলেন। ভাইয়ার কথাও জিজ্ঞেস করলেন। ভাইয়া রিটেনে টিকেছে, ভাইভাতেও টিকবে বলে আশাবাদী। আব্বু বললেন, এত চিন্তা করার দরকার নেই। পৌরসভায় নিজেদের ঘর আছে। কিছু না হলে একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দিতে পারলে চলতে পারবে। তারপর আব্বু উঠলেন। পাশের খালি জায়গাটুকু দেখিয়ে বলেন, জায়গাটুকু একটু ভরাট করে একটা ঘর তুলে রাখতে চেয়েছিলাম, সেটা আর হলো না। আমি বললাম, বাদ দেন তো আব্বু, যা করেছেন অনেক। কী হবে এত কিছু দিয়ে?
আব্বু আমার মুখের দিকে চেয়ে হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তার কী জানাল?
তেমন কিছু না। নরমাল সব। বলছে বিশ্রাম নিতে, নিয়মিত খাওয়া দাওয়া আর ওষুধ ঠিকমতো খেতে।
আব্বু হাসেন। তোদের কইলাম না; আমার কিছুই হয়নি। অযথা চিন্তা করিস। তোদের মাকে একটু বুঝাইছ।
আমি সেদিন ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখিয়ে বাড়িতে আনার সাহস পাইনি। দুমড়ে-মুচড়ে নদীতে ফেলে দেই! আব্বুর দিকে তাকাই আর মনে মনে বলি, আব্বু এমন জোর তুমি কোথায় পাও নাকি শুধু অভিনয় করো। কোথা থেকে শিখলে এমন অভিনয়? মন চায় আব্বুর বুকে মুখগুঁজে কাঁদি আর বলি, আব্বুÑ কে কাকে ধোঁকা দিচ্ছেরে আব্বু...?
শিমুর বিয়ের দিনও সন্নিকটে। খুব ব্যস্ততায় দিন যাচ্ছে আমাদের। আব্বুকে দৌড়ঝাঁপে না জড়িয়ে বলছি বিশ্রামে থাকতে। তার কাছে পরামর্শ করি। কিছু করলে তাকে জানাই। আব্বু মানেন না। মাঝেমধ্যে নিজেই কাজে জড়িয়ে যান। বিয়ের অনুষ্ঠান কমিউনিটি সেন্টারে করতে চাইলেও আব্বু রাজি হলেন না। তার মতে, কমিউনিটি সেন্টারে টাকা খরচে গ্রামের অনেক গরিব স্বজনরা যেতে পারবেন না। বাড়ির উঠোনে শামিয়ানা টানিয়েই আয়োজন হবে।
আম্মুকে ঘরের সব কিছু দেখভাল করতে হয়। সবার দিকে নজর দিতে হয়। বিয়ের দিন ঘনাতে বাড়িতে মেহমান বাড়ছে। বাড়িতে মেহমান যত বাড়ছে আম্মুরও ব্যস্ততা তত। চুলা তাকেই সামলাতে হয়। সারা দিন তার নিস্তার নেই। সেদিন সন্ধ্যার পর ফুফা ও মামা এসেছেন। আব্বু তাদের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ করেন। রাতে আমাদের ডেকে সব কিছুর খোঁজখবর নেন। দাওয়াত কিভাবে পৌঁছাচ্ছি, সবাইকে দিয়েছি কি না খবর নেন। বারবার তাগিদ দেন নিজের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব কেউ যাতে বাদ না পড়ে। কেনাকাটা কিছু বাদ পড়েছে কিনা জিজ্ঞেস করেন। আব্বুকে নিয়ে কাপড়ের দোকানে গিয়েছিলাম। সবার জন্য কিনলেও নিজের জন্য কিছু নিচ্ছেন না। আম্মু চাপা ক্ষোভে বলেন, সারা জীবনটা তোমার এমন করে গেল। আসলে আব্বু এমনই। বিদেশ থেকে যখন আসতেন, লাগেজ ভরে আনতেন আর বিলাতেন। যাওয়ার সময় ব্যবহৃত শার্ট গায়ে বিদেশের পথ ধরতেন। এ নিয়ে আম্মু কম রাগারাগি করতেন না। আব্বু বলতেন, একটা হলেই হলো, চলছে তো। ভাইয়া পিস কাপড় কিনে গায়ের জরিপে দর্জির কাছ থেকে পাঞ্জাবি নিয়ে এসেছে। আব্বুকে পরতে বললে বলেন, রেখে দাও, এখন রাত। কাল জুম্মাতে নিয়ে যাবো নে। আব্বু ভাঁজ না খুলে নেড়েচেড়ে দেখে রেখে দিলেন। আমাদের সাথে অনেকক্ষণ খোশগল্প করেন। শিমুর মন খারাপ। তাকে বললেন, তোকে কি একেবারে দিয়ে দিচ্ছি, আমি তোকে প্রতিদিন একবার দেখতে যাবো, বলে দিলাম। আম্মু বললেন, তোর আব্বু তোর বাড়িতে একেবারে চলে যাবেরে শিমু। শিমুসহ আমরা সবাই হেসে উঠলাম। আব্বুও হাসলেন। রাত বাড়তে আমরা দেরি না করে আব্বুকে ঘুমানোর তাগিদ দিয়ে আম্মুসহ সবাই চলে আসি। কেননা ডাক্তারের পরামর্শ মতে আব্বুর বিশ্রামের দরকার। তার জন্য বেশি রাত জাগা ঠিক নয়।
রাতে আব্বু ঘুমালেন। এমন ঘুম ঘুমালেন ভোরে উঠে তাকে জাগানোর সাধ্য নেই! এত ডাকাডাকি তবুও আব্বু ওঠেন না। অথচ আমাদের আব্বু ঘুমভোলা আব্বু। একটুতে জেগে ওঠেন। ছোটবেলা যখন বাড়িতে আসতেন, রাতে আমরা উহ্ শব্দ করলেও আম্মুর আগে তিনি উঠে আমাদের সামলে নিতেন। আজ তাকে ঘিরে কান্নার রোল, তিনি নড়ছেন না। শিমু তার এত আদরের মেয়ে, দুই দিন পর তার বিয়ে। সে আব্বুর বুকে পড়ে কাঁদছে তবুও আব্বুর ঘুম ভাঙছে না। আব্বু তলিয়ে গেছেন বেখবর ঘুমের অতলে! হ


আরো সংবাদ



premium cement

সকল