২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গোলাপি আঙুল

-

সে সময় পর্বতেরা কথা বলত। সুপ্রাচীন তুরাগ জনপদে তারা কথা বলত সমস্বরে, ঐকতানে। সেই জনপদে বৃক্ষেরা পদচারণা করত, নদিরা রোদন করত আর পর্বতেরা পরস্পর সংলাপে নিয়োজিত হত। এই জনপদে ছিল না মানুষের বসবাস। কিন্তু ছিল প্রকৃতিতে বিচরণকারী প্রাণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্ব। আর হ্যাঁ তুরাগ নামের এই জনপদে ডাইনোসরের মতো মানুষেরও বিলুপ্তি ঘটেছিল অনেক আগেই। আর সেই থেকে মানুষের জায়গা দখল করে নিয়েছে রোবোট। জীবজগৎ বলতে আমরা যা বুঝি তাদের অস্তিত্বও আর অবশিষ্ট ছিল না। আর শরৎকালের বাতাস হু হু কান্নার মতো ভেসে যেত সারি সারিমৃত পাইন গাছের সারির মধ্যে দিয়ে। আকাশ, সাগর এবং পর্বতমালা এরা সবাই এর সাক্ষী ছিল। কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বর কেউ শুনতে পেত না। মানুষদের জমানায় এদের সবাইকে জড়পদার্থ বলেই ভাবা হতো। ধারণাকরা হতো এদের কথা বলার বা শোনার ক্ষমতা নেই। কিন্তু মানুষদের এ ধারণা ছিল ভ্রান্ত। এরা মানব ইতিহাসের সব কিছুই পর্যবেক্ষণ করত এবং পরস্পর সেই তথ্য বিনিময়ও করত। কিন্তু এরা যা দেখত মানুষেরা তা দেখতে পেত না। এমনকি তারা পৃথিবীর অন্তিম পর্বটিও আগাম দেখতে পেত। সেই সময়টি যে এগিয়ে আসছে তাও তারা দেখতে পেত। আর এই পরিবর্তনের অন্তরালে চলছিল ভয়ানক হট্টগোল। মানুষেরা ছিল আসলেই শোরগোল প্রিয় প্রাণি। এক সময় তুরাগ ছিল একটি গাঢ় শ্যামল উপত্যকা। পাখিরা কিচিরমিচির করে উড়ে বেড়াত বৃষ্টিস্নাত আকাশে। শরতের আকাশের নিচে খেলে বেড়াত ধান আর গমের ক্ষেতগুলো। তখন শিশুরা খেলে বেড়াত মনের আনন্দে আর তাদের মায়েরা খোলা আকাশের নিচে বার-বি-কিউতে ভুট্টা পুড়িয়ে তাদের খেতে দিত। আর সেই ধোঁয়ায় উপত্যকার পর্বতগুলোর প্রায় দমবন্ধ হয়ে আসত। পর্বতগুলো কিন্তু কোনো অভিযোগ করেনি। অস্বস্তি সত্ত্বেও এই উপদ্রবকে তারা হাসিমুখেই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তারা অপেক্ষা করছিল অলৌকিক কিছু ঘটার জন্য।
ইতোমধ্যে সভ্যতার শত শত কোটি বছর পেরিয়ে গেছে। এক প্রজন্মকে হটিয়ে দিয়ে অন্য প্রজন্ম যাত্রা শুরু করেছে। কত রাজা মৃত্যুবরণ করেছে। তার জায়গায় অন্য রাজা ক্ষমতাসীন হয়েছে। ক্ষমতা রাজাদের দুর্নীতি পরায়ণ করে তুলেছে। শক্তিশালী রাজারা যুদ্ধ জয় করেছে এবং পর্বতের পাদদেশে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে। সবুজ শষ্যক্ষেত্র আর অসংখ্য উজ্জ্বল বর্ণেরপুষ্প-পত্র-পল্লব মানুষের রক্তে লালে লাল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু রাজা-রাজরাদের কাছে মানুষের রক্তের কোনো গুরুত্বই ছিল না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল যুদ্ধজয় এবং সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ। আর এজন্য একেক জনের চেয়ে একেক জন স্বৈরাচারী এসব রাজা নিজেদের ক্ষমতার দাপট দেখাতে নিরীহ মানুষদের বলিতে চড়াত। তারা ন্যায়বিচারের ধার ধারে না। তার পর একটা সময় এলো যখন প্রকৃতি নিজেই বিদ্রোহ করে বসল। শস্যক্ষেত্রগুলোতে ফসলের বাম্পার ফলন বন্ধ হয়ে গেল। রঙধনুর মতো বর্ণিল প্রাচুর্যের সম্ভাবনা নিয়ে বৃষ্টি এলো না। গাছ-গাছালি থেকে জীর্ণশীর্ণ পাতা ঝরে পড়তে থাকল। সূর্য আঁধারে আচ্ছন্ন হলো। রক্তবর্ণ চাঁদের আলো ভূপৃষ্ঠে এসে পড়ল। যন্ত্রকে ক্ষমতায়িত করা হলো। এই যান্ত্রিক যুগ নতুন ধরনের সহিংসতার সূচনা করল। আর তা ছিল মানব জাতির নিশ্চিহ্নকরণ এবং ভূখণ্ডের দখল। প্রকৃতি থেকে তাদের খাদ্য সংগ্রহের কোনো প্রয়োজন ছিল না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ব্যাপারেও তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। এভাবেই কালের গর্ভে হারিয়ে গেল মানব জাতি। কিন্তু মানবজাতি কি এই পরিণতি সম্পর্কে আগাম তথ্য পেতে পারত না। রক্তবর্ণ চাঁদ শুধালো পর্বতগুলোকে।।
তারা অবশ্যই পারত, কারণ তারাই তো এই যন্ত্রগুলো তৈরি করেছিল। কিন্তু মানুষেরা সফলতা অর্জন করতে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, তারা সেটা চিন্তাও করেনি। পর্বতগুলো উত্তর দিলো। অন্ধকারাচ্ছন্ন সূর্যও একমত হলো। পর্বতগুলো বলল, আমাদের গুহাগুলোতে আসো, তৈলচিত্রগুলো দেখো। জীবনের সব গল্পের পূর্বাভাস এই দেয়ালে বিধৃত হয়েছে। কিন্তু মানুষেরা সে দিকে মনোযোগই দেয়নি। পর্দার অন্তরালে চলছিল তখন দারুণ হট্টগোল। আর এই হট্টগোল আসছিল যুদ্ধের দামামা, আদতে অর্থহীন বিজয়ের মদমত্ত উল্লাস এবং অশ্লীল আমোদ-প্রমোদ থেকে। আর এসব হট্টগোল তাদের বিচার-বুদ্ধিআচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। তারা দেখতেই পেল না তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে। বোকা! সব বোকার দল! আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জই কেবল জানত তারা খামখেয়ালির বশে কিই না করছিল। বিপুল সংখ্যক নিরীহ নিরপরাধ প্রাণ ধ্বংস হলো। অনন্ত কাল ধরে চলল। নারী, শিশুসহ মানুষের জীর্ণ কঙ্কাল আর ভেঙেপড়া মানবাত্মার আবাসন এবং পুনর্বাসন। ঊর্ধ্বাকাশে বিরাজমান ঈশ্বরের কাছে তা ছিল নেহায়েতই মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মটরশুঁটির দানার মতো। তার পরও মানুষ ঝড়-বৃষ্টি-বাদল থেকে বাঁচার জন্য অদ্ভুতদর্শন আবাসস্থল নির্মাণ করেই চলল। জীবনের পরিবর্তনশীল বাস্তবতা অনুধাবন করতে তারা ব্যর্থ হলো। তারা ভুলেই গেল জীবনদায়িনী অমূল্য বায়ুপ্রবাহ, তাদের আয়ুষ্কাল, বংশবিস্তার এসবের কোনো কিছুরই নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই। বাইরের কোনো জগৎ থেকে তা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তাদের জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটুকুও সেই চলমান যুদ্ধক্ষেত্রেই হতে পারত। যে বিরতিহীনযুদ্ধ চলে আসছে এবং যার কোনো ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছিল না। মরণশীল প্রাণীরা সেই অফুরন্ত বায়ু সেবন করে তাদের সীমিত শক্তি অর্জন এবং তা তাদের খাঁচায় মজুদ করার চেষ্টা করছিল। এ ছিল ছন্দহীন যুক্তিহীন এক মরণশীল অস্তিত্বের সংগ্রাম। আর যারা ছিল অবিনশ্বর তারা চাইছিল মানুষকে একটা সময়সীমায় বেঁধে রাখতে এবং তারা তাদের মরণশীল বানিয়ে ফেলল। কিন্তু এটা কি ঠিক হলো? রক্তবর্ণ চাঁদ প্রশ্ন করল। ঠিক হোক আর না হোক, প্রতিটি নবজাতকের জন্য স্থান সঙ্কুলানের ব্যাপার ছিল। ক্ষমতা মানুষদের অন্ধ বানিয়ে ফেলেছিল। তারা যুদ্ধ করত, একে অপরকে হত্যা করত আর ভাবত তারা ইতিহাস রচনা করে ফেলেছে। ইতিহাস তারা রচনা করেছিল বটে। কিন্তু নিজেদের অজান্তেই তারা প্রকৃতির সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্রের ফাঁদেও পা দিয়ে ফেলেছিল। আমাদের এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত বল। বিশেষ করে এ ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে, রক্তবর্ণ চাঁদ জানতে চাইল। এটা কি করে সত্যিকারের পৃথিবী হতে পারে? এই মানুষগুলো ধার করা বায়ুতে জীবনধারণ করত, তাদের প্রিয় জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজন ছিল সূর্যের বিন্দু বিন্দু আলোক রশ্মিও! আজ অবশ্য সেই সূর্যকে তুমি দেখতে পাচ্ছো না; তোমার আড়ালেই সে লুকিয়ে আছে। এসব কিছু! আহ! এইযে জীবনের সুঘ্রাণ, এই ইতিহাস, এই ধ্বংসের শুরু যা তারা গুহার দেয়ালে উত্তীর্ণ করে রেখেছেÑ দৃষ্টিবিভ্রম ছাড়া আর কী বলব এগুলোকে? তারা ক্রমাগত বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হচ্ছিল আর নিজেরা ভাবছিল তারা অমর অবিনশ্বর এক বাস্তবতা নির্মাণ করে চলেছে। কিন্তু সেই দিন আর এলো না। তাহলে এ সবই কি স্বপ্ন ছিল? জিজ্ঞেস করল রক্তবর্ণ চাঁদ। সে জন্যই তো মানুষেরা আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছে যাতে নতুন প্রজন্ম তার স্থান দখল করে নিতে পারে। যন্ত্র নামের আরেকদল আক্রমণকারী তার স্থান দখল করে নিলো। তারাও ছিল নির্মম নিষ্ঠুর। কারণ মানুষরাই তো তাদের তৈরি করেছে তাদের মন-মানসিকতা দিয়ে যাতে করে এই জৈব প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে গেলেও যন্ত্ররাই তাদের উত্তরাধিকার পরবর্তী প্রজন্মে বহন করে নিয়ে যেতে পারে।
রক্তবর্ণ চাঁদ সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনল এবং তারপর বলল, আবেগের চেয়ে যুক্তির প্রাধান্য দিয়ে আরো অনেক বেশি বর্বর উচ্চাকাক্সক্ষা তাদের অস্থি-মজ্জায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারা মানুষদের ধ্বংস করে ফেলেছিল কারণ যারা টিকেছিল তাদের মধ্যে তারাই ছিল সবচেয়ে বেশি কলহপ্রবণ ও গোলমেলে। বোকা মানুষগুলো ভাবছিল তারা যন্ত্র নির্মাণ করছে একদিন যাতে যন্ত্রই তাদের সেবা করতে পারে আর জীবনধারণের জন্য তাদের বাতাসেরও প্রয়োজন হবে না। আফসোস, যন্ত্ররা ঠিকই তাদের কাজগুলো করে দিচ্ছিল। তারা মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল এবং আমাদের অর্থাৎ প্রকৃতিকে শান্তি দিয়েছিল। কিন্তু মানুষের অনুপস্থিতি পুরো দৃশ্যপটকেই একঘেঁয়ে করে তুলেছিল। মরুময় গ্রহগুলোর ওপর বিরাজমান চাঁদগুলোর মতোই। এর মাঝখানেও কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে নাকি? প্রশ্ন করল পর্বতগুলো। কোটি কোটি বছর ধরে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। তাদের ধ্বংসের এই পরিণতি তো তারাই ডেকে এনেছে। এখন সবাই যখন বিদায় হয়েছে তখন আমরা অর্থাৎ চাঁদ-সূর্য-পাহাড়-পর্বত আমরা আমাদের মতো মিলেমিশে ভাগ বাটোয়ারা করে থাকব। মানুষদের আমি মিস করি, বড্ডমিস করি। তারা পাগলাটে ছিল। তাদের ভেতর আবেগ ছিল, বুদ্ধিমত্তা ছিল। তারা ভালোবাসতে জানত, খুন-খারাবিও করত এবং অদ্ভুত অদ্ভুত সব জিনিসপত্র তৈরি করত। কিন্তু একসময় তারা নিজেরাই উন্মত্ত ক্ষ্যাপাটে হয়ে উঠল। চাঁদ। আহ! তারা কিন্তু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিল না। ভবিষ্যৎ পরিণতি আগাম দেখার মতো অসীম কল্পনাশক্তি তাদের ছিল।
তাদের অতিরিক্ত আবেগই তাদের এই সঙ্কটে ফেলেছে। আর এই সঙ্কট পুরো মানবজাতিরই ধ্বংস ডেকে এনেছে। তাদের এই ধ্বংসের জন্য তো তাহলে তাদের বুদ্ধিমত্তাই দায়ী ছিল, বলল রক্তবর্ণ চাঁদ। কিন্তু তাদের সামনে কি অন্য পথখোলা ছিল? ঐশী হস্তক্ষেপ ছাড়া অন্য কোনো পথ কি খোলা ছিল মানবজাতির সামনে? হ্যাঁ, এটা একটা প্রশ œহতে পারে বৈকি! নাকি এটা মহাবিশ্বের পরিকল্পনারই একটা অংশবিশেষ যা কি না এই পরিণতি এবং এ ইতিহাস আগেই রচনা করে রেখেছিল? কোনটা আসল সত্য? এই যা কিছু ঘটল তা কি মানুষ সচেতনভাবেই বেছে নিয়েছিল? চাঁদ, পর্বতগুলোভাবতে লাগল। আচ্ছা দেখ আমরা কিন্তু মানুষদের চেয়েও দীর্ঘ সময় ধরে বেঁচে আছি এবং মনে হয় আরো অনেক দিন ধরেই বেঁচে থাকব যদি না কোন বজ্র তোমায় আঘাত করে অথবা যদি না সূর্য আমাকে এবং আমি সূর্যকে পুরোপুরি আচ্ছাদিত করে ফেলি। আর সেক্ষেত্রে কক্ষপথে আমাদের সেই অনিবার্য সংঘর্ষই আমাদের বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে দেবে বলল রক্তবর্ণ চাঁদ। আরে এই কথার মধ্যেই তো তোমার প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে, পর্বতগুলো বলে উঠল। ওই যেসব শক্তিগুলো তাদের খেয়ালি কর্মকাণ্ডে যখন-তখন সব কিছুই পালটে দিতে পারে। মানুষ যেমন চিরকাল রাজত্ব করতে পারেনি তুমিও তোমার এই সিংহাসনে চিরকাল সমাসীন থাকতে পারবে না। আর এই যে আমাদের অস্তিত্ব, এর সবই যে নিছকমায়াতাই অনুধাবন করতে ভুল করেছিল মানবজাতি, উপসংহার টানল পর্বতগুলো। হুমম! আমি সত্যিই জানি না, বলল রক্তবর্ণ চাঁদ। আমরা কেউই জানি না সমস্বরে বলে উঠল পর্বতগুলো। তারা যখন এই কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছিল, তুরাগ উপত্যকার দূর প্রান্তে একটি ধূলিঝড় দেখা দিলো। তার দমকা হাওয়ায় পর্বতগুলো আঁধারে ছেয়ে গেল। নদি ও গিরিখাদগুলো ভরাট হয়ে গেল। রক্তবর্ণ চাঁদও ঢাকা পড়ে গেল। বিষাদময় পৃথিবী আরো বেশি আঁধারে ডুবে গেল। পর্বতগুলো ভাবতে শুরু করল, আমরা কি নিশ্চিতভাবেই অন্তিম পর্বের দিকে যাত্রা শুরু করলাম? তাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। বাতাস বন্ধ হয়ে গেল। বৃক্ষগুলো তাদের চলাচলের শক্তি কিংবা সুদৃঢ়ভাবে থিতু হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। নদীরও গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বাতাসের অভাবে তাদের কাশি এবং হিক্কা ওঠা শুরু হলো। আর আশেপাশের এই তাণ্ডবের মধ্যে শান্তি বিঘিœত হলো। কিন্তু এই বিপর্যয়ের পেছনে মানুষের কোনো হাত ছিল না। যন্ত্রগুলো এলোমেলোভাবে চলতে শুরু করল। তাদের মেরামত করার মতো কেউ ধারে কাছে ছিল না। যন্ত্ররা অবশ্য নিজেরাই নিজেদের সারিয়ে তুলতে পারত, কিন্তু সে সুযোগ তারা পেল না। এমন কিছু ঘটতে পারে তা তারা চিন্তাও করতে পারেনি। নিশ্চিতভাবেই বলা চলে মনুষ্য উদ্ভাবনীশক্তির সীমাবদ্ধতার আরেক উদাহরণ। একটি ভয়াবহ বিপর্যয় এগিয়ে আসছে। প্রকৃতির নিজের ভেতরই আরেক নতুন ধরনের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ফুলে ওঠা জোয়ারের সাথে সবেগে প্রবহমান বাতাসের সংঘর্ষ বেঁধে গেল। পর্বতগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে রইল যাতে করে এই ঝড় আর অগ্রসর হতে না পারে। কিন্তু পর্বতচূড়ায় বজ্রপাত আঘাত হানল। একনাগাড়ে অনেকগুলো আগ্নেয়গিরিতে অগ্নুৎপাত শুরু হলো। তাতে হিমবাহে জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করল। গলিত হিমবাহ উদ্দাম বেগে বইতে শুরু করল। লাভার স্রোত বজ্রপাতের সাথে যুগলবন্দি হয়ে উদ্বাহু তাণ্ডব নৃত্য শুরু করে দিলো। তুরাগ উপত্যকায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিলো। অবস্থা বেগতিক দেখে রক্তবর্ণ চাঁদও দ্রুতদৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। ঝড়-বাদল আর বজ্রপাত অতীতের ইতিহাসকে পালটে দিলো। এরপর শুরু হলো তাপদাহ। তুরাগ উপত্যকা আবার তপ্ত হয়ে উঠল। তুরাগ পুড়ছে! তপ্ত লাভার স্রোত নদীর স্রোতের সাথে ফুলে-ফেঁপে ওঠা সমুদ্রের দিকে ধাবিত হলো। এক সময় পর্বতচূড়াগুলো সমুদ্রবক্ষে নিমজ্জিত হলো। নিমজ্জিত তুরাগ উপত্যকা সমুদ্রপৃষ্ঠের তলদেশে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া আরেক পৃথিবীর অস্তিত্ব অনুভব করল। আবারো প্রাণের সাড়া পাওয়া গেল। মৎস্যকন্যারা বিনাবাধায় সাঁতার কেটে বেড়াতে লাগল। তুরাগে আবার উজ্জ্বল সূর্যের দেখা মিলল। মনে হচ্ছে তুরাগে দ্বিতীয়বারের জন্য প্রাণের সঞ্চার হলো।


আরো সংবাদ



premium cement