২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

আবুল কালাম শামসুদ্দীন তাঁর কর্মময় জীবন

-

আবুল কালাম শামসুদ্দীন ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে ধানীখোলা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত জোতদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯১৭ সালে এন্ট্রান্স ও ঢাকা কলেজ থেকে ১৯১৯ সালে এফএ পাস করে কলকাতা রিপন কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু ওই সময় পরাধীন ইংরেজ আমলে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে কংগ্রেস নেতা মোহনচাঁদ করমচাঁদ গান্ধী ও মুসলিম নেতা মোহাম্মদ আলীর আহ্বানে যুগপৎ অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন (১৯২০-১৯২২) চলায় তিনি তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কংগ্রেসের আহ্বানে তিনি বিএ পরীক্ষাও বর্জন করায় উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হন। অবশ্য পরে ১৯২১ সালে তিনি গৌড়ীয় সুবর্ণ বিদ্যায়তন থেকে ‘উপাধি’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি মুসলিম সমাজে যে নবজাগরণ ঘটে, আবুল কালাম শামসুদ্দীন তার অন্যতম ফসল। সাংবাদিকতা, সাহিত্য, সমাজ উন্নয়ন, রাজনীতি, ভাষা ও মননশীলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে তিনি বাঙালি মুসলিম নবজাগরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে তিনি আমৃত্যু সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ছিলেন স্বজাতি ও স্বদেশপ্রেমিক একজন চিন্তাশীল, নিষ্ঠাবান সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। তাঁর মতো নিঃস্বার্থ নিবেদিতপ্রাণ মহৎ ব্যক্তি সমাজে নিতান্ত বিরল।
আবুল কালাম শামসুদ্দীন কর্মজীবনে অনেক দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। তিনি ১৯২৩ সালে কলকাতার দৈনিক মোহাম্মদী পত্রিকায় সহযোগী সম্পাদক, ১৯২৪ সালে কলকাতার সাপ্তাহিক মুসলিম জগৎ পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে যোগদান করেন। ১৯২৫-১৯২৯ পর্যন্ত ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘দ্য মুসলমান’-এর (১৯০৬) সহকারী সম্পাদক (১৯২৪ থেকে সপ্তাহে এটি তিনবার প্রকাশিত) ছিলেন। ১৯২৬ সালে একই সাথে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত ‘সওগাত’ ও ‘দৈনিক সুলতান’-এর সম্পাদনা বিভাগে যোগদান করেন। ১৯২৭ সালে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদী’র সম্পাদনার দায়িত্ব পান। ১৯৩৬ সালে ৩১ অক্টোবরে বাঙালি মুসলিম সাংবাদিকতার জনক খ্যাত মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকা প্রকাশের পর তিনি ১৯৩৭ সালে এর সম্পাদনা বিভাগে যোগদান করেন। ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকা তৎকালে অবিভক্ত বাংলার মুসলিম সমাজের একমাত্র বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত ছিল। তিনি ১৯৪০ সালে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ২২ বছর কৃতিত্ব ও সুনামের সাথে তিনি আজাদ সম্পাদনা (১৯৪০-১৯৬২) করেন। ‘দৈনিক আজাদ’-এর প্রকাশনা শুরু হয় কলকাতায়। বাঙালি মুসলিমের নবজাগরণ, স্বাতন্ত্র্য-চেতনা, আত্মবিকাশ, অধিকার-সচেতনতা, স্বাধীনতা আন্দোলন ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ‘দৈনিক আজাদের’ ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক যথাক্রমে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ও আবুল কালাম শামসুদ্দীনের যুগপৎ ভূমিকা ছিল বিশেষ স্মরণীয়। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কবি ও গবেষক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ বলেন, ‘দৈনিক আজাদ শুধু মুসলিম বাংলার প্রাচীনতম সংবাদপত্রই নয়, উপমহাদেশের মুসলিম নবজাগরণ এবং আজাদী আন্দোলনেরও নির্ভীক মুখপত্র। পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম বাংলার সাংস্কৃতিক নবজাগরণে ‘আজাদ’-এর ভূমিকা ঐতিহাসিক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে নতুন রাষ্ট্রের এবং বিশেষভাবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এ নিয়ে আমাদের সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ভাষাতত্ত্ববিদ, পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবীরা ‘দৈনিক আজাদ’ ও ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় আলোচনার সূত্রপাত করেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগেই।’ (ভাষা-আন্দোলনে আবুল কালাম শামসুদ্দীন)।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কিছু দিন পর ‘দৈনিক আজাদ’ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬২ সালে পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার পর আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে নব প্রতিষ্ঠিত ‘দৈনিক জেহাদ’ পত্রিকার সম্পাদক হন। প্রায় দেড় বছর তিনি এ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। অতঃপর ১৯৬৪ সালের ৬ নভেম্বর তৎকালীন প্রেস ট্রাস্ট অব পাকিস্তান ‘দৈনিক পাকিস্তান’ (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা) নামে পত্রিকা প্রকাশ করলে তিনি এর সম্পাদক পদে যোগদান করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে এ পদ থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। এখানেই তাঁর সুদীর্ঘ গৌরবময় সাংবাদিক জীবনের অবসান ঘটে।
১৯৩০ দশকে আবুল কালাম শামসুদ্দীন মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। মুসলিম লীগ তখন উপমহাদেশের মুসলিমদের একমাত্র রাজনৈতিক দল। মুসলিম লীগে যোগদান করে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক উত্থাপিত ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’ (যা বিশেষভাবে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে পরিচিত) পাসের পর পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। লাহোর প্রস্তাবানুযায়ী, উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে দু’টি স্বতন্ত্র স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। এ কারণে অবিভক্ত বাংলা ও আসাম নিয়ে পূর্বাঞ্চলে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বাঙালি মুসলিম সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে। এ সময় পশ্চাদপদ বাঙালি মুসলিম সমাজকে সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সচেতন করে তোলার জন্য আবুল কালাম শামসুদ্দীনের নেতৃত্বে কলকাতায় ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’ (১৯৪২) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সম্পাদক হন দৈনিক আজাদের সহকারী সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক মুজীবুর রহমান খাঁ। দৈনিক আজাদকে কেন্দ্র করে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ভবিষ্যৎ স্বাধীন রাষ্ট্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্দেশ্যে এ সময় থেকেই তাঁরা তৎপর হন।
১৯৪৬ সালে আবুল কালাম শামসুদ্দীন মুসলিম লীগের মনোনয়নে ময়মনসিংহ জেলা থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দৈনিক আজাদ পত্রিকা কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে তিনিও ঢাকায় চলে আসেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে আন্দোলন সূচিত হয়। ক্রমান্বয়ে এ আন্দোলন জোরদার হয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথে পুলিশের গুলিবর্ষণে রক্তপাত ঘটায় আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। এর ফলে তৎকালীন সরকার বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। আবুল কালাম শামসুদ্দীন এ ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শনরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও ছাত্র-হত্যার প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য পদ থেকে তিনি পদত্যাগ (২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) করেন। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার তিনি উদ্বোধন করেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী গণ-আন্দোলনের সময় (জানুয়ারি-মার্চ) সরকারের দমননীতির প্রতিবাদে তিনি তাঁকে প্রদত্ত ‘সিতারা-এ-খেদমত’ ও ‘সিতারা-এ-ইমতিয়াজ’ খেতাব বর্জন করেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন সৃজনশীল সাহিত্যিক। সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনি প্রধানত মননশীল লেখক হিসেবে পরিচিত হলেও উপন্যাস, অনুবাদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। বিশেষত অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন সাহিত্য-সমালোচক হিসেবে তাঁর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি ও বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকদের সম্পর্কে তাঁর প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আলোচনা-পর্যালোচনা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যের বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নে তাঁর কৃতিত্ব অসামান্য। নজরুলকে তিনিই প্রথম ‘যুগ-প্রবর্তক’ কবি বলে অভিহিত করেন। কবি ফররুখ আহমদের প্রখ্যাত ‘হাতেম তায়ী’ কাব্য সম্পর্কে তিনি বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন মহাকাব্য পর্যালোচনা ও আধুনিককালে মহাকাব্যের আকার-আকৃতি ও ধরন বিশ্লেষণ করে যুক্তিসহ প্রমাণ করেন যে, ‘হাতেম তায়ী’ একটি সফল আধুনিক মহাকাব্য।
তাঁর রচিত গ্রন্থাবলিÑ কচিপাতা (শিশু সাহিত্য, ১৯৩২), প্রখ্যাত রুশ ঔপনাসিক তুর্গেনিভের ‘ভার্জিন সয়েল’-এর বাংলা অনুবাদ ‘অনাবাদি জমি’ (১৯৩৮), ‘ত্রিস্র্রোতা’ ১৯৫৩ (তুর্গেনিভের তিনটি গল্পের বাংলা অনুবাদ), ‘খরতরঙ্গ’ (তুর্গেনিভের ‘টরেন্টস অব স্প্রিং’ গ্রন্থের ছায়ানুসরণে রচিত, ১৯৫৩), ‘দৃষ্টিকোণ’ (প্রবন্ধ সঙ্কলন, ১৯৬১), ইলিয়ড (হোমারের মহাকাব্য ইলিয়ডের বঙ্গানুবাদ, ১৯৬৭), পলাশী থেকে পাকিস্তান (ইতিহাস, ১৯৬৮), অতীত দিনের স্মৃতি (আত্মজীবনী ও স্মৃতিচারণ, ১৯৬৮) সম্পাদনা : সেকাল ও একালের সেরা গল্প (১৯৬৩)।
উপরোক্ত গ্রন্থাবলি ব্যতীত তাঁর লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় রয়েছে, যা এখনো সঙ্কলিত ও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। তিনি অনুবাদ সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭০) এবং সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে একুশে পদক (১৯৭৬) লাভ করেন। হ


আরো সংবাদ



premium cement
প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের শেষ ধাপের পরীক্ষা শুক্রবার লম্বা ঈদের ছুটিতে কতজন ঢাকা ছাড়তে চান, কতজন পারবেন? সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন

সকল