১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সাহিত্যে নোবেলজয়ী তোকারচুক ও পিটার

-

সাহিত্যে নোবেল নিয়ে জল্পনকল্পনা চলে কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। অনেক সময় দেখা যায়, যা ভাবা হয়েছে তার ধারেকাছেও নেই বিজয়ীর নাম। গত বছর এবং এবার মিলিয়ে পোল্যান্ডের লেখিকা ওলগা তোকারচুক ও অস্ট্রিয়ার পিটার হ্যান্ডকে নোবেল জয় করেছেন। যৌন কেলেঙ্কারির জেরে গত বছর স্থগিত হয়ে যাওয়ায় এ বছর সাহিত্যে দুই বছরের নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করেছে সুইডিশ একাডেমি। ২০১৮ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ওলগা তোকারচুক এবং ২০১৯ সালের পুরস্কার উঠছে পিটার হ্যান্ডকের হাতে। গত বছরের কেলেঙ্কারির কারণে এবার অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করেছে রয়েল সুইডিশ একাডেমি। পাল্টেছে নোবেল কমিটির কাঠামোও। তবে বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।

দুই. ২০১৮ সালের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া পোলিশ লেখিকা ওলগা তোকারচুকের জন্ম ১৯৬২ সালের ২৯ জানুয়ারি পোল্যান্ডের পশ্চিমপ্রান্তে সুলেকচোতে। তার দাদী নানীদের মধ্যে একজন ইউক্রেনের বংশোদ্ভূত। ওলগা কিন্তু পাঠকদের কাছে অপরিচিত নন। কেননা গত বছরই তিনি ব্রিটেনের মর্যাদাবান ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার লাভ করেন ‘ফ্লাইটস’ উপন্যাসের জন্য। জনপ্রিয়তার দিক থেকে তার প্রজন্মের সবচেয়ে সফল লেখক বলে মনে করা হয় তাকে।
এর আগে ১৪ জন নারী সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। প্রয়াত টনি মরিসন একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ নারী যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। যা হোক, সাহিত্য জীবন শুরুর আগে তোকারচুক ১৯৮০ সালে পোল্যান্ডের নামকরা ওয়ারশ বিশ^বিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে লেখাপড়া করেন। ছাত্রী থাকা অবস্থায় অস্বাভাবিক আচরণকারী কিশোর বয়সীদের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন তিনি। ১৯৮৫ সালে গ্র্যাজুয়েশন লাভের পর তিনি থেরাপিস্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রথমে কাজ করেন রকলোতে ও পরে ওয়ালব্রিচে। তিনি কার্ল জং-এর অনুসারী ছিলেন এবং মনোবিজ্ঞান বিষয়কে তার সাহিত্যকর্মের অনুপ্রেরণাদায়ক বলে মন্তব্য করেন। কেননা এর ফলে তিনি নানা ধরনের মানুষের সাহচর্যে এসেছেন, মানুষকে কাছ থেকে দেখেছেন, যা তার সাহিত্যে চরিত্র সৃজনে সহায়ক হয়ে থাকবে। ১৯৯৮ সাল থেকে তোকারচুক নোয়া রুদার কাছে ছোট্ট একটি গ্রামে বসবাস শুরু করেন। সেখান থেকেই তার সাহিত্য জীবনের শুরু, তিনি সেখানে অবস্থানকালেই প্রকাশনা সংস্থা রুতার সাথে যোগাযোগ করেন। পোল্যান্ড দীর্ঘ দিন কমিউনিস্ট শাসনে ছিল আর তোকারচুক নিজেও একজন বামপন্থী ছিলেন, সেইসাথে ছিলেন একজন নারীবাদী ও নিরামিষাশী।

তিন. তোকারচুক কবিতা লিখেই তার লেখক জীবন শুরু করেন। তার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে। বইয়ের নাম পোলিশ ভাষায় ‘মিয়াস্তা ওয়ো লাসট্র্যাচ ’ ইংরেজিতে ‘সিটিজ ইন মিররস ’। তার প্রথম উপন্যাস ‘ পোদরুজ লুদুজ সিয়েগি ’ ইংরেজিতে ‘দ্য জার্নি অফ দি বুক-পিপল’। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। এটা ফ্রান্সের সপ্তদশ শতকের দুই প্রেমিকের কাহিনী। এটার সিক্যুয়াল ‘ ই. ই.’ উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। উপন্যাসের একটি নারী চরিত্র এরনা এল্টনারের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে ব্যতিক্রমী নামের এই উপন্যাসটির নামকরণ করা হয়েছে। তার তৃতীয় উপন্যাস ‘প্রাইমভাল অ্যান্ড আদার টাইমস’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে। এই বই প্রকাশিত হওয়ার ও তোকারচুক নভেলা থেকে শুরু ছোট আকারের লেখা ও প্রবন্ধ টাইপের লেখা লিখতে শুরু করেন। এসব বইও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ওলগা তোকারচুককে পোল্যান্ডের বাণিজ্যিক দিক থেকে সফল একজন লেখিকা হিসেবে দেখা হয়। এর কারণ তার বই বাজারে ভালো চলেছে। তার অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘ফ্লাইটস ’, ‘দ্য বুক অফ জ্যাকব’, ‘ড্রাইভ ইউর প্লাও ওভার দি বোনস অফ দি ডেড’ ইত্যাদি।
আগেই বলেছি ‘ফ্লাইটস ’ উপন্যাসের জন্য তিনি ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছিলেন। এ ছাড়াও ওলগা নাইক এওয়ার্ড (২০০৮ ও ২০১৫), ভিলেন্সিয়া প্রাইজ (২০১৩), পোলিশ পুরস্কার ব্রুকপ্রেইস (২০১৫), জান মাইকেলস্কি প্রাইজ ফর লিটারেচার (২০১৮) ও প্রিক্স লওে ব্যাটালিয়ন প্রাইজ (২০১৯) লাভ করেন। এসব স্বীকৃতি তার সাহিত্যকৃতীর জন্য তা বলাই বাহুল্য।
১০ অক্টোবর স্টকহোমে পুরস্কার ঘোষণা করেন সুইডিশ একাডেমির পার্মানেন্ট সেক্রেটারি ম্যাটস মালম। তিনি সাইটেশনে ওলগাকে ২০১৮ সালের পুরস্কার প্রদানের ব্যাখ্যায় বলেন 'ভড়ৎ ধ হধৎৎধঃরাব রসধমরহধঃরড়হ ঃযধঃ রিঃয বহপুপষড়ঢ়বফরপ ঢ়ধংংরড়হ ৎবঢ়ৎবংবহঃং ঃযব পৎড়ংংরহম ড়ভ নড়ঁহফধৎরবং ধং ধ ভড়ৎস ড়ভ ষরভব." অর্থাৎ তাকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে তার লেখায় জীবনের সীমারেখায় বর্ণনামূলক কল্পনা প্রবণতাকে জ্ঞানকোষের মতো করে দুঃখদুর্দশাকে উপস্থাপন করার জন্য। ভাষা একটু কঠিন হয়ে গেল। সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয়, জীবনের কান্না ও দুঃখের কথা পাঠকের হৃদয়গ্রাহী ভায়ায় তুলে ধরার জন্য। প্রতিবারই সাইটেশনে এ রকম ভারি ভারি কথা বলা হয়। এখন বিশে^র বিভিন্ন দেশের মানুষ ওলগা তোকারচুকের অনূদিত বই পড়ে এই স্বাদ পাবে কিনা সেটাই দেখার বিষয়।

চার. ২০১৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া অস্ট্রিয়ান লেখক পিটার হ্যান্ডকের জন্ম ১৯৪২ সালের ৬ ডিসেম্বর। জন্ম স্থান অস্ট্রিয়ার গ্রিফেন। তার পরিচয় ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, কবি, অনুবাদক ইত্যাদি। তার পিতা এরিখ স্কনেমান ছিলেন একজন জার্মান সৈন্য ও পরে ব্যাংকের ক্লার্ক। শিশুকালে বহুদিন পিটার তার পিতার দেখা পাননি, সেনার চাকরি বলে। অস্ট্রিয়া বহুদিন জার্মানির দখলে ছিল, তাই সে দেশের প্রধান ভাষা এখনো জার্মান। আর পিটারের বাবার জার্মান সেনা হওয়ার ভেদও এখানেই। তার মা মারিয়া একজন সেøাভেনিয়ান। পিটারের জন্মের আগে তার মা ব্রুনো হ্যান্ডকে নামে এক ট্রাম চালককে বিয়ে করেছিলেন, তিনিও একসময় বার্লিনে সৈন্য হিসেবে কাজ করেন। এই পরিবার সোভিয়েট দখলকৃত পাংকোতে বাস করতেন। সেখানে পিটারের সৎবোন মনিকার জন্ম ১৯৪৭ সালে। এর পর পরিবারটি তার মায়ের জন্মস্থান গ্রিফিনে চলে আসে। সৎ বাবার সঙ্গে পিটারের সম্পর্ক ভালো ছিল না, সে বাবার অতিরিক্ত মদ খাওয়া পছন্দ করত না। পিটারের এই পরিচয় ও ভাঙা সংসার বা ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান বিষয়টি তাকে বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় হবে বলে উল্লেখ করা হলো। তিনি ক্লাগেন ফুর্ট হাইস্কুলে পড়ার পর ১৯৬১ সালে ইউনিভার্সিটি অফ গ্রাজ-এ আইন শাস্ত্রে লেখাপড়া করেন।

পাঁচ. পিটারের লেখক জীবনের সূচনা হয় বোর্ডিং স্কুলের ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশের মাধ্যমে। ছাত্র জীবনেই লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি নিজেকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি যোগ দেন ‘গ্রাজার গ্রুপপি’ নামক একটি লেখক সমিতিতে। এর ইংরেজি নাম ‘দ্য গ্রাজ অথরস অ্যাসেম্বলি’। এটা ছিল তরুণ লেখকদের একটি সমিতি। এই সমিতি একটি ম্যাগাজিন বের করত আর তিনি তার প্রথম দিকের লেখা এ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। ১৯৬৫ সালে জার্মানির প্রকাশনা সংস্থা সারকাম্প ভারলেগ পিটারের একটি উপন্যাস প্রকাশ করে। এ সময়ই হ্যান্ডকে পড়াশোনা ছেড়ে দেন। বইটির নাম জার্মান ভাষায় ‘ডাই হরনিসেন’, ইংরেজিতে ‘দ্য হরনেটস’। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি পরে আমেরিকার নিউ জার্সিতে যান। পরে তার লেখা নাটক জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের একটি থিয়েটারে অভিনীত হয়। তিনি পরে বেশ কিছু চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেন। উপন্যাস, নাটক লেখার পাশাপাশি অনুবাদক হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে এই নোবেল জয়ীর।
তিনি ১৯৯৬ সালে ভ্রমণ কাহিনী ‘এ জার্নি টু দি রিভার্স : জাস্টিস ফর সার্বিয়া’ লেখেন। এই কাহিনী নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তিনি বইয়ে সার্বিয়াকে আর বসনিয়া যুদ্ধের কসাই নামে পরিচিত স্লোবোডান মিলোসেভিচকে সমর্থন করেন। আক্রমণ করেন পশ্চিমা মিডিয়াকে। নরওয়ের মিডিয়া তাকে যুদ্ধাপরাধী বলে অভিহিত করে। মুসলমানরা আর যুক্তিশীল মানুষ পিটারের এই মনোভাবকে মেনে নেয়নি। ফলে তার নাম ঘোষণার পর প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে থাকে। পিটারের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়ে আলবেনিয়া ও কসোভো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। পিটারকে তারাও ‘বলকানের কসাই’ নামে কুখ্যাত সার্ব নেতা স্লোবোদান মিলোসেভিচের কট্টর সমর্থক বলে মনে করে, যে কথা আগেই বলেছি। আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী এডি রামা টুইটারে লেখেন, ‘কখনো ভাবিনি নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর নাম শুনে আমার বমি আসবে’। এমনকি এই অস্ট্রিয়ান লেখক ২০১৪ সালে নোবেল পুরস্কার বিলোপের বিতর্কিত দাবি তুলেও সমালোচিত ছিলেন। হ্যান্ডকেকে ২০১৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইবসেন অ্যাওয়ার্ড দেয়ার পরও প্রতিবাদ ওঠে। অনেকেই এই পুরস্কারের জুরিদের পদত্যাগও দাবি করেন।
পরে পিটার গ্রাজ ছেড়ে জার্মানির ডুসেলডর্ফ, বার্লিন, ক্রোনবাগে কিছু দিন থাকেন। এরপর ফ্রান্সের প্যারিস হয়ে আমেরিকায় চলে যান। নোবেলের ইতিহাসে দেখা যায় অনেক সময় অপাত্রে এই বিশাল পুরস্কার দেয়া হয়। এবারো না হয় সে রকমই হলো। তবে নোবেল কমিটি পিটারের লেখার প্রশংসা করে সাইটেশনে লিখেছে তাকে পুরস্কার দেয়ার কারণ। এতে লেখা হয়েছে
‘ভড়ৎ ধহ রহভষঁবহঃরধষ ড়িৎশ ঃযধঃ রিঃয ষরহমঁরংঃরপ রহমবহঁরঃু যধং বীঢ়ষড়ৎবফ ঃযব ঢ়বৎরঢ়যবৎু ধহফ ঃযব ংঢ়বপরভরপরঃু ড়ভ যঁসধহ বীঢ়বৎরবহপব.’
অর্থাৎ একটি প্রভাবশালী কাজেরই স্বীকৃতি এটি, যার ভাষাতাত্ত্বিক বর্ণনা মানব অভিজ্ঞতার বিভিন্ন স্তর ও বৈশিষ্ট্যকে উপজীব্য করেছে। নোবেল কমিটির কাছে এমনটা মনে হলেও সবার কাছে তা গ্রহণীয় হবে কিনা তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement