২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ঐতিহ্যের পুনর্মূল্যায়নে কবি ফররুখ আহমদ

-

ঐতিহ্যের পুনর্মূল্যায়ন এই অসামান্য বাক্য দু’টি কেবল ফররুখ আহমদের মতো কবির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এমনটি ভাবলে ভুল করা হবে। আসলে প্রকৃত বড় কবি মাত্রই তার জাতির ঐতিহ্যের মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে থাকেন। ফররুখ আহমদও করেছিলেন। কবিতা দীর্ঘজীবী হওয়ার অন্যতম সূত্র হিসেবে অতীতের ঘটনাবলির সাথে কবিতার সরাসরি বর্তমানের যোগসূত্র স্থাপন করা। আবার ভালো কবিতার এই অপরিহার্য উপসর্গ কোনো কবিই জন্মসূত্রে অর্জন করতে পারেন না। করাও সম্ভব নয়। বিশ্ব সাহিত্যের দিকে তাকালেই এই তালিকা দীর্ঘতর হবে। ইংরেজি সাহিত্য এই ঐতিহ্য চেতনার কবি অনেকেই পাওয়া যাবে। তবে গত শতাব্দীর বির্তকিত নোবেল লরিয়েট কবি টমাস স্টার্ম এলিয়ট তার লিখিত ঞৎধফরঃরড়হ ধহফ রহফরারফঁধষ ঃধষবহঃ প্রবন্ধে ঐতিহ্য চেতনার পক্ষে বিশ্ব সাহিত্যে মস্ত বড় প্রচারক হয়ে দাঁড়ান। তিরিশের পঞ্চ কবিরা বলতে গেলেই সবাই কমবেশি এলিয়টের কবিতামালা ও সমালোচনার সাথে পরিচিত হলেও তারা সবাই তার রীতিনীতিকে ধ্রুববাক্য বলে এরকম ভাবা ঠিক হবে না। যদিও সবাই ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এলিয়টের একটি কবিতা অনুবাদ করলেও তাঁর অনুসারী কবিরা আপন করে এলিয়টকে গ্রহণ করেননি। বিশ্ব কবির পক্ষে যা ছিল সহনশীল সর্বগ্রাহ্য অবশ্য তা হয়তো বুঝতেই পারেনি। কেবল বিষ্ণু দে এলিয়টের চেতনাকে গ্রহণ করেছিলেন মনে-প্রাণে। পরবর্তীতে অবশ্য রবীন্দ্র জগতে প্রত্যাবর্তন বাংলা কবিতা সাহিত্যে একটি আলোচিত ঘটনা বটে। এলিয়ট অবশ্যই কবিতার ঐতিহ্যচেতনা বলতে কবির ঐতিহাসিক জ্ঞান-গরিমাকে বুঝিয়েছেন। যাই হোক, এবার আসা যাক আলোচনার বিষয়ে, আমাদের সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের গ্রিক পুরাণের ওপর অতিমাত্রায় আসক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রামায়ণ ও মহাভারতের চর্চাকে উদাহরণের তালিকায় রাখা যেতে পারে। আমরা সাধারণত ঐতিহ্য চর্চার প্রায় ক্ষেত্রেই বিষ্ণু দের নাম উল্লেখ করতে দেখি; কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাম তেমন উল্লেখ করি না। কিন্তু অনেক সমালোচক ভুলে যান কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে ঐতিহ্য চর্চার ক্ষেত্রে এক স্মরণীয় নাম। তাঁর উজ্জ্বল উদাহরণ হলো তার বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। তবে সমালোচকরা যতই বলুক না কেন, বিষ্ণু দে ঐতিহ্যচর্চার ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় এলিয়ট-নির্ভর হয়ে পড়েছিলেন। অনেক সময় তার কবিতা আমাদের সমাজ ব্যবস্থার সাথে অমিল দেখে কবি বুদ্ধদেব বসু লিখিতভাবে (পত্রাকারে) অনুযোগ করেছিলেন এই বলে যে, তাঁর অনেক কবিতাই তিনি ভালোভাবে বুঝতে পারেন না।
আবার এটা বলতে দ্বিধা নেই, সমালোচনা সত্ত্বেও বিষ্ণুদের কবিতার প্রভাব চল্লিশ দশকের উদীয়মান সমাজ কবি গোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। পরবর্তী অনুজ কবি ফররুখ আহমদের মতো সচেতন কবিকর্মী সেটা লক্ষ করেছেন, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আবার এটাও ঠিক যে, কবি ফররুখ আহমদের মতো বাঙালি মুসলমান কবির পক্ষে মিথ বা পুরাণকে সরাসরি ব্যবহার করাটা সত্যিই কঠিন ছিল। কারণ ইসলামে কোনো মিথের অস্তিত্ব না থাকার কারণে, আরব্য উপন্যাস, রাসূল করিম সা: ও ইসলামের ঘটনাবলিকে আশ্রয় করে কবিতার বিষয়বস্তু সৃজনে ব্রতী হয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে ফররুখ আহমদের সাথে তার পূর্ববর্তী অগ্রজ কবি কাজী নজরুল ইসলামের অবশ্যই পার্থক্য রয়েছে। কারণ ফররুখ আহমদের ইসলামী ঐতিহ্য ছাড়া অন্য কোনো মিথের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। কাজী নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে ছিলেন অত্যন্ত উদার। কারণ তার কবিতার মিশন সফলতার জন্য যেভাবে পেরেছেন, জাত-পাতহীনভাবে ঐতিহ্যকে ব্যবহার করেছেন। এ ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী ধর্মীয় আদর্শের পরস্পরের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। তাই ফররুখ আহমদের সামনে খুব বেশি সহজ সাধ্য পথ ছিল না। সচেতনভাবে এ বিষয়টাকে ফররুখ আহমদ আবিষ্কার করে নিয়েছেন। সাম্প্রতিককালে কবিতায় ইতিহাস ও ঐতিহ্য চেতনা নিয়ে আলোচনার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সমালোচকদের ধারণা, প্রকারান্তেই কবিদের সচেতনতার অভাব। তবে গত শতাব্দীর তিরিশ-চল্লিশের ঐতিহ্য চেতনাকে যেভাবে পর্যালোচনা করা হতো, এখন আর সেভাবে দেখা হয় না। কারণ প্রত্যেক সৎ লেখক তার স্বসমাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থেকেই তার সাহিত্যকর্ম চালিয়ে যান। সুতরাং বড় লেখকরা তাদের সৃজনশীলতার সাথে ঐতিহ্য চেতনা প্রায়ই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যায়। জড়িয়ে যাওয়াটাই স্বভাবিক। কবিতার দীর্ঘ জীবনের ওপর এই ঐতিহ্য চেতনা জড়িয়ে আছে। তাই বিস্তারিত আলোচনার দরকার রয়েছে। কারণ আমাদের কবিতা পাঠকদের মধ্যে ধারণা রয়েছে কবিতায় গ্রিক পুরাণের উল্লেখ থাকলেই কবিতাই ঐতিহ্য চেতনার অস্তিত্ব রয়েছে বলে মনে করে থাকে। প্রসঙ্গটা উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, বিষ্ণু দের কবিতায় গ্রিক পুরাণের কথা যতটা রয়েছে, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ততটা নেই, তবুও এই দুই কবি আমাদের কাছে আলোচিত হয়ে আছেন। পরবর্তীকালের কবিরা বিশেষ করে পঞ্চাশের কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি যেমন শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদও স্বক্ষেত্রে কবিতায় ঐতিহ্যের ব্যবহার সমসাময়িক কালের তুলনায় বেশি দেখা গেছে এটা অবশ্যই কাব্য সাহিত্যে শুভকর দিকও বটে। যাই হোক, আলোচনার শুরুতেই জানা দরকার ঐতিহ্য বলতে আসলে কী বোঝায়। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, এই ঐতিহ্যের সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা পাওয়া একটু কঠিন, কারণ ঐতিহ্যের ব্যবহার সব কবির হাতে সমানভাবে সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রস্ফুটিত হয় না। আর প্রত্যেক কবি এক অর্থে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, নিজ নিজ গোষ্ঠীর বাইরে অবস্থান করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। ঐতিহ্য যার আভিধানিক ইংরেজি শব্দ ঞৎধফরঃরড়হ বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকেÑ এর অর্থ হলো অতীতের কিছু ঘটনাবলির সমন্বয় যা একটি সম্প্রদায়ের কাছে দুঃখের, ক্রোধের এমনকি বীরত্বের হতে পারেÑ যা বহুদিন পরে সেই জাতির পুনর্জাগরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তবে এ কথা ঠিক যে, আধুনিককালে সঙ্কীর্ণ জাতীয়াবাদী চেতনায় ঐতিহ্যকে অনেকেই ব্যবহার করার পক্ষপাতি, যার কারণে রবীন্দ্রনাথ অকারণে পৃথিবীতে সঙ্ঘাতময় পরিবেশের সূচনা দেখেছিলেন। বলা বাহুল্য, সাম্রাজ্যবাদীরাই এদের ধারক বাহক। এ ক্ষেত্রে অবশ্য আরেকটি প্রশ্ন উঠতে পারেÑ ঐতিহ্যের পুনর্মূল্যায়ন করা কি কবির একমাত্র কাজ নাকি অন্য সাহিত্যিক কর্মীরাও তা করতে পারে। এর উত্তরে বলা যেতে পারেÑ অবশ্য পারে। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে যতটা জোরালো হতে পারে, অন্য ক্ষেত্রে ততটা পারে না বলে আমার বিশ্বাস। তবে আধুনিককালে বিশেষত টিএস এলিয়ট কাব্যনাট্য সৃজনের সময়ে ঐতিহ্যকে যেভাবে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন, তাতে নতুন করে ভাবতে হবেÑ কেবলমাত্র কবিতায় নয়, অন্য ক্ষেত্রে এর সম্প্রসারণ ঘটেছে তা বলাই বাহুল্য।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, আমাদের আলোচ্য কবি ফররুখ আহমদ সেই এলিয়টি চিন্তাধারায় বহুলাংশে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তা কেবল তথ্য দ্বারাই সমর্থিত নয়, রচনাকর্মকে উদাহরণের তালিকায় আনলেই আমার বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হবে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে কবির কাব্যনাটক ‘হাতেম তায়ী’র নাম উল্লেখ করলে দোষাবহ হবে না, কারণ এটি এলিয়টি চিন্তাধারায় সফল কাব্যনাট্য। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আলী আহসানের ‘সতত স্বাগত’ গ্রন্থ থেকে ফররুখের ঐতিহ্য বিষয়ক কিছু মতামত তুলে রাখা যাক। এ ক্ষত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, সৈয়দ আলী আহসান ছিলেন কবি ফররুখের কলকাতা জীবনের একজন গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু, প্রাথমিক ধ্যান-ধারণায় কাব্যজীবনের সঙ্গীও বটে। সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, ‘চাহার দরবেশ’ যখন লিখি তখন এলিয়টের ডধংঃব খধহফ আমার দৃষ্টিতে একটি আদর্শ কাব্য প্রক্রিয়ার ফলে, আমার কোরবানি বা জোহোরা ও মুসতারি যখন লিখি, তখন ইয়েটসের অঃ ঞযব ঐধশিং ডবষষ এবং ঞযব ঞড়বিৎ পাঠ করে অভিভূত হচ্ছি। ফররুখের সাথে ইয়েটস এবং এলিয়টের কবিতা নিয়ে আমি অনেক আলোচনা করেছি। কিন্তু ফররুখ এদের কাব্য প্রক্রিয়াকে অশান্ত মনে করতো। অবশ্য এদের বিশিষ্ট ঐতিহ্যবাদিতা ফররুখকে আশ্বস্ত করেছিল এবং আপন কাব্য কর্মের উৎসমূলে প্রারম্ভিক যুগের ইসলামকে স্থাপন করতে অসুবিধা হয়নি।’ (স্বততঃ স্বাগত, সৈয়দ আলী আহসান, পৃষ্ঠা-১২৩)।

[বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়]

 


আরো সংবাদ



premium cement
অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশপ্রেমিক জনতার ঐক্যের বিকল্প নেই : ডা: শফিকুর রহমান সোনাগাজীতে জামাতে নামাজ পড়ে বাইসাইকেল পুরস্কার পেল ২২ কিশোর গফরগাঁওয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১ মনুষ্য চামড়ায় তৈরি বইয়ের মলাট সরানো হলো হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে বর্জন করতে হবে : ডা: ইরান আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা ভিয়েনায় মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রদূতদের ইফতারে ইসলামিক রিলিজিয়াস অথোরিটি আমন্ত্রিত এবার বাজারে এলো শাওমির তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি

সকল