২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিল্পের মহিমা

-

সৃজনশীল কাজ যদিও সমকালীন, কিন্তু সমকালের সমাজে তা তেমন আদৃত হয় না। কারণ শিল্পী ও সমকালীনতা অনুভূতিগতভাবে বৈষম্যে অবস্থান করে। শিল্পী সামগ্রিকতা থেকে অধিক সংবেদনশীল ও প্রতিভাধর শিল্পী আরো বেশি সংবেদনশীল থাকার কারণে গোটা বিষয়ের বিরুদ্ধে সে বিরুদ্ধবাদী। সে সমকালে চলমান জীবনধারায় বসবাস করলেও শিল্প-চেতনাটি গড়ে ওঠে সামাজিক জীবনধারার অসঙ্গতিগুলোর বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ হয়ে। কারণ প্রকৃত শিল্পী চায় একটি পরিচ্ছন্ন সামাজিক মানবজীবন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য, শিল্পের শিল্পীরা তাদের কাল, স্থান ও সময়কে সৃষ্টিতে যুক্ত করেন বিরাজমানতার মধ্য দিয়ে বিদ্রোহী হয়ে। তারা তাই বলেন না বা আঁকেন না যা আছে তাই, তারা সব কিছুর মলিনতাকে মূল্যায়ন করেন সুন্দরের তুল্যমূল্যে। কিন্তু আপাতদৃষ্টে দেখা যায় তার সমাজের মানবজীবন, ব্যবহারিক রীতি, মূল্যবোধ ইত্যাদিকে সংশ্লেষিত রূপে যাতে তার পাঠক তার উপস্থাপনাকে অপরিচিত মনে না করে এবং পাঠ ও অনুভব থেকে বিযুক্ত না হয়। একটি উপন্যাসে সমকালীন জীবন বিবৃত হয়েছে, নতুন কিছু নেই এমন পাঠকের কাছে মনে হলেও চলমানতা উপস্থাপনার মুনশিয়ানায় যে নান্দনিকতা তৈরি হয়েছে এবং শিল্পীর সততার কারণে যে চিত্রটি উপস্থাপিত হয়ে পাঠকের বোধের সাথে ভাবের আত্মীয়তা গড়েছে তাই হলো বিদ্রোহÑ হুবহু কিন্তু হুবহু নয়। সৃষ্টি এ ভাবে তার মহত্ত্ব দ্বারা একজন ভোক্তাকে জীবনের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য তৈরি করে ভোক্তাকেই দিচ্ছে চেতনাগত উদ্দীপনা, যার মাধ্যমে মনোহৃদয়ে বোধের যে পরিবর্তন ঘটল তাই শিল্পের মহিমা। একটি ভালো সৃজনশীল কাজের সমকালীন ভোক্তারা শিল্পের অন্তর্গত আলোক বিচ্ছুরণ উপলব্ধি করতে অপারগ হলেও শিল্পের দাবি শেষ হয়ে যায় না। বরং বরফস্তূপের মধ্যে চাপা পড়া হাজার বছরের মানব কাঠামোর অটুটতার মতো জেগে থাকে এবং ধীরে ধীরে আবিষ্কারের মতো তা ভোক্তা বা পাঠকের মনোজগতে স্থিতি নেয়। যুদ্ধের উন্মত্ততার মতো নয়, কিন্তু যুদ্ধের নৃশংসতার মধ্যেও যেসব ছোটখাটো ঘটনাবলি কিংবা যুদ্ধ পরিচালনার ভেতর যে বিবেচনা তা বর্ণনায় যখন শিল্প হয়ে ওঠে, তাতে ভয়াবহতার বর্ণনা থাকে মানুষকে যুদ্ধবিরোধী হিসেবে তৈরি হওয়ার বার্তায়Ñ এটাই শিল্পের মহিমা।
সৃজনশীল মানুষ তার সৃষ্টিতে বাস্তবকে বাতিল করে। বাতিলের মধ্য দিয়ে স্থাপন করে রীতি ও নীতির সাথে সম্পৃক্ত এক বাস্তবতাকে। এই বাস্তবতা মূল থেকে পৃথক কিন্তু শিল্পীর মনোজগতের প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব। সে কারণে প্ল্যাটো বলেছিলেন কবিরা সত্য বলে না। বাস্তবে কবিমানস বিষয়ের যে রূপমানস নিজ কাক্সক্ষায় ধারণ করে তা বাস্তব থেকে সংগৃহীত সংবেদ। কিন্তু সে বাস্তবটিতে এক বিদ্রোহ বর্তমান থাকে এবং এই বিদ্রোহের কারণে বস্তুগত বিষয়টি বাতিল হয়ে নতুনে সংযোজিত হয় সৃষ্ট রূপ। রূপগুলো স্রষ্টার রূপান্তরÑ সৃষ্টির সাথে, সভ্যতার সাথে। রূপ ও বস্তুর মাঝের সম্পর্ক রূপায়ণে যদিও পুরোপুরি বাতিল হয় না কিন্তু সৃষ্টির বিবর্তন ঘটে স্রষ্টার রূপান্তর ক্রিয়ায়। আর যদি তা না ঘটে তা হলে বুঝতে হবে বাস্তব ও রূপান্তরে কুণ্ঠিত রূপকার সময়ের ক্রীতদাস। তার সৃষ্টি তোষণে তোয়াজে লাভে লালসায় ভোগে; মহত্ত্বের কোনো আলোক রেখা সেখানে উপস্থিত নেই।
০২.
অন্য দিকে পাঠক যারা একে গ্রহণ করে তুষ্টি লাভ করেন, তারাও প্রকৃতির শিক্ষা থেকে পিছিয়ে থাকেন। রূপায়ণের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতিকে বদলিয়েছে এবং নিজের সপক্ষে উপযোগী করেছে এই ধারণাকে সে অতিরঞ্জন মনে করে, কারণ বৈষম্যের সমাজে তার মনোবিকাশ গতানুগতিকতাকে অতিক্রম করতে পারে না। নানা আয়রনির ভেতর দিয়ে সে যে আধুনিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে বসবাস করছে তার সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে তা তাকে এক বিবর্তনিক ধারায় নিজের অজ্ঞাতে নতুনে উপস্থিত করছে, তাও সে গতানুগতিক ধারণাগুলোর মধ্যে বসবাস করতে করতে নিয়তিবাদিতার কারণে আমলে নিতে পারে না। এর ফলে সৃজনশীল কাজগুলো বিবর্তনিক ধারায় তার দৃশ্যমানতার মধ্যে নতুনের উন্মেষ ঘটিয়েছে তাকে উপলব্ধি করে তার সাথে যুক্ত হতে পারে না। এগুলোকে তারা আত্মস্থ করতে চায় না এবং এর সুন্দর উপলব্ধিতে সে অপারঙ্গম থাকে। এ কারণে মার্কস-এঙ্গেলস বলেছিলেন সৃজনশীল মানুষেরও কর্তব্য রয়েছে তার অনুরাগী ভোক্তা, পাঠক তৈরি করার প্রয়াস সৃষ্টিতে রাখা; অর্থাৎ আকস্মিকতাই কেবল সৃজনের ক্ষেত্রে যথাযথ নয়, বরং ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে নতুন ভোক্তাকে উপস্থিত করার চেষ্টাও তাকে করতে হবে নিরাসক্ত হয়ে। আয়না পর্বে যে মানুষ স্বাধীন, সেই মানুষই সামাজিক জীবনপর্যায়ে হয়ে পড়ে পরাধীন। এই অধীনতাকে সে চিনতে পারে না কতগুলো উদ্ভটতার কারণে। ফলে সৃজনশীল কাজে শিল্পীর দূর চিন্তাকে অনুধাবন করার এবং নতুন রাজ্যে প্রবেশে প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে তার উদ্যোগ আলস্য নিদ্রার মতোই স্থবির। যেখানে সৃজনের উদ্দেশ্যই হলো প্রয়োজনীয়, জাগরণ ক্রমেই নতুনের দিকে সেখানে এসব গতানুগতিকতাকে পরিহার করার বোধশক্তি অর্জনে সামাজিক জীবনে রাজনৈতিক পরিবর্তন অত্যাবশ্যকীয়। সামগ্রিকভাবে সব সৃজনেই মানবজীবনের বন্দিত্বকে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আগামীকে ইঙ্গিতবাহী না করলে প্রশিক্ষিত ভোক্তার অভাবের প্রকটতা কমে না। লেখক কেবল লেখক নয়, নাট্যকার, শিল্পী নয়, তার দায়িত্বটি সে নিজে যদি উপলব্ধি না করে, সে ক্ষেত্রে গতানুগতিকতাকে অতিক্রম করা তার নিজের দিকে যেমন দূরপূর্ণ তেমনি ভোক্তা তৈরির সময়কালকে খাটো করার চেষ্টাও দূর হয়েই থাকে। শিল্পের সব অঙ্গনে শিল্পীর কোনো কোনো সৃষ্টি সে কাব্য কথাসাহিত্য, ভাস্কর্য, অঙ্কন এমনকি ফটোগ্রাফিও প্রতিক্রিয়াশীলদের দিকে নিষ্ঠুরতম চাবুক হয়ে উঠতে পারে অথবা হতে পারে সেবাদাস। যদি কবি-লেখক বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের মেরুদণ্ডটি সোজা ও নৈতিকভাবে মস্তিষ্কের ভার বহনে সক্ষম থাকে, তা হলে সে স্বাধীনভাবেই লিখবে স্তবস্তুতিতে নয়। আধুনিক শিল্প এবং এর প্রায় সমগ্রতা কবি বা শিল্পীর মানসিক যন্ত্রণার সামগ্রিকতার সাথে যুক্ত। আর তা না হলে এর সমগ্রতা এক স্বৈরাচারী ও ক্রীতদাসদের শিল্পবাস্তবতা যা বাস্তবের রূপকে বাতিল করে নতুন বাস্তবতা তৈরি করেনি বা তৈরিতে ক্রমাগত অসঙ্গতির রূপান্তর ঘটিয়েছে। এগুলো ক্রীতদাস মানসিকতার সৃষ্ট শিল্প মেধাবী স্রষ্টার নয়।
০৩.
চিরকালই মহৎ সাহিত্য থেকে মানুষ নিজের শিক্ষা ও রুচির তাৎপর্য অনুসন্ধান করেছে। ইলিয়াড-ওডিসিসহ রামায়ণ ও মহাভারতের পাঠকেরা বা শ্রোতারা জীবনে মানবিক পথে পরিচালিত হওয়ার অলিখিত নির্দেশ অনেক ক্ষেত্রেই অন্তরে মান্যতা দিয়েছিল বা এখনো দিচ্ছে। ন্যায়-সঙ্গতির সঞ্চয়ও একজন ব্যক্তির মনে সাহিত্য পাঠ থেকেই অনুভূত হয়।
কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সমাজ ও অর্থনীতির ব্যাপকতা জীবনে ক্রমাগত জটিল কুটিল বেষ্টনী তৈরি করে এবং মানুষকে পতিত আত্মায় পরিণত করে, সে কারণে মানুষ সচেতন আত্মা থেকে বিচ্যুত হয় এবং অনুভূতিগুলোর ধসের মধ্যে নিক্ষেপিত হয়। ফলে ন্যায় ও কল্যাণবোধ পতিত সত্তায় পরিণত হয়। শিল্প সাহিত্য পাঠে, শ্রবণে লুপ্ত চৈতন্যে যে অনুভূতির সৃষ্টি করে আপাতদৃষ্টিতে তা ঠুনকো বা তামাশা বলে পতিত সত্তাধারীদের বিবেচনা পেলেও এর দূর ক্রিয়া মানবমনে ধীর এবং স্থায়ী অনুভূতি নির্মাণ করে দিতে পারে। মানুষের সদাত্মা কখনো মানব অনুভব থেকে মুছে যায় না লুপ্ত থাকে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবেশ পরিস্থিতি শিক্ষা সামাজিক অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা ইত্যাদির সমজোগান পেলে পুনরাত্মা লাভ করে। সাহিত্যের এই মহিমা সেই আদিমকাল থেকেই বহমান রয়েছে। গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনকাল থেকেই মানুষ তার প্রয়োজনে সব কিছু সৃষ্টি রূপান্তর করে চলেছে। প্রয়োজনেই শিল্প সাহিত্যের সৃষ্টি আবার প্রয়োজনেই তার বিকাশ, যা অবিরাম সভ্যতার গতির মধ্যে সঞ্চালিত। অরণ্য বিচরণরত গোষ্ঠী মানুষদের গুহাগাত্রে আঁকা ছবি, শিকার নৃত্য পান ভোজনের অঙ্কন প্রমাণ করে সে কালের প্রয়োজন এতে ভালোভাবে মিটেছে এবং অস্বীকার করার কারণ নেই যে, আত্মরক্ষা ও বংশগতির মতো প্রাথমিক স্তরের কামনা-বাসনা থেকেই এর জন্ম। এসব শিল্পে আজকের দৃষ্টিতে সুরুচি সুকুমার বোধ নেই, কিন্তু তখনকার মানুষের প্রয়োজন মিটেছিল বলেই শিল্পী মানুষ তা এঁকেছিল, গোষ্ঠী মানুষ তাতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল। ধারাবাহিকতায় লক্ষ করলে দেখা যাবে, আজো তারই উপস্থিতি শিল্পে সাহিত্যে কোনো-না-কোনোভাবে টিকে আছে।
০৪.
এখন এই কোনো-না-কোনোভাবের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। জীবন যাপনে গোষ্ঠীমানুষ আর আজকে অর্থনৈতিক জটিল জীবনে রাজনৈতিক মানুষের বিভেদে সামগ্রিকতা বিভাজিত হয়েছে, পক্ষ-বিপক্ষ হয়েছে। কোনোটা সেবা করছে ভোগবাদের এই কথা বলে ‘শিল্প সাহিত্যের কোনো উদ্দেশ্য নেই, শিল্পই শিল্পের উদ্দেশ্য’ আনন্দই তার মুখ্য। আবার অপর ভাগের সীমিতরা বলছে, শিল্পের উদ্দেশ্য মানুষের প্রয়োজনকে প্রত্যক্ষায়নে বিস্তার পাওয়ায়। ধনিকের সেবায় শিল্প-সাহিত্য নয়, তাদের প্রাণশক্তি নেই বরং প্রাণশক্তি আছে নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের মধ্যে যারা সংখ্যায় গরিষ্ঠ। এর রূপ হবে মানবিক, মানবজীবনকে চেতনাসমৃদ্ধ করা এবং নতুন জীবন বোধের দিক আলোকিত করা। প্রথমটি সেই শ্রেণীর মানুষদের প্রয়োজন যারা লুটেছেন, লুটবেন, নোংরামি, ভণ্ডামীর কুক্ষিগতকরণে ও শিল্পীর শিল্পকে পণ্য করে ফরমায়েশে খাটিয়ে মুনাফা লুটবেন এবং তার সদাত্মাকে বিলীন করে পতিত সত্তার ধারক বাহকে পরিণত করে তারাই বা তাদের শ্রেণী অর্থনৈতিক সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে আলোক উদ্ভাসন থেকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করে, যাতে ওই মানুষেরা চিরকাল চেতনাহীন থাকে, থাকে সেবাদাস হয়ে। শিল্পী যখন তার প্রয়োজনেই এমন আটকলে আটকা পড়ে তখন তার চেতনা আর স্বাধীন থাকে না। তারপরও দ্বিতীয় ভাগ খুব ক্ষীণগলায় এবং নেতিয়ে পড়া হাতে ছেনি/কলম চালিয়ে নির্মাণ করে চেতনা উদ্ধারে সামাজিক বাস্তবতার ছবি শিল্পের রূপেÑ চলমানতায় সে বিদ্রোহী।
০৫.
হ্যাঁ সৃষ্টি নয়, আবর্জনা দ্বারাই আমরা প্রতিনিয়ত শিল্পের জগৎকে ভরিয়ে তুলছি। শিল্পের মহিমা সেখানেই যখন তা পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী, যা এখনো উপলব্ধিতে উপস্থিত নেই বৃহতের। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement