১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ছড়ার মানুষ হাসান হাফিজ

-

আমার বিশ্বাস, ছড়া হচ্ছে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উৎসার। মানুষ যখন আবেগে অধীর হয়, অবরুদ্ধ ক্রোধ বা ক্ষোভে ফেটে পড়ে, গভীর হতাশা ও নিরাশায় ভেঙে পড়ে, বেদনায় বিচূর্ণ হতে থাকে, কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা পায় না, তখন তার ভেতরটা ছড়ার আকারে বেরিয়ে আসে। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ভুবনজয়ী কবি যেমন ছড়া লিখেছেন, সাম্প্রতিক বাংলাদেশের অন্যতম বিশিষ্ট কবি হাসান হাফিজ বিপুল কবিখ্যাতি সত্ত্বেও ছড়া ছেড়ে দেননি। লিখেছেন অনেক ছড়া এবং এখনো লিখেই চলেছেন। তাঁকে নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।
হাসান হাফিজ মূলত কবি। পেশায় তিনি সাংবাদিক। এ দুটো নিয়েই তিনি দিব্যি থাকতে পারতেন। ছড়ার ‘কলঙ্কতিলক’ কপালে না পরলেও পারতেন, কিন্তু তিনি পরেছেন। যদিও তিনি জানেন, আমাদের দেশের নাক-উঁচু শ্রেণীটির চোখে ছড়া অতিশয় তুচ্ছ ও বর্জনীয় জিনিস। সাহিত্যের এ মাধ্যমটিতে যে যতই সিদ্ধি অর্জন করুক, ‘বুুদ্ধিজীবী’দের চোখে তার অবস্থান ততই নিচে নেমে যায়। যদিও রবীন্দ্রনাথ কিংবা অন্নদাশঙ্করের ছড়াচর্চার প্রসঙ্গ উঠলে এদের মুখে রা সরে না।
হাসান হাফিজের এসব না জানার কথা নয় একেবারেই। তবুও তিনি ছড়া লিখেছেন এবং লিখেই চলেছেন। কেন? নিজের বিশ্বাসটিই পুনরাবৃত্তি করি : ছড়া হচ্ছে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উৎসার। যিনি প্রকৃত কবি, কবির আবেগ যার ভেতরে সতত গুঞ্জরিত, তিনি কবিতা তো লিখবেনই, ছড়াও লিখবেন। ছড়া তিনি লিখতে বাধ্য। কারণ ছড়া হচ্ছে কবিতার পূর্বপুরুষ। তার আত্মার আত্মীয়।
কাজেই কবি হাসান হাফিজ ছড়া লেখেন এবং লিখবেন। কবি হাসান হাফিজ অবশ্যই ছড়াকার হাসান হাফিজও বটে।
কবি হাসান হাফিজ কী লিখেন ছড়ায়। তার ছড়া কি ছড়া হয়? কেমন তার ছড়াÑ ভালো, মন্দ, মোটামুটি, নাকি ‘কিচ্ছু হয় না।’
এসব প্রশ্নের জবাব দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এটা আমার কাজও নয়। এই কাজ সমালোচকের। আমি সমালোচক নই, মুগ্ধ পাঠক। তবে পাঠক হিসেবে আমারও ভালো লাগা মন্দ লাগা আছে। এ আলোচনায় সেটাও সুযোগমতো বলা হবে।
হাসান হাফিজ তার ছড়ায় কী লিখেন বা কী নিয়ে ছড়া লিখেন তিনি, এ প্রশ্নের এককথায় জবাব দিতে হলে তার কয়েকটা বইয়ের নাম শোনা যাকÑ ছন্দে ছড়ায় ঈশপ, গল্প ছড়ায় ঈশপ, ঈশপের গল্প থেকে ছড়া, মজার ছড়া, সাতটা কাকে দাঁড় বায়, সজনে পাতা কলমী ফুল, টোনাটুনি ছড়া শুনি ইত্যাদি।
এসব বইয়ের নাম শুনেই বোঝা যায়, ছড়াকার হিসেবে হাসান হাফিজ সর্বত্রগামী। ঈশপের চিরায়ত নীতিকথা থেকে শুরু করে সজনে পাতা কলমী ফুল হয়ে টোনাটুনি পর্যন্ত কিছুই বাদ দেননি তিনি। একজন জাতকবি ও ছড়াকারের পক্ষেই শুধু এটা সম্ভব। সম্ভব হয়েছে হাসান হাফিজের পক্ষেও।
ছড়া যে সব সময় অর্থ বহন করে, তাও নয়। ছড়া কখনো কখনো খেয়ালি মনের অর্থহীন ছন্দের ঝঙ্কারও। ছড়ায় এমনসব ঘটনা ঘটতে পারে, যা বাস্তবে কদাচ সম্ভব নয়। এই অসম্ভবের পায়ে দাঁড়িয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করাও, কখনো কখনো ছড়ার কাজ। একে বলা হয় অর্থহীন ছড়াÑ ননসেন্স ভার্স। হাসান হাফিজ, অসংখ্য বাস্তবানুগ ছড়ার ফাঁকে ফাঁকে, ননসেন্স ভার্সও লিখেছেন। কেন লিখেছেন? কারণ তিনি নিছক ছড়া লেখক নন, ছড়াকার। আর ছড়াকার তো তিনিই, ছন্দ যার বুকের ভেতর সদাসর্বদা ঝঙ্কার তুলে চলে। হাসান হাফিজের সাতটা কাকে দাঁড় বায় বইতে সেই ননসেন্স ভার্সের ঝঙ্কার শোনা যায় অবিরল। শোনা যাক তাহলে : গয়না নামের নৌকায়/ সাতটা কাকে দাঁড় বায়।/ পাল তুলে দ্যায় এ্যাইও/ সামাল সামাল হেঁইয়ো।
এরকম আরো আছে। যেখানে টাট্টু ঘোড়া ডিম পাড়ে, ভূত তার একপাটি জুতো হারিয়ে ফেলে।
এসবের কোনো অর্থ হয় না, কিন্তু আবার হয়ও। কী যে হয়, সে কথা বলে বা লিখে বোঝানো যাবে না। এ কেবল অনুভবের।
তবে হাসান হাফিজ কেবল অনুভববেদ্য ছড়া লিখেছেন, তা কিন্তু নয়। আগেই তো বলেছি, তিনি কবি ও সাংবাদিক। ফলে তার দু’চোখে ননসেন্স ভার্সই কেবল ধরা পড়ে না, আমাদের চার পাশের অনেক রঙ, অনেক ছবি তার কলমে নতুন চেহারা নিয়ে ধরা দেয়। আমরা অবাক চোখে দেখি আর ভাবি, আরে, এ তো আমার চেনা!
তা তো বটেই, চেনা ছবিকে নতুন করে চিনিয়ে দেয়াই কি কবি ও ছড়াকারের কাজ নয়? তাই তো এক খুকুমণিকে দেখি, ছবি আঁকার নেশায় যে অনেক রাত অবধি ঘুমাতেও যায় না। কী আঁকে সে? আঁকে : দোয়েল শাপলা কুলো ফিতে দেশলাই/ চশমা তালের পাখা ঘুড়ি ও নাটাই। কিন্তু আঁকিয়ে ভুলেই গেছে নাওয়া খাওয়া ঘুম/ এখন গহীন রাত নিশুতি নিঝুম। মা তাকে তাড়া দেন শুতে যাওয়ার জন্য। শেষে খুকু আর কী করে। গাঁইগুঁই করে খুকু, আঁকবেই আরো/ শেষমেশ শুতে যায়, বেজে গেছে বারো।
এই খুকুটি আমাদের অচেনা নয়। কিন্তু ছড়ার ছন্দে সে যেন নতুন করে হাজির হলো আমাদের সামনে। আমরা তাকে দেখে চমৎকৃত হলাম।
আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এমন একটি অনুষঙ্গও ছড়ার ছন্দে ধরেছেন হাসান হাফিজ। সেটি পালের নাও। ইঞ্জিনচালিত নৌকার দাপটে হারাতে বসেছে এই নৌকাটি। কিন্তু নদী থেকে উৎখাত হলেও ছড়া থেকে কে তাকে উৎখাত করবে? ছড়ার ছন্দে বহু-বহুকাল এই নৌকার স্মৃতি মানুষকে কাতর করবে : নৌকা নতুন রঙিন ছই/ পথ বাকি আর সামান্যই।
তবে পালের নাও হারিয়ে গেলেও মানবজাতি থেমে থাকবে না। পৃথিবী নামের এই গ্রহ ছাড়িয়ে সে ছুটে যাবে গ্রহান্তরেÑ সে কথাও জানেন ছড়াকার হাসান হাফিজ। সেই স্বপ্ন দেখানও তিনি : মঙ্গল নয় দূরের গ্রহ, আয় সেখানে যাই/ তৈরি আছে নীল নভোযান, সময় হাতে নাই। কেন যাবেন মঙ্গলে? যাবেন কারণ : এই দুনিয়া দূষণভরা/ এইখানে শোক দুঃখ জরা/ লেগেই আছে ঝুট ঝামেলা ..।
আসলেই। এখানে ঝুটঝামেলার শেষ নেই। এখানে আছে মন্দ ও ভালোর দ্বন্দ্ব, আছে যানজট, আছে ঘাতক ট্রাক। কারই বা ভালো লাগে এসব? তাই হাসান হাফিজ স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্ন দেখান : স্বপ্নে যদি পাই কখনো/ মেঘমেঘালির পাখা... উড়াল দেবো কোন সুদূরে/ ভিন ঠিকানায় অচিনপুরে...।
কিন্তু অচিনপুরে যাওয়ার উপায় কি আছে? আছে, আছে। হাসান হাফিজের ছড়া সে পথ দেখাতেও ভোলেনি। সেখানে যাওয়ার একমাত্র বাহন হলো ছড়ার গাড়ি। কেমন সেই গাড়ি? দেখা যাক একটুখানি : ছড়ার গাড়ি/ রঙ বাহারি/ খুব সহজেই/ দূরের পাড়ি/ ছড়ার গাড়ির সচল চাকা/ পথ যতো হোক/ জটিল বাঁকা/ পাখনা মেলে / পেছন ফেলে/ যাচ্ছে দূরে/ অচিনপুরে। ...
হাসান হাফিজ এভাবেই ছড়ার গাড়িতে করে পাঠকদের নিয়ে যান অচিনপুরে, যেখানে আছে, কবিগুরুর ভাষায়, বিবিধ বর্ণে রঞ্জিত, বায়ুস্রোতে যদৃচ্ছ ভাসমান মেঘমালা। যেখানে কোনো অভাব নেই, কষ্ট নেই, সেই কল্পনার দেশে।
অবশ্য এর মানে এই নয় যে, হাসান হাফিজ কেবলই কল্পনার জগতে নিয়ে যান। বরং বেশির ভাগ সময় তিনি বাস্তবেই ঘোরাঘুরি করেন। আমাদের পরিপার্শ্বের নানা অসঙ্গতিকে কখনো সরাসরি, কখনো বা ভিন্নমাত্রায় ছড়ার ভাষায় দেখিয়ে দেন। হাসান হাফিজের ছড়ার সাথে যারা পরিচিত, তাদের কাছে এ কথা বলা বাহুল্যমাত্র।
কাজেই বাহুল্য বর্জন করে একটা কথা বলে আলোচনার ইতি টানা যায় যে, কবি হিসেবে যেমন, ছড়াকার হিসেবেও তেমনই সফল হাসান হাফিজ। কবি বলে ছড়াকে তুচ্ছ ভাবেননি তিনি, এখনো নিয়মিত লিখেই চলেছেন। তার কলম সতত সচল থাকুকÑ এটাই কামনা; আন্তরিকভাবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement