২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘এয়া’ ও মনস্তাত্ত্বিক দিক

-

আমার ব্যর্থতাগুলো গভীরভাবে সফল/ আতঙ্কের চাষাবাদে ভরপুর/ জাগিয়ে তুলতে পেরেছে নদীর বুকভরা হাহাকার/ খেলার মাঠ থেকে শিশুদের তাড়িয়েছে মহানন্দে/ মায়া হরিণকে উলঙ্গ করছে বীভৎস নির্মমতায়/আমার ব্যর্থতাগুলো এক একটি উদ্ভট রঙ প্রসব করে/ আমি নিতে চাই না/ ফেলানী, তনু, সাত খুন, বিশ্বজিৎ, সাগর-রুনি, হজরত আলী, আয়েশা, হোলে আর্টিজানকেও আমি মানি না। (আমার ব্যর্থতাগুলো গভীরভাবে সফল)
জুননু রাইন। হৃদয়ে দাগ কাটা ওপরের কথামালাগুলো তারই নিপুণ হাতের অনবদ্য সৃষ্টি ‘এয়া’ কাব্যগ্রন্থের অংশবিশেষ। জুননু রাইন সমকালীন তরুণ কবিদের মধ্যে অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল একজন শক্তিমান মেধাবী কবি। ‘এয়া’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে যিনি ইতোমধ্যে আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে যথেষ্ট সাড়া ফেলে দিয়েছেন। তার কবিতা বাংলা সাহিত্যে সংযোজন করেছে ভিন্ন মাত্রিক ধারা ও রূপ। কবিতাকে দিয়েছেন পূর্ণতা। মানুষের অন্তরের চিন্তা-চেতনা যখন ভাবানুভূতির বর্ণবৈচিত্র্যে যথোপযুক্ত শব্দবিন্যাসে সুবিন্যস্ত চিত্রে ও ছন্দিত বিন্যাসে উপস্থাপিত হয় তখনই সে হয়ে ওঠে কবিতা। কিংবা আরেকটু ঘুরিয়ে বললে, মানুষের ভাবাবেগের প্রকাশ যেমন কবিতা, তেমনই ভাবাবেগের সমব্যথিও কবিতা। যেটা আমরা কবি জুননু রাইনের কবিতাগুলোতেও বেশ ভালোভাবে দেখতে পাই।
আমরা জানি কবিতা মানেই একটি জীবন। কবিতা একটি জাতি। কবিতা একটি দেশ। কবিতাই একটি পৃথিবী। যে জীবনে কবিতা নেই সে জীবন নিরানন্দ-বিতান। যে জাতির কবিতা নেই সে জাতি উন্নত জাতি নয়। যে দেশ কবিতাহীন সে দেশে ভালোবাসা থাকে না। যে পৃথিবী কবিতামুক্ত সে পৃথিবীতে মানুষ বসত করতে পারে না। কবিতাই সুন্দরের শ্রেষ্ঠ উপমা। কবিতার মতো শোভনীয় সুন্দর আর কিছু হয় না। কবিতার জৌলুশ যে রপ্ত করেছে সেই প্রকৃত মানুষ। তাই এই কবিতাকে একেকজন আবার একেকভাবে ফেঁদেছেন, তাদের স্বকীয়তা ও যোগ্যতার মাপকাঠিতে সুবিন্যস্ত করার মধ্য দিয়ে বিদগ্ধ পাঠকসমাজের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে গেছেন, যাচ্ছেন। কিন্তু কবি জুননু রাইন যেন পণ করে নেমেছেন কোনো গলদ-গলতি বা ভুলচুক নয়, বরং গতানুগতিক ধারার বাহিরে একটু ভিন্নপথে হাঁটার, নিজেকে পরিচালিত করার শপথ নিয়েছেন। একজন পাঠকের জায়গা থেকে আমি বলব, এ ক্ষেত্রে তিনি অনেকাংশে সফল হয়েছেন। যদিও কবিতার অনেক সুদীর্ঘ পথ। আর কোনো পথই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। অনেক খানাখন্দ, কণ্টক বিস্তৃত পথে পা ফেলতে হয় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে।
এয়া সিরিজের ৩৭টি কবিতা রয়েছে, এছাড়াও স্থান পেয়েছে আরো ১৭টি অনবদ্য স্বতন্ত্র কবিতা। মৌলিক বিষয়বস্তু বিবেচনায় প্রতিটি কবিতা পাঠককে ভাবুক হৃদয়কে নিঃসন্দেহে নাড়া দেবে। মোদ্দাকথা বাছাইকৃত জনপ্রিয় মোট চুয়ান্নটি কবিতার সঙ্কলন ‘এয়া’। কবিতার বিষয়বস্তুতেও রয়েছে বৈচিত্র্যে ঠাসা। প্রতিটি কবিতায় বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে মানবজীবনের সম্পর্কের রসায়ন, জটিলতা, প্রেম ও প্রকৃতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও সমসাময়িক প্যাট-প্যাটার্ন নির্ভর নানান ঘটনার ইতিবৃত্ত। একটি কবিতায় কবি অমোঘ মৃত্যু নিয়ে লিখেছেন, মৃত্যুর হৃদয়ে সূর্যাস্তের লাল দাগ নেই/ নেই হারানোর চিৎকারে কম্পনও/ তবু তাকে মৃত্যু বলতে/ আমার অনীহাকে অদৃশ্য হুমকি আছে/আমি আজরাইল দেখিনি প্রভু,/ক্রসফায়ার দেখেছি (জীবন)। ক্রসফায়ার নামক মৃত্যুর বিভীষিকাময় জীবনের ভয়াল নৃশংসতার চিত্র উঠে এসেছে কবির কবিতায়। প্রতিটি কথা হৃদয়ে দাগ কাটার মতো।
জুননু রাইনের কবিতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পাঠককে চুম্বকের মতো ধরে রেখে তাদের ভেতরের সুন্দর কবিত্বকে টেনে বের করে নিয়ে আসতে পারা। যেখানে কবিতা ও কাহিনীর চিত্রকল্পগুলো একইসাথে জীবন্ত প্যারালাল দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। তার কবিতায় ত্রিকাল (অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ) ফুটে ওঠে সহসায়। এয়া’খ্যাত কবি জুননু রাইনের সৃষ্ট কবিতা অনিবার্য সত্য ও রূঢ় বাস্তবতা। সুতরাং এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, বিদগ্ধ পাঠক সমাজকে একবার হলেও ভাবতে বাধ্য করবে ‘এয়া’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো।

 


আরো সংবাদ



premium cement