১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উত্তুরে হাওয়া

-

উত্তুরে বাতাসে মন উচাটন করা এক মাদকতা মিশে থাকে।
গাছে গাছে পাতায় পাতায় কিসের যেন অজানা শিহরণ! সদ্য যৌবনার মতো রহস্যময় ভীরু পদচারণ... ফিসফিসিয়ে কানাকানি।
তার অকারণে হেসে লুটিয়ে পড়া ঝঙ্কারের মতোই ব্যস্ত হাওয়ারাও শব্দ তোলে শনশন... শনশন...
সেই শব্দের সাথে ভেসে আসে হারিয়ে যাওয়া প্রিয় কোনো মুখ। খুলে যায় লুকিয়ে রাখা স্মৃতির সিন্দুক।
গফুর মাস্টার শীতের এই হাওয়াটিকে ভীষণ রকম ভয় পায়।
একে তো স্মৃতি নিয়ে টানাহেঁচড়া চলতে থাকে মনের ভেতর, তার ওপরে বয়স্ক হাড়ে হিড়হিড়ে ঠাণ্ডাটা একেবারে কেটে কেটে বসে যায়। লেপের ওমেও শরীর যেন সবটুকু উষ্ণতা খুঁজে পায় না। ঘাপ্টি মেরে বিছানায় পড়ে থাকে ঠিকই, তবু নিস্তার মেলে না শীতের আগ্রাসী ছোবল থেকে।
দিনের বেলাতে উত্তুরে বাতাসকে অবজ্ঞা করেই কাজে বেরোতে হয়।
বিলের রাস্তাটা দিয়েই প্রতিদিন আসা-যাওয়া করেন তিনি। কচুরিপানারা সারি বেঁধে মানববন্ধন করতে করতে নিজেদের সাম্রাজ্য বানিয়ে ফেলেছে পুরোটা খাল। সেদিকে তাকিয়ে থই মেলে না পানির গভীরতার।
খাল পার হওয়ার বাঁশের সাঁকোটা বড় বেশি নড়বড় করে এখন। অথচ ছেলে-ছোকরাগুলো বইখাতা শুদ্ধ কেমন তরতর করে হাসতে হাসতে পার হয়ে যায় সেই বাঁশের সাঁকো!
তিনি বুঝতে পারেন, সাঁকো নড়বড়ে হয়নি। নড়বড়ে হয়েছে তার শরীরের কলকব্জাগুলো। কাজের ধকলে বিদ্রোহ শুরু করেছে তারা। কম তো চড়াই-উতরাই পার হতে হয়নি তাদের এত দিন!
এই সামনের ডিসেম্বরেই জীবনের পঞ্চান্নটা বছর পুরো হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে ধেয়ে চলেছেন অবসরের দিকে। এই তো... আর মোটে ক’টি বছর!
অথচ মনে হয় এই তো সেদিন!
নতুন চাকরি পেয়ে বাবা-মাকে মিষ্টিমুখ করালেন। খুশিতে নাকফুল নাচিয়ে নাচিয়ে মায়ের বলা সেই কথাগুলো আজো কেমন কানে ভাসে,
“এই অঘঘান মাসেতই পোলার বিয়া দিয়া দিমু হামি। বুড়া বসত হাত পুড়াইয়া আর রান্ধবার যামু না! পোলার বউ আইয়া রাইন্ধা-বাইড়া হামাক খাওয়াক ক’ডা দিন!”
এমনই তার পোড়া কপাল!
ছেলের বউয়ের হাতের রান্না খাওয়াও বেশিদিন কপালে জুটলো না। হাত পুড়িয়ে সেই তাকেই আজো রান্না করে যেতে হচ্ছে।
হাড় জিরজিরে শরীরটা নিয়ে তিনি আজ অবধি টিকে রইলেন, অথচ ছেলের বউ-সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে অকালেই পরপারের পথে রওনা দিয়ে দিলো।
স্বামী খুইয়েছেন আরো আগে, নাতিপুতি নিয়ে ভর-ভরান্তি সংসার দেখে যাওয়ার প্রকাশ্য আকুতি আর কখনোই সত্যি হলো না তার।
হাজার অনুনয়েও তার গফুর আর বিয়ে করতে রাজি হলো না।
সন্তান বেঁচে থাকলে হয়তো তার প্রয়োজনেও অন্য কাউকে ঘরে আনার দরকার পড়ত। কিন্তু সেই দায়টুকুও বউ তার নিজের কাঁধে নিয়েই চলে গেল... মৃত সন্তান প্রসব করে।
গফুর মাস্টারের বউটি ছিল ভারি লক্ষ্মী। দিনমান চড়ুইপাখির মতো তিড়িংবিড়িং করে সংসারের কাজ করত। শাশুড়ি আর বরের ছোটখাটো তিরস্কারে মুখ লুকিয়ে হাসত। অথচ সেই মানুষটিই আবার বাপের বাড়ির কথা ভেবে কেঁদে বালিশ ভেজাত।
কতই বা বয়স ছিল বেচারীর! সেই বয়সেই বাপের বাড়ি ছেড়ে আসার শোক সে ভুলতে পারত না। গফুর মাস্টার খুব ভালোবাসত তার পাগলী বউটাকে।
শখের জিনিসপাতি কিনে এনে চুপিচুপি কোথাও লুকিয়ে রেখে দিত। মেলা থেকে ভাজা, গজা কিনে এনে গৃহকর্মরতা বউয়ের শাড়ির আঁচলে গিঁট বেঁধে দিত।
হঠাৎ চোখে পড়ে গেলে বউয়ের চোখে মুখে সে কী খুশির ঝিলিক! দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কিছুক্ষণ পাক খেয়ে নিত। কখনো বা লাজ শরম ভুলে স্বামীকে এসে জড়িয়ে ধরত। কী সব যে করত পাগলী!
গফুর মাস্টার মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখত সেই ছেলেমানুষি পাগলামি।
চার বছরের মাথায় বউটা পোয়াতি হলো।
দেরি হতে দেখে গফুর মাস্টারের মা শিকড়-বাকড় নিয়ে এসে খাইয়ে মারতে লাগল বেচারীকে। বউটাও কোনো কথা না বলে চুপচাপ শাশুড়ির নির্দেশ মানতে লাগল। মনে অগাধ আস্থা, হয়তো ভালো কিছুই হবে!
শিকড়-বাকড়ের গুণেই হোক অথবা অন্য কিছুর গুণেই.... চার মাসে শুকনো গাছে ফুল ধরল।
শাশুড়ির খুশি দেখে কে! পাড়া-প্রতিবেশী একত্রিত হয়ে খুশির গীত গাইতে বসল। সুখের পায়রা উড়ে বেড়াতে লাগল এখানে-ওখানে।
সে সুখ বেশিদিন সইলো না। সব আলো মুছে গিয়ে অন্ধকারে ছেয়ে গেল চার দিক।
দিন গেল, মাস গেল... দেখতে দেখতে বছরও ঘুরে এলো।
ঘরে ঘোমটা টানা নতুন কোনো মুখ এলো না আর।
মায়ের ঘ্যানঘানানিতে অতিষ্ঠ হয়ে গফুর মাস্টার ক্ষেদ জানাত,
‘হ্যাক কি তুমি এনাও ভালোবাসবার পারোনি? এত জলদি ভুলা গ্যালিন? কেউ ছিল না হ্যায় তুমার?’
মা আঁচলে অশ্রু গোপন করত।
তার অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া দৃষ্টি যতদূর দেখতে পেত, পুত্রের রঙিন পর্দা আঁটা চোখ তা আর দেখতে পেত কই?
সেই ধূসর সময়টাও একদিন অতীত হয়ে গেল। গফুর মাস্টারের বিয়ে করার বয়সও আর পড়ে রইল না।
গফুরের মায়ের ভরভরান্তি সংসারের স্বপ্নটাও এক সময় চোখের আড়ালেই চাপা পড়ে গেল। বৃদ্ধা মায়ের ছানিপড়া চোখে এখন শুধুই সুদূরের প্রতীক্ষা।
স্কুল থেকে ফিরে মায়ে-ছেলেতে গল্প করতে করতে বেলা পার হয়ে যায়। একসময় গল্প ফুরোয়, দুয়ারে ওঠে সাঁঝের বাতি।
বিকেলের দিকে ঘরদোর আর উঠোন ঝাঁট দিতে কুমুদ আসে। বিশ-বাইশ বছরের ছটফটে তরুণী।
দুধের শিশুটিকে ঘরে ফেলে রোজ কাজে আসে। তাই সব কাজেই অহেতুক ছটফটানি, দৌড়ঝাঁপ। উঠানের এক কানা ঝাঁট দিয়েই দৌড়ে কলপাড়ে গিয়ে কাপড় কাচতে বসে। ভরসন্ধ্যায় ভেজা কনকনে কাপড়গুলো উঠানে বেঁধে রাখা দড়ির ওপরে ঝুলতে থাকে।
গফুর মাস্টারের মা তাই দেখে চেঁচামেচি করতে থাকে,
‘কদ্দিন কছি তরে বিয়ান থাকতে থাকতেই চলে আসিস! এই বিক্কাল বেলাত কুন বাড়িত কাপড় ধোয়? যত্তসব অনাছিস্টি কাইজ কারবার হামার বাড়িত!’
জানালার ফাঁক দিয়ে গফুর মাস্টার তাকিয়ে তাকিয়ে মেয়েটির দৌড়ঝাঁপ দেখে। চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেঁথে যায় অনন্তযৌবনা নারীদেহের অপার রহস্যের মাঝে।
সন্তান প্রসবের পরের ভরন্ত যৌবনা শরীর। সেই শরীরের আঁকেবাঁকে গর্জে ওঠা ভরা জোয়ারের উচ্ছ্বাস। অকারণেই সেই জোয়ারের ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কখনো বা বশ মানতে নারাজ বেহায়া অসভ্য দৃষ্টির সামনে মুখ থুবড়ে লুটিয়ে পড়ে।
বেসামাল পদক্ষেপে স্খলিত বেপরোয়া আঁচল অবজ্ঞা অনাদরে লুটাতে থাকে মাটিতে। একরাশ ঘন কেশের মেঘমালা সাপের মতো ফণা তুলে ছোবল মারতে আসে... জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকা কোনো স্থির ঘোরলাগা দৃষ্টিকে।
গফুর মাস্টারের মা চাপাগলায় হিসহিস করে,
‘পিন্ধনের কাপড় সামলাইবার পারোস না পোড়ামুখী! দূর হ সামনে থিইক্যা!’
মায়ের চেঁচামেচি, কুমুদের নেচে নেচে সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়ানো... এসবের মাঝেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে পড়ে।
তারপরে আবারো আসে শীতার্ত জমাট রাত।
কনকনে উত্তুরে হাওয়ারা বন্ধ জানালার ওপারে সবেগে কড়া নাড়তে থাকে। সেই শব্দে কানে ঝাপ ধরে যায়।
গফুর মাস্টার সপ্ত ইন্দ্রিয়ের ঘরে তালা মেরে তীব্রভাবে লুকিয়ে থাকে লেপের গহ্বরে।
বাইরে তখন হাওয়াদের মাতম লেগেছে!


আরো সংবাদ



premium cement