২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সৈয়দ মুজতবা আলী ; তাঁর বহুমাত্রিকতা

-

সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন একজন প্রতিভাধর মানুষ। তাঁর প্রতিভা ছিল বহুমাত্রিক। সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর প্রতিভা সর্বজনবিদিত। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতার পাশাপাশি তিনি বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য রচনাশৈলীর প্রবর্তক। সৈয়দী ঢং নামে একে অনেকেই চেনেন। এই গুণের জন্য কেউ কেউ তাকে রম্য লেখক পরিচয়ে সীমাবদ্ধ করতে চান। কিন্তু তিনি শুধু রম্য লেখক নন। শুধু সাহিত্যিকও নন। তিনি শিক্ষাবিদ, গণমাধ্যম শিল্পী এমনকি বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের এক দার্শনিক ছিলেন। তাঁর জাতীয়তাবাদ চিন্তার সাথে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পার্থক্য ছিল না।
সৈয়দ মুজতবা আলীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় সুনামগঞ্জ জুবিলি স্কুলে। তারপর মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে এবং তারপর সিলেট শহরের সরকারি স্কুলে। ভালো ছাত্র হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল। কিন্তু ইংরেজ নিয়ন্ত্রিত এসব স্কুলের শিক্ষাপদ্ধতি তাকে টানেনি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে বিশ্বভারতীতে শিক্ষা লাভ করে তিনি তৃপ্তি লাভ করেছেন। এরপরে ভর্তি হয়েছেন আলীগড়ে। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ তাকে মুগ্ধ করেনি। সেখান থেকে পড়াতে যান কাবুলে। আফগানিস্তানে অভ্যুত্থান হলে তিনি হুম্বোল্ট বৃত্তি নিয়ে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যান। সেখান থেকে মিসরের কায়রোতে আল আজহার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু দিন শিক্ষালাভ করেন। এরপর আবার বরোদার মহারাজের আমন্ত্রণে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের শিক্ষক নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে দেশভাগের পরে তিনি বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে কিছুদিন অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার শিক্ষাজীবন ও শিক্ষক জীবন বিচার করলে দেখা যায়, তিনি কখনই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। আর সে কারণের কোথাও থিতু হননি বেশি দিন।
সৈয়দ মুজতবা আলী ভারতীয় বেতারমাধ্যম আকাশবাণীতে কাজ করেছেন। আনন্দবাজারসহ বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখেছেন। গণমাধ্যমের বিভিন্ন দিক তিনি বুঝেছেন দরদ দিয়ে।
এই কাজকে তিনি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।
বাংলাদেশের ভ্রমণ সাহিত্যে ভিন্ন ধারার প্রবর্তক ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। ‘নিতান্ত বিপদে না পড়লে আমি আপন গাঁ ছেড়ে যেতে রাজি হইনে। দেশ ভ্রমণ আমার দু’চোখের দুশমন। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন আপন ভূমির গান গেয়ে ওঠেন তখন আমি উদ্বাহু হয়ে নৃত্য আরাম্ভ করি।’ এ কথাটি বলেছেন তিনি। সুযোগ পেলেই বলতেন ভ্রমণে তার কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু সেটা ছিল নিছকই তার বিনয়। জন্মের পর থেকেই তিনি ভ্রমণ করেছেন। সারাজীবনই ছিলেন এ ব্যাপারে অক্লান্ত। জন্মপর্যটক এ লেখক কোথাও বেশি দিন থিতু হতে পারেননি। কর্মজীবনেও কোথাও স্থায়ী হননি। ভ্রমণ বিমুখতায় তিনি গুরুদেবের দোহাই দিলেও বাস্তবে রবীন্দ্রনাথ এবং তার শিষ্য মুজতবা আলী দুজনেই ভ্রমণকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। তাদের লেখক জীবনে এবং রচনাশৈলীতেও পড়েছে তার গভীর প্রভাব। ভ্রমণ তার শুধু কায়িক ছিল না। মানস ভ্রমণেও মুজতবার তুলনা ভার। তিনি দেশের কোনো কিছুর বর্ণনা দিতে গেলেই সেখানে অবলীলায় বিদেশী প্রসঙ্গ টেনে আনেন। আবার কায়রোয় বসে তার প্রাণ কাঁদে চারটে আতপ চাল, উচ্ছে ভাজা, সোনা মুগের ডাল, পটোল ভাজা আর মাছের ঝোলের জন্য।
মুজতবা আলীর লেখা প্রথম বইটিই ছিল ‘দেশ-বিদেশ’। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ধারাবাহিকভাবে ‘দেশ’ পত্রিকায়। সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তার সম্পাদকের বৈঠকে গ্রন্থে ‘দেশেবিদেশে’র বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি সুন্দর স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি একে ভ্রমণকাহিনী বলেই অভিহিত করেছেন। শ্রীঘোষ তার অফিসের কক্ষে সদ্যপাওয়া দেশে বিদেশের পাণ্ডুলিপি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। তখনো সেটি দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। আড্ডার বন্ধুরা তার এই মনোযোগে বিরক্ত হতেন। একজন কথাশিল্পী একদিন বলেই বসলেন, ‘রাবীন্দ্রিক হাতের লেখা যে বিরাট পাণ্ডুলিপিটার ওপর আপনি এতক্ষণ হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছিলেন সে বস্তুটি কী জানতে পারি?’ ‘ভ্রমণ কাহিনী’। আমার কথা শুনে সব্যসাচী-সাহিত্যিক গাল্পিক সাহিত্যিককে একটু ভরসা দেয়ার সুরে বললেন ‘যাক বেঁচে গেলেন। উপন্যাস তো নয়। উপন্যাস হলেই ভয়। আবার একজন প্রতিদ্বন্দ্বী দেখা দিলো।’ আমি বললাম নাই বা হলো উপন্যাস। এ লেখার জাতিপাঁতি স্বতন্ত্র। উপন্যাস এর ধারে কাছে লাগে না। দশ জোড়া বড় বড় চোখে এক রাশ বিস্ময় ভরা প্রশ্ন জেগে উঠল ‘লেখকটি কে?’ আপনারা চিনবেন না। সৈয়দ দা। লেখকরা যাকে সে দিন চিনতে পারেননি প্রথম লেখা ভ্রমণ কাহিনী দিয়েই মুজতবা আলী বাংলাসাহিত্যে তার আসনটি পাকা করে নিয়েছিলেন।
‘দেশে বিদেশে’ কোনো বাস্তবতাবিবর্জিত কাহিনী নয়। এটা লেখকের আফগানিস্তানবাসের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল। ১৯২৭ সালে তিনি আফগানিস্তানের শিক্ষা বিভাগে চাকরি লাভ করেন। কাবুলের কৃষি বিজ্ঞান কলেজে মাসিক দুই শ’ টাকা বেতনে ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার প্রভাষক নিযুক্ত হন। বছর না যেতেই কাবুলের শিক্ষা বিভাগ মুজতবা আলীর জার্মান ভাষায় গভীর জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে তার বেতন বাড়িয়ে তিন শ’ টাকা করেন। এতে পাঞ্জাবি শিক্ষকরা ঈর্ষাকাতর হয়ে শিক্ষা সচিবেরর কাছে গিয়ে বলেন, সৈয়দ মুজতবা আলীর ডিগ্রি হচ্ছে বিশ্বভারতীর। সেটা কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়। জবাবে শিক্ষা বিভাগ থেকে বলা হয়, আপনাদের সনদে পাঞ্জাব গভর্নরের দস্তখত আছে। আমাদের এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রেও গভর্নরের অভাব নেই। কিন্তু মুজতবা আলীর সনদে দস্তখত করেছেন স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর। আর তিনি পৃথিবীর কাছে সারা প্রাচ্য দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।
তবে আফগানিস্তানের পটভূমিতে শুধু দুই খণ্ড ‘দেশে বিদেশে ’ নয়, ‘শবনমের’ মতো কালজয়ী উপন্যাসও লিখেছেন মুজতবা আলী। তার বিভিন্ন রচনায় ঘুরে ফিরে এসেছে আফগানিস্তানের প্রসঙ্গ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই অভিজ্ঞতা প্রকাশে তিনি সময় নিয়েছেন অনেক বেশি। কিশোর বয়সে হাতে লেখা ‘কুইনিন’ পত্রিকার মাধ্যমে যার সাহিত্যচর্চার হাতে খড়ি, তিনি রীতিমতো পরিণত বয়সে গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর আগে তার যে পাঁচটি প্রবন্ধের সন্ধান পাওয়া গেছে সেগুলি ঠিক মুজতবা সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করে না। লক্ষণীয় যে, রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় গুরুদেবের কাছ থেকে উৎসাহ পাওয়ার পরও মুজতবা আলী সাহিত্য চর্চার ব্যাপারে কিছুটা কুণ্ঠিত ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর দেশেবিদেশে প্রকাশিত হয় এবং সাহিত্যাঙ্গনে তিনি প্রথম বইটি দিয়েই অক্ষয় প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
বাস্তব অভিজ্ঞতার কারণে ‘দেশে বিদেশে’র একটি প্রামাণ্য মূল্যও আছে। তবে লেখক একে সাল তারিখ দিয়ে তথ্য ভারাক্রান্ত করতে চাননি। সাল তারিখ না দিয়ে তিনি একে প্রতীকী করে তোলার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন। দেশ সমাজ ও মানুষের বিবরণ এলেও এর কাহিনী হয়ে গেছে কাল নিরপেক্ষ। তবে এতে রস ক্ষুণœ না হয়ে আরো বেড়েই গেছে বলা চলে। তার ভাষায় বৈদগ্ধ্য আছে। পাণ্ডিত্য আছে। কিন্তু সেটা অহেতুক জটিলতা সৃষ্টি করে না। সে কারণে সাধারণ গল্প উপন্যাস যখন পাঠকের কাছে একঘেয়ে মনে হচ্ছিল তখন এরকম রম্য বর্ণণায় তত্ত্ব কথা ও ভ্রমণের আনন্দ পেয়ে পাঠক এই বইটি লুফে নেয়।
মুজতবা আলীর সবচেয়ে বড় অবদান বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের দার্শনিক চিন্তা। স্কুল জীবনেই তিনি স্বাধিকার চেতনা থেকে সরকারি স্কুল বর্জন করেছিলেন। বিপদে ফেলেছিলেন তার সরকারি চাকরিজীবী বাবাকে। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশ মাতৃকার মুক্তির কথা ভেবেছেন বারবার।
তার বিভিন্ন লেখায় এসেছে সে কথা। যেমন, ছোট গল্পে লিখেছেনÑ পণ্ডিত মশাই তার ছাত্রদের কাছে প্রশ্ন করেছেন। বিলিতি সাহেবের পা অলা কুকুরের পেছনে যে টাকা খরচ হয় প্রতি মাসে, শিক্ষকের বেতন তার তিন ভাগের এক ভাগ। তার মানে দেশী শিক্ষকের পরিবার ওই কুকুরের একটা পায়ের সমান। দেশ ভাগের মাত্র তিন মাসের মাথায় তিনি সিলেটে এসে ঘোষণা করলেন বাংলাকেই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। এ নিয়ে পাকিস্তান আমলে সরকারি দমন-নিপীড়নের শিকার হতে হলো। বাধ্য হয়ে তিনি চলে গেলেন ভারতে। সেখানে তিনি বাঙালির জাতীয়তাবাদ ও মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে লেখালেখি করেন। তিনি একা ছিলেন ভারতে, আর তার পরিবারের সব সদস্য পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর পরিবারের অনেক সদস্য তারই অনুপ্রেরণায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ভ্রাতুষ্পুত্র সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী একজন কূটনীতিবিদ হিসেবে পাকিস্তান সরকারের চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। তাঁর ভাগ্নে মাহবুব উর রব সাদী মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার হন এবং বীরত্বের জন্য বীর প্রতীক খেতাব লাভ করেন। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি নির্মাতাদের তিনি একজন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ফিরে এসেছিলেন মাতৃভূমিতে। বাংলাদেশের মাটিতেই আজিমপুর গোরস্থানে ভাষা শহীদদের পাশে শেষশয্যা হয়েছে তাঁর।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল