২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শোকার্ত মানুষের বেদনাবোধ

-

মানব সমাজে প্রতিটি মুহূর্তেই কোনো না কোনো মানুষ শোকাহত হয়ে পড়ছে। কারো বাবা মারা যাচ্ছে, সে শোকাহত হচ্ছে। কারো মা মারা যাচ্ছে, সে শোকাহত হচ্ছে। কারো সন্তান মারা যাচ্ছে, সে শোকাহত হচ্ছে। কারো স্ত্রী-পুত্র মারা যাচ্ছে, সে শোকাহত হচ্ছে। সাধারণত শোকরস মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ঘনীভূত হয়। অর্থাৎ যেখানে মৃত্যু আছে, সেখানে শোকও আছে। আপনজন, প্রিয় মানুষ, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের মৃত্যু ঘটলে মৃত্যুজনিত বিয়োগবেদনায় মানুষ শোকাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে, বিহ্বল হয়ে পড়ে। প্রিয়জনের আসনটি শূন্য হলে মানুষের মনের গহীনে প্রিয়জনের ভবিষ্যৎ অনুপস্থিতি ভেসে উঠতে থাকে। তখন মনের মণিকোঠায় এক ধরনের হাহাকারের সৃষ্টি হয়; হাহাকারের এই অনুভূতিকেই শোকসন্তপ্ত বলা হয়ে থাকে। নিজের মৃত্যু কল্পনা করে মানুষ অস্থির হয়ে ওঠে; মৃত্যু মেনে নিতে পারে না এবং প্রিজনের মৃত্যুকেও মানুষ সহজে মেনে নিতে পারে না। পারে না বলেই মনের মধ্যে তৈরি হয় আফসোস; মানুষ অনুভব করতে থাকে এক প্রকারের নিঃসঙ্গতা, হতাশা ও বেদনা। প্রতিনিয়ত যাকে অনুভব করা যায়, এমন মানুষের মৃত্যু হলে শোকের বেদনা তীব্র আকার ধারণ করে। তখন কোনো কোনো মানুষ অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে; কাতর হয়ে ওঠে। শোক আরো গভীর ও তীব্র হলে মানুষ পাথরের মতো নিঃস্তব্দ হয়ে যায়। সে জন্য বলা যেতে পারে মৃত্যু না হলে যেমন শোক হয় না, তেমনি ভালোবাসা না থাকলেও শোকাহত হওয়া যায় না। ভালোবাসা যত গভীর হয়, শোকের বেদনাও তত অসহনীয় হয়। যাকে ভালোবাসা যায় না, এমন মানুষের মৃত্যু হলে শোকাহতও হওয়া যায় না। কাজেই শোকাহত হওয়ার বিষয়টি কখনো কখনো আপামর হয়ে উঠতে পারে না। আবার শোকাহতের বিষয়টিও কোনো বাইরের বিষয় নয়। এটি মানুষের অভ্যন্তরে মনের অবস্থাগত একটি বিষয়। বাইরে ঘটা করে যতটা শোকবেদনা প্রকাশ করা হয়, ততটা বেদনা মানুষের মনের মধ্যে নাও থাকতে পারে অথবা মনের ভেতরে যতটা বেদনারস সঞ্চারিত হতে থাকে, সে তুলনায় বাইরের প্রকাশটা অতি নগণ্যও হতে পারে। অর্থাৎ শোকবেদনার পরিমাপটা নির্ভুল হতে পারে না।
শোকরস ঘনীভূত হয় মনের মধ্যে। সেখানে শোকবেদনা দলা পেকে ওঠে। মনের মধ্যেই শোক দীর্ঘ সময় এমনকি আজীবন বসবাস করতে পারে। কোনো কোনো শোক মনের কোঠরে সুপ্তভাবে যুগের পর যুগ জীবিত থাকতে পারে। সময়ে সময়ে সে শোক আপন মনে চাড়া দিয়ে ওঠে। শোকাহত মানুষ কোলাহল ছেড়ে নিভৃতে যখন অবসরে একাকী থাকে, তখন সেই পুরনো শোকের বেদনায় মানুষ আনমনা হয়ে চোখের কোণায় দু-এক ফোঁটা অশ্রু ঝরায়। কখনো শোক কিছু দিনের জন্য আত্মগোপন করে আবার জেগে ওঠে; এভাবে শোক বেদনাক্লান্ত হয়ে বেঁচে থাকতে পারে। কোনো কোনো শোকের আয়ু অতি অল্পবিস্তর হয়; নিমিষেই সে শোক মন্দিভূত হয়ে যায়। এমনও শোক রয়েছে, যা সময়ের ব্যবধানে স্মৃতি থেকে চিরতরে মুছে যায়। চেষ্টা করেও সেসব শোকের বেদনা অনুভব করা যায় না। ব্যক্তিবিশেষে শোক দীর্ঘ হয়, ব্যক্তি বিশেষে শোক নিমিষেই শেষ হয়ে যায়।
শোক একটি আবেগীয় বিষয়। এই আবেগকে যেমন মনের ভেতরে ধরে রাখা যায়, আবার শোককে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করতেও দেখা যায়। শোকের গভীরতা বা শোকের বেদনা তীব্র হলে এই তীব্র শোক সইতে না পেরে অনেক মানুষ স্থবির হয়ে পড়ে, কেউ উন্মাদও হতে পারে; কেউ সংসারত্যাগী হয়ে সন্ন্যাস জীবনকে বেছে নিতে পারে কিংবা সংসারে থেকেই কেউ সংসার নিয়ে উদাসীন থাকতে পারে। অন্য দিকে, শোকের বেদনা যদি অগভীর হয়, তাহলে শোকের বেদনা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে শেষ হতে পারে। অগভীর শোকবেদনা নানাবিধভাবে কৃত্রিম হতে থাকে এবং তা প্রকাশ সর্বস্ব হয়ে শোকসভা, শোকগাথা, শোকর্যালি, পোস্টার, ব্যানার, পত্রিকার বিজ্ঞাপন ইত্যাদির ওপর আশ্রয় নেয়। শোক প্রকাশের এসব আশ্রয়ে অংশগ্রহণ করা মানুষকে শোকাহত হতে দেখা না গিয়ে বরং মানুষগুলোর চলাফেরা, অঙ্গ-ভঙ্গি, কথা-বার্তা, পোশাক-আসাক দেখে উৎসবে অংশ নেয়া মানুষের মতো মনে হতে থাকে। কোনো কোনো শোকর্যালিতে দা, বঁটি, খুন্তি, তলোয়ার, চাকু, ছুরিসহ যুদ্ধ যুদ্ধ সাজে যুদ্ধসরঞ্জামসহ তলোয়ার ঘুরানো এবং কৃত্রিম রক্ত মাখামাখির মতো উন্মাদনাও চোখে পড়ে। এসব দেখে সন্দেহ হতে পারে যে, শোকবেদনা আজ আনন্দোৎসবে পরিণত হতে চলেছে। শোক প্রকাশের এ দৃশ্য শোকবেদনার অন্তসারশূন্য অবস্থাকে প্রকাশ করে কি না সেটাও মনে হতে পারে।
প্রতি বছর মহররম মাস এলে বাংলাদেশে এক ধরনের শোকের মাতম লক্ষ করা যায়। মহররম মাসে যে শোক প্রদর্শিত হয়, সে শোককে আরবি ভাষায় মর্সিয়া বলা হয়েছে। মর্সিয়া কথাটির অর্থ দাঁড়ায়Ñ শোক প্রকাশ করা। আরবি সাহিত্যে মর্সিয়ার উদ্ভব নানা রকমের শোকাবহ ঘটনা থেকে, তবে বাংলা সাহিত্যে তা কারবালা প্রান্তরে নবী দৌহিত্র শহীদ ইমাম হোসেনকে উপজীব্য করে লেখা কবিতাকে বোঝায়। এসব কবিতাকে যুদ্ধ কবিতাও বলা হয়েছে। অর্থাৎ ইমাম হোসেনকে নিয়ে লেখা কাব্যকে মর্সিয়া সাহিত্য বলা হয়েছে। এই কবিতাগুলোও শোক প্রকাশের মাধ্যম। কবিতাগুলো পড়লে মনের মধ্যে ইমাম হোসেনের প্রতি এক ধরনের সহানুভূতি জাগ্রত হতে থাকে। এই ভাবধারার কবিতা প্রথমে আরবি সাহিত্য থেকে ফারসি সেখান থেকে উর্দু এরপর তা বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নেয়। কবিতাগুলোর জন্ম হয়েছে মধ্যযুগে। বাংলায় নবাবদের শাসন শিথিল হয়ে পড়লে ইংরেজ ও হিন্দুদের সাহিত্য প্রভাবে পড়ে মুসলমানরা। এতে মুসলিমদের ধর্মীয় জ্ঞানে ভাটা পড়ে। এ অবস্থা থেকে মুসলমানদের ফিরিয়ে আনতে কারবালার বিষাদময় ঘটনা অবলম্বনে রচনা করা হয় মর্সিয়া কবিতা। মর্সিয়া ভাবধারা অনুসৃত হয়েছে ফার্সি কবিতার আদলে। তখনো ফার্সি সাহিত্যের প্রভাব একেবারে লুপ্ত হয়নি। ফারসি সাহিত্য ছিল শিয়া মুসলিমদের দ্বারা রচিত। সে জন্য হজরত আলী ও ইমাম হোসেনের বিষয়গুলো মর্সিয়া সাহিত্যে গুরুত্বের সাথে উঠে আসে। শিয়া মুসলিমদের কাছে আলী ও ইমাম হাসান-হোসেন নবী মুহাম্মদ সা:-এর পরই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। খেলাফতের দায়িত্বে থাকা আমিরে মুয়াবিয়া শর্ত ভঙ্গ করলে মুসলমানেরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল হজরত আলীর পক্ষাবলম্বন করে এবং অন্য দল মুয়াবিয়াকে সমর্থন দেয়। মুয়াবিয়ার ছেলে ইয়াজিদ খেলাফতের মসনদে আরোহন করলে ইমাম পরিবার তার আনুগত্য মানতে অস্বীকার করে। এই অস্বীকৃতি যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়। পরিবারসহ ইমাম হোসেন শহীদ হন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হতে থাকে মর্সিয়া। মুসলিম সমাজে এর সমাদরও বাড়তে থাকে। নবী মুহাম্মদ সা:-এর ওপর মুসলমানদের ছিল অগাধ ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা থেকে নবী পরিবার অর্থাৎ হজরত আলী, ফাতেমা, ইমাম হাসান, হোসেন কেউই বঞ্চিত হয়নি। ফলে মুসলমানদের হৃদয় নবী পরিবারের প্রতি এক ধরনের টান অনুভব করে। এই টান থেকেই মুসলমানেরা আজো শোকবেদনা অনুভব করতে পারে। তার মানে এই নয় যে, শোকর্যালি বা তাজিয়া শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে উদোম শরীরে দা-কুড়াল, খুন্তি-বঁটি, তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ দৃশ্যের অবতারণা করা যায়; বুক চাপড়িয়ে আর্তনাদ করে কৃত্তিম রক্তে হোলি খেলা যায়। এসব দৃশ্যের সাথে শোকবেদনার সংযোগ ঘটে না, এতে শোকও প্রকাশ পায় না। এতে যা হয়, সেটা পুরোটাই কৃত্রিম শোকাহতদের উন্মাদনা বিলাসে পরিণত হয়। ইমাম হোসেনের সাথে ইয়াজিদের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত বেধে ছিল ইসলামী আদর্শ নিয়ে। নানার রেখে যাওয়া ইসলামী আদর্শ থেকে ইয়াজিদ ক্রমাগত বিচ্যুত হতে থাকলে খলিফা হিসেবে ইয়াজিদকে মুসলমানেরা মেনে নিতে পারছিলেন না। সঙ্ঘাতের সূত্রপাত সেখানেই হয়েছিল। যে আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে ইমাম হোসেনকে শহীদ হতে হয়েছিল, সেই আদর্শ ও হককে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যেই রয়েছে ইমাম হোসেনের প্রতি শোকবেদনা অনুভব করা এবং শ্রদ্ধা জাননোর সার্থকতা। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement
গ্যাস বিতরণে সিস্টেম লস ২২ শতাংশ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে : নসরুল হামিদ গণকবরে প্রিয়জনদের খোঁজ কক্সবাজারে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, স্বজনদের হাসপাতাল ঘেরাও বঙ্গোপসাগরে ১২ নাবিকসহ কার্গো জাহাজডুবি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশকে ‘নেট সিকিউরিটি প্রোভাইডার’ হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি রাজশাহীতে টানা তাপদাহ থেকে বাঁচতে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন মুসল্লিরা শরীয়তপুরে তৃষ্ণার্ত মানুষের মাঝে পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ জামায়াতের এক শ্রেণিতে ৫৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী নয় : শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী নজিরবিহীন দুর্নীতির মহারাজার আত্মকথা ফতুল্লায় ১০ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে নির্মাণকাজ বন্ধ, মারধরে আহত ২, মামলা

সকল