২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইবরাহিম খাঁ তাঁর বাতায়ন

-

স্মৃতিকথা, শিক্ষা-সাহিত্য-ধর্মবিষয়ক প্রবন্ধ, নাটক, ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস ও জীবনচরিত, শিশুসাহিত্য, পাঠ্যবই ও তরজমায় ইবরাহিম খাঁর (১৮৯৪-১৯৭৮) বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, নাটক ও কথাসাহিত্যবিষয়ক রচনাবলি তাঁর মৌলিক সাহিত্যকর্মের অন্তর্গত। তরজমা, নীতি ও ইতিকথার সঙ্কলন এবং পাঠ্যবই রচনা/সম্পাদনায় তাঁর রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান। তাঁর বেশির ভাগ প্রকাশিত গ্রন্থ ইতোমধ্যে দষ্প্র্রাপ্য হয়ে উঠেছে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর কোনো নির্ভরযোগ্য তালিকা না থাকায় এবং বেশ কিছু গ্রন্থ উদ্ধার করা তখনো সম্ভব না হওয়ায়, বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা ‘গ্রন্থপঞ্জি’ তালিকায় পরিপূর্ণতা ও শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে কিছুটা সংশয় প্রকাশ করা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত এবং আমার সম্পাদিত ‘ইবরাহিম খাঁ রচনাবলি’র ভূমিকায়। প্রকাশিত প্রধান প্রধান গ্রন্থের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য নাটক : কামাল পাশা ১৩৩৪, আনোয়ার পাশা ১৩৩৭, ঋণ পরিশোধ ১৯৫৫, ভিস্তি বাদশা ১৩৫৭, কাফেলা। উপন্যাস : বৌ বেগম ১৯৫৮। গল্পগ্রন্থ : আলু বোখরা ১৯৬০, উস্তাদ ১৯৬৭, দাদুর আসর ১৯৭১, মানুষ। স্মৃতিকথা : বাতায়ন ১৩৭৪, লিপি সংলাপ। ভ্রমণ কাহিনী : ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র ১৯৫৪। শিশু সাহিত্য : ব্যাঘ্র মামা ১৯৫১, শিয়াল পণ্ডিত ১৯৫২, নিজাম ডাকাত ১৯৫০, বেদুঈনদের দেশে ১৯৫৬, ছোটদের মহানবী ১৯৬১, গল্পে ফজলুল হক ১৯৭৭, ছোটদের নজরুল ইত্যাদি।
মৃত্যুর মাত্র সাড়ে তিন মাস আগে নিজের লেখা বই ও পাণ্ডুলিপি সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে দান করেন ইবরাহিম খাঁ। এ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উদ্দেশ্য করে লেখা ‘অন্তিম ইচ্ছা’ পত্রে তিনি উল্লেখ করেনÑ
‘আমার কর্মজীবনের এক বিপুল অংশ আমি সাহিত্য সেবায় যাপন করেছি। সাহিত্য রচনা আমার জীবনের বিলাস ছিল না, এ ছিল আমার জীবনের অন্যতম তপস্যা। এই তপস্যার মারফত আমি আমার তন্দ্রাহত সমাজকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। আমার সে আহ্বানে সমাজের সব নিদ্রাতুরের নিদঙ্গ হয় নাই সত্য, তবে অনেকে মোচড় দিয়ে অর্ধজাগ্রত হয়েছে, আর কতকে পূর্ণ জাগৃতি নিয়ে উঠে বসেছে। আমার এই ক্ষুদ্র সাফল্যকে আমি আমার জীবনের অন্যতম সার্থকতা বলে মনে করি। আমি অনুভব করি আমার সে আহ্বানের প্রয়োজন আজো মিটে নাই। আজো আমরা কর্মের ক্ষেত্রে ও সাহিত্যের সাধনায় বহু সভ্য জাতির হাজারো মাইল পেছনে পড়ে আছি।
‘বাতায়ন’ ইবরাহিম খাঁর আত্মজৈবনিক রচনা। তাঁর জীবনেতিহাস এই ভূখণ্ডের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ কাল পরিক্রমার ইতিহাস। এখানে তিনি ‘তাঁর জীবনের সাথে সংলগ্ন একটি সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের পরিচয়’ তুলে ধরেছেন। খেলাফত আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, ভারত বিভাগ, ভাষা আন্দোলন এবং প্রাক-স্বাধীনতা সমাজ ব্যবস্থার অবয়ব এবং এর সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতের সন্ধান বাতায়নে পাওয়া যায়। বস্তুত এ গ্রন্থে সদ্যসমাপ্ত শতাব্দীতে বাঙালি মুসলমানের পুনর্জাগরণ প্রয়াসের প্রতিলিপি প্রত্যক্ষ করা যায়। ‘বাংলা সাহিত্যে আত্মজীবনী’ গ্রন্থের লেখক সোমেন বসু এ জাতীয় রচনার তাৎপর্য বিবেচনা করেছেন এভাবেÑ ‘যে জীবন মানুষ কাটায়, ক’জন তাঁর গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতন।
দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছ পর হয়ে বৃহত্তর জীবনের কী সার্থকতা থাকতে পারে, কে-ই বা তা নিয়ে মাথা ঘামায়। গতানুগতিকতার সীমানা পার হয়ে কেউ যদি কোনো অর্থ খুঁজে পায় জীবনের, তবেই তো প্রকাশ করার প্রেরণা আসে। বিচিত্র পরিবেশে ও প্রতিক্রিয়ায় বিচিত্র মানুষের মৌলিক সত্তার স্বতঃস্ফূর্ত সন্তরণের অন্তরঙ্গ অনুলিপি ‘বাতায়ন’-এ এঁকেছেন ইবরাহিম খাঁ। ‘বাতায়ন’ তাই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর ভুয়োদর্শনের কোষগ্রন্থ। মানুষের জন্য, সমাজের জন্য প্রতিভার সর্বোচ্চ ব্যবহারেই জীবনের সার্থকাÑ এই ছিল তাঁর জীবনাদর্শ। তাঁর কর্মে ও জীবনে এ দর্শন ছিল খুবই স্পষ্ট, উচ্চারিত।
‘বাতায়ন’ স্মৃতিকথা, কনফেসন নয়। এখানে লেখক নিজেকে উপস্থাপন করেছে সরব স্বগতোক্তিতে। জাতির প্রতি ইবরাহিম খাঁর কমিটমেন্ট ছিল শর্তহীন। যে সমাজ তাঁর জন্ম দিয়েছে আলোবাতাস, সেবা ও ভালোবাসা দিয়ে তাকে বড় করেছে, মুহূর্তের জন্যও সে সমাজের কথা তিনি ভোলেননি। তিনি চাকচিক্যে বিভ্রান্ত হননি, জীবনের শুভলগ্ন থেকেই ছিলেন আদর্শ অনুসারী। অতিমাত্রায় আত্মমর্যাদাসচেতন তিনি প্রচারবিমুখ ছিলেন। আবার আত্মকেন্দ্রিকও ছিলেন না। মহত্ত্ব তাঁর চরিত্রের কোনো পোশাকি জৌলুস ছিল না। দেশের ছেলেমেয়েদের আত্মমর্যাদাবোধ ক্ষুণœ হতে পারে এমনবই পাঠ্য হিসেবে নির্বাচনে তার ছিল সুস্পষ্ট ঘোর আপত্তি। তিনি ছিলেন মানবপ্রেমিক। মানুষের দুঃখ তাঁকে সাঙ্ঘাতিকভাবে বিচলিত করত। ‘মানুষের প্রতি মানুষের উপেক্ষা, অবহেলা, ছোটর প্রতি বড়র নির্মমতা, আশরাফ আতরাফের ভেদাভেদ, মানুষের কৃত্রিম মহত্ত্বের অভিনয়, মানবমনের সঙ্কীর্ণতা ও ভীরুতা এসবই তাঁকে চঞ্চল করে তুলত। এসবের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন কণ্ঠ উঁচু রেখেছেন।
‘বাতায়ন’-এর লেখাগুলোতে পল্লীর আটপৌরে জীবনের নানান প্রসঙ্গে-লোকসাহিত্য, সংস্কার, আচার-আচরণ, অনুষ্ঠান-আনুষ্ঠানিকতার বিবরণ অন্তরঙ্গ অবয়বে অঙ্কিত হয়েছে। মানুষের সামাজিক আচরণ, সংস্কৃতি ও মনুষত্বকে ঊর্র্ধ্বে তুলে ধরা হয়েছে। বস্তুত ‘খোলা বাতায়ন থেকে (তিনি) দেখেছিলেন একটি বিশাল আকাশ আর দিগন্ত প্রসারিত জীবনের সৌন্দর্য।’ গ্রামপ্রধান বাংলাদেশেরই প্রতিনিধিস্থানীয় করটিয়া পল্লীর দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতময় জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার বর্ণনায় ‘বাতায়ন’-এ এক দরদী শিল্পী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সামাজিক জীবনের বিস্ময়কর সব অতীত চিত্র এখানে প্রোথিত। ইবরাহিম খাঁর চিন্তাধারা মার্জিত এবং ভাবোদ্দীপক। সূক্ষ্মদর্শন এবং সুবিশাল পরিসর ছিল তাঁর মনশ্চক্ষের। মর্মস্পর্শী, প্রাঞ্জল ও সাবলীল গতিসম্পন্ন ভাষায় তাঁর উপস্থাপনায় মজলিশি পরিবেশের পরিচয় পাওয়া যায়। নিছক নিজেকে কেন্দ্র করে যে রচনা তা পাঠক সাধারণের কাছে অপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণ থাকতে পারে বটে কিন্তু ইবরাহিম খাঁর রসবোধ ও ঔদার্য পাঠককে বিমুগ্ধ রাখে। জাতীয় ইতিহাসের কথাকে তিনি যথার্থভাবে তুলে ধরেছেন-সেখানে অন্যকে আহত করার কোনো প্রয়াস নেই। ‘বাতায়ন’ এ স্পষ্টবাদী ও উদার উন্মুক্ত সৃজনশীল সত্তারই সাক্ষাৎ মিলে। প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘বাতায়ন’-কে বিবেচনা করেছেন, ‘খোলা সচেতন সংস্কারমুক্ত নিজস্ব দৃষ্টি, সরল সরস কৌতুকোজ্জ্বল মন, সহজ রসাদ্র ক্ষমাশীল অস্তিত্ববাদী লিখন ভঙ্গিমাÑ সব মিলিয়ে সঙ্কীর্ণ বাঙালি-মুসলমান প্রায়ান্ধকার সমাজকক্ষের একটি রৌদ্রদীপ্ত জানালা।’ হ


আরো সংবাদ



premium cement