২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চোখের ভেতর নদী

-

আমাকে ট্রেনিংয়ে পাঠানো হলো। তখন আমাদের ছোট ছেলের পরীক্ষা চলছে। ভেবে রেখেছিলাম ওকে সময় দেবো। কারণ স্কুল থেকে ইতোমধ্যে আমাকে বলা হলো ছেলেটার ওপর যেন আরো নজর দেই। বিশেষ করে বাংলা। বাংলা ও পড়তে চায় না, পড়াতে গেলে এটা ওটা বলে আর মাথা ব্যথার কারণ দেখিয়ে সটকে পড়ে। অগত্যা তখন ছেলেকে মোবাইলে খেলার লোভ দেখাই, গায়ে জড়িয়ে বুকে টেনে বিদেশী চকলেট হাতে দেই। এভাবে চলে মা ছেলের ছলচাতুরি আর পড়ার প্রশিক্ষণ।
মন্দ লাগেনি ট্রেনিং। এবারের বিষয় ছিল অটোক্যাড আর পাওয়ার পয়েন্ট নিয়ে কাজ করা। নতুন বিষয়, বেশ উদ্দীপক। সব চেয়ে ভালো লেগে গেল ইরাজ হোসেনকে, তার প্রেজেন্টেশন আর সহাস্যে বলা কথার মালা। সে প্রশিক্ষক, ক্লাসে এলেই আমরা ইনজয় করি তার কথা। কারণ, তার কথা মাদকতা রহস্য চোখ ধাঁধানো সব উপকরণে মিশ্রিত এক মুগ্ধকর বিবৃতি। সে কথার ফাঁকে ফাঁকে মোটিভেশনের রেফারেন্স নিয়ে আমাদের ক্লান্তিকে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু সে একদিন আমাকে নিয়ে সব গুলিয়ে ফেলে। আমার চোখের তারায় নাকি সে নিজেকে দেখতে পায়। মোটিভেশনের কথা বলতে গিয়ে আমার চোখের প্রশংসা করে রেফারেন্স করে। তারপর থেকেই দু’-একজন কলিগ আমাকে নিয়ে রহস্যের জাল বুনে।
আমি নিজেও জানি আমার চোখের যে নদী তাতে এখনো যেকোনো যুবক বা প্রৌঢ় সাঁতার কাটতে পারে। কিন্তু আমার স্বামী কোনোদিন তা খুঁজে পেল না। কোনোদিন বলল নাÑ সামিয়া তোমার চোখ সুন্দর গভীর ও মায়ার জাদুতে ভরা। থাক, তা নিয়ে আফসোস করি না, কারণ ১৫ বছর হয়ে গেল সংসারী জীবন। বড় মেয়ে তানিশা নবম শ্রেণীতে আর ছেলে ওয়াসিত ফাইভে। আর কিইবা আছে চাহিদার, কিছু নেই। ছেলেমেয়ে মানুষ করতে পারলেই হলো।
কিন্তু ইরাজ হোসেন যে আমাকে আক্রান্ত করে বসল। আমি ভুলে যেতে চাইলেও সে আমাকে ভুলতে দেয় না। তার পরের দিনও আমাকে উদাহরণ টেনেই ক্লাসে বক্তৃতা করে গেল। তাতে করে সে অন্যদের ভেতর জেলাস তৈরি করে গেল, আমাকে তর্কের জালে আটকে গেল, আমার দেহ সৌন্দর্যকে ঈর্ষার ভেতর আরেক নতুন পৃথিবীতে রেখে গেল তা আমি কোন মুখে তাকে জানাই !
ক’রাত ঘুম নেই। একই মানুষ একই পুরুষ একই নারী। তবু কত তফাত আমাদের চিন্তাধারায়। ১৫ বছর ঘরকন্যা করে যাচ্ছি, এই ঘরের কর্তাও পুরুষ এবং আমরা দু’জন প্রেম করেই বিয়ে করেছি। প্রথম যদিও কয়েকদিন আমার রূপ নিয়ে হাসান কথা বলেছে, তারপর এই যে বছরের পর বছর যাচ্ছে তার এসবে মনোযোগ নেই। সে কী তবে আমাকে নিয়ে বোরড? আমি কী তবে তার কাছে খুব ভার, যে বহনে সমস্যা হচ্ছে, নাকি সংসার আর সন্তান নিয়ে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। তা হওয়ার কথা নয়। কারণ, হাসান বেশ টাকা বেতন পায় আর আমারটা মিলে অনেক। কোনো অভাব নেই সংসারে। কোনো চাহিদা অপূর্ণ থাকে না। সপ্তাহে কমপক্ষে দুই দিন সন্তানদের নিয়ে বাইরে গিয়ে ফাস্ট ফুড চাইনিজ খাই এবং প্রয়োজনে শহরের বাইরে মুক্ত নির্মল বাতাস টেনে ভেতরের শক্তি সঞ্চয় করি। সব চলছে নিয়মের ভেতর। কিন্তু হাসান বদলে যায়, ওর সে প্রেমময় কথা, আমার জন্য ওর আগের ব্যাকুলতা নেই। ও কেমন যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। তবে কী হাসান কোনো প্রেমে পড়েছে, নাহ! এসব ভাবা ঠিক নয়। কারণ ও ঠিক টাইম মেনটেইন করে ঘর ও সংসারের কাজে।
অযথা ভাবনার মাঝেই আমি ডুব দেই, হঠাৎ ইরাজ হোসেনের মুখ আসে আমার ভাবনার বাগানে। তার কথার ফুলঝুরি মনে পড়ায় একটু হাসি। কী আশ্চর্যরকম আপন করার যোগ্যতা তার, ভাবলে আশ্চর্য হই। ট্রেনিং ক্লাসে ইরাজ বলল, সে নাকি ১৫ বছর যাবত ঘরে ঘুমায় না। মুখে হাসির কৌতূহল নিয়ে আমিই প্রশ্ন করলামÑ স্যার বলেন কী, এটা কী সম্ভব? -হ্যাঁ সম্ভব। তার মানে আমি কিন্তু বলিনি যে, অন্য কোথাও ঘুমাই না। বলেছি ঘরে ঘুমাই না।
Ñমানে কী? বিষয়টি নিয়ে আমি এলোমেলো ভাবনায় জড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ। তারপর সে আমার চোখের ভেতর ঢুকে অনেকটা সময় নিয়ে হাসতে হাসতে বলেÑ শুনুন আমি প্রতিদিন টঙ্গি থেকে অফিস করি এই ধানমন্ডিতে। আমি যখন বাসে বসে থাকি, তখন খুব ঘুম পায়। আর পথে তখন খুব ট্রাফিক জ্যামও থাকে, এই ফাঁকে আমি প্রায় দুই ঘণ্টা আর ফেরার সময়ও আরো দুই ঘণ্টা ঘুম। তা হলে কী হলো, আমি চার ঘণ্টা ঘুমাই আর তা ১৫ বছর ধরে বাসে বাসে গাড়িতে গাড়িতেই।
আমরা সবাই হাসতে থাকি। তার কথার রহস্য ভেদ হলে আমরা আরো মজার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু অন্য প্রশিক্ষক এসে পড়ায় তার আর মজার কথা শোনা হলো না। হ্যাঁ, কথা বলেছি ট্রেনিংয়ের পর। আমি দেইনি তাকে আমার ফোন নম্বর। তা হলে? সে হয়তো আমাদের এটেনডেন্স থেকে নম্বর সংগ্রহ করেছে অগোচরে।
একদিন ফোন করে। তখন আমি ছেলে ওয়াসিতকে নিয়ে বসেছি বাংলা পড়াব। আননোন নম্বর সাধারণত ধরি না। কিন্তু এটা কি বিধাতার কোনো রহস্য। প্রথম কলেই ধরলাম। Ñহ্যালো কেমন আছেন আপনি? Ñআপনি কে প্লিজ বলবেন? Ñচিনতে পারছেন না। আমি ইরাজ, ইরাজ হোসেন, সেই যে ঘুমের গল্প করেছি। Ñওহ আপনি হ্যাঁ, হ্যাঁ, কেমন আছেন স্যার। Ñস্যার বলছেন কেন। আমি আপনার চেয়ে সিনিয়র নই। আপনিও অনেক যোগ্য। Ñথাক থাক ওসব বলতে হবে না। এমনিতে ক্লাসে অনেক বলে আমাকে বিতর্কিত করে গেছেন। আর বলার প্রয়োজন নেই। Ñতবে কী লাইন কেটে দেবো? বিরক্ত হলেন? Ñনা না তা কেন। আমি লাইন কাটার কথা বলছি না। বলছি আপনার কারণে এখন অনেকেই আমাকে চিনেছে বন্ধুত্ব হয়েছে, খোঁজখবর নিচ্ছে। আমি এসবে সহজ হতে পারছি না। Ñআচ্ছা বলুন কেমন আছেন? আপনার ফেসবুক আইডি বলবেন প্লিজ। আমি রিকোয়েস্ট পাঠাব, অ্যাকসেপ্ট করবেন কিন্তু। আজ ভাবছিলাম একটি গল্প শোনাবো কাউকে। ভেবে ভেবে কারো মুখ চোখ মনে করতে পারছি না। আপনার ওই গভীর চোখে ডুবে গেলাম তাই নক করা। Ñআবারো চোখের গল্প করছেন? এসব না বললে হয় না? Ñআহা রাগ করছেন কেন? আপনার ওই চোখ তো নদী। বিশ^াসের সমুদ্র। কী অসম্ভব সুন্দর ওই চোখ আপনি জানেন?
আমি একটু চুপ করে থাকি। আমার পাশে ছেলে ওয়াসিত পড়ছে। কি যেন বলতে চাচ্ছিলাম। কিছুটা ভয় কিছুটা সঙ্কোচ নিয়ে বললামÑ এসব কথা বারবার বলতে হয় না। আমি সারা জীবন আপনার এই কথাটিই মনে রাখব।
ইরাজের সাথে বেশ সময় যাচ্ছে ফেসবুকে ফোনে। ওর অভিজাত্যপূর্ণ চেহারা আর কথার গভীরতায় মুগ্ধ হচ্ছি। সে অতটা মেধাবী কী করে হলো, তা ভাবতে গিয়েই অবাক হই। নিজের অনিচ্ছায় অজান্তে সে ধীরে ধীরে আমার মনের কোঠায় একটি ছোট্ট স্থান দখল করে।

দুই. মাস খানেক হলো আমার মেয়ে তানিশাকে মহল্লার এক ছেলে ডিসটার্ব করছে। প্রথম সে আমাকে বলেনি। অবশ্য আমিই লক্ষ করতাম মেয়েটি স্কুলে যাওয়ার সময় ছেলেটি গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকত। হতেই পারে একটি ছেলে মেয়ের দিকে তাকাবে। আমি তা নিয়ে বেশি ভাবনার ভেতরে যাইনি।
বিষয়টি মনে রেখেছি, মেয়েকে বলিনি। কিন্তু খেয়াল করতাম বিকেলে মেয়ে স্কুল থেকে ফেরার সময়ও ওই একই ছেলে গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। এবার আমি সিরিয়াস। তাই খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে মেয়ের সাথে কথা বলি। আজকাল মেয়ে-ছেলে সবাই একটু চালাক, ওরা নিজেদের ভেতরের আজব রহস্যপূর্ণ সংলাপ নিয়ে নিজেরাই একা গোপনীয়তা রক্ষা করে। আমার মেয়েও এর বাইরে নয়। অনেক দরকষাকষি হলো তার সাথেও। তার নতুন ক্যালকুলেটর-কলম-পেন্সিল কাটার কিনে আনি। তাকে সাথে করেই মার্কেটে যাই। সেদিন আমি সাথে থাকার পরও লক্ষ করলাম, ছেলেটি খুব সাহস করেই আমাদের সামনে এল এবং আমাকে সালাম দিলো। একটু ভরকে গেলেও সামলে নিলাম। জানি সে আমাদের প্রতিবেশী। তাই হাসির ছলে রিকশায় উঠলাম এবং মেয়েকে জেরার কবলে ফেললাম। জেরা করতে করতেই বেরিয়ে এলো যে, ছেলেটি মাঝে মধ্যে আমার মেয়েকে মোবাইলেও ডিসটার্ব করে। এ কথা শুনে আমি বিমর্ষ হই না, তবে টেনশনে গা থেকে ঘাম ঝরে। কী করব এই সমস্যার? মেয়ে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কদিন সময় নেই। হাসানকে বলি না। কারণ বাবা হিসেবে হাসান খুব সিরিয়াস এবং প্রয়োজনে ওই ছেলের বাসায় গিয়ে লঙ্কাকাণ্ড বাধাবে, থানায় গিয়ে মামলা ঠুকে দিয়ে আসবে। কিন্তু মেয়ের ব্যাপার আমি ওসব গোপনেই সারতে চাই। তাই একদিন ছেলেকে বাসায় ডেকে আনি এবং খুব ভদ্রভাবে আর যেন আমার মেয়ের পেছনে না লাগে তার উপদেশ দেই। এ সময়ে ছেলেরা খুব ডেসপারেট হয়, তাই ভেতরে ভেতরে একটু ভয়ও কাজ করে। একসময় ছেলেটির নম্বর ব্লক করে রাখি আর মেয়েকে অন্য সিম কিনে দেই।
ক’দিন পরই ঘটনা ঘটে যায়। ছেলেটি তার আরো দুইজন বন্ধু নিয়ে আমাদের পথরোধ করে। জরুরি কাজ। আমার অফিস আর মেয়ের স্কুল টাইম, মেজাজ ঠিক রাখতে পারলাম না। রিকশা থেকে নেমে কষে চড় বসালাম ওর গালে। শাসনের সুরে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললামÑ আর বাড়লে খুব বিপদ হবে মনে রাখিস, নোংরা ছেলে কোথাকার। পথের কজন প্রতিবেশী আমার ক্রুদ্ধতায় হতবাক, কারো প্রতিবাদ নেই, দৃশ্যটি উপভোগ করা ছাড়া।

তিন. দু’মাস হলো আমার চোখ অপারেশন হলো। দু’চোখের পাশেই মুখের চামড়া বেশ কুঁচকে গেছে। এসিডের ঝলকানো তেজে হয়তো মরণই হতো। কিন্তু ওই ছেলের হাত থেকে মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের চোখ ও মুখের সব সৌন্দর্য হারালাম। এক নাগাড়ে ২৩ দিন হাসপাতালে থেকে ঘরে ফিরেছি। মাঝখানে তিন দিন ইরাজ হোসেন ফোন করেছিল। কিন্তু বলিনি আমার দুঃসময়ের কথা, চোখ নষ্ট হওয়ার কথা। বলিনি আমার চোখের নদীতে এসিডের চর পড়েছে, এখন আর ওই নদীতে ডুব দেয়া যায় না। বলিনি আমার গভীর কালো চোখের পাড়েও শাদা ছেঁড়া কাশবনের জটলা। ওখানে সুন্দর বলে কিছু নেই এখন। আমি আর কষ্টের সাগর থেকে উপরে ভাসতে পারলাম না, পারলাম না জীবনের সুখকর ভূমিতে আগের মতো হাসিখুশি বিচরণ করতে।

চার. কোথা থেকে ইরাজ হোসেন ঠিকানা জোগাড় করল জানি না। শুধু চাতুর্যের সাথে যা করল তা হলোÑ আমার বাসার দরজার কাছে এসে মোবাইলে রিং করল। প্রশ্ন করে যাচ্ছেÑ কেমন আছি, কোথায় আছি। তখনো বুঝিনি যে, ইরাজ হোসেনই আমার বাসার কলিংবেল টিপে যাচ্ছে। মোবাইল কানে রেখে কথা বলতে বলতেই আমি দরজা খুলে দেই।
ইরাজ হোসেন বেশ একটু সময় দাঁড়িয়ে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে...। হ


আরো সংবাদ



premium cement