২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আবদুল মান্নান সৈয়দের উপন্যাস

-

আবদুল মান্নান সৈয়দ সব্যসাচী লেখক, সৃজনশীল ও মননশীল উভয় সাহিত্যে তাঁর অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি বোদ্ধা পাঠদের সহজেই আকৃষ্টি করে। মান্নান সৈয়দ প্রধানত কবি। মগ্নচৈতন্যের গভীরে ডুব দেয়া পরা বাস্তবের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সমালোচনা সাহিত্যে মান্নান সৈয়দ তাঁর গভীর অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি ও আনকোরা নতুন চিন্তা ও পদ্ধতির কারণে চৌকস প্রাবন্ধিক হিসেবে তাঁর মুন্সিয়ানা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। বাংলা ছোট গল্পে তাঁর স্বতন্ত্র শিল্প চিন্তা ও বিশেষত্ব স্পষ্ট। উপন্যাস রচনা তাঁর অন্যতম শিল্প মাধ্যম। তিনি ‘রহস্যময়’, ‘দরোজা,’ ‘অ-তে অজগর,’ ‘পোড়ামাটির কাজ’, ‘গভীর’, ‘শ্রাবস্তীর দিন রাত্রি,’ ‘শ্যামলী তোমার মুখ’, ‘প্রেম’, ‘ভাঙ্গানৌকা’, ‘ক্ষুধা প্রেম আগুন’, ‘একাত্তর’, পরিপ্রেক্ষিতের দাসদাসী’সহ বহু উপন্যাস রচনা করেছেন। তাঁর উপন্যাসে বিষয় ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্যমণ্ডিত নতুনত্বের ভেতর রয়েছে গভীর ও সূক্ষ্ম জীবনবোধ। তাঁর রচনা মাত্রই নিরীক্ষাধর্মী। তাঁর উপন্যাস রসগ্রাহী পাঠকের পাঠ অভিজ্ঞতাকে বিস্তৃত ও শিক্ষিত করে।
আবদুল মান্নান সৈয়দের জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার জালালপুর গ্রামে। ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বাবা-মা’র সাথে চলে আসেন ঢাকায়। তখন তাঁর বয়স মাত্র সাত বছর। ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় হতে ১৯৫৮ সালে প্রবেশিকা ও ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক সম্মান ও ১৯৬৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে আবদুল মান্নান সৈয়দ জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা এবং নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৩ সালে ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার, ২০০১ সালে নজরুল পদকসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়। ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০ তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
‘জন্মান্ধ কবিতা গুচ্ছ’ (কবিতা), সত্যের মতো বদমাশ (গল্প), শুদ্ধতম কবি (প্রবন্ধ) আবদুল মান্নান সৈয়দের সাহিত্য সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ে যেভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সেই তুলনায় তাঁর উপন্যাস একটু আড়ালে পড়েছিল। ষাটের দশক থেকে মান্নান সৈয়দ উপন্যাস লিখে গেছেন। অনুরোধে উপরোধে তাঁর উপন্যাসগুলো প্রকাশিত হয়েছে অপেক্ষাকৃত পরে। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধে তিনি যেমন নিরীক্ষাধর্মী- আনকোরা নতুনত্বের সন্ধানী-স্বতন্ত্রসত্তার অধিকারী, উপন্যাসের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নন। আবহমান বাংলা উপন্যাসের ধারায় তিনি সবার চেয়ে একটু ব্যতিক্রম। তাঁর কাহিনী পরিকল্পনা, চরিত্র সৃষ্টি, ভাষার উপযোগিতা, বাস্তবতা, জীবনবোধ ও সংলাপ পাঠকের পাঠ অভিজ্ঞতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। তাঁর উপন্যাস বাণিজ্যিক রচনামাত্র নয়, ভেবে চিন্তে লেখা। তাঁর উপন্যাস সাহিত্যকে বিস্তৃত করার পাশাপাশি পাঠকদের নানা বিষয়ে শিক্ষিতও করে তুলে। বিশেষত তাঁর ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাসগুলো বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ‘পোড়ামাটির কাজ’, ‘উৎসব’, ‘শ্রাবস্তীর দিন রাত্রি’, ‘একাত্তর’, ‘ক্ষুধা প্রেম আগুন’ ইত্যাদি।
‘পোড়ামাটির কাজ’, ‘উৎসব’ এবং ‘শ্রাবস্তীর দিন রাত্রি’ উপন্যাসে ঐশ্বর্যমণ্ডিত ভোগ বিলাসে মত্ত প্রাচীন ভারতের বিলাসবহুল আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে পাঠক পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। ভারত উপমহাদেশ প্রাচীন কাল থেকে কৃষি বাণিজ্য ধনধান্যে ঐশ্বর্য মণ্ডিত একটি দেশ। শিল্প সাহিত্যে সমগ্র বিশ্বে প্রাচীন ভারতের একটা গৌরবময় অবস্থান রয়েছে। রাজা অশোক, বিক্রমাদিত্য, উদয়ন, মহিপাল, লক্ষণ সেন ঐতিহাসিকভাবে যেমন স্মরণীয় তেমনি প্রাচীন ভারতের শিল্প সাহিত্যেও তাঁরা নানাভাবে স্মর্তব্য। প্রাচীন ভারতের সাহিত্য সংস্কৃতি বিলাসকলায় পরিপূর্ণ। সংস্কৃত কবি কালিদাস ভর্তৃহরি, ভবভূতি, জয়দেব প্রমুখের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতের কাব্য ও নাটকের সাথে আমরা পরিচিত হয়েছি। সে সাহিত্য বিলাস ঐশ্বর্য ও যৌনতায় ভরা। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ জয়দেবের গীত গোবিন্দ’এর সাথে যাঁরা পরিচিত তারা অবশ্যই আমার বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন না।
আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘উৎসব’ উপন্যাস বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাজার ইতিহাস আশ্রিত। এ উপন্যাসের নায়িকা ‘সিরিমা’। নায়ক ভিক্ষু ‘কল্যাণ’। সিরিমা নগর গণিকা। যার রূপ সৌন্দর্য্য ব্যক্তিত্বে রাজা, অমাত্য, শ্রেষ্ঠী, বিদ্বান, অভিজাত বর্গ, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত সবাই মুগ্ধ ও উন্মাদ। রাত্রিযাপন করতে চাইলে দিতে হয় সহস্্র কার্ষাপণ। সিরিমার রাতগুলো এ জন্যে বণিক বা শ্রেষ্ঠীদের দখলেই থাকে। রাজকার্যে ব্যবহৃত হলে সিরিমার এক রজনীর উর্পাজন সহস্রকার্ষাপণও ছাড়িয়ে যায়। সে বিপুল সম্পদের অধিকারী। রাজার সঙ্কটে সে সহায়তা করে, দরিদ্র সাধারণকে অকাতরে দান করে। আর ধর্ম প্রচারের কাজেও তার অর্থ ব্যয় হয়। আটজন ভিক্ষুকে সে প্রতিদিন অন্নদান করে। বুদ্ধদেবের আগমন সংবাদ শুনে সিরিমা বিপুল অর্থ দান করে বুদ্ধদেবের থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থার জন্য। তিনি না আসলে সিরিমার প্রদত্ত অর্থ গ্রামোন্নয়নে ব্যয় হয়। এক সময় রাজ দরবারের এগার সদস্যের একজন ছিল সিরিমা। এক বৃদ্ধ শ্মশ্রুল শ্রেষ্ঠী তাকে অপমানজনক কথা বলায় সে রাজসভা থেকে পদত্যাগ করে। রাজার অনুপস্থিতিতে এ ঘটনায় রাজা তার কাছে ক্ষমা চায়। তাতে রাজাকে রাজ্যের স্বার্থে সহায়তা করলেও সে আর রাজদরবারের সদস্যপদ গ্রহণ করেনি।
‘একাত্তর’ মান্নান সৈয়দের আর একটি ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাসটিতে মুক্তিযোদ্ধা শওকতই উপন্যাসের নায়ক। শওকত বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্র। আগরতলায় সে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের কাজে নিয়োজিত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা হারুনের মাধ্যমে মালতির সাথে প্রথমে পরিচয় ও পরে প্রণয়াবদ্ধ হয়। নায়িকা মালতির ভালোবাসা শওকতের কর্তব্য বোধে বিঘœ সৃষ্টি করতে পারেনি। লেম্বুছড়া ক্যাম্পে যাবার পূর্বে মালতির সাথে শেষবারের মতো দেখা হয় শওকতের। বিদায়ের ক্ষণে শওকত মালতিকে বলে- ‘মালতি ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর সরাসরি যুদ্ধ করতে হবে আমাদের। আর যদি না ফিরি, তাহলে এই শেষ দেখা। কিন্তু দেশ স্বাধীন করে যদি ফিরে আসি তখন কিন্তু তোমাকে ডাকাতি করে নিয়ে যাব।’ লেম্বুছড়া ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন কে. পি. সিং, ক্যাপ্টেন শর্মা, মেজর মাহমুদের প্রশিক্ষণের পর সরাসরি শওকত যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দেশ স্বাধীন হলো। মালতির ভালোবাসা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে শক্তি জুগিয়েছে। দেশ স্বাধীন হবার পর মালতির খবর নেয়া আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। খালাতো বোন মনিকেই বিয়ে করে শওকত সংসারী হয়। শেষ পর্যন্ত স্বপন আর স্বপ্না তথা শওকত ও মালতির স্বপ্ন জগতের দুই তরুণ তরুণীই থেকে যায়। যুদ্ধের কালো ঝড়ো দিনগুলোতে ওরা ফুটেছিল দু’টি লাল গোলাপের মতো। ঝরে গেছে তারপর। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত এ উপন্যাসে দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করার মন্ত্রে দুই তরুণ তরুণীর প্রবল আবেগে বহমান প্রেমের ট্র্যাজিক পরিণতি সহৃদয় সংবেদি পাঠক হৃদয়কে আমূল বিদ্ধ করে।
‘ক্ষুধা প্রেম আগুন’ একাত্তরের জানু ছেঁড়া উত্তাল সময়ের উত্থান-পতনের সাথে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তন পর্যন্ত বিস্তৃত। উপন্যাসের নায়ক ‘নবাব’ ও নায়িকা ‘ঝরনা’। নবাবের গতিশীল উচ্চ বিলাসী জীবন নদীর বাঁকে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী উত্তাল ঢেউয়ে স্বেচ্ছাচারী জীবনের শূন্যতা বিধৃত।
আবদুল মান্নান সৈয়দের কাহিনী পরিকল্পনা, গল্প তৈরি, সংলাপ ও জীবন বোধের সুখ্যাতি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁর অনুসন্ধানী চরিত্রকে। কাহিনী উপযোগী ভাষা ও সংলাপ, বুদ্ধিভিত্তিক মুনশিয়ানার জোরে তাঁর উপন্যাস পাঠককে কথাসাহিত্যের এক নতুন জগতের সন্ধান দেয়। তাঁর উপন্যাসগুলো হয়তো উপন্যাস সাহিত্যের ধ্রুপদী নিয়ম লংঘন করেছে। মহৎ সৃষ্টি মাত্রই নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ নয়। মহৎ শিল্প ও শিল্পী নতুন নিয়ম তৈরি করে। ক্ষুদ্র পরিসরে বৃহত্তর পটভূমিকে উপস্থাপনের বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলে মান্নান সৈয়দ বাংলা সাহিত্যের একজন সার্থক ঔপন্যাসিক। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement