২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`
শ্রুতি ও স্মৃতির সোনালি শিখা

যেমন দেখেছি তাঁকে

-

তেইশ.

আজীবন যারা আল মাহমুদের কাছে থেকেছেন, ভালো বেসেছেন, আগলে রেখেছেন; তাদের অন্যতম একজন কবি আসাদ চৌধুরী। যখন যেখানে গেছেন আল মাহমুদের কবিতার সুনাম-সুখ্যাতির কথা তুলেছেন। বলেছেন। বলছেন এখনো। আল মাহমুদের প্রতি তার সমর্থন দ্বিধাহীন। আন্তরিক এবং বিবেচনাপ্রসূত। অযৌক্তিক কোনো অন্ধ ভালোবাসায় নিমজ্জিত কোনো কবি নন আসাদ চৌধুরী। তিনি ষাটের কবি। অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন কবি। কিন্তু কোনো রাজনীতির অঙ্গে তার নাম নেই। তিনি দূরদর্শী। ভবিষ্যৎ অনুমান করার ঘ্রাণ আছে তার। তিনি দক্ষতার সাথে কথা বলেন। সময় ও পরিবেশ অনুধাবন করেন তীক্ষèতার সাথে। তার বাচনভঙ্গি চমৎকার। উচ্চারণ আকর্ষণীয়। অসাধারণ আবৃত্তি করেন কবিতা। আমাদের কবিদের কবিতার স্বাদ সম্বন্ধে তার অভিজ্ঞতা যুগোপযোগী। কবি ও কবিতা সম্পর্কে মূল্যায়নে আছে তার নিরপেক্ষ দৃষ্টি।
তার এসব গুণ সামনে রেখেই আল মাহমুদের কবিতা বিশ্লেষণ করেন তিনি। বলেন আল মাহমুদের কবিতার নান্দনিক দিকের কথা। কবিতায় তার অনন্য অবদানের কথা। আল মাহমুদ বাংলা কবিতার একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি এ কথা তিনি বলেন। আল মাহমুদের সাথে তার সম্পর্ক একেবারেই আত্মিক, যা আত্মীয়তার ঊর্ধ্বের। যা কখনো খাটো অথবা নীচু হয়নি। হবেও না কোনো দিন। যুগের পর যুগ আল মাহমুদের পাশে থেকেছেন তিনি। থেকেছেন আল মাহমুদের শেষ দিন পর্যন্ত। আল মাহমুদও তাকে গ্রহণ করেছেন হৃদয় থেকে। সময়, অসময়, সুসময় কিংবা দুঃসময় মাহমুদ ভাই স্মরণ করেছেন তাকে। পাশে চেয়েছেন। তিনিও থেকেছেন।
আল মাহমুদের কোনো অনুষ্ঠানÑ হোক সেটা কবিতার অথবা জন্মদিনের অথবা অন্য কোনো আয়োজন, আসাদ চৌধুরীর উপস্থিতি অনিবার্য। এটি তিনি জীবিত থাকাকালীন যেমন তেমনি তার মৃত্যুর পরও। বিশেষ সমস্যায় থাকতে না পারা সেটি অন্য কথা। কিন্তু আসাদ চৌধুরীকে বাদ দিয়ে আল মাহমুদের কোনো অনুষ্ঠান ভাবতে পারিনি আমরা। এখনো পারি না। পিঠাপিঠি দশকের কবি তারা দু’জন। আল মাহমুদ পঞ্চাশের। আসাদ চৌধুরী ষাটের। ষাটের কবিদের মধ্যে আর যাদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক ছিল আল মাহমুদেরÑ কবি আল মুজাহিদী, রফিক আজাদ, কে জি মোস্তফা, ফরহাদ মজহার, নির্মলেন্দু গুণ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, অসীম সাহা, সানাউল হক খান, মাহবুব সাদিক, কাজী রোজী প্রমুখ। এদের মধ্যে কবি আল মুজাহিদীর সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল অন্যরকম। আল মুজাহিদী ছিলেন ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক। এটি একটি মোটা দাগের সূত্র সম্পর্ক গভীর হওয়ার ক্ষেত্রে। এটি ছাড়াও আল মাহমুদের চিন্তাধারার আধুনিকতার সাথে অনেকাংশে মিলে যেত আল মুজাহিদীর। দু’জনই মুক্তিযোদ্ধা কবি। দু’জনেরই দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত।
ফরহাদ মজহারের সাথে আল মাহমুদের সম্পর্ক ছিল বেশ আন্তরিক। আল মাহমুদের কবিতা অসম্ভব পছন্দ করেন ফরহাদ মজহার। ফরহাদ মজহারের কবিতা বিশেষ করে তার কাব্যগ্রন্থ ‘এবাদত নামার’ প্রতি আল মাহমুদের ছিল এক ধরনের প্রশংসার দৃষ্টি। যাকে মুগ্ধতাও বলা যায়। চিন্তা-চেতনায় ফরহাদ মজহার যেমন আধুনিক, তেমনি ভাবুক। তার এ আধুনিক ও ভাবুকতার সমন্বয় পছন্দ করতেন আল মাহমুদ। আল মাহমুদের কবিতার আধুনিক চিন্তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ফরহাদ মজহার।
রফিক আজাদ একজন সাহসী কবি। তার কবিতার উচ্চারণ এবং কবিতা বিষয়ে উচ্চারণ দুটোই ছিল দ্বিধাহীন। মেদামার্কা কোনো কবিকে পছন্দ ছিল না তার। আল মাহমুদের প্রতি তার ধারণা ছিল বেশ উঁচু। কেমন উঁচু, তার একটি উক্তি থেকে অনুধাবন করা যায়। তিনি বলেছেনÑ ‘আল মাহমুদ যা লেখেন তা তো কবিতাই। যা বলেন তাও কবিতা।’ এই যে যা বলেন তাও কবিতা একজন কবির প্রতি এমন বিশেষণ সাধারণত দেখা যায় না। আল মাহমুদও বেশ প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখতেন রফিক আজাদকে। বলতেনÑ রফিক আজাদের কবিতা লাগামহীন নয়। তার কবিতার শরীর নির্মিত হয়েছে ছন্দ ও অলঙ্কারের উচ্ছ্বাসে এবং তার কবিতায় লুকিয়ে আছে সাহস।
কে জি মোস্তফা নানাভাবে আল মাহমুদের গুণমুগ্ধ। আল মাহমুদকে চিরকালীন কবিদের তালিকায় তুলে রেখেছেন তিনি। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে আল মাহমুদের খবরাখবর রাখতেন। বিশ্ব কবিতা দিবসে প্রেস ক্লাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আল মাহমুদকে অতিথি হিসেবে রাখতেনই। এ ক্ষেত্রে কবি-সাংবাদিক এরশাদ মজুমদারের ভূমিকাও স্মরণীয়। তিনিও নানাভাবে মাহমুদ ভাইকে সম্মান দিতেন। কে জি মোস্তফা একজন অসাধারণ গীতিকার। তার গানের প্রতি কান খাড়া ছিল আল মাহমুদের। শুনতেন তার গান। ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে’, ‘আয়নাতে ওই মুখ পড়বে যখন/কপোলের কালো তিল পড়বে চোখে’ এমন জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা কে জি মোস্তফা।
এভাবে প্রত্যেকের সাথে একেকটি সূত্রে একেক রকম সম্পর্কের সেতু ছিল তার। এসব সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠতায় দৃঢ় ছিল তেমনি ছিল দীর্ঘতর। আল মাহমুদ গণকণ্ঠে নিয়ে এসেছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ এবং কবি অসীম সাহাকে। নির্মলেন্দু গুণ আল মাহমুদের কবিতার প্রতি ভীষণ আকৃষ্ট এক কবি। আল মাহমুদের মৃত্যুর পর একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছেন গুণ। যাতে আল মাহমুদের প্রতি তার গভীর মুগ্ধতা প্রকাশ পেয়েছে।
কাজী রোজী বরাবরই আল মাহমুদের ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ। কবি এবং কবিতা দুই-ই তার আগ্রহের বিষয়। মাহমুদ ভাইয়ের কবিতায় আকণ্ঠ ডুবে থাকা একজন কাজী রোজী। কাজী রোজী ছাত্রজীবন থেকেই আল মাহমুদের ভক্ত। কবি ও কবিতার এ সম্পর্ক সত্যিই আনন্দের। কাজী রোজীর আম্মাও আল মাহমুদকে বেশ স্নেহ করতেন। এভাবে সম্পর্কটি হয়ে যায় পারিবারিক। এসব কবির মধ্যে আসাদ চৌধুরীর সম্পর্কটি একেবারে অন্য মাপের। অন্য ধরনের। তিনি আগাগোড়া আল মাহমুদের সাথে জড়িয়েছিলেন। আছেন। আল মাহমুদের সাথে তার সম্পর্কের সেতুটিও বেশ পুরনো। এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের শিক্ষক ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী। কলেজশিক্ষক হিসেবে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। তার প্রতি ছাত্রছাত্রীদের মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধার কথা খানিকটা ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে তিনি একজন কবি-শিক্ষক, এ কথাটি নানা দিকে চাউর হয়ে যায়। তার উচ্চারণ এবং বাচনভঙ্গি নান্দনিক হওয়ার ফলে তার জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে। তিনি একটি নিয়মিত সাহিত্য আড্ডার আয়োজন করলেন। এ আড্ডায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন কলেজের লেখিয়ে, কবি, সাহিত্যিক ও শিক্ষক যোগ দিতেন। যোগ দিতেন লেখিয়ে ছাত্ররাও। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাইরে থেকেও কলেজশিক্ষক অনেকে যোগ দিতেন। মাঝে মধ্যে ঢাকার কবি-সাহিত্যিকও কেউ কেউ অংশ নিতেন আসাদ চৌধুরীর এই সাহিত্য আড্ডায়। এ আড্ডাতেই যোগ দিতেন আল মাহমুদ। এখান থেকেই তাদের সম্পর্কের সূচনা। এ আড্ডা ছিল নিয়মিত।
এ আড্ডায় যারা আসতেন, তারা একধরনের পরিশীলিত মানুষ। জ্ঞানগরিমায় তাদের অবস্থান ছিল খানিকটা উঁচুতে। এখানে নিয়মিত আড্ডা দিতেন আল মাহমুদ। যাকে আসাদ চৌধুরীর ডেরা নামেই অভিহিত করেছেন তিনি। আড্ডা ছাড়াও উপস্থিত হতেন আল মাহমুদ। সুযোগটি আসাদ চৌধুরীও হাতছাড়া করেননি। তাকে নিয়মিত পাওয়ার আনন্দে তিনিও পুলকিত। তার যতœআত্তি এমনভাবে করলেন, যাতে আল মাহমুদ কোনোভাবেই তাকে মিস না করেন। না, আল মাহমুদ মিস করেননি। প্রায়ই হানা দিতেন আসাদ চৌধুরীর ডেরায়। চলত আড্ডার পর আড্ডা। সময়ের হিসাব কে রাখে? কে ভাবে ঘড়ির কাঁটার কথা! শিক্ষক-ছাত্র সমান হয়ে উঠতেন আড্ডার আনন্দে। যেহেতু আসাদ চৌধুরী একজন জমানো মানুষ। আড্ডা জমে ওঠার ক্ষেত্রে তার ইন্ধন ছিল নিত্যসক্রিয়। তার প্রথম কবিতার বইয়ের নাম ‘তবক দেয়া পান।’ সেই পানের আসর জমজমাট করে তুলতেন আল মাহমুদের মতো তুমুল কবিতাপাগল স্বাপ্নিক মানুষেরা। যারা জীবন সম্পর্কে বরাবরই বেহিসেবি। এদের কারো জীবনে দুইয়ে দুইয়ে চার হয়নি। কখনো পাঁচ হয়েছে। কখনো তিন। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানো মানুষেরা আড্ডায় সময় খরচ করার ব্যাপারে একেবারেই নারাজ। এরা সম্পদের ওজনে জীবনের ভার নির্ণয় করার পক্ষপাতী। আর আল মাহমুদ, আসাদ চৌধুরীর মতো কাল্পনিক জীবনে বেঁচে থাকা মানুষের জীবনকে কেবলই স্বপ্নের পাখায় উড়িয়ে দেয়ার আনন্দে পঞ্চমুখ। এসব স্বপ্নবাজের হৃদয় আশ্চর্য উদারতায় বিস্তৃতি পায়। তারা জীবনের সব কিছু কবিতার ভেতর দিয়ে উন্মোচনে বিশ্বাসী। আসাদ চৌধুরী পরে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন। একাডেমির একজন পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
এ আনন্দ থেকেই তারা জীবনকে শিল্পের উষ্ণতায় জাগিয়ে রাখেন। জাগিয়ে রেখেছিলেন আল মাহমুদ। রেখেছেন আসাদ চৌধুরীও।
আসাদ চৌধুরীর এ আড্ডায় আল মাহমুদের সাথে পরিচয় ঘটেছে আহমদ ছফার। প্রথম সাক্ষাতেই দু’জন দু’জনকে বেশ পছন্দের জায়গায় তুলে নিলেন। আল মাহমুদের কবিতা আহমদ ছফাকে প্ররোচনা দিয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দিকে। ছফার বুদ্ধিবৃত্তি, পঠন-পাঠনের গভীরতা এবং কথা বলার ভঙ্গিতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন আল মাহমুদ। মজার বিষয় হলো, প্রথম সাক্ষাতেই আহমদ ছফা আল মাহমুদকে আংকেল বলে সম্বোধন করলেন। প্রথম পরিচয়েই কেন আংকেল বলতে হলো তার কারণ ছফা ভাই ছাড়া কে বলবে! তবে আহমদ ছফা এমনই বৈশিষ্ট্যের মানুষ। একটু অন্যরকম। একটু আলাদা। চিন্তার ক্ষেত্রে। চেতনা ও চৈতন্যের ক্ষেত্রে। উপস্থাপনা ও উপস্থিত বুদ্ধির ক্ষেত্রে। আল মাহমুদ কি কম যায়? আংকেল ডাকটি লুফে নিলেন তিনিও। ভাতিজা বলেই আহমদ ছফাকে ডেকেছেন তিনি। এ ছিল সব সময়ের ডাক। দেখা হলেই আল মাহমুদ ভাতিজা বলে হাত বাড়াতেন। আংকেল বলে হ্যান্ডশেক করতেন আহমদ ছফা।
আমাদের দেশে বুদ্ধিবৃত্তির যে শাণিত ধারা তার পুরো ভাগের একজন আহমদ ছফা। তিনি পক্ষপাতে বিশ্বাসী ছিলেন না। দলীয় দালালি অথবা নিজের স্বার্থকে বড় করে তোলার ভাবনা তাকে আলোড়িত করেনি। তিনি যা বুঝতেন সোজাসাপটা উচ্চারণে কোনো দ্বিধা ছিল না তার। এ কারণে নানারকম হেপা পোহাতে হয়েছে তাকে। তার শত্রুর কোনো কমতি ছিল না। সমালোচনা ছিল বিস্তর। এ দেশের স্বার্থান্ধ বুদ্ধিবাদীদের মুখোশ খুলে আসল চেহারা দেখিয়ে দেয়ার অবাক সাহস ছিল তার। ফলে যাদের মুখোশটি উদম হয়ে যেত, তারাই তার বিরুদ্ধে লাঠি উঁচু করার সঙ্কল্প নিতেন। কিন্তু মুহূর্তের জন্যও দমে যাননি আহমদ ছফা। তিনি একজন চিন্তাবিদ। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী। প্রবন্ধশিল্পী, একজন কবি। ঔপন্যাসিক ও অনুবাদক। তার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’, ‘সংকটের নানান চেহারা’, ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’, ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’, ‘যদ্যপি আমার গুরু’Ñ এসব রচনা আজো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
বুদ্ধিবৃত্তির নতুন ১৯৭২ সালে দৈনিক গণকণ্ঠে ধারাবাহিক ছাপা হয়েছে। গণকণ্ঠের সম্পাদক ছিলেন আল মাহমুদ।
আহমদ ছফাকে ঘিরেও জমত একটি আড্ডা। ঢাকার শাহবাগে আজিজ মার্কেটে ছিল এ আড্ডার আয়োজন। এখানে মেধাবী উঠতি তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে অনেক খ্যাতিমান কবি-লেখক জমা হতেন। যে যার চিন্তা বলার চেষ্টা করতেন। যেকোনো বিষয়ে আহমদ ছফার চিন্তা ছিল একেবারেই আলাদা। ছফা ভাইয়ের এই আড্ডায়ও যোগ দিতেন আল মাহমুদ। এখানে আসতেন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন ছিলেন আহমদ ছফার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসাথে চলাফেরা ছিল তাদের। একদা ছফা ভাই হুমায়ূন আহমেদসহ ক’জন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সাহিত্যের জন্য তারা কেউ বিয়ে করবেন না। সাহিত্য সাধনাই হবে তাদের একমাত্র কাজ। বাংলা সাহিত্যকে তারা নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবেন। কিন্তু বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞাটি আহমদ ছফা ছাড়া কেউ রক্ষা করেননি। আহমদ ছফা তার প্রতিজ্ঞায় অটল ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছফা ভাইয়ের এ আড্ডা ছিল জমজমাট। আমাদের মতো ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল প্রবল। যারা লেখালেখির সাথে নিজেদের সম্পর্ক জুড়ে দিতেন, তারা ছফা ভাইয়ের আড্ডায় আসতেনই।
ছফা ভাই মাহমুদ ভাইকে মাঝে মধ্যে ক্ষেপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন। ক্ষেপানোর কৌশল ছিল ভিন্ন রকম। এবং যখন কোনো কারণে তার মন খারাপ থাকত তখন কৌশলটি প্রয়োগ করতেন। মাহমুদ ভাইকে দেখেই দুই হাত জড়ো করে কপাল পর্যন্ত তুলে বলতেনÑ হায় শামসুর রাহমান একজন দেবতুল্য কবি। প্রথম দিকে মাহমুদ ভাই মনে মনে ক্ষেপে যেতেন। কিন্তু এটি যে ইচ্ছাকৃত তাকে ক্ষেপানোর জন্য করছেন ছফা ভাই, এটি সহসা ধরে ফেললেন আল মাহমুদ। তারপর থেকে ছফা ভাই যখনই দেবতুল্য কবি শামসুর রাহমান বলতেন হেসে উড়িয়ে দিতেন মাহমুদ ভাই।
ছফা ভাইয়ের সাথে খুব লাগালাগি ছিল হুমায়ুন আজাদের। দু’জন কেউ কাউকে ছাড় দিয়ে কথা যেমন বলতেন না, তেমনি লেখায়ও সমানে সমান। হুমায়ুন আজাদ আহমদ ছফাকে আক্রমণ করে লিখতেন কোনো পত্রিকায়। জবাবে ছফা ভাই আরো তীব্র আক্রমণ করে লিখতেন হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে। সন্ধ্যার আড্ডায় এসব বিষয়ে দারুণ মুখরোচক গল্প হতো। মাহমুদ ভাইকে এসব বিষয় বেশ রসিয়ে বলতেন ছফা ভাই। ছফা ভাইয়ের বলার ঢঙ দেখে হাসতে হাসতে ঢলে পড়তে হতো। এমনই রসাল এবং জ্ঞানময় ছিল ছফা ভাইয়ের আড্ডা। আড্ডা থেকে আমরা নানাভাবে উপকৃত হয়েছি।
ষাটের একজন বিশিষ্ট কবি আফজাল চৌধুরী। তিনিও পৃথিবীতে নেই আজ। সিলেটের এ কৃতী সন্তান ছিলেন কলেজশিক্ষক। মাঝখানে চাকরিতে ছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনে। আল মাহমুদের সাথে আফজাল চৌধুরীর ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অন্য সম্পর্কের চেয়ে আলাদা ছিল এ সম্পর্কটি। বিশেষ করে আফজাল চৌধুরী হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন আল মাহমুদকে। মাহমুদ ভাইও তাকে খুব স্নেহের গভীরতায় দেখতেন। আফজাল চৌধুরীর কাব্যগ্রন্থ ‘হে পৃথিবী নিরাময় হও’ বেশ আলোচিত। তিনি একজন অন্যমাত্রার জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। ‘বার্নাবাশের বাইবেল’ অনুবাদ করেছেন তিনি। বলা হয়ে থাকে, হজরত ঈসা আ:-এর ১১ বা ১২ জন সঙ্গী যাদেরকে হাওয়ারি বলা হয়Ñ বার্নাবাশ ছিলেন তাদেরই একজন। বার্নাবাশ লিখিত এ বাইবেলটি আসল বাইবেল বলে অনেক পণ্ডিতজন মতামত দিয়েছেন। কিন্তু খ্রিষ্টান দুনিয়ায় বার্নাবাশের এই বাইবেলটি নিষিদ্ধ। এটির বাংলায় অনুবাদ করেছেন আফজাল চৌধুরী। আল মাহমুদকে তিনি আত্মীয়ের মতো জানতেন। যেন আল মাহমুদের প্রতি আছে তার অতিরিক্ত কর্তব্য। সেই কর্তব্য পালনে তিনি ছিলেন সদা তৎপর।
আফগানিস্তান যখন আক্রান্ত হলো রাশিয়ার ঔদ্ধত্যে। বাংলাদেশে তার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছিল বাংলাদেশের রাজপথ। এ সময় আফজাল চৌধুরী ছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কর্মরত। তিনি আল মাহমুদকে প্রস্তাব দিলেন আফগানিস্তান নিয়ে একটি গ্রন্থ সম্পাদনার। বইটি প্রকাশ করবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। তবে একটি অনুরোধও ছিল সাথেÑ সম্পাদক হিসেবে আল মাহমুদ নামটির সাথে আফজাল চৌধুরীর নামটিও থাকবে। প্রস্তাবটি আনন্দের সাথে গ্রহণ করলেন আল মাহমুদ। কাজটি ভীষণ পরিশ্রম করে গুছিয়েছেন আফজাল চৌধুরী। আফগানিস্তান বিষয়ে সমস্ত তত্ত্ব, তথ্য ও উপাত্ত নিয়ে প্রকাশ পেল গ্রন্থটি। নাম দেয়া হলোÑ ‘আফগানিস্তান আমার ভালোবাসা’। নামটি দিয়েছিলেন আল মাহমুদ। সম্পাদক আল মাহমুদের সাথে আফজাল চৌধুরীর নামটিও ছাপা হয়ে গেল, যা এখন কেবলই ইতিহাস। এভাবেই ইতিহাস দীর্ঘ হয়ে ওঠে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে স্থানান্তরিত হয়। অতীত পৌঁছে যায় বর্তমানের কাছে। আর বর্তমান ছুটতে থাকে ভবিষ্যতের দিকে। [চলবে]

 


আরো সংবাদ



premium cement