২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একজন শব্দযোদ্ধা মাহমুদ দারবিশ

-

কবি মাহমুদ দারবিশ (৩১ মার্চ ১৯৪১-০৯ আগস্ট ২০০৮) ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি হলেও তিনি তাবত বিশ্বের আগ্রাসনবিরোধী মানুষের প্রাণের কবি। বিশ্বের প্রায় পঞ্চাশটি ভাষায় তার লেখা গ্রন্থ অনুবাদ হয়েছে এবং সব ভাষায় অনুবাদকৃত বই ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। ৩১ মার্চ ১৯৪১ সালে অধিকৃত ফিলিস্তিনে জন্ম নেয়া আরব বিশ্বের জনপ্রিয় এই সাম্যবাদী চেতনার কবির প্রতিটি প্রতিবাদী শব্দ ঘৃণিত ইসরাইলকে পরমাণুর চেয়ে শক্ত আঘাত করেছেন। তাঁর শব্দমালা স্বাধীনতা সংগ্রামী ফিলিস্তিনিদের জাগরণের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিল। কবি মাহমুদ দারবিশকে এ জন্য তিনবার জেল ও অনেকবার অবরুদ্ধ গৃহবন্দী হতে হয়েছে।
মাহমুদ দারবিশ ১৯৪৮ সালে মাত্র সাত বছর বয়সে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে গৃহহীন হয়ে নিজের জন্মভূমিতে পরাধীনতার তিক্ত স্বাদ অনুভব করা শুরু করেন। তুখোড় কাব্য প্রতিভার অধিকারী কবি ১৯৫৩ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাবাষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কবিতাটির ভাববস্তু ছিল আবেগ, জিজ্ঞাসা আর আক্ষেপের বিস্ফোরণ। এক ইহুদি বালকের প্রতি আরব বালক মাহমুদ দারবিশের করুণ আবেদনÑ
‘হে বন্ধু
তুমি তোমার খেয়াল খুশিমতো দিনের বেলায় খেলতে পারো
তুমি তোমার খেলনা বানাতে পারো,
তোমার যা কিছু আছে, আমার তার কিছুই নেই
তোমার বাড়ি আছে, আমার নেই,
আমি উদ্ধাস্তু...।
আমরা কেন একসাথে খেলতেও পারব না?’
মাত্র ১২ বছর বয়সী পরাধীন এক কিশোর কবির এমন করুণ আর্তি যেকোনো মানবতাবাদীর হৃদয়ে আন্দোলন সৃষ্টি করবেই।
কবি মাহমুদ দারবিশের অভিনব কর্মকৌশল গ্রামে গ্রামে আসর বসিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস ‘আসমিয়া’ (সন্ধ্যা কবিতা পাঠ) স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বেগবান করেছিল। ‘আসমিয়া’র জাগরণে ভীত ইহুদিবাদী ইসরাইল সরকার সন্ধ্যা থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত কবি মাহমুদ দারবিশকে গৃহবন্দী করে রাখত। ব্রিটিশবিরোধী বাঙালি কবি নজরুলের মতো ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশও বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রিয় কবি। সম্ভবত এই দু’জন কবির চেয়ে কঠোর ও ক্রিয়াশীল ভাষায় পৃথিবীর অন্য কোনো কবি শব্দের চাষ করতে পারেননি। মাহমুদ দারবিশের কবিতায় প্রতিটি শব্দ থেকে নির্গত অদৃশ্য বারুদের তীব্র ঘ্রাণ নির্যাতনকারীর হৃৎপিণ্ড অসুস্থ করে তুলে। মাহমুদ দারবিশের কবিতায় শব্দে শব্দে দারুণ শৈল্পিক কারুকাজের মাধ্যমে প্রেমও রক্তরাঙা প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়ায়,
‘মেঘকে শুধায় নারী : আমার প্রিয়কে তুমিই ঢেকে রেখো
আমার পোশাক যে সিক্ত তার রক্তে।’
কবি মাহমুদ দারবিশ ফিলিস্তিন বা আরব ভূখণ্ডেই শুধু নন, পৃথিবীর দেশে দেশে দখলদার
শক্তিবিরোধী তার কবিতাগুলো বেশ জনপ্রিয়। তাঁর কবিতা যেন অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে বিকল্প অস্ত্র! একজন আরব সমালোচক মাহমুদ দারবিশের কবিতার মূল্যায়ন করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘মাহমুদ দারবিশের কবিতা যদি অস্ত্রের বিকল্প হয়ে না উঠত, তাইলে এতটা সামনে তিনি আসতে পারতেন না।’
ফিলিস্তিনি স্বাধীকার আন্দোলনে তিনি নিজের কলমকে অস্ত্রের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ইসরাইলি দমন-পীড়নে নিজের দেশের দুরবস্থা, জনগণের দুর্দশা ও নিজের মাতৃভূমি বধ্যভূমিতে পরিণত হওয়ার বিষয়ে লিখেছেনÑ
‘ভদ্র লোকেরা, আপনারা আমাদের দেশকে
পরিণত করেছেন কবরে
বুলেটের চাষ করেছেন আমাদের মাথায়
এবং সম্পন্ন করেছেন গণহত্যা।’
গোটা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেন কবি মাহমুদ দারবিশ। কবিতায় শব্দের নিখুঁত চয়ন ও বচনে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর দেশপ্রেমমূলক কাব্যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন এমনভাবে ফুটে ওঠে, যেন তিনি নিজে বা তাঁর কবিতাই ফিলিস্তিনÑ
‘আমি শিখে নিয়েছি সকল শব্দ আর ভেঙে সাজাতে
শুধু একটি শব্দ তৈরির জন্যÑ মাতৃভূমি।’
প্রত্যেক কাজের সুনির্দিষ্ট সময় থাকে। সময়কে ধারণ করতে না পারলে কোনো ফুলে পরাগায়ন হয় না, কোনো নারীও গর্ভবতী হয় না। সাহসী শব্দসৈনিক মাহমুদ দারবিশ তার জনগণকে সূবর্ণ সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বাত্মকভাবে অংশ নেয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে লিখেছেনÑ
‘হ্যাঁ, এখনই সময় দলিল-দস্তাবেজের জন্য উপযুক্ত শব্দ নির্মাণ করার
এখনই সময় দেশ আর বুলবুলির জন্য ভালোবাসা প্রমাণ করার
এই বয়সে অস্ত্রকে করতে হবে বাজনার যন্ত্রে।’
ভাবা যায়, কী বিপ্লবাত্মক কথা! ‘এই বয়সে অস্ত্রকে পরিণত করতে হবে বাজনার যন্ত্রে’র মাধ্যমে তিনি তারুণ্যে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন, তা আর কয়জন কবিই-বা পারে!
জুলুম-নির্যাতন যত বেশি প্রকট হয়, আধিকার আদায়ের সংগ্রাম তত বেশি বেগবান হয়। মজলুম মানবতার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে যেকোনো ক্ষমতাবানের জন্য অনিবার্য ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসে। একজন কল্পিত কারারক্ষীর সাথে কথোপকথনে কারাগারের লৌহকপাট থেকে স্বাধীনতা আসবে বুঝিয়ে মাহমুদ দারবিশের লিখেছেনÑ
‘সেই শিকল থেকে যা দিয়ে তুমি আমায় বেঁধেছিলে গতরাতে।’
সমাজতান্ত্রীক মূলমন্ত্রে দিক্ষিত কবি মাহমুদ দারবিশ মানবিক মূল্যবোধকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতেন। কিন্তু মানবাধিকার হরণকারীদের জন্য তাঁর কোনো সহানুভূতি নেই। সর্বোচ্চ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে কবি মাহমুদ দারবিশ ইসরাইলি দখলদারদের উদ্দেশে লিখেছেনÑ
‘মানুষকে আমি ঘৃণা করি না
কিন্তু ক্ষুধার্ত হলে
জবরদখলকারীর মাংসই হবে আমার খাবার।’
১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরিকারী কবি মাহমুদ দারবিশ ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃত হলেও সমগ্র আরব বিশ্বে তিনি একজন অবিসংবাদিত কবি। ‘পরিচয়পত্র’ কবিতায় কবি লিখেছেনÑ
‘শুনে রাখ
আমি একজন আরব
আমার পরিচয় পত্রের নম্বর পঞ্চাশ হাজার
আট সন্তানের জনক আমি
এবং নবম সন্তান আসছে পরের গ্রীষ্মে
তোমার কি হিংসে হচ্ছে?’
মাহমুদ দারবিশের কবিতায় ইতিহাস-ঐতিহ্য বর্ণিত হয়েছে সাবলিলভাবে। বৈমাত্রেয় ভাইদের সাথে হজরত ইউসুফ আ:-এর শৈশবকালের ঘটনার কাব্যিক বিবরণ দিয়ে লিখেছেনÑ
‘প্রবাহিত মৃদুমন্দ হাওয়া যখন আমার
চুলে দোলা দিয়ে যায়
তখন ওরা ঈর্ষায় কাতরায়।’
শুধু আত্মকেন্দ্রীক চিন্তা-চেতনায় কখনো আবদ্ধ ছিলেন না মাহমুদ দারবিশ। নিজস্ব ক্ষুরধার চিন্তাশক্তি ও উদারতা নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। তিনি শুধু ফিস্তিনের জাতীয় কনন। তিনি বিশ্বকবি, আপামর মুক্তিকামী জনতার প্রাণের কবি। তাবৎ মানবসভ্যতাকে নিয়ে অসাধারণ স্বপ্ন বুনেছেন কবি মাহমুদ দারবিশÑ
‘স্বপ্ন দেখি পৃথিবী তার মানচিত্রের চেয়েও বড়।’
কী বিচিত্র এবং উদার স্বপ্ন দেখুন! অথচ পৃথিবীর দো’পায়া প্রাণীগুলো কতই না স্বার্থপর!
মাহমুদ দারবিশের কবিতার শক্তি ফিলিস্তিনি জাতিকে যেভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে তরঙ্গবিক্ষুব্ধ করে তোলে, সেখান থেকেই বুঝে নিতে হবে, তাঁর কলমের তেজ কত শক্তিশালী ও ধারালো। কবি মাহমুদ দারবিশ ৯ আগষ্ট ২০০৮ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে মৃত্যুর আগে তিনি স্বার্থকতার সাথে দেখিয়ে দিয়েছেন, একজন কবি তাঁর শক্তিশালী অস্ত্র কলমের মাধ্যমে কিভাবে নিজের পরিচয়, মাতৃভূমি, দেশ ও জাতির পরিচয়, হারানো শৈশব নিখুঁত অঙ্কনের পাশাপাশি কলম দিয়ে শব্দ তৈরি করে সে শব্দগুলো জোড়া দিয়ে যুদ্ধ করে। পৃথিবী মহাকাল পর্যন্ত শব্দসৈনিক মাহমুদ দারবিশকে মনে রাখবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement
জামালপুরে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টা ৪৬তম বিসিএস প্রিলি পরীক্ষার আসন বিন্যাস প্রকাশ ছোট দেশ কাতার অর্থনীতি ও কূটনীতিতে যেভাবে এত এগোল আশুলিয়ায় ছিনতাইকারীর হামলায় আহত নারীর মৃত্যু ‘মুসলিমদের সম্পদ পুনর্বণ্টন’ অভিযোগ মোদির, এফআইআর সিপিএমের প্রথম ধাপের উপজেলা ভোটে ২৬ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী বিখ্যাত চালকবিহীনবিমানের আবিষ্কারক কটিয়াদীতে আসছেন গাজার গণকবরের ‘বিশ্বাসযোগ্য ও স্বাধীন’ তদন্তের আহ্বান জাতিসঙ্ঘের চতুর্থ ধাপের উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পেকুয়ায় জমি নিয়ে সংঘর্ষে আহত ১৪ তড়িঘড়ি ও জোরপূর্বক একীভূতকরণ ব্যাংকিং খাতে অব্যাহত দায়মুক্তির নতুন মুখোশ : টিআইবি

সকল