২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মেঘ ও বর্ষার নিঃসঙ্গতা এবং শরত

-

কখনো রোদ, কখনো মেঘঢাকা আকাশ, কখনো রিমঝিম বৃষ্টি, কখনো কদমচেতনায় আন্দোলিত হয়ে ওঠে বিরহী মন। এরই নাম আষাঢ়-শ্রাবণ, এরই নাম বর্ষা এবং তারপরই শরৎ। বাংলায় বর্ষা আসে এমনই হরেক আনন্দ-চেতনার ঢেউ জাগিয়ে। বর্ষার আকাশে মেঘ জমলেই মনে জেগে ওঠে বিরহ-চেতনা। বর্ষায় ভাবুকের মন নিঃসঙ্গ মেঘমালার মতো ভেসে বেড়ায় কল্পনার আকাশে বিরহের পাল উড়িয়ে; মনে হয় যেন কিছু নেই, কেউ নেই...
বর্ষা-বন্দনায় ভাবের মেঘে রাঙিয়ে কবি রচনা করে কত কবিতা, গান...
তৃষ্ণার্ত ভূমিই যেন ডেকে আনে বর্ষাকে; চৌচির ফসলের মাঠ ষোড়শী ললনার যৌবনজ্যোতির মতো ভরে ওঠে নব বর্ষার জলে। পৃথিবীর মাটিতে যেন নতুন করে প্রাণ ফিরিয়ে আনে বৃষ্টি; নতুন করে সবুজ-শ্যামলময় গাছ-গাছালি, লতাপাতায় সবুজের সমারোহে ভরপুর হয়ে ওঠে।
বর্ষার প্রকৃতি অনন্যভাবে সাজিয়ে তোলে বিলের জলে পাপড়ি মেলে বিকশিত হওয়া শ্বেত-হলুদীয়া শাপলা; গ্রামের কিশোর-কিশোরীরা নৌকা বেয়ে ছুটে যায় বিলে, মনভরে শাপলা তুলে, অগভীর জলে ডুব দিয়ে তুলে আনে শালুক। আর স্থলের বাতাসে ভাসে শিউলি, বেলী, কামিনী ও কেয়ার মুগ্ধময় সুবাস। কদম গাছগুলো ভরে ওঠে ফুলে ফুলে...
বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টিমুখর স্তব্ধতা যেন মনে করিয়ে দেয় কত কথা, কত স্মৃতি, মনে করিয়ে দেয় শৈশবের স্মৃতিরাঙানো দিনগুলো, মনের আকাশে মেঘের মতো ভেসে বেড়ায় হারানো প্রিয়জনের কথা; কাছে পেতে চায় তাকে।
কালীদাসের মেঘদূত কাব্যে এমন দৃশ্যই অঙ্কিত হয়েছে মেঘরাঙা বর্ষায়। রামগিরির নির্জনতায় নির্বাসনরত বিরহী যক্ষের মনও আন্দোলিত করেছিল এমন বর্ষার মেঘ, বিষণœ মেঘমালা যক্ষের মনে জাগিয়ে তুলেছিল স্ত্রীকে কাছে পাওয়ার বিরহ-বিষণœ চেতনা।
বর্ষার প্রথম মেঘই ক্লান্ত কৃষকের মনে সাময়িক অবসরের জানান দিয়ে যায়। কৃষকের লাঙল, কাস্তে-কোদাল, নিড়ানি এবার ঘুমোবে ঘরের কোণে, ওদের ঘুম ভাঙবে তখন, যখন কার্তিকের পাকা ধানের সোঁধা গন্ধে মেতে উঠবে বাংলার বাতাস।
বর্ষায় কিষাণ-কিষাণীর নির্দিষ্ট কাজ থাকে না। এসময় গবাদি পশুর খাদ্যের কিছুটা অভাব দেখা দেয়। তাই ভোরে ঘুম থেকে উঠেই কৃষক নৌকা নিয়ে চলে যায় বিলের ধারে কিংবা হুর হুর বাতাসে উড়ে বেড়ানো আমন ধানের ক্ষেতে; ধানের চারা খুব ঘন হয়ে উঠলে সেখান থেকে বেছে তুলে নিয়ে আসে কচি ধানের ডগা, অথবা বিলের ধারে স্বছন্দে ভেসে বেড়ানো কচুরিপানা কেটে নিয়ে আসে গবাদি পশুর খাদ্যের অভাব পূরণ করতে।
অবসর বসে বসে আনন্দ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কার্তিকের অপেক্ষা করতে থাকে কৃষককুল; এসময় গ্রামের কৃষককুল নানান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আনন্দে মত্ত হয়ে থাকে। রাত হলেই উঠোনে উঠোনে বসে বাউলের আসর, গাজীর গান, রায়জনপুরীর কিচ্ছা; নিজস্ব অভিনয়ের মাধ্যমে আয়োজন করে যাত্রাপালা; আপন-দুলাল, গরিবের আর্তনাদ, কাশেম মালার প্রেম, সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামানের মতো কিংবদন্তি কল্প-কাহিনীর অভিনয়। উপচেপড়া মানুষের ভিড়ে নাট্যমঞ্চের অভিনয় যেন রাঙিয়ে তুলে বর্ষার প্রকৃতিকে।
বর্ষার বিকেলে পাড়ায় পাড়ায় জমে উঠে বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি খেলার ধুম। কাবাডি মূলত বর্ষাকালীন খেলা। বিবাহিত বনাম অবিবাহিত দলে বিভক্ত হয়ে গ্রামের কৃষক-শ্রমিক-যুবকেরা আনন্দের মধ্য দিয়ে শক্তির লড়াইয়ে মেতে ওঠে।
প্রতি বর্ষায় গ্রামে আয়োজন হয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার। লম্বা নৌকায় চড়ে বাহারি সাজে সেজে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জয়লাভ করতে যুবকেরা অংশগ্রহণ করে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায়।
বর্ষার গ্রাম-বাংলা আরেক অনন্য উৎসবে মেতে ওঠে, তা হলো ‘কাঁঠালি দাওয়াত’। শ্বশুরবাড়ি কর্তৃক জামাইবাবুদের নিয়ে কাঁঠালি দাওয়াতের আয়োজন না করলে, জামাইরা মান করে ফুলে-ফেঁপে থাকে। তাই বর্ষার শুরুতেই প্রস্তুত নিতে হয় শ্বশুরদের।
ছইওয়ালা নৌকা ভাড়া করে স্ত্রী-সন্তানসহ বেশ আনন্দের সাথে আম-কাঁঠাল নিয়ে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যায় জামাইবাবুরা। কিন্তু সে সময় শ্বশুরবাড়িতে রাত্রি যাপনের সুযোগ থাকে না, বিকেলের আকাশে মেঘ জমলেই তড়িঘড়ি খেয়েদেয়ে শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করে নিজ বাড়িতে ফিরে আসতে হয়। কেননা বাড়িতে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি বৃষ্টিতে ভিজে না জানি কষ্ট পায় কি না!
কিষাণীদের অবসর দিন কাটাতে ভালো লাগে না। যারা নিজেদের সবসময় গৃহস্থালি কাজের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করে, এমন অবসর কি ভালো লাগে! ওরা ঘরে বসে বসে কাঁথা সেলাই করে, কাঁথায় বিচিত্র নকশা আঁকে, সুতোর বুননে তৈরি করে রঙ-বেরঙের হাতপাখা।
বর্ষার শেষদিকে খাল-বিল কিংবা নদীতে মাছ ধরার ধুম পড়ে যায়। হরেক রকমের জাল, বড়শি ও কোঁচ নিয়ে মাছ শিকারে মেতে ওঠে গ্রামের মানুষ। এর অল্পদিন পরই কৃষককে আমন ধান কাটার প্রস্তুতি নিতে হয়। বাংলার রূপময়ী এমন বর্ষার রূপ পৃথিবীতে বিরল। এ বিরল রূপ আরো রূপসী হয় শরতে। সাদা মেঘের ভেলায় ভরে উঠবে আকাশ। এসে গেছে ভাদ্র। এ ভাদ্রেই শুরু শরতের। শরত আমাদের আনন্দ দেয়। নির্মল পরিবেশ এবং সাদা মেঘের ফাঁকে গভীর নীল আকাশ এনে দেয়। আমরা দেখি আর হৃদয় উদার করি মনের সুখে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল