২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ডেঙ্গু

-

বেলা ১০টা। ক্ষুধায় শরীরটা কাঁপছে জুলেখার। ভোরের আঁধার কেটে যাওয়ার আগেই ওরা কোদাল-ঝাঁকা নিয়ে মাটি কাটতে এসেছে। ক’দিন ধরে বৃষ্টিবাদল নেই। সেই সুযোগে মাস্টার মশাই দু’বেলা মাটি কাটিয়ে নতুন ভিটা ভরাট করছেন। নতুন বাড়ি করবে কি না তাই ভিটার চার দিকে বাঁধ দিয়ে সকাল-বিকেল মাটি ফেলছেন সেখানে।
সাড়ে ১০টার সময় শরিফ মাস্টার নিজে এসে সবাইকে বললেনÑ এখন রাখো, হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নাও। একটু জিরিয়ে নাও। তারপর আবার কাজে লাগো।
সবাই হাতমুখ ধুয়ে ওখানেই লাইন ধরে খেতে বসল। কেউ এনেছে কয়েকটি রুটি আর সবজি নিরামিষ। কেউ পানতা কেউ খিচুড়ি। সবাই তৃপ্তি ভরে খাচ্ছে। জুলেখার মনটা ভালো নেই। সে ধীরে ধীরে তার কাপড়ে বাঁধা মুখ বন্ধ প্লাস্টিকের বাটিটা বের করে হাত দিলো পানতা ভাতে।
দুটো কাঁচা মরিচ আর দুটো পেঁয়াজও রয়েছে। এই খাবারেই জুলেখা খুশি থাকে। কিন্তু আজ তার খেতে ইচ্ছে করছে না। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবেÑ আহারে বাছা, আমার ঘরে একলা রইছে। রাইতে শরীলডা গরম দেখলাম। বেশি কইরা জ্বর আইল কি না অহন জানমো কেমনে। চাইড্ডা পানতা থুইয়া আইলাম খাওনের লাইগা। তা কামডা ভালা অইলো না। এই শরীলে পানতা খাইয়া বাপ আমার অসুখ না বান্দায়। কৌটায় অল্প চাইড্ডা আটা তো আছিলই। দুইখান রুটি তো বানাইয়া দিবার পারতাম। হায়রে আল্লাহ আমি কী করলাম। নিজে আতে পোলডার ক্ষতি কইরা দিলাম।
জুলেখা খুব সভ্য শান্ত মেয়ে। একটু ধীর প্রকৃতির। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে কাজকর্মে তেমন চালু ছিল না। কাজ সবই করত কিন্তু ধীরেসুস্থে। কারো সাথে কোনো দিন ঝগড়াও করতে পারে না। যেমন পারে অন্যান্য অশিক্ষিত বউ-ঝিয়েরা। কিছু দিন কেটে যাওয়ার পর শ্বশুর-শাশুড়ি বিরক্ত হলো। বউয়ের অমন আলসেমি ধরনের চলাফেরা তাদের পছন্দ নয়। স্বামী প্রথম দিকে ওকে পছন্দ করত। নরম স্বভাবের। কোনো দিন মুখে মুখে কথা বলে না। মুখে সারাক্ষণ মিষ্টি লাজুক হাসি। এসব রশিদের খুব ভালো লাগত। দিন যেতে যেতে মা-বাবার কথায় তার মনও তীক্ত হয়ে উঠল। এক সময় শ্বশুর-শাশুড়ির মতো স্বামীও খারাপ ব্যবহার শুরু করল।
ইতোমধ্যে কোলজুড়ে এলো এক ছেলে বাচ্চা। জুলেখা খুশিতে আটখানা হয়ে ছেলের নাম রাখল বিজয়। বিজয় শব্দের অর্থটা সে একদিন মাস্টার মশাইয়ের মুখে শুনেছিল। তাই এ নামটি তার ছেলের জন্য পছন্দ হয়। নানা অপমান-অত্যাচার সহ্য করেও জুলেখা ছেলে নিয়ে খুব খুশি ছিল।
একদিন বিকেলে জুলেখা ভাত রান্না করছিল। এমন সময় রশিদ এসে চিৎকার করে মাকে ডেকে বলে, মাÑ ওমা, গরুর চাড়ে তো পানি নাই। তোমরা আইজ চাড়ে পানি দেও নাই?
মা রেগে বলে, তোর বউয়েরে জিগা। দিন ভইরা কামের খেয়াল না কইরা খালি পোলা নিয়া আহ্লাদ। আপোলাতির পোলা অইছে। অমন পোলা আর মাইনষের অয় না। একটা কাম করতে তো তার চাইড্ডা ঘণ্টা লাইগা যায়।
মা-বাবার মুখে এসব কথা শুনে শুনে রশিদ অতিষ্ঠ। তার আর ভালো লাগে না। সে রান্নাঘরে গিয়ে জুলেখাকে খুব ক্ষীপ্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেÑ আইজ চাড়ে পানি দেসনাই ক্যা?
জুলেখা ভয়ে ভয়ে বলেÑ সকালে তো দিসি। দুপুরে দিতে ভুইলা গেছি। আমারে মাফ কইরা দেও। অহনই পানি দিয়া দিতাছি। ভাত অইয়া গেছে। ঠেকনাডা দিয়াই যাইতাছি।
রশিদ আবার রেগে বলেÑ তুই আগে চাড়ে পানি দে। গরু পানি পিয়াসে কাঁপতাছে।
দিমু তো। ভাত বেশি নরম অইয়া গেলে তা নিয়া আবার অশান্তি অইব।
কী কইলি আমার মা-বাপে তোরে খালি অশান্তি করে? আইজ তোর একদিন কি আমার একদিন।
রশিদ নিজের রাগ সংবরণ করতে না পেরে জুলেখাকে মারতে শুরু করল। মারতে মারতে এক সময় অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল জুলেখা। কিছুক্ষণ ওভাবেই পড়ে রইল। তারপর শাশুড়ি চোখে-মুখে পানি দিলে জ্ঞান ফিরে এলো।
রশিদের মা তাকে বলল, বাবা একখানা সত্য কতা কইতাছি। আমরা আর এই বউ নিয়া খামু না। কাইল ওরে বাপের বাড়িতে দিয়া আইবা। ওরে আমরা তালাক দিমু। তোমারে ভালা একখান গুণী মাইয়া দেইখা বিয়া করামু বাবা। তুমি চিন্তা কইরো না।
কথাটি শুনে রশিদের বুকের ভেতরটা আনচান করে উঠল। কিন্তু কেন এমন হলো সে তা জানে না। সে কোনো কিছু না ভেবে বলে দিলোÑ আমি পারুম না। তোমরা পছন্দ কইরা ওরে আনছিলা। এইকাম তোমরাই কইরো।
পরের দিন দুপুরবেলা কাজ শেষ করে মাঠ থেকে লাঙল কাঁধে গরু নিয়ে রশিদ বাড়ি ফিরে। ফিরেই ডেকে বলে, জুলেখা এক গ্যালাস পানি খাওয়াও। গরু গুলানরে খাওন দেও।
রশিদের মা পানি হাতে নিয়ে এগিয়ে যায়। বলে, নে বাবা পানি খা। কারে ডাকতাছ বাবা। ওই দুর্মুশি মাইয়া মাইনষেরে আর ডাইকো না। তারে তোমার বাপে পার কইরা দিয়া আইছে। অলক্ষ্মীর কতা আর মনে রাইখো না।
রশিদ তখনো বুঝতে পারে না কিসের ব্যথায় তার হৃদয় টনটন করে উঠল। কেন দু’চোখ ভরে জোয়ার এলো। তা লুকাতে তাকে মায়ের চোখের সামনে থেকে পালাতে হলো। তবে সে একটি কথা জানে, তার মা-বাবার কথাই তার জীবনের শেষ কথা।
জুলেখার বাবা বেঁচে নেই। একটি ভাই। শহরে রিকশা চালায়। ওখানেই তার পরিবার। খালি বাড়িতে ভয়ে ভয়ে তার দিন কাটে। সারাক্ষণ আল্লাহকে ডাকে। চার দিকে ধর্ষণ-খুন-লুটপাটের কথা শুনে সে শিউরে ওঠে। মানুষের বাড়িতে কাজ করে তার জীবন ধারণের খরচ জোগায়। ছেলেটাকে খালি বাড়িতে একা রেখে যেতে সাহস হয় না তার। তাই সাথে নিয়ে যায়।
যথারীতি তার তালাক হয়ে যায় এবং রশিদ আবার বিয়েও করে। শরিফ মাস্টার গ্রামের একজন দয়ালু মানুষ। তিনি বিচার করে জুলেখার ছেলের খোরপোশের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জুলেখা চায়নি বলে তা সম্ভব হয়নি। জুলেখার মনে জমে থাকা কষ্ট অভিমান হয়তো কেউ কোনো দিন জানবেও না, কেউ খবরও নেবে না। তবুও সে তো মানুষ, তারও কষ্ট হয় অভিমানে চোখে জল আসে।
বিজয় তার চোখের মণি। সাত রাজার ধন। তাকে বুকে নিয়ে তার রাত কাটে। তার মুখে দু’মুঠো খাবার জোগাড়ের প্রত্যাশায় তার দিন কাটে।
দুপুর ১২টা বাজে। মাটি কাটা শেষ করে জুলেখা বাড়ি যায়। গিয়ে দেখে ছেলে পানতাটুকুও খায়নি। না খেয়ে বিছানায় পড়ে আছে। গায়ে ভীষণ জ্বর। সে তাড়াতাড়ি ছেলের মাথায় পানি ঢালে। ছেলের জন্য দুটো রুটি বানায়। কিন্তু ছেলেকে রুটি খাওয়াতে পারে না। জোর করে একটু খাওয়াতে গেলে বমি করে দেয়। কী করবে জুলেখা। গ্রামের এক হাতুড়ে ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ এনে ছেলেকে দু’বেলা খাওয়াতে থাকে।
ছেলে ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। শরীরে প্রচণ্ড জ্বর। খুব মাথাব্যথা। চোখ ব্যথা। পেটে কিছু নেই তবুও বমি করছে। সামান্য লালচে পানি পড়ছে। গায়ে লাল ফুসকুড়ি। শরীর ব্যথা। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এমন অবস্থায় অসহায় জুলেখা কী করতে পারে। সে আল্লাহকে ডাকছে আর কত কী মানত করছে। মাস্টার মশাইয়ের কাছে গেলে হয়তো কিছু সাহায্য পাওয়া যেত। তার বাড়ি একটু দূরে। এমন অবস্থায় ছেলেকে রেখে সে যাবেই বা কী করে।
জুলেখা কয়েক দিন কাজে যায়নি বলে শরিফ মাস্টার জানতে পারে জুলেখার ছেলেটা খুব অসুস্থ, তাই কাজে যেতে পারছে না। কথাটি শুনেই তিনি আর দেরি না করে নিজেই দেখতে যান বিজয়কে। অবস্থা দেখে দয়ালু শরিফ মাস্টার একটি ভ্যান ডেকে বিজয়কে হাসপাতালে নিয়ে যান। বুকের কাছে ছেলেকে ধরে ভ্যানের ওপর বসে থাকে জুলেখা। চোখের পানিতে দুই গণ্ড ভেসে যায়।
ডাক্তার দেখেই বুঝতে পারে ডেঙ্গু হয়েছে। রক্তশূন্যতা হয়েছে চরমভাবে। তাড়াতাড়ি ব্লাড গ্রুপিং করা হয়। ডাক্তার জানান ও-নেগেটিভ রক্ত জোগাড় করতে হবে। তিনি বলেন, এই রোগ হলে ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ হয়। বমির সাথে রক্ত যায়, এমনকি কান দিয়েও রক্ত পড়তে পারে।
মাস্টার মশাইয়ের সৌজন্যে ডাক্তার বেশ গুরুত্ব দিয়েই বিজয়কে দেখছেন। মাস্টার মশাইয়ের চেষ্টায় দুই ব্যাগ ব্লাড জোগাড় হলো। আজকের ব্যবস্থা হলো, কিন্তু কালকের জন্য ব্যবস্থা রাখতে হবে।
শরিফ মাস্টার বলেন, ডাক্তার সাহেব এ আবার কেমন রোগ এলো দেশে? নাম ডেঙ্গু, এমন নাম তো জীবনে শুনিনি ডাক্তার সাহেব।
ডাক্তার বললেন, কী আর বলব মাস্টার মশাই। যান্ত্রিক সভ্যতা মানুষকে দিয়েছে সুখ-ভোগের অঢেল প্রাচুর্য। তবে কোনো সভ্যতাই মানুষকে সম্পূর্ণ সুখী করতে পারেনি। দেয়নি শান্তি ও স্বস্তি। বর্তমান প্রেক্ষাপটও তার ব্যতিক্রম নয়। আজকের সভ্যতাও আমাদের জীবনে প্রসারিত করেছে বহুবিধ সম্পদের কালো ছায়া। তার মধ্যে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ অন্যতম। এই পরিবেশ দূষণের ফলেই আজকের দিনে নোংরা পরিবেশে জন্ম নিয়েছে এক ভয়াবহ জীবাণু বহনকারী ক্ষুদ্র পতঙ্গ, যার নাম এডিস মশা। যার দংশনে মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এ রোগের আলাদা কোনো চিকিৎসা নেই। তবে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়। প্রথম দিকে হাসপাতালে নিয়ে এলে বাঁচানো সম্ভব।
এ রোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের চার পাশ তথা পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কোথাও কোনো পানি জমে থাকলে সেখানে এডিস মশা ডিম পাড়ে। তাই কোথাও পানি জমিয়ে রাখা উচিত নয়।
পরের দিন বিকেলে জুলেখার ছেলে তার বুক খালি করে তাকে একা করে দিয়ে চলে গেল। জুলেখার জীবনের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিলো ভয়ঙ্কর ডেঙ্গু জ্বর। এই শোকে কান্নার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছে সে। ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে আছে।
মাস্টার মশাইয়ের বাড়িতে জুলেখার ঠাঁই হলো। দিনকাল ভালো না, এ অবস্থায় মাস্টার মশাই জুলেখাকে অমন ফাঁকা বাড়িতে একা থাকতে দিতে পারেন না। তাই তিনি বললেন, মা তুই কোনো চিন্তা করিস না। তুই তোর চাচীর কাছেই থাকতে পারবি। তার রান্নায় সাহায্য করবি তাই হবে।
মাস্টার মশাইয়ের তিন ছেলে। বড় ছেলের জন্য নতুন বাড়ির ব্যবস্থা হচ্ছে। দুই ছেলে অবিবাহিত। ওখানেই বা জুলেখার কতটা নিরাপত্তা আছে তা কে বলতে পারে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement