২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিচ্যুতিবলয়

-

অনেক বছর আগে এই ক্যাম্পাস, এই ভবন, এই ঘাসে ছাওয়া মাঠ, বৃক্ষরাজি একটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলাম, আজ আবার ফিরে এলাম। আজ আমি এই মেডিক্যাল কলেজে একজন গায়নোকোলজিস্ট হিসেবে জয়েন করলাম। একদিন এই মেডিক্যাল কলেজেই আমি ছাত্রী হিসেবে চিকিৎসাশাস্ত্রের জটিল ধাপগুলো একটি একটি করে অতিক্রম করেছিলাম। এখানেই আমরা সবাই ইন্টার্ন করেছিলাম দল বেঁধে বন্ধুত্ব ভাগাভাগির মধ্য দিয়ে। আমরা ‘ডিউটি’ ধার করে আবার ‘ডিউটি’ শোধ দিতাম। কী অদ্ভুত ছিল সেসব দিন!
আনন্দময় স্মৃতির সাথে সাথে বেদনাময় স্মৃতিও থাকে। যেমন গোলাপের সাথে থাকে কাঁটা। মনে পড়ছে সোমার কথা, বিরলতম বন্ধু সোমার কথা। সবাই বলতÑ
‘রিমি সোমা দুই শরীর এক আত্মা’
সেদিন আমার রাত্রিকালীন ডিউটি ছিল। আমরা হোস্টেলে থাকতাম। কিন্তু বিয়ের পর থেকে ও শ্বশুরবাড়িতে থাকত।
আমি ডিউটিরুমে বসে আছি, মাত্রই ওয়ার্ড থেকে ফিরেছি। বাইরে একটা গোলযোগ উঠল। সরকারি হাসপাতালে গোলযোগ লেগেই থাকে, তাই বলে এই মাঝরাতে! সরকারি হাসপাতালেও রাত নিশুতি হয়। চিকিৎসকেরা জেগে থাকলেও অন্য মানুষজন ব্যথা বেদনা হজম করে নিদ্রা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে।
বাইরের গোলযোগ থেকে দু-তিনবার উচ্চারিত হলো ‘সোমা’ ‘সোমা’। জানি না কেন যেন বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। কে যেন আর্তনাদ করে উঠলÑ
-সোমাকে ওটিতে নিতে হবে, ওটিতে নিতে হবে...
গায়ের অ্যাপ্রোন, গলার স্টেথো উড়িয়ে আমি দৌড়াতে লাগলাম গোলযোগের দিকে। হাসপাতালের সুদীর্ঘ করিডোর যেন আরো দীর্ঘ এক পাইথন। কানে আসছে জলির চিৎকার,
-সোমা এসেছে! সোমা এসেছে!
সোমা এসেছে তাতে চিৎকার করার কী হলো! জানি তো আজ ওর ডিউটি নেই, তাহলে অন্য কারো ডিউটি করতে কি এসেছে! তাছাড়া ওরা তো হানিমুন সেরে কক্সবাজার থেকে আজই ফেরার কথা। আমরা বন্ধুরা ওকে বেশি ডিউটি করতে দেই না। সদ্য বিয়ে হয়েছে তো, তাই।
হ্যাঁ, সেদিন আমার বন্ধু সোমাই এসেছিল কিন্তু হেঁটে নয়। একটা বাঁশের চাটাই দিয়ে মোড়ানো অবস্থায়। ফেরার পথে বাসে, বাসের হেল্পার আর কয়েকজন ছেলে মিলে ওকে ক্ষতবিক্ষত করে, হত্যা করেছিল। পাথরের মূর্তি ছাড়া, ওর জন্য আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। লাশ কাটা ঘরে ওর ময়নাতদন্ত দেখতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।
আজও ওর জন্য বুকের গহিনে এক জমাট বাঁধা নিদারুণ দুঃখ আর ব্যর্থ ক্ষোভ বয়ে বেড়াই, যা আমৃত্যু যাবে না। প্রিয় বন্ধু আমার!
থাক ওর কথা। পুরনো গন্ধের সিন্দুকটা বন্ধ করে কর্তব্যে মনোসংযোগ করি।

২.
জয়েন করার এক মাস পার হয়ে গেছে। চেম্বারে আছি। রোগীদের উপচে পড়া ভিড় হালকা হয়ে আসছে। ঘড়ির দিকে তাকাই। কর্তব্য করে যাচ্ছি কিন্তু মনটা পড়ে আছে বাসায়। ছোট মেয়েটার জ্বর, একটু তাড়াতাড়ি যদি ফিরতে পারতাম!
একজন বয়স্ক মহিলা একটি বালিকার হাত ধরে প্রবেশ করলেন। বসতে বললাম।
তিনি চেয়ারে বসে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেনÑ
-বলুন, কী সমস্যা? কথা বলতে বলতে আমি বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকাই। আশ্চর্য, মেয়েটি ঘন ফ্রিলের ফোলা যে ফ্রকটি পরেছে ঠিক এমন একটি ফ্রক আমার মেয়েরও আছে। হাসি পেল, আড়ং নামের বুটিকশপের অনেক আউটলেট এই শহরে ছড়িয়ে আছে। অবাক হওয়ার তো কিছু নেই।
-আমি একটু একা কথা বলতে চাই।
অনুমান করতে কষ্ট হয় না, ছোট মেয়েটি হয়তো প্রথম পিরিয়ডের মুখোমুখি হয়েছে। গার্জেনরা দুশ্চিন্তায় পড়েছে। অহরহ এমন গার্জেনরা আসেন, একা কথা বলতে চান অথচ পিরিয়ড বা মাসিক একটি স্বাভাবিক ব্যাপার।
-অসুবিধা নেই, আপনি বলেন। তার পরও তিনি কিছু না বলে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পিয়ন শিরিনের দিকে তাকান। আমি হাত ইশারায় ওকে বেরিয়ে যেতে বলি। এরপর তিনি মেয়েটির দিকে চোখের ইশারা করে বলেনÑ
-তুমি ওকে পরীক্ষা করে বলো তো ওর কী হয়েছে...
-আচ্ছা, পরীক্ষা করব। তার আগে বলুন ওর সমস্যা কী... কোনো উত্তর নেই।
-বলুন আপনি, ও কী কী অসুবিধার কথা বলে? আচ্ছা আপনি ওর কী হন? নিরুত্তর- কেমন যেন মরা মাছের চোখে তিনি তাকিয়ে থাকেন আমার মুখের দিকে।
-দেখুন, আপনি খুলে না বললে আমি কিভাবে ওর চিকিৎসা করব? আরো কিছু সময় বয়ে যাওয়ার পর তিনি হুড়মুড় করে এসে আমার হাত চেপে ধরেনÑ
-মা, আমাকে বাঁচাও মা, ও আমার নাতনি। ওর বয়স কম, ও খুব ছোট, ওর মা অসুস্থ... বাচ্চাটা আমার মরে যাবে মা... লোকে জানলে কী হবে...আমি এখন কী করব মা... অবাক হয়ে বাচ্চাটির দিকে তাকাচ্ছি। ওর সামনে এমন করা, প্রলাপ বকা কতটা শোভন হচ্ছে...
-তুমি ওকে পরীক্ষা করো। ওর পেটে হাত দিয়ে দেখ... এবার চমকে গিয়ে ভালো করে মেয়েটির দিকে তাকাই, আমার বুক নবীন ডাক্তারদের মতো ঢিব ঢিব করতে থাকে। উঠে ওর হাত ধরে বেডের কাছে নিয়ে যাই। শুয়ে পড়লে ওর জামাটা তুলে পেটে হাত দেয়ার আগেই ঘটনা বুঝে যাই। আমার পায়ের নিচের মাটি দুলে ওঠে!
-তোমার নাম কী মা? কী বললে? নাম শুনে আমি আরো যেন হতবিহ্বল হয়ে যাই। একটা ঘোরের ভেতরে চলে যাই।
চেয়ারে বসে কলিং বেলে হাত রাখলে শিরিনের প্রবেশ। ওকে বুঝিয়ে দিয়ে, বললাম
-একে নিয়ে যাও। ওরা চলে গেলে মুখ ফেরাই ভদ্র মহিলার দিকেÑ
-এবার বলুন তো, ঘটনা কী?
-মা, আসলেই কি ঘটনা সত্যি? আমরা যা আশঙ্কা করছি সেটাই? ও বাঁচবে তো মা...
মাথায় ঝড় বইছে, ভাবছি আমার ডায়াগনসিস যেন ভুল হয়। মুখে বললামÑ
-আপনি বসেন, আমি আসছি।
আলট্রাসনোগ্রাম শেষ হলো। ৪ পেরিয়ে ৫ মাসে পড়েছে। এসব ঘটনা আজকাল আমাকে এক অন্ধকার নিতল বিবরে ঠেলে দেয়। আমি বিষাদগ্রস্ততায় ভুগি। আমি একজন চিকিৎসক, বিষাদ, হতাশা আমার জন্য বিলাসিতা। রোগ আর রোগীই আমার কঠিন বাস্তবতা। কিন্তু ঘরে আমার এই বয়সের একটি ছোট্ট মেয়ে, যার মুখে এখনো মায়ের দুধের গন্ধ লেগে আছে! যার ফ্রক বয়স আর নামের সাথে এই বাচ্চাটির কাকতালীয় এবং অদ্ভুত এক মিল! তাই বলে এতটা মিল! কেন এই মিল!

৩.
-এবার আপনি বলুন, এমন ঘটনা কী করে ঘটল!
-মা! তুমি আমার চেয়ে বয়সে ছোট, তাই তুমি করে বলছি। তাছাড়া আমি একসময় গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলাম। আমার মেয়েও একজন শিক্ষক। সেই ওর ব্যাপারটা প্রথম বুঝতে পেরেছে। মহিলার কণ্ঠ এবার গভীর, শান্ত।
মেয়ের এই খবর ওর মা নিতে পারেনি। অনেক ট্যাবলেট খেয়ে ফেলেছে, সে এখন হাসপাতালে। তুমি আমাদের রক্ষা করো মা। আমার অনুরোধ... তার কথার মাঝখানে অসহিষ্ণু স্বরে, চিৎকার করে উঠলামÑ
-বাচ্চাটির যা করা লাগে আমি করব। যদিও মাথায় ঝড় বইছে এই অবস্থায় এবরশন অনেক রিস্কি হবে। ওকে সুস্থ করে তুলব, ওকে আমি বাঁচাব। কিন্তু কাজটি করেছে কে? কোন নরাধম? ওর কাজিন? কাজের ছেলে? কে? আপনি বলুন দরকার হলে আমি নিজে থানায় যাবো... সেই জানোয়ারটার শাস্তি হওয়া দরকার। এসব নোংরা লোকেরা সমাজের কলঙ্ক।
বলুন কে করেছে? এসব ধামাচাপা দেয়ার বিষয় নয়, লুকানোর বিষয় নয়! তাছাড়া, আপনারা বাসায় করেন কী? বাচ্চাদের দেখেশুনে রাখতে পারেন না! আজব! এত্তটুকুন মেয়েকে কোন সে হারামজাদা এভাবে...
ক্রোধে মাথা ফেটে যেতে লাগল। সম্ভবত আমার জ্বর আসছে, মাথা দপদপ করছে। চোখের চার পাশে কালি, ফ্যাকাসে ছোট্ট মেয়েটার মলিন মুখ ঘরময় ভাসতে লাগল।
আপনি কথা বলছেন না কেন! কথা বলতে লজ্জা লাগছে! নাম বলুন, বলছেন না কেন! মাথা দপ দপ করছে...গায়ের উত্তাপ বেড়ে যাচ্ছে...নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি...
এমন সময় চেম্বারের বাইরে একটা গোলযোগ উঠল। শোরগোল বেড়ে যাচ্ছে, কে যেন আমার নাম ধরে চিৎকার করছে। কে? এ কার গলা? এ তো সোমা! সোমা আমার মেয়ের নাম ধরে আর্তনাদ করছেÑ এখানে সোমা আসবে কোত্থেকে! কিন্তু আমি শুনতে পাচ্ছি ওর আর্তনাদÑ
-রিমি, ওকে বাঁচা রিমি! ওকে বুকে তুলে নে, ওকে মরতে দিস না। এরা এভাবে মরতে পারে না! আমি দৌড়াতে থাকি... দৌড়াতে... থাকি... অনিঃশেষ দৌড় ফুরায় না। করিডোর ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে শেষ মাথায় দেখি আমার নিজের মেয়েটাকে চাটাইয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে আসছে... আমার মেয়ে! আমার ছোট্ট মেয়ে! না, না, আমার মেয়ে নয়, এ তো প্রেগন্যান্ট মেয়েটি! আসলে কোন মেয়েটি? আমি বুঝতে পারি না!
ঘামে জবজব হয়ে যায় আমার শরীর, জ্বর, প্রচণ্ড জ্বর, পিপাসা...পিওন শিরিন এসে আমাকে ধরে ফেলে,
-ম্যাডাম, আপনার কী হয়েছে? খারাপ লাগছে? মাথা ঘুরছে? চলেন বাসায় চলেন...
সম্বিত ফিরে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত আমি শিরিনের ঘাড়ে নিজের মাথাটা এলিয়ে দেই।

৪.
বালিকার নানী নিশ্চুপ।
চশমা আর কানের মেশিনটা খুলে হাতে নিয়ে স্থির বসে থাকেন। নৈঃশব্দের এক ঘেরাটোপ সব কোলাহলকে গিলে খায়।
একজন পরাজিত শিক্ষক। সারাটা জীবন তিনি অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এসেছেন, কিন্তু আজ তিনি জানোয়ার, হারামজাদা, নরাধমের সাথে কিছুতেই ‘পিতা’ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারলেন না। হ


আরো সংবাদ



premium cement
গৌরীপুরে পুকুর থেকে মাদরাসাছাত্রীর লাশ উদ্ধার বুড়িচংয়ে হিটস্ট্রোকে শ্রমিকের মৃত্যু নলছিটিতে স্বামীর নির্যাতনে স্ত্রীর মৃত্যুর অভিযোগ ইউপি চেয়ারম্যানরা পদে থেকেই উপজেলা নির্বাচন করতে পারবেন খুলনায় ইসতিসকার নামাজ আদায় ইথিওপিয়ার উত্তরাঞ্চলে সংঘর্ষে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত শিশুদের বিকাশে অটিজম অভিভাবকদের সচেতনতা ফরিদপুরে মন্দিরে আগুন : দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বিএনপির তদন্ত কমিটি নেতাদের মুক্তির দাবিতে রিজভীর নেতৃত্বে নয়াপল্টনে বিএনপির মিছিল বৃষ্টির জন্য দেশবাসীর প্রতি ইস্তিস্কার নামাজ আদায়ের আহ্বান আমিরে জামায়াতের সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে চুক্তি স্বাক্ষর করল তুর্কি, ইরাক, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত

সকল