২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`
স্মৃতির সোনালি শিখা

যেমন দেখেছি তাঁকে

-

সতেরো.

সময়টি নব্বইয়ের দশক। অবশ্য এ দশকের শেষপাদে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল একটি সংগঠন। নাম-‘জাতীয় নাগরিক ফোরাম’। এর সদস্য সংখ্যা ছিল ১২ শতাধিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন কুড়িজনের বেশি। সরকারি বেসরকারি মিলেই ছিলেন এসব ব্যক্তিত্ব। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, অভিনেতা, শিক্ষাবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, আলেম ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এদের সবার প্রতিনিধি ছিলেন জাতীয় নাগরিক ফোরামে। এই ফোরামের প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন কবি আল মাহমুদ। তিনিই ছিলেন চেয়ারপারসন। মহাসচিব ছিলেন বিশিষ্ট ভূগোলবিদ, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রব। বাংলাদেশের সর্বস্তরে পরিচিত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী, বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর আফতাব আহমাদ ঘনিষ্ঠভাবে ছিলেন এই ফোরামের সাথে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল এই ফোরাম। ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় এই ফোরামের উদ্যোগে হয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। হয়েছে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও আলোচনা সভা। এসব অনুষ্ঠানে বেশ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন কবি আল মাহমুদ। তার প্রজ্ঞা ছিল অসাধারণ। তীক্ষè ধী-শক্তির অধিকারী এই কবি নেতৃত্বেও ছিলেন পোক্ত। দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন নানা ক্ষেত্রে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়ার এবং দেয়ার ক্ষমতা ছিল তার। ঝুঁকি নেয়ার মানসিক দৃঢ়তা ছিল প্রশংসা করার মতো। সবচেয়ে বড় বিষয়Ñ নিরাশার পক্ষে কখনো যেতেন না তিনি। বরাবরই আশার দিকে ছিল তাঁর দারুণ পক্ষপাত। ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে যত অনুষ্ঠান হয়েছে এর প্রায় সবগুলোর সাথেই ছিলাম আমি। এসব অনুষ্ঠানে নানা জায়গায় ঘটেছে নানা রকম কাহিনী, ঘটনা এবং মনে রাখার মতো স্মৃতি। একবার রাজশাহী মহানগরীতে একটি সেমিনার। রাজশাহী টাউন হলে অনুষ্ঠান। আগের দিন সন্ধ্যায় রওনা হলাম আমরা। একটি মাইক্রোতে। আল মাহমুদ, আফতাব আহমাদ, গিয়াস কামাল চৌধুরী, ড. আবদুর রব এবং আমি এই মাইক্রোর যাত্রী। এক অসাধারণ স্মৃতিময় ছিল এ যাত্রা। সারা পথ মাতিয়ে রাখলেন প্রফেসর আফতাব এবং গিয়াস কামাল চৌধুরী। মাঝে মাঝে আল মাহমুদের কাব্যিক উচ্চারণ এবং কবিতা। কখনো কখনো ড. আবদুর রবের ভৌগোলিক বর্ণনা। থেকে থেকে নিজের বিভিন্ন কবির কবিতা থেকে আবৃত্তি করতে হয়েছে আমাকে। আবৃত্তি করতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমদ এবং আল মাহমুদ থেকে। এভাবে গালগল্প ও কবিতার ঝংকারের আনন্দে আমাদের পথযাত্রাটি হয়ে উঠল অনন্য। প্রফেসর আফতাব গিয়াস কামাল চৌধুরীর সাথে খুনসুটি করেছেন খুব। গিয়াস কামাল চৌধুরী অসম্ভব স্মৃতিধর একজন সাংবাদিক ছিলেন। সন তারিখ ও স্থানসহ তিনি বর্ণনা দিতেন ইতিহাস ও ভূগোলের সবচেয়ে বড় কথা গোটা বাংলাদেশের মানচিত্র ছিল তার স্মৃতিতে আঁকা। পথে পথে অসংখ্য জায়গায় তিনি গাড়ি থামিয়েছেন। রাস্তার দীর্ঘ বাঁক পেরোলেই বলতেন, এই ড্রাইভার একটু থামো। থামোতো ড্রাইভার। গ্লাস নামিয়ে মাথা বের করতেন। পাশে থাকা কোনো লোককে জিজ্ঞেস করতেন এটি অমুক জায়গা না! গ্রামের সাধারণ লোক বিস্ময় ও আনন্দ মিশ্রিত স্বরে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেন। ব্যাস, গ্লাসটি লাগিয়ে বলতেনÑ চলো। এভাবে সারা পথেই এমন কাহিনীর জন্ম দিয়েছেন গিয়াস কামাল চৌধুরী। আমরা বিস্মিত হয়েছি। আল মাহমুদ একাধিকবার বলেছেন, এটি কী করে সম্ভব গিয়াস ভাই! আফতাব আহমাদ বিস্ময় ভাব গোপন রেখে খোঁচা দিতেন। বলতেন আসার আগে মানচিত্র মুখস্থ করেছেন গিয়াস ভাই! আমরা হেসেছি ভীষণ। গিয়াস ভাইয়ের ভাবখানা এমন তিনি যেন কিছুই শোনেননি। তিনি তার মতো। কিছু দূর গিয়ে আবার থামান গাড়ি। এভাবেই চললো গাড়ি।
নাটোর শহর ছেড়ে একটু এগিয়ে চলনবিলে যখন আমাদের গাড়ি তখন প্রায় মধ্যরাত। এখানে গাড়ি থামালেন প্রফেসর আফতাব। নামলেন গাড়ি থেকে। নামালেন সবাইকে। কিন্তু কেনো? বলছেন না তিনি। নামলাম সবাই। চাঁদ ছিল আকাশে। কিন্তু খানিক আগে ডুবে গেছে চাঁদটি। এখন চাঁদের রেখে যাওয়া আলোর দ্যুতিতে অন্ধকার বেশ হালকা হয়ে উঠেছে। বিলের বুকে আকাশসমান জমে আছে অন্ধকারের জমাট। ঠিক বিলের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন প্রফেসর আফতাব। আল মাহমুদ যেন বিস্ময় ঘোরের জগতে সেঁধে গেলেন। প্রফেসর আফতাবের পাশেই তিনি। ড. আবদুর রবও দাঁড়িয়ে। গিয়াস ভাই খোঁচা দিলেন প্রফেসর আফতাবকে। বললেন, আফতাব নতুন কবি হবার স্বপ্নে বিভোর। জবাবে প্রফেসর আফতাব বললেন, কবি নই আমি একথা ঠিক কিন্তু কবিতা আমার নিত্যসঙ্গী। বলেই ডাকলেন আমাকে। বললেন, জাকির আবু জাফর তোমার কবি আল মাহমুদ এখানে আছেন। বলো তো এই জায়গায় দাঁড়িয়ে কোন কবিকে মনে পড়ছে তোমার?
বলার অপেক্ষা রাখে নাÑ নাটোরে প্রবেশ করার সাথে সাথে জীবনানন্দ উঠে এলো আমার মনের ভেতর। তার ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি গুঞ্জরিত হচ্ছিলÑ। আমি জীবনানন্দের নাম না বলে আবৃত্তি শুরু করলামÑ ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি...। তিনি থামিয়ে দিলেন আমাকে। বললেন এই নিশিরাতে এমন নির্জন পথে তোমাদের নামিয়েছি গাড়ি থেকে। নৈশব্দিক এই পরিবেশে জীবনানন্দের বনলতা সেন কবিতাটি শুনব বলেই। এক ধরনের আবেগ এবং যোশের সাথেই প্রফেসর বললেনÑ আবৃত্তি করো ‘বনলতা সেন।’
আবেগে টইটই তখন আল মাহমুদ। বললেনÑ আফতাব ঠিকই বলেছেনÑ এটি এমন একটি পরিবেশ যখন কবিতা ছাড়া আপাতত আর কিছু ভাবা যায় না। পড়ো শুনি বনলতা সেন। গিয়াস কামাল চৌধুরী এবং ড. আবদুর রবও হৈ হৈ করে উঠলেন। এ সময়ে এর চেয়ে ভালো কিছু উপহার হয় না বললেনÑ ড. রব।
‘বনলতা সেন’Ñ কবিতাটি আমার স্মৃতিতে গাঁথা। এক অনিন্দ্য আবেগে আবৃত্তি করতে শুরু করলাম। আবৃত্তি চলছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। কবিতার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দও নেই। রাতের অঘুমো বাতাসের ঝিরি আমাদের শরীর বুলিয়ে দিচ্ছে। আর বোলাচ্ছে ‘বনলতা সেন’। কবিতার শব্দ। একসময় শেষ হলো আবৃত্তি। শেষ হলো ঠিক। কিন্তু নীরবতা তখনো ঘিরে ছিল সবাইকে। যে যার মতো মনের পৃথিবীতে ঘুরছিল। একসময় মুখ খুললেন প্রফেসর আফতাব। বললেন, এ স্মৃতি মনের ভেতর থেকে যাবে বহুদিন। আল মাহমুদ বললেনÑ এটি জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা। জীবন ও জগতের অনেক রহস্যময় দর্শন লুকিয়ে আছে এ কবিতায়। গাড়িতে বহুদূর পর্যন্ত চলল জীবনানন্দের আলোচনা। এ সফরে আসা যাওয়ার পথে অসংখ্য কবিতা আবৃত্তি করতে হয়েছে আমাকে এবং সেটি প্রফেসর আফতাবের কারণেই। তিনি কবিতা এত ভালোবাসতেন আমার জানা ছিল না। নজরুলের বিদ্রোহী, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, শাতিল আরব, ভয় করিও না হে মানবাত্মা, আজাদ, কামাল পাশা, ফররুখের সাত সাগরের মাঝি, পাঞ্জেরী, রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ থেকে শুরু করে জসীমউদ্দীন, শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদের বেশ ক’টি কবিতা আবৃত্তি করতে হয়েছে।
যে অনুষ্ঠানে আমরা গেলাম সেই সেমিনার শুরু হলো পরদিন সন্ধ্যায়। হল ভর্তি শ্রোতা দর্শক। অনুষ্ঠানে সভাপতি আল মাহমুদ। প্রধান অতিথি প্রফেসর আফতাব আহমাদ। বিশেষ অতিথি গিয়াস কামাল চৌধুরী। সূচনা বক্তা প্রফেসর ড. আবদুর রব। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক’জন গুণী অধ্যাপক এবং রাজশাহী মহানগরীর বেশ কিছু মান্যগণ্য বুদ্ধিজীবী বক্তা হিসেবে ছিলেন। একসময় শুরু হলো প্রধান অতিথির বক্তব্য। প্রফেসর আফতাব ছিলেন এক তুমুলবর্ষী বক্তা। বুক ভরা ছিল দূরন্ত সাহস। কাউকে ছেড়ে কথা বলতেন না। যা সত্য মনে হতো তাই তিনি বলতেন। এ অনুষ্ঠানেও ব্যতিক্রম হলো না। বলছেন তিনি।
বক্তৃতার মাঝামাঝি হঠাৎ দর্শক সারি থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক দাঁড়িয়ে প্রফেসর আফতাবের দেয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ করলেন। তার কথা শোনার লক্ষ্যে থামলেন প্রফেসর। ওই শিক্ষকের প্রতিবাদী শব্দে আশপাশ থেকে তার বিরুদ্ধে জনতা ক্ষেপে উঠলেন। বেশ শোরগোল শুরু হলো হলের ভেতর। প্রফেসর আফতাব ডায়াসে দাঁড়িয়েই রইলেন। শোরগোল যখন গোটা হলে ছড়িয়ে গেল। আল মাহমুদ দাঁড়ালেন। মাইক্রোফোনটি তুলে নিলেন হাতে। নিয়েই শব্দটি খানিকটা টেনে বললেনÑ বন্ধুগণ.....। এ শব্দের প্রভাব এতটাই বিস্ময়ের ছিলÑ খানিকক্ষণের মধ্যেই চুপ হয়ে গেল সারা হল। এরপর হাত উঁচু করে বললেন আল মাহমুদÑ প্রফেসর আফতাবকে ইঙ্গিত করেÑ যার কণ্ঠ রাষ্ট্রকে বিব্রত করে তার কথা আপনাদের শুনতে হবে। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মুখে রাষ্ট্রের কথা আপনাদের শুনতে হবে। এ সময় গোটা হলে হাজার দর্শক যেন শ্বাসহীন চোখ তুলে চেয়েছিল আল মাহমুদের দিকে। তারপর প্রফেসর আফতাবের দিকে ফিরে বললেনÑ আফতাব বলুন আপনার কথা। এই বলে বসে পড়লেন আল মাহমুদ। সেদিন তার সাহস এবং উপস্থিত নেতৃত্বের ক্ষমতা দেখে অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। বলেছেন একজন কবির এই কি ক্ষমতা!
[চলবে]

 


আরো সংবাদ



premium cement
নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’ পুকুরে পাওয়া গেল ১০০ ইলিশ অবন্তিকার আত্মহত্যা : জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবারো নামঞ্জুর

সকল