২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`
স্মৃতির সোনালি শিখা

যেমন দেখেছি তাকে

-

ষোলো.

মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা, কাহিনী ও কলকাতার জীবন ছিল আল মাহমুদের সত্যিই বিস্ময়ের। এসব কিছু তার জীবনের সাথে যোগ হয়েছে বলেই তার জীবন এতটা বর্ণাঢ্য। এতটা বৈচিত্র্যময়। জীবনকে এক রকম হাতে নিয়েই ঘুরেছেন এ সময়। কত ঘটনা বলেছেন নানাভাবে। পার্ক সার্কাস রোডে তৌফিক ইমামের সাথে তার থাকার সুবিধাটি তাকে ঘুরে বেড়ানোর বাড়তি সুযোগ এনে দিয়েছিল। বলেছেনÑ পার্ক সার্কাসের মোড়েই ছিল সোহরাওয়ার্দী ভিলা। একটি আভিজাত্যপূর্ণ বাড়ি। দেখেই এ বাড়ির মর্যাদার কথা স্মরণ করা যায়। এ বাড়িতেই একদা বাস করতেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পিতৃপুরুষ। তাদের স্মৃতিচিহ্ন জড়িয়ে রেখেছে বাড়িটি। শুনলাম সে বাড়িতে বাংলাদেশের কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবে। শুনে একদিন ওই বাড়িতে উপস্থিত হলাম। গিয়ে যাকে পেলাম, তিনি কবি বেলাল চৌধুরী। আমাকে পেয়ে খুব খুশি হলেন বেলাল। আমিও দারুণ খুশি। বছরখানেক আগ থেকে বেলাল চৌধুরী কলকাতায় স্বেচ্ছায় নির্বাসন জীবন কাটাচ্ছিলেন। কেন নির্বাসন জীবন বেছে নিয়েছেন জানি না। কিন্তু তাকে পেয়ে আমার ভীষণ উপকার হয়েছিল। কলকাতা নতুন করে আমাকে চিনিয়েছেন বেলাল চৌধুরী। কলকাতার গলি-ঘুপচি আমার কাছে স্বচ্ছ করে দিলেন তিনি। কলকাতার লেখকদের সাথেও বেলাল নতুন করে আমার সংযোগ ঘটিয়েছেন। কবিতাসিংহের বাড়িতে বেলালই নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে। কমল কুমার মজুমদার, মৃণাল সেন এদের সাথেও পরিচয় বেলালের মাধ্যমে। সময় পেলেই আমি বেলাল চৌধুরীর সাথে বেরিয়ে পড়তাম। কখনো কখনো খ্যাতিমান লেখকের বাসায়, কখনো কোনো পরিচিত কবির বাড়ি আবার কখনো দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়াতাম। কলকাতা ছিল বেলাল চৌধুরীর নখদর্পণে। কোথায় কী আছে, কেমন আছে, কিভাবে আছে সবই জানত বেলাল। কোন জায়গায় মজাদার খাবার সস্তায় পাওয়া যায় তাও ছিল তার অভিজ্ঞতার আওতায়।
একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের একজন কবি আরেকটি দেশের মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কবিদের বাসায়, পত্রিকা অফিস, সাহিত্য আড্ডায় ও কফি হাউজের টেবিলে; এটি সত্যিই অন্য রকম। আল মাহমুদের সোনালি কাবিনের সুনাম তখন কলকাতার সব লেখকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কবিতা উচ্চারিত হতে থাকল তরুণদের মুখে মুখে। বেলাল চৌধুরী আল মাহমুদকে পেয়ে নতুন আনন্দে মেতে উঠলেন। আনন্দবাজারের রবি বাসরীর বিভাগে একটি কবিতা ছাপা হলো আল মাহমুদের। কবিতাটির নাম প্রকৃতি। এ কবিতাটি ছাপা হওয়ার পর কবিরা বেশ নড়েচড়ে বসছিলেন। নড়েচড়ে বসেছিলেন বুদ্ধদেব বসুরাও। নানা আড্ডায়-আসরে কবিতাটি আলোচিত হলো বেশ। কবি বেলাল চৌধুরী বেশ উৎফুল্ল হলেন। বললেনÑ আল মাহমুদ, আপনি অসাধ্য সাধন করেছেন। বুদ্ধদেব বসুরা এত দিন যা বলার চেষ্টা করেছেন, আপনি একটি কবিতায়ই তা বলে দিয়েছেন। আপনার কবিতার এ বাণী অনন্য, অন্য রকম, যা অনেকের ভাবনায় আছে। কিন্তু একে গুছিয়ে ভাষা দেয়ার যোগ্যতা কারো হয়নি। আপনার এ কবিতা বেশ আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে। বেলাল চৌধুরী এভাবে আল মাহমুদকে সান্নিধ্য জুগিয়েছেন। উৎসাহ দিয়েছেন। দিয়েছেন এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। সেই প্রেরণার স্রোতে আল মাহমুদ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন নানান প্রতিবন্ধকতা থেকে।
কবিতা এবং সাহিত্যে যারা অগ্রগামী, কলকাতায় তাদের সাথেই ঘনিষ্ঠ হলেন আল মাহমুদ। এদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, কবিতা সিংহ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, তারাপদ রায়, মুনুজ বসু, সন্তোষ ঘোষ, রাজেশ্বরী রায় চৌধুরী, মৃণাল সেন, পূর্ণেন্দু পত্রী, রনেশ দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন, সন্দিপন চট্টোপাধ্যায়, কমল মজুমদারÑ এরা প্রত্যেকে তাদের নিজস্বতা রচনা করেছিলেন। কলকাতাকেন্দ্রিক তো বটেই, বাংলা কবিতা ও সাহিত্যের সাথে এদের অনেকে জড়িয়ে আছেন। এখন যেমন তখনো এদের প্রতিটি মুখই পরিচিত। আলোচিত এবং সাহিত্যে অগ্রসরদের অন্যতম।
এদের মধ্যে আল মাহমুদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আক্ষরিক অর্থে আল মাহমুদকে প্রায় আশ্রয় ছাতায় জড়িয়ে রেখেছিলেন তিনি। আন্তরিক আত্মীয়ের মতো ছিল তার ভূমিকা। অফিসে আড্ডায় আসরে কাছে রেখেছেন আল মাহমুদকে। যেমন সঙ্গ দিয়েছেন, তেমনি বাড়িয়েছেন সাহায্যের হাত। অরুণা প্রকাশনী থেকে ‘আল মাহমুদের কবিতা’ নামে যে বই প্রকাশ হয়েছে, সেটিও সুনীলের উদ্যোগেই হয়েছে। অরুণা প্রকাশনীর মালিক বিকাশ বাগচীকে প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন সুনীল। সুনীলের এ পৃষ্ঠপোষকতা পারিবারিকভাবেও ছিল আন্তরিক।
কবি হিসেবে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি পক্ষপাত ছিল আল মাহমুদের। শক্তির কবিতার বিষয়ে বরাবরই উচ্চ প্রশংসা করেছেন আল মাহমুদ বলেছেনÑ কলকাতার কবিদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম। শক্তিও আল মাহমুদকে নানাভাবে সঙ্গ দিয়েছেন। সাহায্য করেছেন। এ সাহায্য ছিল ব্যক্তিগত ও পারিবারিক। শক্তির উপকারেও লেগেছিলেন আল মাহমুদ। ঘটনাটি এমনÑ একবার শক্তি দুপুরে দাওয়াত করেছিলেন আল মাহমুদকে। যথারীতি দাওয়াতে হাজির হলেন আল মাহমুদ। কিন্তু বাসায় তখনো ফেরেননি শক্তি। এ দিকে আল মাহমুদকে দেখে শক্তির স্ত্রী কেঁদে ফেললেন।
জিজ্ঞেস করলেন আল মাহমুদ কী ব্যাপার?
কান্নার স্বরেই শক্তির স্ত্রী বললেনÑ তোমার বন্ধুর চাকরিটি সম্ভবত গেছে!
বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন আল মাহমুদ কেন?
কেন আর! সেই পুরনো ঘটনা। মদ খেয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক থেকে শুরু করে সবাইকে বিশ্রী রকম গালিগালাজ করেছে। অপমান করেছে। ব্যস, যা হওয়ার তাই হয়েছে। কে সহ্য করবে ওর এসব পাগলামী-মাতলামী! কত করে বলেছি, এসব নেশাটেশা ছাড়ো! না, ছাড়া তো দূরের কথা, আরো বেশি মাত্রায় নেশা করছে ও। শুনে আল মাহমুদ বললেনÑ ঠিক আছে আমি এখন আসি।
শক্তির স্ত্রী বললেনÑ না, তুমি খেয়ে যাবে। তোমার জন্য আয়োজন করেছি আমি।
শক্তি আসুক তার পর খাবোÑ বললেন আল মাহমুদ। বলেই ছুটলেন। ছুটলেন আনন্দবাজার সম্পাদক সন্তোষ ঘোষের বাসায়। সন্তোষ বাবুর বাসায় ঢুকেই দেখেন তিনি খাবার টেবিলে। আল মাহমুদকে দেখেই বললেনÑ বসে যাও। যা কথা পরে হবে। আগে খেয়ে নাও। বসে পড়লেন আল মাহমুদ। খাওয়া হলো। নানা রকম কথা হলো। খেয়েই সন্তোষ বাবু বললেনÑ চলো আজ আর বিশ্রাম নেয়া চলবে না। অফিসে মেলা কাজ। এখনই ছুটতে হবে। বলেই গাড়িতে চড়লেন। গাড়িতেও এ কথা সে কথা নানা রকম কথা চলল। এক সময় খানিকটা চুপ করলেন সন্তোষ ঘোষ। এ সময় আল মাহমুদ কবিতার কিছু লাইন আওড়াতে শুরু করলেন। বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন সন্তোষ বাবু। পড়ে থামলেন আল মাহমুদ। সাথে সাথে বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেনÑ কবিতাটি কার?
আল মাহমুদ বললেনÑ একটু পরে আপনি যার চাকরিটি খেতে যাচ্ছেন, সেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের!
আল মাহমুদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়েছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেনÑ কী করি বলুন! বারবার অপমানের ঘটনা কতটা হজম করা যায়!
আল মাহমুদ আচমকা সন্তোষ ঘোষের হাত ধরে বললেনÑ এবারের মতো ক্ষমা করে দিন। শক্তির স্ত্রীর চোখে যে অশ্রু আমি দেখেছি, তা অত্যন্ত বেদনার এবং একজন অসহায় নারীর। জবাবে কোনো মন্তব্য করেননি সন্তোষ ঘোষ। কিন্তু শক্তির চাকরিটি বেঁচে গিয়েছিল সে যাত্রায়।
সেই শক্তির সাথেই একসময় সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল আল মাহমুদের। তাও সেই মদপানকেন্দ্রিক। যদিও ঘটনাটি খুবই তুচ্ছ। তবুও শক্তি একে তুচ্ছভাবে নেননি। একবার শান্তিনিকেতনে দাওয়াত পেলেন আল মাহমুদ। সাথে ছিলেন কবি আল মুজাহিদী। আমন্ত্রণটি জানিয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল সেখানে। একটি অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন তারা গাড়িতে চড়ে। গাড়িতে বেপরোয়া মদপান করছিলেন শক্তি। আল মাহমুদ ভাবলেন, এভাবে পান করলে শক্তি অনুষ্ঠান মঞ্চে দাঁড়াতেই পারবেন না। ভেবে শক্তির হাত থেকে বোতলটি নিয়ে ফেলে দিলেন গাড়ির বাইরে। বোতলটি একদম খালি হয়ে গেলো। ঘটনায় বেশ রেগে গেলেন শক্তি। সেই থেকে দীর্ঘ দিন আল মাহমুদের সাথে কথা বলেননি এবং কোনো যোগাযোগও ছিল না। অনেক দিন পর শক্তির সেই রাগ মিলে গেলে আবার সম্পর্ক ঠিক হলো দু’জনের।
মুনুজ বসু খুব পছন্দ করতেন আল মাহমুদকে। তিনি বেঙ্গল পাবলিশার্সের স্বত্বাধিকারী ছিলেন। আল মাহমুদকে জয় বাংলা পুরস্কার দিয়েছিলেন এই মুনুজ বসু। এই পুরস্কার মঞ্চে বুদ্ধদেব বসুও উপস্থিত ছিলেন।
সন্দিপন চট্টোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠভাবে আল মাহমুদকে বিভিন্ন সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। একান্ত আপনজন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সোনালি কাবিনের চৌদ্দটি সনেট নিয়ে যে মিনি বুকটি প্রকাশ পেয়েছিল, তার উদ্যোক্তা এই সন্দিপন চৌধুরী। এ বইটি প্রকাশের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েছিল। পরবর্তীকালে ভানু সিংহ পদক পেয়েছিলেন আল মাহমুদ। পদক প্রদান অনুষ্ঠানে আল মাহমুদকে বাংলা ভাষার জ্যান্ত কবি বলে বর্ণনা করেছিলেন সন্দিপন।
অমীয় চক্রবর্তী ছিলেন আল মাহমুদের প্রিয় কবিদের একজন। তার সাথে আন্তরিক আলাপ এবং বিনিময় ছিল আল মাহমুদের। শক্তির আমন্ত্রণে যখন শান্তি নিকেতন গেলেন আল মাহমুদ তখন অমীয় চক্রবর্তী শয্যাশায়ী। দেখতে গিয়েছিলেন আল মাহমুদ। তার কিছু দিন পর মারা গেলেন ত্রিশের পঞ্চপাণ্ডবখ্যাত কবি অমীয় চক্রবর্তী। তার মৃত্যুতে আল মাহমুদ লিখলেনÑ ‘কেঁদেও পাবে না তারে।’ প্রবন্ধটি ছাপা হয়েছিল ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায়।
[চলবে]


আরো সংবাদ



premium cement