২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
স্মৃতির সোনালি শিখা

যেমন দেখেছি তাঁকে

-

চৌদ্দ.

চট্টগ্রামের মাটিতে বসে পাহাড় ও প্রকৃতির নীলার বৈচিত্র্যে তিনি লিখেছেন সোনালি কাবিন। পাথরঘাটার বাসায় বসেই লিখেছেন এটি। এখানেই আল মাহমুদের পাশের বাসায় থাকতেন খ্যাতিমান লোক সঙ্গীতশিল্পী শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব। বৈষ্ণব শুধু সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন না, একই সাথে ছিলেন খ্যাতনামা প্রেসম্যান ও মেশিনম্যান। সঙ্গীতের পাশাপাশি এ দক্ষতা তাকে জুগিয়েছে প্রফেশনাল সম্মান। বৈষ্ণবের সঙ্গীত সহচরী ছিলেন শেফালী ঘোষ। শ্যাম সুন্দরের মাধ্যমেই আল মাহমুদের সাথে পরিচয় ঘটে বিখ্যাত এ আঞ্চলিক সঙ্গীতশিল্পী শেফালী ঘোষের। চট্টগ্রামের বিখ্যাত বংশীবাদক সুচরিত চৌধুরীর সাথেও পরিচয় ঘটে এখানে। সুচরিত চৌধুরী আল মাহমুদকে আত্মীয়ের মতোই গ্রহণ করেছিলেন। এর কারণ হয়তো এই সুচরিত চৌধুরী নিজেও একজন সাহিত্যিক ছিলেন। কিন্তু সঙ্গীত সাধনায় বিশেষ করে বংশীবাদনের ঘোর তাকে সাহিত্যের পথে বেশিদূর যেতে দেয়নি। তার বাবা আশুতোষ চৌধুরী বিশিষ্ট লোকগীত সংরক্ষক। লোকসঙ্গীত সংগ্রহ ও সংরক্ষণে আশুতোষ চৌধুরীর অবদান স্মরণীয়।
সুচরিত চৌধুরীর বাড়িতে আল মাহমুদের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল। এক ধরনের নেশার মতো এখানে হাজির হতেন তিনি। চট্টগ্রামের অনেক বিত্তশালী লোকেরও আনাগোনা ছিল এই বাড়িতে। যারা সুচরিত চৌধুরীকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন, এদের অনেকের সাথে পরিচয় ঘটে আল মাহমুদের। আল মাহমুদের কাছে এ বাড়িতে বিশেষ আকর্ষণ ছিল একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার। বই পাঠের নেশা তো ছিলই তার। সেই সাথে আল মাহমুদের ভাষায়Ñ এখানেই আমার পড়াশোনার গোপন কৌশল রপ্ত হয়। বইয়ের বুক থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের রসদ কুড়িয়ে নেয়ার পথ এই পাঠাগারেই পেয়েছিলাম। এই পাঠাগারে ডুবে থাকতে থাকতেই আমার মাথায় খেলে নতুন কবিতার দোল। সোনালি কাবিন হয়ে যা বেরিয়ে আসে আমার ভেতর থেকে।
তার ভাষায়Ñ এই পাঠাগারে যেমন বুঁদ হয়ে থাকতাম, তেমনি ছিলাম শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবের প্রশ্রয় ও একরকম শাসনে। শ্যাম সুন্দর বেশ আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবান পুরুষ। এ সময় কবি হিসেবে আমার ভেতর নানা রকম লোভ-লালসা মাথা চাড়া দিত। ডানে-বাঁয়ে কাত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল সারাক্ষণ। এসব স্খলন থেকে শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবই আমাকে ফিরিয়েছিল। আমি যদি এ সময় শুধু কবির জীবন বেছে নিতাম এবং উপেক্ষা করতাম শ্যাম সুন্দরের মতো আন্তরিক স্বচ্ছ মানুষকে তবে সোনালি কাবিনের মতো একটি কাব্যগ্রন্থের জন্মই হতো না। শ্যাম সুন্দরের আধ্যাত্মিক প্রভাব আমাকে ধ্বংসাত্মক পিচ্ছিল পথ থেকে রক্ষা করেছে।
লেখা শুরু হলো সোনালি কাবিন। দিন-রাত কবিতার ঘোরে থাকছেন আল মাহমুদ। নানা রকমের আঁকিবুঁকি নানারকম ভাবের উদয় এ সময় আল মাহমুদকে বিচলিত করে তুলল। নতুন আঙ্গিকের এই রচনার বিস্ময় বিভা তাকে আর সব কাজে অমনোযোগী করে তুলল। যে সনেটটিই শেষ হয় তার প্রথম শ্রোতা শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব। অপূর্ণাঙ্গ থাকা সনেটেও তিনি চোখ বোলাতেন। মাঝে মাঝে গভীর রাতে দরজায় টোকা দিতেন শ্যাম সুন্দর। বলতেন ওঠো কবি। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চলো রাস্তায় নেমে পড়ি। তোমার কবিতায় ঢুকে পড়–ক জোছনার জল। আল মাহমুদ দরজা খুলে দিলে টেবিলের ডায়েরির দিকেই চোখ দিতেন শ্যাম। হাত বাড়িয়ে ডায়েরিটি নিতেন। দেখতেন কতদূর এগোল সোনালী কাবিন। এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে আনন্দে গেয়ে উঠতেনÑ হায়রে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা...।
যে ডায়েরিতে সোনালি কাবিন লিখেছেনÑ ডায়েরিটি পরিবারের কাছে এখনো সংরক্ষিত আছে। যখন ডায়েরিটি আমি দেখেছিলাম, আল মাহমুদের আল মাহমুদের ঘোরের বিস্ময়ের সাথে কল্পনায় আমি যেন শ্যাম সুন্দরের স্পর্শ পাচ্ছিলাম। একজন কবির একটি বিস্ময় রচনার সাথে জড়িয়ে আছে শ্যাম সুন্দরের হৃদয় ও হাতের উষ্ণতা। আল মাহমুদের জন্য তার হৃদয়ে ভালোবাসা ছিল ভরপুর।
একসময় সোনালি কাবিন সমাপ্ত হলো। চৌদ্দটি সনেট রূপ পেল তার পূর্ণতায়। এক অন্যরকম উত্তেজনায় উদ্বেলিত আল মাহমুদ। শেষ হওয়ার পর আল মাহমুদ প্রথমে ছুটে গেলেন অধ্যাপক আবুল ফজলের কাছে। একরকম অসময়েই গেলেন। অসময়ে আল মাহমুদকে দেখে তিনি খানিকটা বিস্মিত হলেন। তাকে বিস্মিত হতে দেখে আল মাহমুদ বললেনÑ আমি একটি সনেট সিকুয়েন্স আজই শেষ করেছি। বেশ সময় ধরেই লিখছিলাম এ সনেটগুচ্ছ। মোট চৌদ্দটি সনেট এখানে। এর মধ্যে সাতটি কবিতা সমকালে দিয়ে এসেছি। আপনাকে শোনাতে চাই কবিতাগুলো। শুনে আবুল ফজল হাসলেন। একটি চেয়ার দেখিয়ে বললেনÑ বসো। মুখোমুখি বসলেন তিনিও। বললেনÑ পড়ো।
আল মাহমুদ ডায়েরিটি খুলে শুরু করলেন পাঠ। থেমে থেমে চৌদ্দটি কবিতাই পড়ে ফেললেন। আল মাহমুদের মনে হচ্ছিলÑ ছন্দের দোলা ও ঝঙ্কারে মাঝে মধ্যে মৃদু দুলছেন তিনি। কবিতা পাঠ শেষ হলে কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তার পর বললেনÑ মনে হচ্ছে বাংলা কবিতায় নতুন কিছু যোগ করেছ তুমি। এর মধ্যে চা এলো। বললেনÑ চা খাও। চা খেয়ে তাকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে এলাম তার বাসা থেকে। বেরিয়ে আমার মনে হলোÑ আকাশ বাতাস প্রকৃতি নতুন ভাষায় কথা বলছে আমার সাথে। মনের ভেতর গানের সুর ঢেউ খেলে উঠল। শ্যাম সুন্দরের কণ্ঠ যেন বেজে উঠল আমার ভেতরÑ হায়রে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা...।
এর আগে ঢাকায় যখন সোনালি কাবিনের সাতটি সনেট সিকান্দার আবু জাফরের হাতে তুলে দিলেন, তিনিও আপ্লুতির আনন্দে বলেছিলেনÑ সত্যিই এগুলো অন্যরকম কবিতা। সমকালে যাওয়ার আগে সকালে শহীদ কাদরীর বাসায় গেলেন আল মাহমুদ। তার কথায়Ñ যখন শহীদ কাদরীর বাসায় গেলাম, তখনো কাদরী চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। আমি গিয়েই তার মুখের কাপড় সরিয়ে দিলাম। মাথা তুললেন শহীদ কাদরী। বললাম, আমি ক’টি সনেট লিখেছি। শোনাব তোমাকে। তখনো নিরাসক্ত চোখ কাদরীর। নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেনÑ শোনাও। পড়তে শুরু করলাম আমি। সাতটি সনেটই পড়লাম।
আমি পাঠ শেষ করতেই উঠে বসে পড়লেন কাদরী। দ্রুত তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেনÑ বেশ ভালো হয়েছে। ছাপতে দিয়ে দাও সমকালে। হয়তো তোমার এ কবিতা কথা বলবে।
বিভিন্ন প্রেক্ষিত ও সময়ে সোনালি কাবিনের বাকি কবিতাগুলো লেখা হলো। তার পর শুরু হলো বইটি প্রকাশনার কার্যক্রম। বইটি প্রকাশ করার দায়িত্ব নিলো সন্ধানী প্রকাশনী। এ প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী ছিলেন গাজী শাহাবুদ্দিন। সন্ধানী প্রকাশনী ছিল বেশ পরিচিত। বইটির একটি অসাধারণ প্রচ্ছদ আঁকলেন কাইয়ুম চৌধুরী। সন্ধানী প্রকাশনীর চমৎকার আয়োজনে বইটি প্রকাশ পেল। কিন্তু বাজারে আসার আগেই ঘটল বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহতম পঁচিশে মার্চের কাল রাতের ঘটনা। একটি মাত্র কপি হাতে নিয়ে সপরিবার ঢাকা থেকে বেরিয়ে পড়লেন আল মাহমুদ। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে যখন কলকাতা গেলেন তার সাথে ছিল সোনালি কাবিনের সেই কপিটি। এ বইয়ের কবিতা পড়ে কলকাতার কবিরা বিপুলভাবে আল মাহমুদের প্রশংসা করেছেন। অমীয় চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই কবিতার প্রশংসায় উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। সোনালি কাবিন যোগ করে কলকাতার অরুণা প্রকাশনী প্রকাশ করলেন ‘আল মাহমুদের কবিতা’। বইটি প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। বইটির জন্য তখন ৯০০ রুপি রয়্যালটি পেয়েছিলেন; যা যুদ্ধের ভয়াবহ সময়ে অভাব থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল আল মাহমুদকে।
কলকাতায় সোনালি কাবিন নিয়ে ঘটেছে অনেক চমকপ্রদ ঘটনা। তার উল্লেখযোগ্য হলোÑ বইটির সনেটগুচ্ছ পকেট বুক হিসেবে প্রকাশ। বলবেন, পকেট বুক তো হতেই পারেÑ উল্লেখযোগ্য কি তবে? উল্লেখযোগ্য হলো পকেট বুক বাসে-ট্রেনে-ট্রামে পুরুষের পকেটে যেমন ছিল, তেমনি ছিল নারীদের ব্লাউজের ভাঁজে। তরুণ-তরুণীদের প্যান্টের পকেটে এবং ব্যাগে। কোথাও যাচ্ছিলেন আল মাহমুদ। বাসে উঠে শুনলেন সোনালি কাবিন আওড়াচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। একজন আরেকজনকে বলছেÑ দেখো এর চেয়ে ভালো কবিতা আর হয়ই না।
[চলবে]


আরো সংবাদ



premium cement