২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্মৃতির সোনালি শিখা যেমন দেখেছি তাকে

-

তেরো.

এখলাস উদ্দীনের সাথে আল মাহমুদের প্রথম সাক্ষাৎটিও অন্য রকম। ঘটনাটি মাহমুদ ভাই বলেছেন যার সারকথা এমনÑ একদিন ইত্তেফাক অফিসে বিকেলের শিফটে কাজ করছি। হঠাৎ একটি কণ্ঠ- আল মাহমুদ তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই।
মুখ তুলে দেখি ফর্সামতো লম্বা সুদর্শন একজন ভদ্রলোক। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেনÑ আমি এখলাস উদ্দীন। ছড়াকার ও ছড়া সঙ্কলক এখলাস উদ্দীনের নাম আমি আগেই শুনেছি। খানিকটা তার লেখার সাথেও পরিচিত আমি। সহজে আমি কাউকে তুমি বলতে পারি না। আমাকে কেউ বললেও ভালো লাগত না। কিন্তু এখলাস উদ্দীনের তুমি সম্বোধন তেমন খারাপ লাগেনি। বললাম বসুন।
বসলেন তিনি। কোনো ভূমিকা না করেই বললেনÑ আমি এসেছি তোমার একটি পাণ্ডুলিপি চাইতে। এসেছি চট্টগ্রাম থেকে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি চট্টগ্রাম বইঘর থেকে চারজন কবির চারটি বই বের করব। প্রকাশনা হবে দৃষ্টান্তমূলক। জিজ্ঞেস করলামÑ চারজন কারা?
বললেনÑ শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী এবং সিনিয়রদের মধ্য থেকে সৈয়দ আলী আহসান। আমাদের ইচ্ছে আমরা সিরিজ বই করব। আপাতত এ চারজনের বই আলোর মুখ দেখুক। তোমার সম্মতি চাই। চাই তোমার পাণ্ডুলিপি।
বললামÑ আমি রাজি। বরং এভাবে হলে আমি খুশি।
তিনি বললেনÑ তোমার বইয়ের কী নাম হবে? পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত আছে?
হ্যাঁ, আমার পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত আছে। নাম রেখেছি ‘কালের কলস’। নামটি শুনে আনন্দে শিহরিত হলেন এখলাস উদ্দীন। আবেগঘন কণ্ঠে উচ্চারণ করলেনÑ কালের কলস! কী অদ্ভুত নাম! কোথায় পেলে এমন নাম?
আনন্দে আমিও বললামÑ আমার একটি কবিতা থেকে নিয়েছি নামটি। বললেনÑ বাহ, খুব সুন্দর এবং অর্থপূর্ণ নাম। তোমার কবিতার ধরনকে প্রতিনিধিত্ব করে নামটি। পাণ্ডুলিপিটি এখন কোথায়?
আমি আমার টেবিলের ড্রয়ার খুলে পাণ্ডুলিপিটি বের করে এখলাস উদ্দীনের হাতে তুলে দিলাম। এটি মনে হলো তার ধারণার চেয়ে বেশি পাওয়া। হয়তো ধরে নিয়েছিলেন দু-চার দশ দিন সময় নেবো আমি। হয়তো পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে দেয়ার কথা বলব। কিন্তু গোছানো পাণ্ডুলিপি তার হাতে তুলে দিতে পারব, এমনটি তার ভাবনায় ছিল না। ফলে তিনি আশার তুলনায় বেশি পেয়েছেন বলে দারুণ খুশি হলেন।
এক মাসের মধ্যে চারজন কবির চারটি বই চাররঙা প্রচ্ছদে প্রকাশ পেল। বইগুলো এতটাই নান্দনিক হলো, যার ভেতর দিয়ে আমাদের প্রকাশনা জগতের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার ইতিহাস ঝলমলিয়ে উঠল। কবিতা বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষিত যুবক-যুবতী ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকদের পাঠ্য হয়ে উঠল এবং এই প্রথম বাংলাদেশে বাংলা কবিতার বই পরস্পরকে উপহার দেয়ার উপযুক্ত হয়ে উঠল। বইঘরের এ অবদান অস্বীকার করা যায় না। এর পেছনের কারিগরটি ছড়াশিল্পী এখলাস উদ্দীন।
বাংলা একাডেমি গেটে তিনিই আমার হাত চেপে ধরলেন। বললেনÑ অনেক খুঁজে অবশেষে পেলাম তোমাকে।
আমি জিজ্ঞেস করলামÑ কী ব্যাপার এখলাস ভাই? কেন খুঁজছেন আমাকে। বললেনÑ তোমার ইত্তেফাক বন্ধ। চাকরি নেই। ঢাকায় থাকছো না। আবার আমাদেরও বেশ প্রয়োজন তোমাকে। তোমাকে চট্টগ্রাম নিয়ে যাবো এবং আজই। আজ রাতের ট্রেনেÑ চলো যাই চট্টগ্রাম।
আমি তো অবাক? বললামÑ কী করতে যাবো চট্টগ্রাম?
তিনি হাসি টেনে বললেনÑ আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাকে বইঘরে নিয়ে যাবো। সেখানে টাপুরটুপুরÑ ও আরো ক’টি পত্রিকা আছে। এসবের প্রুফ দেখার কাজ তোমার চেয়ে ভালো আর কে পারবে? চলো ভাই। না করো না। তোমার থাকার ব্যবস্থাও পাকাপোক্ত করে রেখেছি। কোনো অসুবিধা তোমার হবে না, বরং সুবিধাই হবে। সেখানে কবি-সাহিত্যিকদের জটলা পেয়ে যাবে। আড্ডা আসর আর পত্রিকার জমানো আনন্দে তুমি ভালোই থাকবে। চলো তবে আজই।
আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম এখলাস উদ্দীনের দিকে। ভাবলাম একেই কি বলে নিয়তি! যা মানুষ ভাবে না, ভাবতে পারে না তেমন বিষয়ই ঘটে নিয়তির জোরে। বললামÑ আমি একটিবার বাড়ি যাই। আমার স্ত্রীর সাথে দেখা করে আসি। তারপর যাই চট্টগ্রাম।
তিনি আমার কথায় বাদ সাধলেন। বললেন বউয়ের কাছে যাওয়া যাবে না। বউ বড় ডেঞ্জারাস। বউয়ের কাছে গেলে তুমি আর চট্টগ্রাম যাবে না। তার চেয়ে বরং আজ আমার সাথে চলো। জয়েন করে বউয়ের কাছে যাও। এতে তোমার একটি দায় থাকবে ফেরার। তোমার বউও সহজে আটকাবে না তোমাকে। তোমার যাওয়া-আসার সমস্ত খরচ আমরাই বিয়ার করব। তোমার চিন্তার কোনো কারণ থাকে না এখানে। আর কোনো কথা নয়। চলো ছুটি চট্টগ্রামের উদ্দেশে।
আমি এক রকম জাদুগ্রস্ত হয়ে গেলাম এখলাসের কথায়। কোনো কথা আর বলিনি। এখলাস আমার হাত ধরে টান দিলেন। আমিও চলতে শুরু করলাম। রাতের অন্ধকার চিরে আমাদের ট্রেন পৌঁছে গেল চট্টগ্রাম। এখলাস তার কথা রেখেছিলেন। আমার সুযোগ সুবিধা, থাকার ব্যবস্থাÑ সবই করে দিলেন। বইঘরের সৈয়দ মোহাম্মদ শফির উদারতায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। চট্টগ্রাম ভালো লেগে গেল আমার অথবা আমাকে গ্রহণ করল চট্টগ্রামের পাহাড় ও নদীঘেরা নৈসর্গিক নির্জনতা। পাথরঘাটার ইকবাল ম্যানশনে থাকার ব্যবস্থা হলো আমার। পাশেই ছিলেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট লোকসঙ্গীতশিল্পী শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব।
আল মাহমুদের চট্টগ্রামের জীবনের সাথে অভাবনীয়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন এই লোকসঙ্গীতশিল্পী। শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব যদি আল মাহমুদের সাথে না থাকতেন তখন, হয়তো ‘সোনালি কাবিন’ নামক কাব্য গ্রন্থের জন্মই হতো না। এমনটিই বলেছিলেন আল মাহমুদ। পর্বে থাকছে সোনালি কাবিনের কাহিনী।
[চলবে]


আরো সংবাদ



premium cement

সকল