১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শুদ্ধ সঙ্গীতশিল্পী খালিদ হোসেন

-

নিয়তির এ খেলায় যে যায় সে আর ফিরে আসে না। ফিরে আসে না সময়ের আবর্তে ঘূর্ণায়মান মানুষগুলো। খালিদ হোসেনও তেমন । একটি নাম। একটি ইতিহাস। যে জীবন শুধু সৃজনশীলতারই কথা বলে। সুরের কথা বলে। সুন্দরের কথা বলে। স্বকীয়তার কথা বলে। বরেণ্য সাহিত্যিক আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ভাষায়Ñ আমি এক কিংবদন্তির কথা বলছি। যদিও আর কখনো শুনতে পারব না খালিদ হোসেনের কণ্ঠে নজরুলের ইসলামী গান। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে যারা গান গেয়েছেন । খালিদ হোসেন তাঁদের অগ্রগণ্য। কোটি হৃদয়কে সিক্ত করা কণ্ঠ তিনি গাইতেন।
আল্লাহকে যে পাইতে চায়, হজরতকে ভালোবেসে
আল্লাহকে যে পাইতে চায়
আরশ কুরসি লৌহ কলম, না চাহিতে পেয়েছে সে।
২০১০ সালের দিকে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে অনুষ্ঠান বিভাগে কাজ করতাম। গানের সেরা গান নামে একটি অনুষ্ঠানের জন্য তাঁকে নিয়ে মানিকগঞ্জে আউটডোর শুটিংয়ে গিয়েছিলাম। কথা ছিল, শুটিং শেষে দুপুরে একসাথে পুরো প্রডাকশন লাঞ্চ করব। কিন্তু রাস্তায় যানজট থাকায় আমাদের লোকেশনে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে যায়। তিনটি গান শুটিংয়ের জন্য আমরা প্রায় একেবারে গ্রামের ভেতরে ঢুকে যাই। আশপাশে কোনো দোকানও ছিল না। অবশ্য সাথে বিস্কুট আর পানি ছিল। খালিদ ভাই বললেন, ‘এই যে লোকেশনটা সরিষার ক্ষেত, এখানে ভালো কাজ হবে’ কথাগুলো এত সুন্দর সবিনয়ে বললেন। আমাদের হৃদয় ভরে গেল। আমি প্রডাকশন নিয়ে কন্যাদায়গ্রস্ত বাবার মতো সরিষার ক্ষেতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মানে কাজে লেগে গেলাম। আইলের ওপর দাঁড়িয়ে খালিদ ভাই দরদমাখা কণ্ঠে একে একে গান ধরলেনÑ
তুমি কি আসিবে না
বলেছিলে তুমি আসিবে আবার ফুটিবে যবে হেনা
তুমি কি আসিবে না।

যেদিন রোজ হাশরে করতে বিচার তুমি হবে কাজী
সেদিন তোমার দিদার আমি পাবো কি আল্লাহজি।

আমি যদি আরব হতাম মদিনার ওই পথ
এই পথে মোর চলে যেতেন নূর নবী হজরত

ক্যামেরার বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে একটি গান তিনবার করে শুটিং করতে ভিন্ন ভিন্ন লোকেশনে যেতে হয়েছিল আমাদের । মাস্টার ক্লোজ মিড লং থেকে শর্টের পাশাপাশি কিছু পেন শর্ট নেই স্টক ফুটেজের জন্য। শুটিং শেষ করতে ৫টা বেজে যায়। ড্রাইভার অবশ্য একবার ফোন দিয়ে বলেছিল । খাবার পাওয়া গেছে, কিন্তু অত দূর থেকে নিয়ে আসার কোনো ব্যবস্থা নেই। খালিদ ভাইকে অনাকাক্সিক্ষত বিষয়টা জানালে তিনি হাস্যোজ্জ্বলে বলছিলেন, ‘আমি তো একা নই তেমারাও আমার সাথী। কাজ শেষে একসাথে খাওয়া যাবে, দেখ তখন অনেক আনন্দ লাগবে।’
আমরা শুটিং শেষে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। ড্রাইভারকে বললাম, খাবার হোটেল দেখলে থামাবেন। আমি লক্ষ করলাম, তার সুন্দর মুখখানা ক্লান্ত হয়ে আছে। আমি বললাম ভাই আপনি একটু রেস্ট নিন । তিনি চোখ বুজে আছেন। গাড়ি এগিয়ে চলছে। খালিদ ভাই ক্ষুধাকণ্ঠে চোখ না খুলে মুচকি হেসে বলতে লাগলেন। ফারুক দেশ বিভাগের আমরা পুরো পরিবার কুষ্টিয়ার কোর্টপাড়ায় চলে আসি । তার পর ১৯৬৪ সাল থেকে স্থায়ীভাবে ঢাকায় আছি। অনেক উত্থান আর পতনের সাক্ষী এই নগরী। ‘ভোগবাদ আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে’ কথা শেষ করার আগেই ড্রাইভার কুদ্দুস একটা হোটেলের সামনে গাড়ি রাখলো। তখন প্রায় সন্ধ্যা । এখন তো দুপুরের খাবার পাওয়া যাবে না। পেলেও তা স্বাস্থ্যসম্মত হবে না। খালিদ ভাই বললেন, আমাকে তোমরা বাড়ি ছেড়ে আসো। আরেক দিন সবাই মিলে মন দিয়ে খাবো বলে বোতলের মুখ খুলে একটু পানি পান করলেন। আমরা তাকে বাড়ি ছেড়ে দিলাম। সে দিন আমার স্পষ্ট মনে আছে আমরা সবাই তার কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম।
পত্রিকায় পড়েছি কিছু দিন আগে ভারত থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরেছেন। দেশে ফেরার সময় ভারতের চিকিৎসকেরা বলেছিলেনÑ তার শারীরিক অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাবে। তাকে প্রতি মাসে একটি করে ব্যয়বহুল ইনজেকশন দেয়া হচ্ছিল; যা তার শরীর সহ্য করতে পারছে না। ফলে তিনি আরো দুর্বল হয়ে পড়েছেন। হায় আফসোস! আজ আর তিনি আমাদের মাঝে নেই।
খালিদ ভাইয়ের জন্ম ১৯৩৫ সালের ৪ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর গ্রামে। কর্মজীবনে খালিদ হোসেন সঙ্গীত প্রশিক্ষক ও নিরীক্ষক হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের সব মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ও বাংলাদেশ টেক্সট বুক বোর্ডে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি নজরুল ইনস্টিটিউটে নজরুলগীতির আদি সুরভিত্তিক নজরুল স্বরলিপি প্রমাণীকরণ পরিষদের সদস্য।
তার ছয়টি নজরুলগীতির অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ নজরুলগীতির অ্যালবাম হলো শাওনো রাতে যদি। এ ছাড়া ১২টি ইসলামী গানের অ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছে তার। খালিদ হোসেনের একমাত্র আধুনিক গানের অ্যালবাম ‘চম্পা নদীর তীরে‘ শ্রোতা শোনামাত্রই অন্য এক খালিদ হোসেনেকে আবিষ্কার করে ফেলেন। তার গায়কী ঢঙের চূড়ান্ত খেলা এখানে লক্ষণীয়। তিনি মূলত একজন শুদ্ধ সঙ্গীতশিল্পী। সুস্থ ও সুন্দরকে তিনি লালন ও পালন করেছেন আজীবন। আবহমান বাঙালির বিশ^াসী সুরকে নজরুল যেভাবে আঁকতে চেয়েছেলেন তিনি যেন তা কণ্ঠ দিয়ে প্রস্ফুটিত করে গেছেন এবং বাংলা ইসলামী সঙ্গীতকে করেছেন হৃদয়গ্রাহী।
খালিদ হোসেন নজরুল গীতিতে অনবদ্য অবদানের জন্য ২০০০ সালে একুশে পদক অর্জন করেন। এ ছাড়াও নজরুল একাডেমি পদক, শিল্পকলা একাডেমি পদক, কলকাতা থেকে চুরুলিয়া পদকসহ বহু সম্মাননা লাভ করেছেন। নজরুল-সঙ্গীতের কীর্তিমান শিল্পী, প্রশিক্ষক এবং ইসলামী গানের হিরককণ্ঠ খালিদ হোসেন। তার মাগফিরাত কামনা করি।

 


আরো সংবাদ



premium cement