১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`
স্মৃতির সোনালি শিখা

যেমন দেখেছি তাঁকে

-

এগারো.

জীবন কখনো সরলপথে হাঁটে না। নানা বাঁক-প্রতিবাঁক ঘুরে ছোটে জীবনগাড়ি। ছোটে নানা উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে। একজন কবি জীবনের এ ঘোরলাগা উত্থান-পতন অবলোকন করেন। তুলে আনেন উপলব্ধির আঙিনায়। আল মাহমুদ এ বিষয়ে ছিলেন তুখোড়। তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিচিত্রতায় তিনি আন্দোলিত ছিলেন বরাবর। জীবনে ভাঙাগড়ার কাহিনীকে জীবনের অভিজ্ঞতায় রূপায়িত করেছিলেন। পুরান ঢাকার বিচিত্র গলির একাকী জীবনের অবসান ঘটিয়ে তার স্ত্রীকে নিয়ে এলেন ঢাকায়। ঢাকার আবাসিক জীবনে প্রথম বাসা নিলেন যাত্রাবাড়ী। কাসেম সরদার নামে এক ব্যক্তির পাকা দালান। ইত্তেফাকের নাম শুনে বেশ খাতির করেই বাসার চাবি তুলে দিলেন আল মাহমুদের হাতে। চাবি দেয়ার সময় শুধু জিজ্ঞেস করলেনÑ বউ আছে তো?
আল মাহমুদ বললেনÑ হ্যাঁ, আছে তো। রসিকতা করলেন সেই সাথেÑ আপনি চাইলে একজনকে বানিয়েও নিয়ে আসতে পারি।
উচ্চ হাসি দিলেন কাসেম সরদার। বললেনÑ ইত্তেফাকের লোকেরা এমন করতে পারে না। হাসিমুখে বাসায় ঢুকলেন কাসেম সরদার। আর খুশি মনে চাবি পকেটে পুরে আল মাহমুদ এলেন ইত্তেফাকের কর্মযজ্ঞে। পরদিনই সৈয়দা নাদিরা মাহমুদকে নিয়ে এলেন ঢাকায়। মাহমুদ ভাইয়ের ভাষ্যানুযায়ী, ভাবী খুব খুশি মনে ঢাকায় আসেননি। আসেননি কারণ বড় ছেলের বউ হিসেবে তার একটি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হচ্ছিল পরিবারে। বড় বউয়ের মর্যাদায় তিনি সিক্ত হচ্ছিলেন। এ ছাড়া আল মাহমুদের বড় সন্তান মীর মোহাম্মদ শরীফ তখন পেটে। এ সময় মেয়েরা সাধারণত মায়ের কাছেই থাকতে চায়। এসব ছেড়ে এলেন তিনি। এভাবে ঢাকায় পারিবারিক জীবনের যাত্রা শুরু হলো আল মাহমুদের।
এর মধ্যে বেজে উঠল ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের ডামাডোল। চতুর্দিকে মিছিল-স্লোগান-সমাবেশ। প্রতিবাদী মানুষের উত্তাল ঢেউ।
এ সময় একটি ছড়া লিখলেন আল মাহমুদ। লিখলেন এক কারফিউ রাতে। নাম দিলেন ঊনসত্তরের ছড়াÑ
ট্রাক ট্রাক ট্রাক/শুয়োর মুখো ট্রাক আসবে/দুয়োর বেঁধে রাখ/কেন বাঁধবো দোর জানালা/তুলবো কেন খিল/আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে/ফিরবে সে মিছিল।/ট্রাক ট্রাক ট্রাক/ট্রাকের মুখে আগুন দিতে/মতিয়ুরকে ডাক।/কোথায় পাবো মতিয়ুরকে/ঘুমিয়ে আছে সে/তোরাই তবে সোনামানিক/আগুন জ্বেলে দে।
ছড়াটি প্রকাশ হওয়ার পর সত্যিই আগুন জ্বলেছিল, এমনটিই বলেছিলেন আল মাহমুদ। কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক নেতাদের মুখে মুখেÑ তোরাই তবে সোনামানিক আগুন জ্বেলে দে। গণ-আন্দোলনের উত্তাপ যখন ঢাকার রাজপথে আছড়ে পড়ছে, আল মাহমুদের এ ছড়া তাতে আগুনই ধরিয়ে দিলো। দেখতে দেখতে ঢাকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। ইত্তেফাক বন্ধ করে দিলো সামরিক সরকার। আবার বেকার হয়ে গেলেন আল মাহমুদ। ঢাকায় থাকার মতো উপায় রইল না তার। ফিরে গেলেন গ্রামের বাড়ি। সঙ্গত কারণে ভাবীকে রেখে এলেন শ্বশুরবাড়ি।
এর মধ্যে সৈয়দ আলী আহসানের একটি চিঠি পেলেন হাতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লিখে পাঠিয়েছেন তিনি। লিখেছেন চিঠি পাওয়ার পর যেন আল মাহমুদ চট্টগ্রাম যান এবং দেখা করেন তার সাথে। চিঠিটি পেয়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আল মাহমুদ। তার আগে একবার ঢাকা ঘুরে যাবেন বলে মনস্থির করলেন। এলেন ঢাকায়। রাতের ট্রেনে এসে সকালে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে নামলেন। স্টেশন থেকে হেঁটে গেলেন নবাবপুর। নবাবপুর রোডে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ শুনলেনÑ এই যে আল মাহমুদ, যাচ্ছেন কোথায়? আপনাকে খুঁজে আমি হয়রান। ফিরে দেখেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই। ভীষণ আন্তরিকতার সাথে বললেন আপনার একটি ছবি জরুরি দরকার।
জিজ্ঞেস করলেন আল মাহমুদ কেন খুঁজছেন? কেনই বা আমার ছবি দরকার? আনন্দের সাথে দাদাভাই বললেনÑ আপনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। এ জন্য ছবি দরকার। আপনি কবিতায় পেয়েছেন। আমি পেয়েছি ছড়া সাহিত্যে। পুরস্কারটি ছিল ’৬৮-এর। ঘোষণা হয়েছে দেরিতে ’৬৯-এ। শুনে খুশিতে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন আল মাহমুদ। দুঃসময়ে এমন সুসংবাদে আল মাহমুদ তীব্রভাবে উজ্জীবিত হলেন। দাদাভাইকে বললেনÑ আমার কাছে তো ছবি নেই।
চলুন কোনো স্টুডিওতে ঢুকে পড়িÑ এই বলে মাহমুদ ভাইকে টেনে নিয়ে গেলেন দাদাভাই। নবাবপুরের একটি স্টুডিওতে ছবি তুললেন দু’জন। খুশির আবেগ বুকে চেপে বিদায় নিলেন দু’জন দু’জন থেকে।
পুরস্কার দেয়া হলো। পুরস্কার মূল্য পাঁচ হাজার টাকা। এ সময় পাঁচ হাজার টাকা আল মাহমুদের কাছে অনেক দামি। এ স্মৃতি যখন বলেছেন মনে হচ্ছিল, সেই সময়কার আনন্দই যেন হাজির হয়েছিল। খুশিতে ডগমগ হয়েই বললেনÑ টাকার অঙ্ক পাঁচ হাজার হলেও আমার জন্য তা ছিল অনেক অনেক অনেক। যেখানে আমি সম্পূর্ণ বেকার। শ্বশুরবাড়িতে বউ তত দিনে আমার বড় সন্তান জন্ম দিয়েছে। আমি দারিদ্র্যে-লজ্জায় ভয়ে শ্বশুরবাড়ি যাইনি। পুরস্কারটি আমাকে পারিবারিক এ লজ্জা থেকে মুক্তি দিয়েছে। একই সাথে ঘুরিয়ে দিয়েছে আমার লেখক জীবনের মোড়। মনে হচ্ছিল আমি বাংলা কবিতার একজন অংশীদার। আমার ভেতর কবিতা নতুন করে খেলতে শুরু করল। মাত্র দু’টি বই তো তখন পর্যন্ত প্রকাশ পেয়েছে। একটি ‘লোক লোকান্তর’ অন্যটি ‘কালের কলস’। আমার মনে তখন কবিতার নতুন আঙ্গিক দুলছে। যে দুলুনি আমাকে নিয়ে গেছে সোনালি কাবিনের দিকে।
বললেনÑ পুরস্কার নিয়ে আমি খুশিতে বাগবাগ। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম শ্বশুরবাড়ি যাবো। বাংলা একাডেমি থেকে বের হতেই ঠিক একাডেমির গেটে দেখা শিশুসাহিত্যিক এখলাস উদ্দীনের সাথে। আমাকে দেখেই হাত চেপে ধরলেন। বললেনÑ সাঙ্ঘাতিকভাবে খুঁজছি আমি তোমাকে। ভেবেছি আজ এখানেই দেখা মিলবে তোমার। তাই এখানে আসা।
এখলাস উদ্দীন এ দেশের ছড়া সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। যেমন তিনি সুদর্শন ছিলেনÑ তেমনি ছিল তার রুচিবোধ। এবং তেমনি ছিল লেখার ধার। লিখেছেন কম। কিন্তু যা লিখেছেন তা তুলনাহীন।
[চলবে]


আরো সংবাদ



premium cement