২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গান ও কবিতার রহস্য জগৎ

-

গানের সম্পর্ক প্রাণের সাথে। হৃদয়ের সাথে সম্পর্কিত কবিতা। প্রাণ মানে আত্মা। আর হৃদয় হলো যেখানে আত্মার বসবাস। যদিও আত্মা ও হৃদয়ের সম্বন্ধ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কারো মতে, প্রাণ মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস। আর আত্মা হলো শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুভূতি। প্রাণের সাথে মানুষের জীবন জড়ানো। আত্মা সে জীবনের অনুভবের তীব্র শিখা। প্রাণের প্রবাহ সদা চলমান। কিন্তু হৃদয়ের কাছে মানুষকে ফিরতে হয়। আত্মা হলো নিজের সাথে নিজের কথা বলার মাধ্যম। নিজের সাথে কথা বলার আশ্চর্য ক্ষমতা কেবল মানুষেরই আছে। মানুষই পারে নিজেকে নিজে ভালোবাসতে ঘৃণা করতে এবং নিজেকে স্বীকার অস্বীকার করতে। প্রাণপ্রবাহের সাথে আত্মার আনন্দ অনুভব করার গভীর ও রহস্যময় চুম্বক মানুষ বিনে আর কোনো প্রাণীর কাছে নেই।
প্রকৃত অর্থে আত্মা ও হৃদয়ের খানিকটা তফাত যদিও আছে, কিন্তু গান ও কবিতার উৎসবে এ দুটোই নিবিড়ভাবে জড়ানো। প্রাণ ছাড়া হৃদয় নেই যেমন, তেমনি হৃদয় ছাড়া আত্মার মূল্য নেই। প্রাণ ও আত্মার সমন্বিত সেতুই মানবজীবন। তবুও জীবনে প্রাণের সাথে জড়ানো গানÑ এ কথার একটি গূঢ় রহস্য তো আছেই। আছে দুটোর আলাদা উপত্যকা। দুটোর আলাদা শরীর বোঝার লক্ষ্যে আমাদের খানিকটা এগিয়ে দেখতে হবে।
দেখতে হবে গভীর দৃষ্টির সাথে। অবশ্য একটি সহজ উদাহরণ হাজির করা চলে। যেমন জগতে প্রায় প্রত্যেক মানুষই গান গাওয়ার চেষ্টা করে। কবিতা লেখারও চেষ্টা চালিয়ে যায়। বিশেষত কৈশোরকালে কবিতা চর্চার একটি বেয়াড়া স্বপ্ন সবার বুকে পাখা ঝাপটায়, সে হোক নর কিংবা নারী। বাংলাদেশের যে প্রকৃতিÑ এর রূপ, রস ও গন্ধের টান এতটা চুম্বকীয়; যা প্রত্যেক কিশোর ও যুবককে কবিতা লেখার ইন্ধন জোগায়।
এই ইন্ধনে প্রভাবিত হয় না এমন কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা হয়তো হাতেগোনা। কৈশোরকাল কল্পনার কাল। সে কল্পনার ঘুড়ি হলো কবিতা। সুতরাং সবাই কবিতার বাড়ি এসে কড়া নাড়ে দরজায়। কেউ কবিতা-বাড়ির দরজা খোলার চাবি হাতে দাঁড়ায়। বেশ সানন্দে খুলে ফেলে দরজার মুখ। কেউ ফের চাবিহীন করাঘাত করে দরজার বুকে। চাবিহীন কবিতার দরজা খোলার সাধ্য কারো নেই। সেই চাবি হলো সাধনা ও ধৈর্য।
মজার বিষয় হচ্ছে, এই সাধনা ও ধৈর্য গানের দরজারও চাবি। শুনতে অবাক যদিও লাগে, তবুও এ কথাই সত্য। সাধনা ও ধৈর্য ছাড়া গান-কবিতা কারো বাড়ি প্রবেশ করে না। কিন্তু এ চাবি সংগ্রহ করার কষ্ট বরণ করার সাহস ও হিম্মত থাকে খুব সামান্য লোকের। যারা জীবনের প্রায় অন্য সব দরজা রুদ্ধ করে কেবল গান অথবা কবিতা কিংবা এ দুটোরই খোলা রাখে দরজা; তাদের জীবনের সমস্ত আনন্দ-বেদনার পথ হয়ে ওঠে এ দরজার বুক। আহা গান! আহা কবিতাÑ কিভাবে মনকে মনের ভেতর লুকিয়ে অদম্য হয়ে ওঠে তার ছবি দেখে কেবল ভুক্তভোগী।
কৈশোরে যেমন কবিতা লেখার প্রয়াস উদ্যত, তেমনি গান করার চেষ্টাও বাঁধনহীন। দুটোর জন্মই কৈশোরকালে। দুটোই কৈশোরে বাসা বাঁধে মানুষের বুকের ভেতর। ব্যবধানটি হলো কবিতা কিছু দিন চর্চার পর অল্প কিছু মুখ ছাড়া প্রায় সবাই ত্যাগ করে একে। কিন্তু গান গাওয়ার চেষ্টা কখনো ত্যাগ করে না মানুষ। বাথরুমশিল্পী বলে যে কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত তা তো বিলকুল সাত্যি। একরত্তিও ভুল নেই এখানে। মানুষ একা হলেই গুনগুনিয়ে ওঠে। গানের কোনো মুখ জানা থাক না থাক তাতে কী, হুঁ হুঁ হাঁ হাঁ-তে কোনো কথা মুখস্ত থাকার প্রয়োজন কি? না। এর প্রয়োজন নেই। বলেই এভাবে বেসুরো প্রয়াসে সুর তোলে মানুষ। তবুও গান মানুষের সঙ্গী হয়ে ওঠে। তবুও গান করার এ প্রয়াস চলতেই থাকে। খুশির কোনো সংবাদ এলেই মনে বেজে ওঠে কোনো সুর। একাকী হলেও সুরের দোলায় দুলতে থাকে মানুষ।
গানে যখন থেকে যায় কেউ, তার তো গানই জীবন। গানই ওয়ে ওঠে প্রেরণার শিখা, যা জ্বলতে থাকে আপনাতেই। গানে ডুব দিলে তার দিনরাত গানময় হয়ে ওঠে। সব কাজের ভেতর গানের গুনগুনানি। সব আনন্দের ভেতর গানের সুর। সব বেদনায়ও বেজে ওঠে গানের বীণা। একাকী যখন কেউ গান গায় তখন বিস্ময়ে জেগে ওঠে মন। মনে হয় হৃদয় ও আত্মার কোথাও গান ছাড়া ফাঁকা নেই এতটুকু। মনে হয় পৃথিবীটা গানের সুরে দুলছে। সুতরাং সুরের বিরুদ্ধে গানের বিরুদ্ধে কী করে দাঁড়ায় মানুষ।
হ্যাঁ, এ কথা বলা যায়Ñ আক্ষরিক অর্থেও দুলছে। এই যে বহমান বাতাসে শো শো ধ্বনি, একে সুর ছাড়া আর কিসের সাথে তুলনা দেয়া যায়। বৃষ্টি পতনের যে শব্দ, একে সুর না বলে আর কী-ই বা বলা চলে! নদীর স্রোতের তানে যা বাজে এ কি সুরের খেলা নয়! পাখির কণ্ঠে মধুর ধ্বনি সুর ছাড়া আর কী হতে পারে! পাতার মর্মর আওয়াজ নয় কি সুরের উপমা! আজানের সুর অস্বীকার করার সাহস কার আছে?
আমাদের দেশের একজন খ্যাতিমান সুরকার ছিলেন সুবল দা। তার সুর বাংলা গানে বেশ সমাদর পেয়েছে। সুরের জন্য তার সম্মান ছিল বেশ উঁচুতে। তিনি ছোটকাল থেকেই সুর খুঁজে বেড়িয়েছেন। তার মর্মে প্রথম সুর পৌঁছে দিয়েছিল ভোরের আজান। যে আজান শুনে তিনি ব্যাকুল হতেন। আজানের শব্দ শোনামাত্র বিছানা ছাড়তেন। অন্ধকারেই ছুটতেন সেই আজানের ধ্বনির উৎসের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন সেই মসজিদের মিনার লক্ষ্যে। যে মিনার থেকে ভেসে উঠত বিস্ময় সুরের ধ্যান।
মা তার অবুঝ শিশুকে ঘুম পাড়ান সুরের দোলায়। একটি অবলা প্রাণী সেও ডেকে ওঠে এক ধরনের সুরের ধারায়। এমনকি গরুর হাম্বা শব্দের ভেতর, ছাগলের ম্যাঁ... এর ভেতর, মোরগের কুক্কুরুকুর ভেতর, বেড়ালের মিয়াঁও-এর ভেতর এমনকি শেয়ালের হুক্কা হুয়ার ভেতরও সুরই ছাপিয়ে ওঠে। প্রত্যেক মানুষের হাসির ভেতর এক ধরনের উচ্ছ্বাস থাকে ঠিক। এ উচ্ছ্বাসও এক রকম সুরের প্রবাহে বেজে ওঠে। কান্নার ধ্বনিতে করুণ সুর কী যে শক্তির সাথে বাজে, খানিকটা কান পাতলেই বোঝা যায়। ভোমরের গুঞ্জনের ভেতর, প্রজাপতি পাখার কম্পনের ভেতর এবং মৌমাছির ক্রমাগত স্পন্দিত পাখার ভেতর দোলে সুর। শিশুর কান্নার ভেতর খেলা করে সুর। আদরের সাথে কোনো মাকে যখন ডাকে শিশুসন্তান, তখনো সুর খেলে যায়। সেই আদর ডাকে মায়ের দেয়া জবাবে সৃষ্টি হয় কী মধুর সুর! এভাবে সুর জড়িয়ে মুড়িয়ে আছে আমাদের জীবন ও জগতের পরতে পরতে। প্রকৃতি শব্দহীন বরাবর। কিন্তু এ নৈঃশব্দের ভেতর কান পাতলে শোনা যায় নিঝুমতার আশ্বর্য সুর। প্রকৃতির হৃদয় ভরা সুরের উৎসব। সুরের তরঙ্গে দুলতে থাকে প্রকৃতির অঙ্গ। প্রতিটি যন্ত্রের ঘষটানি এবং শব্দের ভেতর খেলে তাল লয় সুর।
মহাগ্রন্থ আল কুরআন সুর করেই পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন কুরআনের রচয়িতা মহান আল্লাহ তায়ালা। কুরআনের সুরে কী জাদু লুকিয়ে আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কুরআনের বাহক নবী মুহাম্মদ সা:-এর কণ্ঠে সে সুর শোনার আকর্ষণে শেষ রাতের ঘুম ত্যাগ করে নবীর ঘরের পেছনে লুকিয়ে কান পাততো অনেক অবিশ্বাসী। আজকের আধুনিক যুগে সত্যিকার ক্বারিদের কণ্ঠে কুরআন শোনার আকর্ষণ কার না জানা! বিশেষ করে মিসরের ক্বারি বাসেতের কণ্ঠ বিশ্ববাসী কিভাবে অস্বীকার করবে! কিভাবে ভুলবে এমন সুরের সম্মোহন!
সুতরাং সুরের এই যে বিস্ময় বিধান ছড়ানো গোটা বিশ্বজগতে তার মূল্য খোঁজা প্রত্যেক বুদ্ধিমান মানুষের কাজ। যার কণ্ঠে মহান স্রষ্টা গুঁজে দিয়েছেন সুর তাকে প্রকাশ করতেই হবে সুরের আনন্দ। কেননা এটি তার প্রতি স্রষ্টার দান। সে সুর সাধনায় তাকে নিয়ে যেতে হবে একটি পরিণতির দিকে। নইলে স্রষ্টার দানের প্রতি অবহেলা হবে। এ অবহেলা অবশ্যই অপরাধের।
মানুষের কণ্ঠে সুর তো আল্লাহরই দান। যার কণ্ঠ মধুময় মিষ্টি তার স্রষ্টা কি সে নিজে? না। মোটেই তা নয়। তবে? তবে এ কথাই সত্যি মিষ্টি কণ্ঠ স্রষ্টারই দান। নইলে সবার কণ্ঠই তো মিষ্টি সুরের হতে পারত। অথবা সবারই কর্কশধ্বনি ফুটত কণ্ঠ থেকে। যেহেতু কারো কারো কণ্ঠ মধুর এবং কারো কারো কণ্ঠে খেলা করে সুর, সেহেতু এটি কোনো মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়। নয় কারো খেয়ালিপনার আয়োজন। মানুষের ভাগ্য যেমন নির্ধারিত, সুরও নির্ধারণের বাইরের কিছু নয়। এটিও ভাগ্যের অন্তর্গত। রিজিকেরই অংশ এটি। সুতরাং যার কণ্ঠে সুর আছে তার কাছে এ সুর স্রষ্টার দেয়া আমানত। এ আমানতের যথাযথ ব্যবহার করতেই হবে। জগতে কবিতার আয়োজনও এর বাইরের কিছু নয়। কবিতাও এক ঘোর লাগা ঘোরের প্রকাশ। এক বিস্ময়কর অনুভূতির আনন্দে জন্ম নেয়া ভাষার মাধুরী। একাকিত্বের ঊর্ধ্বে কোনো নির্জনতার আশ্চর্য সঙ্গী কবিতা।
সুর যেমন মহান স্রষ্টার দান। কবিতাও একান্ত তাঁরই দেয়া অনুগ্রহের দ্যুতি। কবিতা প্রবাহের ভেতর দিয়ে জীবন্ত থাকে ভাষার শরীর। কবিতা না থাকলে মানুষের ভাষা মরে যেত। মৃত ভাষা আওড়াতে হতো মানুষকে। প্রাণহীন ভাষায় কথা বলত মানুষ। নতুন শব্দের জন্মই হতো না যদি না কবিতা থাকত। কবিতা ভাষার প্রাণ। তাই কবিতাকে বলা হয় মানবজাতির মাতৃভাষা।
কবিতা না থাকলে বিশ্বজগতের সৌন্দর্য প্রকাশের মাধ্যম থাকত কি? কবি না থাকলে সুন্দর দেখিয়ে দিত কে? সুন্দর প্রকাশের প্রাণসঞ্চার কবি ছাড়া কে করত। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেনÑ ‘আল্লাহ সুন্দর, তাই তিনি সুন্দরকে ভালো বাসেন।’ সুন্দরের সব অভিধা কবিদের কবিতায়। কবিতা ছাড়া সুন্দরের সীমা-পরিসীমা ভাবা যায় না। ফুলের সুষমার কথা কে বলত। কে বলত বাতাসে পাপড়ির আনন্দময় দোলানির কথা। ভোমরের গুঞ্জনে, প্রজাপতির কম্পনে মৌমাছির মধু সংগ্রহের শ্রমে এবং পাখির বাসা বুননের শিল্পের কথা কবিরাই লিখেছেন। কবিতার শব্দ বিনে সুন্দরের সান্নিধ্য পাওয়া ভার। রঙের লালিত্য এবং আকাশের বিশাল উন্মুক্ততার কথা কবি ছাড়া কে বলতে পেরেছে কবে? পৃথিবীর কোন শাস্ত্র নর-নারীর প্রেমের সৌন্দর্য চিহ্নিত করেছে? মানবজীবনে আবেগের শরীরে ভাষা জুগিয়েছে কারা? কারা বলেছে মানুষের স্বপ্নের কাহিনী? স্বপ্নহীন মানুষের শেষ আশ্রয় কবিতা। পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টি একেকটি কবিতা। এ কারণে কবিতাপিপাসু হৃদয় সুন্দরের বাসর। সুন্দর বসত করে কবিতার বাড়ি। সুন্দরের চর্চা করেন এমন প্রতিটি হাতকে টোকা দিতে হয় কবিতার দরজায়। কবিতা না পড়ে শিক্ষিত হওয়ার উপায় নেই কোনো মানুষের। একটি শিশুর মুখে প্রথম যে বুলি ধরিয়ে দেন তার মাÑ সেও ছড়া বা কবিতাই। প্রেমের বন্ধন প্রকাশ করার মাধ্যমও কবিতা ছাড়া আর কিছু নয়। কবিতা এমনই জড়ানো মানবজীবনের অস্তিত্বের সাথে। কবিতার পাঠক জগতে সবচেয়ে অগ্রসর পাঠক। কবিতার ধারকও সবচেয়ে অগ্রসর মানুষ। কবিতা যুগের থেকে এগিয়েই চলে। কবিরা আগামীর কথা বলেন। অনাগত দিনের কথা বলেন। আজ-কে পৌঁছে দেন আগামীকালের কাছে। আগামীকালকে নিয়ে আসেন আজকের কাছে। এভাবে কবিতা জীবন ও যৌবনের অনুষঙ্গ। হৃদয়ঘটিত দিক থেকে গান এবং কবিতার তেমন ব্যবধান নেই, বরং এক ধারায়ই দু’জনের চলাচল। তবে শরীর ও অবয়বগত কিছুটা পার্থক্য আছেই। সুরের দিকেও ব্যবধান বেশ।
একদা গান ও কবিতার শরীর প্রায় একই গঠনে ছিলÑ প্রতিটি গানই ছিল আগে কবিতা, তার পর গান। তবে গানের শরীর গঠনে কিছু ধরাবাঁধা তরিকা মানতেই হয়, যা কবিতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কবিতায় যেমন ছিল মাত্রাগত দিক, অন্তমিল ও টাইটাই ছন্দ গানেও তাই। তবে গানে স্থায়ী, অন্তরা ও সঞ্চারী থাকে। থাকে অন্তরা শেষে স্থায়িত্বে ফিরে যাওয়ার ব্রিজ। কবিতার স্থায়ী অন্তরা নেই, সঞ্চারী নেই, নেই ব্রিজও। বরং কবিতার সবটাই স্থায়ী। তাল-লয় গানের ভীষণ অনুষঙ্গ। ছন্দোবদ্ধ কবিতার জন্যও এ অনুষঙ্গ প্রযোজ্য। তবে গান যে কারণে গানÑ অন্য অনুষঙ্গের সাথে সুর অন্যতম প্রধান। সুরই গানকে গান করে তোলার প্রধান নিয়ামক। গানেরও শরীর এবং আত্মা আছে। আছে কবিতারও শরীর-আত্মা। শারীরিক দিক থেকে গান খুব সীমিত কাঠামোয় জন্ম নেয়। কবিতার সীমানা বেশুমার। গানের আত্মা হলো সুর। কবিতার আত্মা বাণী। অবশ্য গানেও বাণী ছাড়া সুর জমে না। বলা যায়, বাণী এবং সুর দুটো মিলে গানের আত্মা। আর কবিতার আত্মা হলো বাণী এবং আন্তঃবাহ।
একসময় গান রচিত হতো কবিদের হাতে। কবিরা ছিলেন গানের স্রষ্টা। ফলে গানের শব্দ, বাক্য, ছন্দ ও অন্তমিল ছিল শিল্পের মাপকাঠিতে অনন্য। কবি নন অথচ গীতিকার এমন গানের শরীরে আর শিল্পের সহবাস নেই। মাত্রাগত ত্রুটি, অন্তমিলে দুর্বলতা এবং শব্দ প্রয়োগে অশিল্পের প্রকাশ প্রকট হয়ে উঠেছে। ফলে সুরের ঠেলাধাক্কায় এসব দুর্বলতা ঢাকার চেষ্টায় বাংলা আধুনিক গান খানিকটা খোঁড়া, ল্যাংড়া ও রুগ্ণ হয়ে উঠেছে। গানের পক্ষে সুর তাল লয় গান যেমন জরুরি। তেমনি জরুরি মাত্রা, অন্তমিল ও যথার্থ শিল্পাবিষ্ট শব্দফুলের প্রয়োগ। এসব অভিধা টাইটাই হলেই কেবল একটি গান সুস্থ সুন্দর ও সবল স্বাস্থ্য নিয়ে জন্ম নিতে পারে।
আধুনিক গীতিকারদের মতো আধুনিক কবিদের অবস্থাও তথৈবচ। আধুনিকতার নামে কবিতায়ও চলছে এক ধরনের নৈরাজ্য। এসব আধুনিক কবির অনেকেরই ছন্দমাত্রার জ্ঞান নেই। বোঝেন না পর্ব ও চিত্রকল্প। শিল্পের সুষমা বোঝার চিন্তাই করেন না। ফলে কবিতা হয়ে ওঠে মনের কিছু অভিব্যক্তি দুর্বল শব্দ ও খোঁড়া বাক্যের তেজহীন নেতানো কথামালা। সবার কবিতার চেহারা অবয়ব প্রায় একই। পাঠের টোন ধরনও এক রকম। এর ফলে ১০ কবির ১০টি কবিতা শুনলে মনে হয় একটিই শোনা হলো। ভিন্নকণ্ঠে পাঠও যেন একজনেরই পাঠ। আধুনিক কবিতার এ অবয়বের সাথে গানের আর কোনো মিল রইল না। যেমনি হোক গান তার শারীরিক অবকাঠামো এখনো অবিকল রেখেছে। ঘাটতি যেটুকু তা আধুনিক গীতিকারদের না জানা অথবা কম জানা বা অর্ধেক জানার ফল। কিন্তু গান তার শিল্পগত সৌন্দর্যের পিপাসায় এখনো তৃষ্ণার্ত।
একজন গীতিকার গান রচনার সাথে যখন সুর সৃষ্টির প্রয়াস নেন, সেটি অন্যরকম দ্যোতনায় বেজে ওঠে। পেশায় তিনি যা-ই হোন গান তার নেশা হয়ে ওঠে। গান যখন কারো নেশা হয়ে ওঠে, তার ভুবন সম্পূর্ণ বদলে যায়। যে কাজই করুন না তিনি, তার মনের স্রোতে ভাসতেই থাকে গান কিংবা সুর শয়নে জাগরণে, চলাফেরায়, দিন অথবা রাত্রিতে সারাক্ষণ গানের তীব্র তৃষ্ণা তাড়া করে তাকে। সব চিন্তায় গান। সব ভাবনায় গান। সব বিষয়ে গান। এমনকি সব কথায়ও বেজে ওঠে গানের বাঁশি। নীরবে নির্জনে একাকী হওয়ার ইচ্ছে জাগে তার। মনে হয় আর কেউ নয় কেবল আমার সঙ্গী হোক আমারই গান। মিটে যাক সকল শোরগোল। সব শব্দ ডুবুক নিস্তব্ধতায়। কেবল আমার গানের শব্দ উচ্চারিত হোক পৃথিবীর বুকের ওপর। এমন করে ভাবতে ভাবতে অশ্রু জমে ওঠে চোখের নদীতে। সেই অশ্রুর নোনা দাগ যখন নদী হয়ে যায় তখন জন্ম নেয় নতুন গান। পৃথিবীতে সবচেয়ে দামি জল চোখের অশ্রু। সেই অশ্রুতে যখন ভিজে যায় গানের শব্দমালা, তখন তার আবেদন অন্যরকম। এমন গানের সুরে নিশ্চয়ই বেজে উঠবে অশ্রুর তরঙ্গধ্বনি। হৃদয় তখন নুয়ে পড়ে স্রষ্টার কাছে। বিনয় রোদনে ফরিয়াদ করে মন। হে প্রভু, আমার বুকে পুরে দাও জগতের শ্রেষ্ঠ ভাষার শৈলী। আমার কণ্ঠে ঢেলে দাও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুরের সুধা। এভাবে মানুষ আত্মার গহিন থেকে দেখে নিজেকে। দেখে পৃথিবীকে। ফলে মানুষটি হয়ে ওঠে গানের। আর গান হয়ে যায় একান্ত তারই।
যে গানের বাণী সুন্দর, মানবিক এবং যে গান শুভ চিন্তার জন্ম দেয় তেমন গান সমাজের জন্য জরুরি। এসব গানের সুর এবং সুরের সঙ্গে প্রয়োজনীয় ইনস্টুমেন্ট প্রয়োগ সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করার অন্যতম প্রয়াস। সুতরাং যার ভেতর আছে সুরের কল্লোল, যার ভেতর আছে গানের তৃষ্ণা তাকে এগোতে হবে এ পথেই। এটি তার জীবনের কর্তব্য। হ


আরো সংবাদ



premium cement
বগুড়ায় ধানের জমিতে পানি সেচ দেয়া নিয়ে খুন জিআই স্বীকৃতির সাথে গুণগত মানের দিকেও নজর দিতে হবে : শিল্পমন্ত্রী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ চুয়েট, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ সখীপুরে সাবেক ও বর্তমান এমপির সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ তীব্র গরমের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অন্যতম দায়ী : মির্জা আব্বাস সৈয়দপুরে জামায়াতের উদ্যোগে সালাতুল ইসতিসকার নামাজ আদায় জিম্বাবুয়ে সিরিজের শুরুতে না থাকার কারণ জানালেন সাকিব ঝালকাঠিতে গ্রাম আদালত কার্যক্রম পরিদর্শনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল চুয়াডাঙ্গায় বাতাসে আগুনের হল্কা : গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ বৃষ্টির নামাজ আদায়ের নিয়ম আজও স্বর্ণের দাম ভরিতে ৬৩০ টাকা কমেছে

সকল