২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এই শহরে মীর তকি মীর

-

রিকশা থেকে নেমে লোকটি ছালাদিয়া হোটেলের ছালার দরজা নাড়িয়ে ভেতরে পা রাখার উদ্যোগ করতেই তার পেছন পেছন এসে জড়ো হয়েছে কয়েকটা কুকুর। এরা এতক্ষণ আশপাশেই ছিল। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শুয়ে, বসে।
ঝুল পাঞ্জাবির লোকটি মুখে একরকম চুকচুক সঙ্কেতে তাদের ইশারা করতেই কুকুরগুলো কী বুঝল তা অনুমানযোগ্য, তাদের চোখগুলোতে মুখগুলোতে একটা আশ্বস্তির প্রভাব ঝিকিয়ে উঠল।
সকাল তখন বাজে সাড়ে ৬টা। ভোরের হোটেলগুলো সদ্য খুলছে খুলবে। ঘুম ঢুুলঢুল বাসি মুখেচোখে গ্যাঁজলা কেঁতুর- বেয়ারা ছোকরা তারা টেবিল চেয়ার বাসনকোসন ঝাড়পোছ কেবল গুছিয়ে আনছে। লোহার বিশালাকার একটা জীর্ণ তাওয়ায় পরোটা ভাজার পুরনো তেল গরম হয়ে ফুটছে এতক্ষণে, রাবারের মতো একজন টান টান খালি গাÑ লোক বড়ো এক পাথুরে ট্রে-তে গুলছে খামির বেলছে রুটি, অন্যদেরকেও হাঁক ডাকে সজাগ করছে। হোটেলের মালিক নিশ্চয় সে। এ ধরনের হোটেলগুলোর অবস্থা একইরকম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুম থেকে মুক্তি পেয়ে ছাত্রাবাসের নিজস্ব রুমে ওঠার পর আজ দ্বিতীয় ভোর। শেষরাতের তাহাজ্জত ওয়াক্তে জাগার অভ্যাস আমার। সকালের শুদ্ধ আবহাওয়ায় একটু বেশি হেঁটে এসে কেন্দ্রীয় মসজিদে ফজর নামাজ পড়ি। প্রতিদিনই। তারপর আরো বেশ কিছুক্ষণ হাওয়া-ভ্রমণ। রমনা কাকরাইল মসজিদ পর্যন্ত।
শাহবাগ মোড়ের ফুলবাজারের পাশ কামড়ে যেই ফুটপাথটা রমনার দিকে গিয়ে উঠেছেÑ বেড়াতে বেড়াতে হাঁটতে হাঁটতে সেখানেই একটা দৃশ্য দেখে থমকে থেমেছি।
মওলানামত দেখতে লোকটি নাশতা শেষ করে খাকি কাগজে মুড়িয়ে কয়েকটা শুকনা রুটি কিনলেন।
এই সময়ে এত ভোরে হোটেলে খদ্দের তেমন আসে না।
লোকটি বাইরে বেরিয়ে আসছেন- দরজার আশপাশে জড়ো হওয়া কুকুর ও ছানাদের মধ্যে কেমন একটা চাঞ্চল্যের ভঙ্গি।
যেন এখনই একটা জাদুখেলা শুরু হবে, ক্যানভাসার তার কালো ঝোলা থেকে সামগ্রী বের করছেন এক এক। কুকুরগুলো ধীরে ধীরে এসে লোকটির চার পাশে জমা হলো। লোকটি যেন অদৃশ্য একটি বৃত্ত আঁকলেন তার চার পাশে, সবাই গোল করে ঘিরে দাঁড়াল তাকে।
সুবোধ, সমাহিত ভাব লোকটার। যেন কোনো মন্ত্রে ডুবে আছে। কুকুরগুলো ঘিরে ধরেছে তাকে।
আক্রমণাত্মক নয়, যন্ত্রণাক্লিষ্ট নয়, উগ্রতা নয়, কুকুরগুলোরÑ এখানে যেন তাদের মোহগ্রস্ত এক ভঙ্গি।

হঠাৎ এই রেশ কেটে গেল।
লোকটি রুটির টুকরো ছিঁড়তে শুরু করল। ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছুড়তে লাগল। এদিকে-ওদিকে। যেন কাক-ভাত ছিটাচ্ছে কেউ।
কুকুরদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেল।
লাফিয়ে লাফিয়ে উঁচু হয়ে নিচু হয়ে সেসব রুটির টুকরো মুখে ধরতে লাগল। আর ঘেউ ঘেউ করে আনন্দ প্রকাশ করছে।
মানুষ হলে বলতাম হই-হল্লা, কুকুরদের কি ঘৈ-ঘল্লা? হা হা হা।
যেন একটা খেলা হচ্ছে এখানে, এত বড় লোকটি দিব্যি খেলাধুলায় মজে যাওয়া বাচ্চার মতো হাসছে আর ক্রমাগত রুটির টুকরো ছিটাচ্ছে। হাসছে আর...
একসময় মনে হলো অনাবিল উচ্ছলতার আতিশয্যে পাগলের মতো হাসতে থাকল হো হা করে, রুটির সব টুকরো নিঃশেষিত হলেও হাতে অদৃশ্য কিছু ছিটাতে লাগলেন বিহ্বল এক শিশুর মতো।
আমি দৃশ্যটা দেখে কিছু সময় ভীষণ মোহঘোরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কী এক আচ্ছন্নতার আত্মা ভর করল। মাথার চার পাশের দৃশ্যজগৎ কী রকম হয়ে আসতে থাকলÑ যেন মাথায় চিন চিন ব্যথা।
কত সেকেন্ড এভাবে পার হয়ে গেল জানি না, একটু পর কোথাও রিকশার অনবরত টুংটাংয়ে সজাগ হয়ে দেখি কোথাও কেউ নেই। সব নীরব। নেই কোনো কুকুর। নেই সে লোকটি। মেলা যে কখন ভেঙে গেছে, বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে আছে কয়েকটি ছেঁড়া রুটির টুকরো। কাকে খুঁটছে।
২.
সদ্য গোসল সেরে এসেছে সে। ফর্সা বুকভরতি পশমের ঝাঁক। গায়ে আধভেজা টাওয়েল। পৌরুষদীপ্ত গৌরবর্ণের এক মুখ। শৈল্পিক দ্যোতনায় দাড়ি-মোচে আবৃত। ভেজা কাপড় লম্বা বারান্দায় টাঙানো দড়িতে শুকাতে দিচ্ছেন।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে রুম ছেড়ে বেরোতে গিয়ে দরজা সরাতেই দেখলাম সকালের সেই লোকটিকে। আমি আচানক বিদ্যুৎ-স্পর্শের মতো চমকে উঠলাম, প্রায় চিৎকার বেরিয়ে এলো কণ্ঠ দিয়ে, আরে ভাই
তুমি এখানে কীভাবে!
আমি রীতিমতো কাঁপছি, উত্তেজনায় ঘামের শিশির জমছে কপালে।
লোকটি আমার দিকে কিছুক্ষণ নিস্পৃহ কৌতুকপূর্ণ চোখে পরখ করল। তার পর স্নিগ্ধ হয়ে এলো দৃষ্টি। একটু হেসে, সহজ গলায়Ñ প্রতিটা অক্ষর আলাদা করে গোনা যায় এমন স্থির ও কম্পমান তার উচ্চারণভঙ্গিÑ বললেন : আমি তো এখানেই থাকি। আমার ঘর এটা, বলে আমার রুমের পাশের রুমটাই ইঙ্গিত করে দেখালেন। রুমটির দরজার দুই পাশে দুই গাছ টব। বললেন, তার পর থামলেন,
আশ্চর্য, আপনি এত উত্তেজিত কেন হচ্ছেন? পরেই আবার সহাস্যে প্রসঙ্গ পাল্টালেন।
গত পরশু দিনই তো বোধয় রুমে উঠলেন আপনারা?
হ্যাঁ, আমি কৃত্রিম কৈফিয়ত বানাই; এই যাবো যাচ্ছি যাই করে এখনো প্রতিবেশীদের সাথে চেনাচিনি হলো না।
ঠিকই তো, আমি কেন আশ্চর্য হচ্ছিলাম! এই একেবারে স্বাভাবিক উনি জানবেন কী করে যে আজ ভোরেই আমি তাকে কীরকম ধাঁধাময় এক চরিত্রে প্রথম আবিষ্কার করেছি।
সেদিনের অপ্রস্তুত মুখোমুখির অস্বস্তিকর নীরবতা বেশিক্ষণ ঝুলে থাকেনি। তার সাথে খুব স্বচ্ছন্দে সহজ পরিচয় হয়ে গেল।
এই মওলানা সাহেব গ্রামের কোনো এক মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস পাস করেছিলেন। তার পাশাপাশি জেনারেল স্কুল-কলেজ থেকে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দু ভাষা ও সাহিত্য বিষয় নিয়ে পড়বার সুযোগ পেয়েছেন।
বাক্যের মধ্যে যিনি নুন পেঁয়াজের মতো উর্দু ফারসি শের শায়েরি ছিটান।
৩.
তার ঘরে যাই মাঝেমধ্যে। কোনো গড় মানুষ এখানে যে থাকে না, দেখেই অনুমিত হয়। তার রুমে আরো যে দু’জনের সিট বরাদ্দ, তারা বিশেষ পলিটিকাল পার্সন। হলে সিট নিয়ে রেখেছে কিন্তু কোনো দিন এদিকে ফিরে ঢুসও খায়নি। রুমটা আপাতত তার একারই হয়ে আছে।
তার মতো নির্বিবাদী একাকী ধরনের শান্ত মানুষের জন্য এই ভাগ্যের ব্যাপার।
মেয়েদের খবর জানি না, হলের ছেলেদের দরজাগুলোতে ভরতি হয়ে থাকে বিভিন্ন উক্তিতে। অধিকাংশতে হাস্যরসাত্মক। মজার।
দুই দলে ভাগ হয়ে হলের একদল ছেলেরা ক্রিকেট খেলেছে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর গো-হারা হেরেছে, মাঠের বকাবাদ্যি স্লেজিংয়ের ধারা রুম পর্যন্ত এসে পড়েছে। ক্যাপ্টেনের রুমের দরজায় কে যেন কখন সেঁটে গেছে রঙের ওপর আঁচড় কেটে, দাদা হেরে এসেছেন নাকি গিয়ে হারবেন?
এই রফিক লুলা, বাম পায়ে কি বেশি ব্যথা?
এই অমরবাণীটা একবার যে জুড়ল গেটে, এরপর এই দল একশবার জিতলেও এইসব উক্তি থাকবে, দরজা নতুন রঙ করানোর আগ পর্যন্ত। এসবে কেউ তেমন গা করে না।
এই একটা রুমের দরজায় ব্যতিক্রম পেলাম।
কারো সাতেপাঁচে নেই, কোনো কোন্দল নেই, বন্ধুবান্ধব নেই, কোনো প্রকার সক্রিয়তায় তার অংশ নেই, যেন অপরিচিত কেউ সে। গাম্ভীর্য কি একাকিত্বের একটা আড়াল তার সমস্তটা ঘিরে রাখে।
নিজের তৈরি করে নেয়া জগতে এতই বুঁদ থাকেন যে সুফি টাইপ লোক ভেবে তাকে কেউ না ঘাঁটানোই শ্রেয়ভাবে।
ধারাবাহিকতা রেখে এই ঘরে কি সবসময় এই প্রকৃতির লোকেরাই বাস করে গেছে?
পুরা দরজায় পুরান টাটকা রঙ, একটুকু আচড়হীন, পরিষ্কার এখনো।
একেবারে মাঝখানে সাঁটানো আয়তকার একটা কাগজ কি ফেস্টুনে যে কথাটি লেখা, সেটা পড়ে মনে কেমন কুয়াশাজমা ভাব হয়।
৪.
আমি বিজ্ঞান থেকে পড়ে এসে উর্দু ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ নিয়েছি। আমাদের দ্বিতীয় বর্ষ চলছিল। আশ্চর্যের বিষয় না, বিগত বছরে কখনো আমি লোকটিকে ক্লাসে দেখিনি। বা দেখলেও লক্ষ করিনি তেমন। আমিও অবশ্য নিয়মিত ছিলাম না।
গত বছর ইয়ার ফাইনালে মেধা তালিকায় প্রথম যে হয়েছিল, তার নাম দেখেছি কিন্তু চিনতাম না আর চিনেওবা কী কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক হালচালে কে কার খোঁজ করে। নামটিও অদ্ভুত, মীর তকি মীর।
উর্দু সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম কবির নামটি আমার জানা ছিল, সেই নামে নাম? তখন এড়ালেও মনে কৌতূহল বাকি ছিল।
নিজেকে মীর তকি মীর বলে পরিচয় দেয়া সে লোকটিই মওলানামতো দেখতে এই লোক, যার সাথে সদ্যই পরিচয় আমার, আমাদের পাশের ঘরে থাকে, উর্দু কবিতা পড়ে সুর করে।
লোকটির আরেকটি পরিচয় আছেÑ যে ক’জনই বা তাকে চেনে, বলেÑ ওই যে পাখিওয়ালা!
তার ঘরের ভেতরটায় ঢুকলেই মনে হবেÑ এলেম কোনো নতুন দেশে।
রুমের চার পাশের দেয়ালজুড়ে টব। টবে বড় বড় গাছ। দুপুরের কড়া রোদেও কেমন নিবিড় আর হিমহিম হয়ে থাকে ঘরটা। সবুজ সবুজ ঘ্রাণ। ছায়ার রঙ সবুজ। বাতাসে সবুজ।
সবুজ মানেই প্রাণ। সবুজ মানেই সজীব।
মেঝের মাঝখানে চৌকি পাতা। পশ্চিমে, জানালার গ্রিলে একটা খাঁচা ঝোলানো। খাঁচার দরজা হাট করে খোলা।
কখনো ঢুকছে, ইচ্ছে হলে বেরোচ্ছে, একটা পাখি।
ফিনফিনে নীল এক পাখি। ইটকাঠলোহার হল ভবনেরর ভেতরেই বনের মতো দেখতে এই রুম তার সাম্রাজ্য।
হাঁটছে, হালকা চালে উড়ছে, বসছে মাটিতে, সারবাঁধা টবেÑ শ্যামল গাছের গতরে গতরে বেড়াচ্ছে একটা প্রভাময় নীল পাখি।
লোকটা কথা বলে। সারা দিন। সারাক্ষণই। পাখিটার সাথে। আর গাছটার সাথে। আর খাতাটার সাথে। আর কবিতা করে। দাবি করে মীর তকি মীরÑ বাস করে তার আত্মায়। কিংবদন্তি সে কবি।
লোকটা নিজের খাবার খায় না। পাখির খাদ্য খায়। লোকটা কি পাখি হয়ে গ্যাছে?
লোকটা পানি খায় না। গাছের জল খায়। লোকটা কি গাছ হয়ে গেছে?
আমাদের সাথে ভালো মানুষ। দেখা হলে হাসিমুখে বিভিন্ন খোঁজখবর জিজ্ঞাস করেন।
পাখিটার জন্য তার প্রেম আর যতœ বিস্ময়কর ঠেকে আমাদের কাছে।
হলের ক্যান্টিন থেকে বন্দোবস্ত। গালিচার দস্তরে পিতলের থালায় সে খাবার সাজিয়ে পাখিটার সামনে পেশ করেনÑ যেন দেবীকে উৎসর্গ করা হচ্ছে প্রসাদ।
পাখি ছোট্ট ধূসর মাথা ঠুকরে ঠুকরে খায়। খুশিমতো। না খেলে না খেলো। তার পর তিনি হাত ধুয়ে থালাটা নিয়ে বসেন।
কোনো বিষ্ঠা নেই কক্ষে, পাখিটা এত পরিচ্ছন্নতাবোধ পেল কীভাবে?
ঘরে জামবাটির মতো প্রমাণ সাইজের তামার একটা পাত্র। সেখানে জলাধার। পানি রাখা। সে পানিতে পাখি মুখ দেয়। তিনিও পান করেন। গাছের শেকড়ে সে জলই ছিটিয়ে দেন। বড় আশ্চর্য লোক।
৫.
সামার ভ্যাকেশনে বাড়িতে ছুটেছিলাম সাত দিন থাকার ইচ্ছায়। কিন্তু এটা সেটা করে একটা মাস নিমেষে কোথায় গায়েব!
মাসখানেক বিগত হলে পর ফিরে এসে ছাত্রাবাসেÑ আমার রুমের বারান্দায় পা রেখেই শঙ্কিত হলামÑ সব আর আগের মতো নেই। কিছু একটা ঘটেছে। কোথাও কিছু একটা স্বাভাবিক নেই আর। প্রথমেই চোখ গিয়েছিল পাশের অদ্ভুত লোকের রুমটাতেই। তালাবদ্ধ দরজা। ধুলোর পরত জমেছে হাতলে। তার মানে দীর্ঘ সময় কেউ আসেনি বাস করেনি এখানে...
দরজায় ফেস্টুনটা আছে। আগের কবিতার লাইনটা একদাগে কাটা। আর তার পরের লাইনে সাংকেতিক একটা চিহ্ন দিয়ে আরেকটি নতুন কবিতার লাইন লেখা।
‘আব এহাঁ চুপচাপ শাম আ-তি হ্যায়
পেহলি চিড়িয়া কো শোর হোতে থে...
পাখির গান শোনা যেতো কান পাতলে এখানে
এখন যদিও নীরবে সন্ধ্যা নামে’
দীর্ঘশ্বাসের কী দগদগে ঘাÑ বাক্যগুলোর গায়ে।
বন্ধুদের আড্ডায় ফিরে শুনি,
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে নাকি নতুন এক উন্মাদের উপদ্রব শুরু হয়েছে। আর অসুস্থদের মতোই, জটাধারী রুক্ষ চুল জংলি দাড়ি। শত শত মণ ধুলোময়লায় ভারী একটা আলখাল্লা। এ পাগল যে অন্য পাগল, কে বোঝায় কাকে।
হাতে একটা শূন্য পাখির খাঁচা নিয়ে সারা দিন ঘোরে, আর কাউকে পেলেই শোনায় মেরা বুলবুল মর গিয়া মর গিয়া মেরা বুলবুল...
এই পাগল আকাশের দিকে তাকিয়ে উপরে, আরো উপরে দু’হাত ছাড়িয়ে উদাত্ত কণ্ঠে কথা বলে, একা একা পথে দীর্ঘ দীর্ঘ শোকে জর্জর কবিতা বলে।
তার ময়লাটে গাল নাক চোখ ভিজে থাকে আঠালো চোখের জলে।
তার চারপাশে অকর্মা লোকদের কৌতূহলী ভিড় জমে যায়। কেউ মাথা দুলিয়ে বিস্মিত মন্তব্য করে, ব্যাটা শিক্ষিত পাগল।
পোলাপান ঢিল ছোঁড়ে, কেউ খিস্তি মারে বিরক্ত হয়ে,
রহস্যময় পাগলটির রহস্য উন্মোচনে রাস্তার ছেলেরা তার পিছু নেয়। তাদের জানার উপায় নেই এই লোক মীর তকি মীর, যমানা একবারই পায় যারেÑ মেধা তালিকায় প্রথম স্থান ধরে রাখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিদগ্ধ ছাত্র। একটা শিল্পজীবনে যে যাপিত ছিল।
তাদের অনাবাদী মস্তিষ্কের দূরতম কল্পনাতেও নেইÑ পাখি ভালোবেসে এক, উন্মাদ কেউ হতে পারে।
তার পর অকস্মাৎ কোথায় যেনো গায়েব হয়ে গেল লোকটি।
ভোরে এখনো হাঁটতে বেরোই। সেই হোটেলের সামনে ফুটপাতে আর কাউকে দেখে থমকে দাঁড়াই না। ক্ষুধার্ত কুকুরদল এখনো দেখি প্রতিদিন বসে থাকে এখানে। অপেক্ষায় থাকে, যেমন আমি অপেক্ষায় থাকি।
আমি আর ভোরের কুকুরেরা অপেক্ষায় থাকিÑ যন্ত্রমানুষদের এই নেক্রোপলিসে একজন পাগলের শূন্যতা খুব করে অনুভূত হয়।
কিন্তু এই শহরে মীর তকি মীর আর কোনো দিন ফিরে আসেন না। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল