যেমন দেখেছি তাঁকে
- জাকির আবু জাফর
- ১২ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০
চার.
আড্ডার অভিসন্ধি প্রত্যেক কবির বুকে তৃষ্ণার মতো জাগ্রত। সময় জমিয়ে তোলার তুমুল আয়োজন এসব সাহিত্য আড্ডা। প্রবীণ থেকে নবীন সব ধরনের কবি-লেখকের সমন্বয় ঘটে সাহিত্য আড্ডায়। আডডা মানেই পরস্পর অভিজ্ঞতা বিনিময়। কবিদের বহির্জগৎ থেকে অন্দরমহল সব উন্মোচনের আসর এই আড্ডা। কবিদের আড্ডা মানেই প্রাণপ্রবাহের এক বিস্ময় ধারা, যা ঠেলে রাখে কবিতার পক্ষে। আড্ডা একজন কবিকে জ্ঞানের পূর্ণতা দানে সহায়তা দেয়। অতীত থেকে আগামীর সাঁকো নির্মাণের কোনো হেতু পেয়ে যান আড্ডা থেকে।
আড্ডায় আল মাহমুদ ছিলেন প্রাণপ্রবাহের জলের মতো। তরুণেরা গোগ্রাসে গিলত তাঁর জলের ধারা। আড্ডার আনন্দ উদযাপন করার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। তবে লাগামহীন আড্ডার বিরুদ্ধে ছিল তার সোচ্চার উচ্চারণ। বলতেনÑ প্রকৃত আড্ডা কবিতার জন্য জরুরি। কিন্তু অকারণ অর্থহীন আড্ডা কবিতাকে নিঃশেষ করে দেয়। প্রায়ই বলতেন আমাকেÑ শোনো মিয়া, কবিদের লেখার বিষয়ে স্বার্থপর হতে হয়। দীর্ঘ আড্ডায় নিজের সময় খরচ করে ফেলো না। চুপি চুপি বেরিয়ে পড়ো আড্ডা থেকে। বাসায় ফেরো। তারপর বসে পড়ো টেবিলে। নিজের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি রচনার প্রয়াসে আঁচড় কাটো কাগজের বুকে। এভাবে তিনি আড্ডার প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের রেখা টেনেছেন। বলেছেনÑ কিভাবে আড্ডাবাজ হয়েও আড্ডার সময় হন্তারক হাঙ্গর থেকে মুক্ত থাকার কৌশল। কত আড্ডা জমতো এই মহানগরীর বুকে। এখনো বহমান এসব আড্ডার ধারা। বিভিন্ন জায়গায় বসত আড্ডার আসর। এর মধ্যে সব থেকে খ্যাতি পেয়েছি বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডা। যদিও এ আড্ডা এখন কেবলি স্মৃতির রঙিন পটে কেটে যাওয়া আঁচড় মাত্র। ইতিহাসের কোনো বাঁকে জেগে আছে তার স্মৃতির মোহর।
নানা কারণে ‘হারুন এন্টারপ্রাইজ’ কবিদের কাছে বিপুল পরিচিত। যা হারুন ডায়েরি নামেই বেশ খ্যাতি পেয়েছিল। এটি ছিল দৈনিক বাংলার মোড়ে প্রায়। পুরানা পল্টন থেকে দৈনিক বাংলার দিকে যেখানে এখন আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের টাওয়ার। হারুন এন্টারপ্রাইজের একজন ডিরেক্টর ছিলেন কবি ফজল শাহাবুদ্দীন, আমাদের ফজল ভাই। দোতলায় ছিল হারুন এন্টারপ্রাইজের অফিস। এখানে একটি কক্ষে বসতেন কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। ফজল শাহাবুদ্দীনের এই কক্ষটি কবিতার একটি অন্যরকম ইতিহাস। জমজমাট একটি অন্যরকম আড্ডার কেন্দ্র। এটি এমন একটি কক্ষ, যেখানে পঞ্চাশ থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত যারা উল্লেখযোগ্য কবি; এদের প্রায় প্রত্যেকেই এই কক্ষের ছায়ায় ভিজিয়েছেন নিজেকে। বিদেশী অনেক কবির উপস্থিতিও ঘটেছে এখানে। গুন্টার গ্রাস, টেড হিউজ, ফয়েজ আহমদ ফয়েজের মতো কবিরা এসেছেন এখানে। ছোট-বড় আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সব রকমের সাহিত্য আড্ডায় জমে থাকত কক্ষটি। আল মাহমুদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। বন্ধু ছিলেন হারুন এন্টারপ্রাইজের মালিক হারুন রশিদ। কবিদের আড্ডার পোষকতায় এই হারুন রশিদও বাড়িয়েছিলেন দৃঢ় হাত। তার প্রশ্রয়ে কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের কক্ষে কবিদের ছিল স্বাচ্ছন্দ্য আনাগোনা। এখানে প্রায় নিয়মিত আসতেন কবি আল মাহমুদ।
হারুন রশিদের পরিচয়টি খানিকটা স্বচ্ছ করা উচিত। কারণ, তিনি আল মাহমুদ এবং ফজল শাহাবুদ্দীনের সাথে, সেই সাথে সাহিত্য আড্ডার সাথে ভীষণভাবে জড়ানো। হারুন রশিদের দাদা ছিলেন পাকিস্তানি। বাবা চলে যান ইন্ডিয়ায় এবং ইন্ডিয়াতেই বসবাস করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর এরা বাংলাদেশে চলে আসেন সপরিবার। এখানেই ব্যবসা করেন। হারুন রশিদ ছিলেন চলচ্চিত্রের একজন নায়ক। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নির্মিত প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’। এটি উর্দু ভাষায় রচিত। ১৯৬৪ সালে ২৩ এপ্রিল ঈদুল আজহায় সমগ্র পাকিস্তানজুড়ে মুক্তি পায় ছবিটি। এই ছবির পরিচালক ও প্রযোজক ছিলেন জহির রায়হান। এই ছবিরই নায়ক ছিলেন হারুন রশিদ। নায়িকা রোজী সামাদ। শ্রেষ্ঠাংশে খলিলুল্লাহ খান এবং সুমিতা দেবীও ছিলেন অভিনয়ে। সুমিতা দেবীই জহির রায়হানের প্রথম স্ত্রী। যিনি ধর্মান্তরিত হয়ে নীলুফার বেগম নাম নিয়েছিলেন। অবশ্য পর্দায় সুমিতা দেবীই থেকে যান। পরে সুচন্দাকে বিয়ে করলেন জহির রায়হান। সুমিতা দেবী তার দুই সন্তান অনল রায়হান ও বিপুল রায়হানকে নিয়ে আলাদা হয়ে যান জহির রায়হান থেকে। এসব গল্পে জমে উঠত আড্ডা। এসব বেশ উপভোগ করতেন আল মাহমুদ। সঙ্গম ছবির নায়ক হিসেবে বিপুল প্রশংসা কুড়িয়েছেন হারুন রশিদ। এটি ছাড়াও আরো চারটি ছবির নায়ক ছিলেন তিনি। আল মাহমুদ ছিলেন এই হারুন রশিদের ভীষণ পছন্দের কবি। বুড়ো বয়সেও হারুন রশিদের নায়কোচিত বৈশিষ্ট্য-চেহারা আকর্ষণীয়। গায়ের রঙ প্রায় গোলাপি-লাল। সদাপ্রসন্ন একজন মানুষ। কবি এবং কবিতার পক্ষে তার মন ছিল অতিশয় খোলা। কবি ফজল শাহাবুদ্দীন আমাকে পরিচয় করিয়েছেন তার সাথে। তার স্বচ্ছ দু’টি চোখ বেশ মায়াবী। উদার হাসির সেই দৃশ্য মনে এখনো জীবন্ত! আমাকে দেখেই বলেছিলেনÑ এ তো দেখছি নজরুলের ছাও। পরে আল মাহমুদসহ কতবার তার লাল কার্পেট বিছানো এসি কক্ষে ধুঁয়া ওঠা কফি গিলেছি, তার সহরদ নেই।
প্রথমত ফজল শাহাবুদ্দীন ছিলেন কবিদের আকর্ষণের বিন্দু। তার কক্ষটি ছিল যেন একটি চুম্বক। এখানে আসতেই হতো কবিদের। আসতেনই। আসতেন আড্ডার উদ্দেশ্যে। আড্ডায় মজার খাবারের উদ্দেশ্যে। আড্ডা ছাড়াও দুপুর বেলা যে কবিই আসতেন বিরানির প্যাকেট হাজির হতো তার সামনে। ফজল শাহাবুদ্দীনই হাজির করাতেন। পকেট থেকে অকাতর অর্থ বের করে দেয়ার ঔদার্য ফজল ভাইয়ের মতো দেখিনি কাউকে। মাহমুদ ভাই দুপুর বেলা কখনো কখনো বলতেনÑ ফজল আজ বিরানি নয়, ডাল-ভাত খাবো। অথবা আজ বিরানিই খাবো। অথবা আজ মোরগ-পোলাও চাই। ব্যস, এটুকু। তারপর ডাল-ভাতের সাথে মাছ-মাংসের পসরা সেজে উঠত। অথবা বিরানি কিংবা মোরগ-পোলাওয়ের উপস্থিতি ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিত কক্ষের ভেতর। চুক চুক শব্দে বেশ আগ্রহের সাথে খেতেন আল মাহমুদ। খাবার নিয়ে মন্তব্য করতেন দু-একবার। বলতেনÑ ফজল আজ মাছটি বেশ স্বাদ লেগেছে। ডাল খুব মজা হয়েছে। মুড়িঘণ্টটায় লবণ একটু কম। কিন্তু খেতে খারাপ লাগেনি কিংবা মোরগ-পোলাওয়ের ঘ্রাণ আজ অন্যরকম। খাওয়ার পরে দই না হলে জমবে না। এভাবে কখনো কখনো সিগারেটের প্রসঙ্গও বাদ যেত না। বলতেন ফজল আজ বেনসন চাই কিন্তু। সিগারেট খেতেন না ফজল শাহাবুদ্দীন। হারুন সাহেবও না। কিন্তু আল মাহমুদের জন্য মজুদ ছিল বরাবর। ফজল শাহাবুদ্দীনের ওই কক্ষটি চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কবিদের পদচারণায় ছিল মুখর। এ মুখরতায় যারা ছিলেন তাদের অনেকের মুখ আর পৃথিবীর আলো-হাওয়ায় নেই। কিছু নাম স্মরণ করার দায় থাকে। যাদের সাথে দেখা হয়েছে এখানেÑ দেখেছি পরিচয় ঘটেছে এমন কবি-সাহিত্যিক বিরাট সংখ্যক। সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দীন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, জাহিদুল হক, আল মুজাহিদী, অসীম সাহাÑ এসব কবি। এখানে আসতেন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদ ফজল ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ফজল শাহাবুদ্দীনের জন্মদিনে ৪ ফেব্রুয়ারি এসব তারকা কবিদের পাওয়া যেত একসাথে।
ফজল শাহাবুদ্দীনের এসব আড্ডায় যারা প্রায় নিয়মিত ছিলেন তাদের উল্লেখযোগ্য ক’জনÑ কবি ফারুক মাহমুদ, কবি মাহবুব হাসান, কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ, কবি বিমল গুহ, কবি আবদুল হাই শিকদার, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, কবি শাহীন রেজা, কবি নুরুল হক, কবি জামাল উদ্দিন বারী, কবি আমিনুর রহমান টুটুল, কবি শাকিল রিয়াজ, কবি কামরুজ্জামান, কবি মুহম্মদ আবদুল বাতেন, কবি ফাতিমা তামান্না, কবি তৌফিক জহুর প্রমুখ।
এদের মধ্যে কবি শাহীন রেজার ঘনিষ্ঠতা ছিল ফজল ভাইয়ের সাথে সব থেকে বেশি। একই সাথে আল মাহমুদের সাথেও। দু’জনেরই অন্তরঙ্গ ছিলেন শাহীন রেজা। কবি ফজল শাহাবুদ্দীন, শাহীন রেজা এবং আমি তিনজন মিলে বহুদিন গেছি আল মাহমুদের বাসায়। গেছি ফজল ভাইয়ের গাড়িতে চড়ে। কী যে খুশির প্রকাশ ছিল মাহমুদ ভাইয়ের, সে দৃশ্য না দেখলে বোঝার উপায় নেই।
সৈয়দ আলী আহসানকে সবাই সম্বোধন করতেন স্যার বলে। আল মাহমুদ বেশ মধুর স্বরে স্যার শব্দটি উচ্চারণ করতেন। জবাবে সৈয়দ আলী আহসানও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতেন। আল মাহমুদের প্রতি তার স্নেহ ছিল অকাতর। কখনো কখনো তা অতি ভালোবাসার মাত্রায় পৌঁছেছে। আল মাহমুদের কোনো কথা সহসা ফেলতেন না সৈয়দ আলী আহসান। বলতেনÑ আল মাহমুদ বাংলাদেশের গ্রামকে শহরে এনে দিয়েছে। বলতেনÑ গ্রামীণ শব্দকে নাগরিক পোশাক পরিয়ে পুরনো শব্দ নতুন করে তুলেছে আল মাহমুদ। জীবনানন্দ এবং জসীমউদ্দীন থেকে আল মাহমুদ এখানেই আলাদা।
মুগ্ধতায় ভরা দু’টি চোখ তুলে আলী আহসানের মুখের দিকে চেয়ে থাকতেন আল মাহমুদ। যেন তার মনের কথাগুলোই ধ্বনি তুলছে সৈয়দ আলী আহসানের কণ্ঠে।
আল মাহমুদের মুখ দেখে পরিতৃপ্তির সুখ নিতেন তিনিও। আলী আহসান স্যারের বলার ভঙ্গি ছিল অসাধারণ। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে যে বাক্য প্রস্তুত করতেন তার তুলনা ভার। যে বিষয়ে বলতেন সে বিষয়েই বলতেন। যা বলতেন লিখে নিলে ঠিক ঠিক প্রবন্ধ হয়ে যেত। আল মাহমুদ নিয়ে যখন বলতেন, মনে হতো তার শব্দের ভেতর গুঞ্জরিত ধ্বনি যেন আল মাহমুদের কবিতার আত্মা। শব্দতরঙ্গে দুলে উঠতেন আল মাহমুদ। চোখে মুখে খুশির ঝিলিক বিদ্যুৎ চমকের মতো খেলে যেত। এর মানে এই ছিল না যে, আল মাহমুদ কারো স্বীকৃতির অপেক্ষা করতেন। কিন্তু সৈয়দ আলী আহসানের মতামত প্রত্যেক কবির জন্য ছিল অসাধারণ কিছু পাওয়া। এ ক্ষেত্রে আল মাহমুদ অসম্ভব ভাগ্যবান। মাত্র দু’টি কবিতার বইÑ লোক-লোকান্তর কালের কলস, প্রকাশের পর বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হলেন তিনি। তখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ আলী আহসান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একজন আল মাহমুদের ভবিষ্যৎ।
শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন এবং শহীদ কাদরী এ তিনজন ছিলেন আল মাহমুদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শহীদ কাদরী যদিও তুলনায় বয়সে তিনজনের কম, তবুও মানিয়ে গেছে সফলভাবে। এ চারজনের পারস্পরিক এক ধরনের প্রতিযোগিতা ছিল। কে কার বৈশিষ্ট্য উঁচু করবে, নিজের অবস্থান পোক্ত করবে এমন সাধনা ছিল অবিরাম। কোনো নতুন কবিতা রচিত হলেই একজন অপরজনকে শোনানোর উচ্ছ্বাসে অস্থির ছিল। কবিতা লেখা যেমন ছিল নিষ্ঠার। পাঠও ছিল ভীষণ আন্তরিক। শোনার ক্ষেত্রেও সামান্যতম কমতি ছিল না কারো। শুনে প্রশংসার মাল্যদান ছিল অকপট। সমালোচনার তীরও বর্ষাতেন স্বতঃস্ফূর্ততার স্বরে। এমনি ছিল চার কবির কাব্যানন্দের জগৎ। আল মাহমুদ অপেক্ষাকৃত বেশি খুঁতখুঁতে ছিলেন কবিতার শুদ্ধাশুদ্ধির বিষয়ে। মান নিয়ে ছিলেন আপসহীন। কবিতার প্রতি তার দৃঢ়তা, বিশ্বস্ততা এবং যতœ ছিল নিখাঁদ প্রেমের। কবিতার প্রতি হৃদয়ভরা প্রেম আল মাহমুদ টইটম্বুর রেখেছেন আমৃত্যু। হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসেছেন কবিতাÑ কুমারীকে। তাই কবিতাও হয়ে উঠেছিল তার পক্ষের নান্দনিক বিতান। কবিতার ক্ষেত্রে পরস্পরের ঈর্ষা কাজ করত তার উদাহরণ বেশ প্রাচুর্যময়। এই ঈর্ষার তীর আল মাহমুদের দিকে ছিল নিত্য গতিমানÑ এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আল মাহমুদের সব থেকে আলোচিত কাব্য ‘সোনালী কাবিন’। এ বইটি উৎসর্গ ছিল তাঁর এই তিন কবি বন্ধুর নামে। উৎসর্গ পাতায় উজ্জ্বল বাক্য এইÑ শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন এবং শহীদ কাদরী আমাদের কাব্যহিংসা অমর হোক।
কাব্যহিংসার এই স্তুতিবাক্য সত্যিই অমর। সোনালী কাবিনের পৃষ্ঠায় এ তিনটি নাম যথার্থতার অনুষঙ্গে অমর। অমর তাদের পারস্পরিক কাব্যহিংসার মূল্যবান স্মৃতির গহন। সাহিত্য পাড়ায় এসব আলোচনা ছিল বেশ মুখরোচক। সমসাময়িক তো বটেই, পরে এবং আজো এসব আলোচনার সমাপ্তি নেই; বরং ডালপালা ছড়িয়ে সাহিত্যাঙ্গনে কাব্যিক বৃক্ষ হয়ে উঠেছে এসব ঘটনা-রটনার বৃত্তান্ত।
যে সাহিত্য আড্ডায় হাজির আল মাহমুদ তার ভার বেশ ওজনদারÑ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন দু-চারটি আড্ডায় যেসব তরুণ নিজেকে হাজির করতে পেরেছে, বদলে গেছে তাদের স্বপ্নের জগৎ। বদল হয়েছে কবিতা ও কবিতা বিষয়ক ভাবনার দিক। আল মাহমুদ আড্ডায় খুব বেশি কথা বলতেন না। অন্যের কবিতা-কথা শোনার ব্যাপারে মনোযোগ ছিল অসাধারণ। কান পেতে শুনতেন কবিতার প্রতিটি শব্দের ধ্বনি। যা বলার বলেই নিতেন অকপটে। খুঁত ধরার প্রয়াস কখনো নেননি তিনি, বরং কবিতার নান্দনিক অভাব এবং পরিপাটির অসামঞ্জস্য দেখিয়ে দিতেন তেজস্বিতার সাথে। এ ক্ষেত্রে কাউকে খাতির করার সুযোগ গ্রহণ করেননি। কথা বলতেন না কারো মুখ চেয়ে। নিজের কবিতার বিষয়ে ছিলেন আরো কঠোর। একটি কবিতা লেখা হওয়ার পর শতবার পাঠ করার প্রাণশক্তি ছিল তাঁর। পড়তেন আর এডিট করতেন। এডিটের পর আবার পড়তেন। একদিন ফজল ভাইয়ের অফিসে। দুপুর বেলা। চারজন আমরা আল মাহমুদ, কবি আলাউদ্দীন আল আজাদ, ফজল শাহাবুদ্দীন এবং আমি লাঞ্চ শেষ করেই মাহমুদ ভাই বললেনÑ ফজল একটি কবিতা শোনাই?
স্বভাবগত খানিকটা অঙ্গভঙ্গি করে ফজল ভাই বললেনÑ শোনান। কবিতা শুনতেই তো কান থাকে খাড়া। আল মাহমুদ কবিতা শোনাবে এত আনন্দেরÑ বলে নড়েচড়ে বসলেন আলাউদ্দীন আল আজাদ।
কবিতা পড়ছেন আল মাহমুদ। সিরিয়াস ভঙ্গি তার। চোখে মুখে এক ধরনের উত্তেজনা। শব্দ উচ্চারণে যতœবান এবং অর্থের দিকে বিশেষ নজর।
ফজল ভাই হঠাৎ বললেনÑ আরে আল মাহমুদ কবিতা পড়তে আপনি সিরিয়াস হয়ে যান কেন?
কবিতা পড়তে গেলেই আমি সিরিয়াস হয়ে যাইÑ খুব সরলভাবে জবাব দিলেন আল মাহমুদ।
আলাউদ্দীন আল আজাদ বললেনÑ আরে ফজল পড়তে দিন তো। এটি আল মাহমুদের নতুন রূপ তো নয়। কবিতার ব্যাপারে আল মাহমুদ সব সময় সিরিয়াস।
আবার পাঠ শুরু হলো আল মাহমুদের। পড়ছেন কবিতা। পড়তে পড়তে যেন হারিয়ে গেলেন কোথাও। কবিতার ভেতর এভাবে হারিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কি থাকে সব কবির!
কবিতা পাঠ শেষ করে যেন ফিরে এলেন অন্য কোনো জগৎ থেকে। আল মাহমুদের কণ্ঠ আবৃত্তিকারদের মতো এত ভরাট ছিল না। কিন্তু পাঠের একটি নিজস্ব ঢং ছিল। সেই ঢং শ্রোতাকে আবিষ্ট করে রাখতো। কণ্ঠের সাথে যখন অন্তর যোগ হয়ে উচ্চারিত হতো ধ্বনি তা মরমে পৌঁছে যেত। পাঠে এক ধরনের মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল কক্ষটিতে।
আকস্মিক ফজল ভাই বললেনÑ এ কবিতাটি তো গতকালও শুনিয়েছেন। হেসে মাহমুদ ভাই বললেনÑ হ্যাঁ শুনিয়েছি বটে। কিন্তু আজ দু’টি শব্দ পরিবর্তন করে দিয়েছি। তাই আবার শোনালামÑ বলে চেয়ে থাকলেন ফজল ভাইয়ের মুখের দিকে।
ফজল ভাই এবার খানিকটা সিরিয়াস। একটু দম নিয়ে বললেনÑ এ জন্যই আপনি একজন কবি আল মাহমুদ। হ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা