২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সাহিত্য সাধক মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল

-

সাতাশে মার্চ নিদ্রা ভঙ্গের পরই শুনতে হলো আমার প্রিয় বন্ধু আউয়াল আর জীবিত নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। দুই সপ্তাহ আগে দেখতে গিয়েছিলাম নারিন্দায় আলী আসগর হাসপাতালে, দেখা হয়নি। লাইফ সাপোর্টে রয়েছে। প্রায় এক মাস এভাবে থেকে ইন্তেকাল করল বাংলাভাষা সাহিত্যের শেষ সেরা অধ্যাপকদের একজন, প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল। আমার সাথে ওর পঁয়ষট্টি বছরের সম্পর্কÑ আমরা একই সঙ্গে ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হইÑ আরো সহপাঠী ছিলেন অথচ এখন আর নেই (সাংবাদিক) আহমেদুর রহমান, জহির রায়হান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শওকত আলী এবং আরো অনেকে। এখন অবধি আমি মমতাজউদ্দীন আহমদ, কায়কোবাদ আর আবদুল গাফফার চৌধুরী প্রমুখ। কিন্তু আউয়াল অনার্সে যেমন, তেমনি মাস্টার্সেও প্রথম স্থান অধিকার করেছিলÑ ১৯৫৭ এবং ৫৮তে। তখন কেউ ফার্স্ট ক্লাস পায়নি।
১৯৫৮ সালে এমএ পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাপারে আমার একটা অভিজ্ঞতা রয়েছে, যা অন্য কারো হয়তো নেই। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে দুপুরের খাবার খেয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে আমি বিকেল ৪টার দিকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দফতরের উদ্দেশে রওনা হই। দেখি, আমাদের রেজাল্ট টাঙানো হয়েছে। আমি একটা কাগজে আমাদের এমএ ফাইনালের পরীক্ষার্থী সবার নামক্রম অনুসারে লিখে নেই। প্রথম মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল, দ্বিতীয় হরলাল রায় এবং তৃতীয় মাহমুদ শাহ কোরেশী।... খুশি ওয়ার বদলে আমি একটু অসন্তুষ্ট হই। কারণ হরলাল হচ্ছে পাস কোর্সের ছাত্র, দ্বিতীয়ত আগের বছর সে রেডিওর জন্য একটি নাটক চুরি করে প্রথম পুরস্কার পায় এবং সেটা একটা কেলেঙ্কারিরূপে চিহ্নিত হয় বিভাগে। যা হোক, আমি হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাই। মেডিক্যাল কলেজের গেটের কাছে পৌঁছুলে দেখি অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল হাই আসছেন সাইকেলে চড়ে। আমার কাছে এসে তিনি সাইকেল থেকে নামলেন এবং বললেন, ‘কংগ্র্যাচুলেশন্স কোরেশী, তুমি তো খুব ভালো করে ফেল্লে হে...?’ আমি কিছু না বলে তার কদমবুচি করলাম। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটে ঢুকে দেখলাম, আমাদের শিক্ষক আহমদ শরীফ সাহেব বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে। আমি এগিয়ে তাঁকে সালাম করলাম। তিনিও একই সুরে আমাকে অভিনন্দন জানালেন। আমি একটু রাগত কণ্ঠে বললাম, ‘কী আর ভালো রেজাল্ট করেছি স্যার, যেখানে হরলাল সেকেন্ড হয়েছে।’ শরীফ স্যার বললেন, ‘নাহে জানো, আউয়াল ফার্স্ট ক্লাস থেকে মাত্র তিন নম্বর কম পেয়েছে, হরলাল তার থেকে ১ নম্বর কম আর তুমি হরলাল থেকে ১ নম্বর কম পেয়েছ। তাহলে বোঝ, তুমি কত ভালো করেছ!’ আমি কথা না বাড়িয়ে মধুর ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ালাম। হাই স্যারের ওপর আমার রাগটা আরো বেড়ে গেল। কেননা তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্র হরলালকে আমার থেকে ১ নম্বর বেশি দিয়েছেন এতে আমি নিশ্চিত। ভাইভা, টিউটরিয়াল ইত্যাদিতে এ কাজ সহজ। তবে স্যারের ওপর রাগটা ছুড়ে ফেলে ১৯৬৮ সালে দেশে ফিরে তাঁর আসন্ন বিলাত গমনের কারণে তাঁর জন্য লন্ডন আমার ছোট ভাই আহমদ শাহ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও আলাউদ্দিন আল আজাদকে দিলাম যাতে তারা স্যারকে রিসিভ করে উপযুক্তভাবে দেখভাল করে।
যা হোক, সেই ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ অবধি আউয়ালের সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ থাকল না, যদিও কায়কোবাদ, আশফাক প্রমুখ সহপাঠীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হলো। চিঠিপত্র লেখালেখি হলো। শুনলাম ষাটের দশকের কোনো একসময়ে সরকারি চাকরি ছেড়ে আউয়াল স্বখরচায় বিলাত গেল ডক্টরেট করতে। আমি ১৯৫৯ সালে ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে প্যারিসে গেলাম। আবু হেনা ’৬৫ কি ’৬৬তে বৃত্তি নিয়ে লন্ডনে গেল এবং ওর সঙ্গে সেখানে দেখা হলো। পরে শুনেছি, আউয়ালের স্ত্রী, আমাদের সালেহা ভাবী চাকরি করে তাদের বিলাতের খরচ অনেকটা যোগাতেন। ১৯৬৮ সালে প্যারিস থেকে আমি দেশে ফিরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলাম। এবং আবার আউয়ালকে পেলাম সেখানে। সে সময় থেকে আমাদের বন্ধুত্ব আরো গভীরতা অর্জন করল। চট্টগ্রামে বাংলা বিভাগ প্রধান প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান ইতঃপূর্বেই ড. আউয়াল ছাড়া মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, বেগম রিজিয়া, রণধীর বড়–য়া, মনিরুজ্জামান (হাই স্যারের জামাতা), হায়াত মামুদ, মোহাম্মদ আবু জাফরকে বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। আমার কিছু পরে এলেন ড. আনিসুজ্জামান রিডার রূপে। আউয়াল আর আমি একই সাথে রিডার হলাম ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। আউয়ালের লন্ডনের ডক্টরেট ডিমারটেশান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হলোÑ মীর মশাররফ হোসেনের গদ্য রচনার ওপর। পরে তার বাংলা অনুবাদ বের হলো বাংলা একাডেমি থেকে।
এখানে একটা কথা বলা হয়নি। শান্তশিষ্ট এবং অসম্ভব ধৈর্যশীল আউয়াল আমার অন্তত তিন বছরের বড়। শুনেছি ও কিছু দিন মেডিক্যালে পড়েছিল। ভালো না লাগাতে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে ভর্তি হল। সে সময়ে সে ফজলুল হক হলের সহকারী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। তারই সুপারিশে এমএ ফাইনালের ছাত্র মাযহারুল ইসলাম হল ম্যাগাজিনের সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৪-৫৫ সালে মাযহারুল ইসলাম আমাদের শিক্ষকরূপে কর্মরত থাকেন। সে সময় থেকে আমৃত্যু তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। কিন্তু আউয়ালকে তিনি বন্ধুরূপে মান্য করতেন এবং ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকাকালে তিনি আমাদের দু’জনকে পরিচালকরূপে ঢাকায় আনতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমরা দু’জনই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হওয়াটাকে বেশি গুরুত্ব দিলাম। প্রফেসর হওয়ার জন্য আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে একই সঙ্গে রাজশাহী রওনা দিলাম ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসের গোড়ার দিকে। আমরা দু’জনই রাজশাহীতে খুব সুন্দর সফল কর্মজীবন কাটিয়ে নব্বই দশকে অবসর গ্রহণ করলাম। প্রফেসর আউয়ালের অসংখ্য ছাত্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে। অনেকে স্বনামধন্য। আউয়ালের স্ত্রী সালেহা খাতুন পাবনার এক বিজ্ঞানী পরিবারের কন্যা। তিনি গণিত শাস্ত্রে মাস্টার্স। ডিন হিসেবে সৈয়দ আলী আহসান তাঁকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সামী, সুমী নামে তার দুই ছেলেমেয়েকে যথার্থ তদারক ও প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য তিনি কোনো চাকরি গ্রহণ করেননি। সূচিশিল্প ও রন্ধন কাজেও তিনি সুনিপুণা। তাঁদের ছেলে ড. সামী আউয়াল আমেরিকায় অতি উচ্চপর্যায়ের প্রকৌশল-বিজ্ঞানীরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত। কন্যা ডা: সুমী আউয়াল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসর এবং বিশেষজ্ঞ সার্জন।
অল্প বয়স থেকে মোহাম্মদ আবদুল আউয়ালের ছিল লেখালেখির হাত। তার কয়েকটি গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস রয়েছে। ‘সমুদ্রে শিশিরে’, ‘কালান্তরের সোপান’, ‘মায়াবতী মতিহার’ প্রভৃতি উপন্যাস বেশ উপভোগ্য। তবে কয়েকটি মূল্যবান ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক গ্রন্থ অধ্যাপক আউয়ালের বিশেষ কীর্তি। এক সময় আমরা দু’জন পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের জন্য একটি গবেষণা প্রকল্পও তৈরি করেছিলাম বলে মনে পড়ে।
সুদীর্ঘকাল এক সঙ্গে কাটিয়ে আমরা গভীর আন্তরিকতায় এক সুসংস্কৃত জীবন অতিবাহিত করতে পেরেছি এটা মহান আল্লাহর বিশেষ রহমত বলতে হবে। তাই সাহিত্যের সাধনায় অগ্রজ প্রতিম বন্ধুটির জন্য রইল আমার অন্তহীন ভালোবাসা। হ


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র তাপদাহে খাবার স্যালাইন ও শরবত বিতরণ করল একতা বন্ধু উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গলাচিপায় পানিতে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু উপজেলা নির্বাচনে অনিয়ম হলে কঠোর হস্তে দমন করা হবে : ইসি শিশু সন্তান অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি, সৎ বাবাসহ গ্রেফতার ২ উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুবককে কুপিয়ে হত্যা রা‌তে বৃ‌ষ্টি, দিনে সূর্যের চোখ রাঙানি শিশুদের হাইড্রেটেড-নিরাপদ রাখতে বাড়তি সতর্ক হওয়ার আহ্বান ইউনিসেফের অর্থ আত্মসাৎ: সাইমেক্স লেদারের এমডি ও তার স্ত্রী কারাগারে ফেসবুকে সখ্যতা গড়ে অপহরণ, কলেজছাত্রীসহ গ্রেফতার ৫ ৫ ঘণ্টা হবে এসএসসি পরীক্ষা, ৫০ শতাংশ লিখিত চকরিয়ায় নিখোঁজের ছয় ঘণ্টা পর ২ যুবকের লাশ উদ্ধার

সকল