২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কাঠের বেঞ্চ

-

পঁঁঁঁয়ত্রিশ বছর চাকরি এক বছর পিআরএল খুব দ্রুতই শেষ হলো। কেমন করে এতটা দ্রুত শেষ হলো, বিশ্বাসই করতে পারছে না গোলাম রসুল। মনে হলো এই তো সে দিন বিকেলে গাঁয়ের মাঠে ফুটবল খেলছিল, বাড়ি থেকে খবর এলোÑ ডাকপিয়ন একটা চিঠি নিয়ে এসেছে, তার জন্য অপেক্ষা করছে। অবেলায় ডাকপিয়ন (!) কিছুটা বিস্ময় কাজ করল তার ভেতরে। বিস্ময় নিয়েই চলে এলো খেলার মাঝামাঝি সময়ে। ডাকপিয়নের মুখোমুখি হতেই তার বিস্ময় বেড়ে গেলÑ পরিচিত ডাকপিয়ন মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে সবার সাথে কথা বলছে। তাকে দেখে হাসির উচ্চতা বেড়ে গেল। বলল, ‘ছোট ভাই আজক্যা মিষ্টির টাকা না লইয়া যামু না’।
তা আপনাকে মিষ্টির টাকা দিতে হবে কেন? আমার জন্য কি আকাশের চাঁদ ধরে এনেছেন?
‘তার চাইতেও বেশি ছোট ভাই। আজক্যা যে চিঠিটা লইয়া আইছি, তা কোনো সাধারণ চিঠি না!’
আপনি তো প্রতিবারই এমন কথা বলেন। অসাধারণ কোনো চিঠি তো দিতে পারলেন না।
‘আজকারটা অসাধারণÑ অনেক ওজন, খুইলা দেখেন।’
গোলাম রসুল দেখল, সেই পুরনো ঢঙের খাম, অফিসিয়াল সিলমোহর দেয়া। হবে হয়তো কেনো ইন্টারভিউ কাডÑ ভাবল সে।
‘ছোট ভাই আগে খুলেন, তারপর কউন সাধারণ না অসাধারণ।’
গোলাম রসুল চিঠি খুলে তার ওপর চোখ রাখতেই ভেতরটা হেসে ওঠে। হয়তো চোখও হেসে উঠেছিল, তাই তো ডাকপিয়ন আরো উচ্চকণ্ঠ হলোÑ ‘কইছিলাম না, এইড্যা অসাধারণ চিঠি। ৩০ বছর ধইরা চিঠি বিলি করি। তাই হাতে লইয়াই বুঝতে পারি কোনটার ওজন বেশি কোনটার কম।’ মা বলে ‘গ্যাদা খবর কী, নিয়োগপত্র না ইন্টারভিউ কার্ড।’
মা প্রথমটা, বলেই মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করল গোলাম রসুল। মা জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করল। দৌড়ে ভেতরে প্রবেশ করে দ্রুতই ফিরে এলো। তার হাতে নতুন একটা ১০০ টাকার নোট। ডাকপিয়নের হাতে দিয়ে বলল, বাড়ির সবার জন্য মিষ্টি নিয়ে যেও।
ঠিক ৩৬ বছর পর আজকে নীল রঙের একটা পেনশন বই হাতে দাঁড়িয়ে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের কাঠের বেঞ্চের সামনে।
গত ৩৫ বছরে সে এই কাঠের বেঞ্চ অনেক দেখেছে। আজকের দেখার সাথে অনেক পার্থক্য গোলাম রসুল বুঝতে পারে।
এসেই তার প্রথম চোখ পড়ে বারান্দায় থাকা কয়েকটা কাঠের বেঞ্চের ওপর। বেঞ্চে বসা অনেকে। কেউ স্যুট পরা, কেউ বা শার্টপ্যান্ট পরা। কারো পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। তবে বেশির ভাগই শ্মশ্রুমণ্ডিত টুপি পরা। সবাই তার মতো অবসরপ্রাপ্তÑ বুঝতে পারে। সবাইকে দেখেÑ একজনও তার পরিচিত নয়। এ অফিসটা তার বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে হলেও কাউকে চিনতে পারে না সে। অবশ্য চেনার কথা নয়। প্রতিবেশীদের অনেকেই তার অচেনা। কারণ স্বাভাবিকÑ ৩৫ বছর কাটিয়েছে নিজ বাড়ির বাইরে, নিজ জেলার বাইরে। শেষবেলা তো কেটেছে দেশের একেবারে উত্তর প্রান্তে। যে প্রান্তে অন্যমনষ্কতায় দু’কদম ফেলা মাত্রই দৌড়ে আসবে প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। গুলিও চালাতে পারে!
৩৫ বছরের হিসাব তার কাছে চরম বিস্ময়েরÑ টগবগে যুবক ঘর থেকে বের হয়েছিল, আর ঘরে ফিরেছে প্রায় বৃদ্ধাবস্থায়।
পেনশনের যে কক্ষে বই জমা দিতে হয়, সেখানে প্রচণ্ড ভিড়। এই ভিড় ঠেলে বই জমা দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাকে অপেক্ষা করতে হবে। কাঠের বেঞ্চে ঠাঁই নেই অবস্থাÑ বসবে কোথায় বুঝতে পারে না। কাঠের বেঞ্চে বসা সবাই প্রচুর হাসাহাসি করছে। কারো দু’আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। তর্জনীতে চুন, মুখে পান। সিগারেটের ধোঁয়া বা জর্দার কড়া গন্ধ কারো ওপর প্রভাব পড়ছে, কেউ বিরক্ত হচ্ছে, তার এমনটা মনে হলো না।
গোলাম রসুল সিদ্ধান্ত নেয় সামনের চায়ের দোকানগুলোর একটায় বসে সে অপেক্ষা করবে। ভিড় কিছুটা হালকা হলে ফিরে আসবে। অফিসের বারান্দা থেকে নেমে আসে গোলাম রসুল। বেশ ক’টা চায়ের দোকান। দীর্ঘ কাঠের বেঞ্চ এখানেও। নানা রকম মানুষ বেঞ্চে বসা। ওপাশেই কোর্ট ভবন।
এখানকার বেশির ভাগ মানুষ কোর্টের উদ্দেশে এখানে এসেছে, আশপাশের কথাবার্তায় এমনি মনে হলো তার। বেশ কিছুটা সময় সে দাঁড়িয়ে থাকল। কাঠের বেঞ্চে অতীতে এক মিনিটের জন্য সে বসেছিল কি না ভাবতে থাকে। পেছনে ফেলে আসা দীর্ঘ অতীতে একবারো এমন ঘটনা ঘটেনি সে নিশ্চিত হয়। অথচ আজ একটা কাঠের বেঞ্চে বসার জন্য সে দাঁড়িয়ে...!
অতীতের গোলাম রসুলের সাথে আজকের গোলাম রসুলের অনেক পার্থক্য। এই পার্থক্য বাড়তেই থাকবে। ভালো ফুটবলার, ব্যাডমিন্টনে সেরা, ক্রিকেটেও মন্দ ছিল না। গল্প-কবিতায় হাত একেবারে কাঁচাÑ এমন কথা কেউ বলেনি। মধ্যমানের সরকারি কর্মকর্তা। সব মিলিয়ে মন্দ ছিল না অতীত।
সে সময়টায় এই মানুষগুলোর সাথে মন খোলে কথা বলা হয়নি। অথচ ইচ্ছে যে হয়নি তা নয়। পরিবেশ তা হতে দেয়নি। ভেতরে বলে ওঠে সবই ব্রিটিশের তৈরি। তারা চলে গেছে। তাদের দেশে এই আমলা পদ্ধতি কোথাও নেই। আমরাই কেবল তা অতি যতনে ধরে রেখেছি, সাধারণ মানুষকে করেছি পর। এখন অমন হবে না ভেবেই গোলাম রসুলের ভেতরে একটা প্রশান্তি কাজ করতে থাকে। কাঠের বেঞ্চের এক পাশ শূন্য হলো। গোলাম রসুল সেখানে বসে চায়ের কথা বলল দোকানদারকে।
কি চা-রঙ চা না দুধ চা?
কৌটার দুধ না গাভীর দুধ?
আমাকে রঙ চা দিন।
সিঙ্গারা, সমুচা, পুরি দেবো সাথে।
না ভাই শুধুই চা দিন। পাশে বসা একজন বলল, ভাইসাব ডালপুরি একটা খাইতে পারেন। সামাদ মিয়ার পুরির সুনাম আছে।
আপনি বলছেন?
হ্যাঁ, একবার খাইয়া দেখতে পারেন।
ঠিক আছে ভাই দুটো ডালপুরি দেন। পাশেরজনকে বলল, তা ভাই আপনি কোথা থেকে এসেছেন?
আমি দেলদুয়ার থেকে এসেছি। আমার নাম মোহাম্মদ মুখলেস।
তা এখানে আসার হেতু জানতে পারি?
পেনশন তুলতে এসেছি।
তা কোন ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেছেন।
পুলিশে ছিলাম।
আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না আপনি রিটায়ার্ড একজন। আপনার শরীর তো এখনো অনেক ভালো।
কেন ভালো থাকব না? রিটায়ার্ড করার পর সারাদিন জমিতে কাজ করি। এখনো দুই কামলার কাজ একা করি। শরীরে মেদ জমতে দেই না। বয়স বাড়বে কেমনে?
দুটো ডালপুরি সামনে রাখে সামাদ মিয়া। গোলাম রসুল বলল, মুখলেস সাহেব একটা আপনি খান।
না না, আমি খেয়েছি। আপনি খান।
আপনার জন্যই তো আমার খাওয়া। আমার তো খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না।
তা আপনি এখানে কেন?
আমিও আপনার মতো রিটায়ার্ড একজন। প্রথম এসেছি। হিসাবরক্ষণ অফিসে বেশ ভিড়। সে কারণে এখানে বসা।
এই ভিড় শেষ হবে দুপুরের পর। তবে মাসের শেষ সপ্তাহে ভিড় কিছুটা কম থাকে।
এ বিষয়টা আমার জানা ছিল না। এরপর আপনার কথামতো মাসের শেষ সপ্তাহেই আসব।
তা কোন ডিপার্টমেন্টে ছিলেন।
আমি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোতে ছিলাম। রিটায়ার্ড করেছি ঠাকুরগাঁও থেকে। পেনশন ট্রান্সফার করিয়েছি এখানে। আকুরটাকুরপাড়া বাড়ি।
খুব ভালো করেছেন। আকুরটাকুরপাড়া তো মাত্রই পাঁচ মিনিটের হাঁটার পথ।
হ্যাঁ তাই।
এখন তো বেশির ভাগ কর্মকর্তা পেনশন নেয় না। এককালীন টাকা নিয়ে যায়। পেনশনের ঝামেলা কেউ বইতে চায় না।
আমার ভাবনা আলাদা। প্রতি মাসে একবার তো মনে হবে, চাকরিতে ছিলাম।
আমার কথাটাই আপনি বলছেন। আমারও চিন্তাভাবনা আপনার মতোই। কোনো থানায় চাকরি করিনি। সারা জীবনই ছিলাম ওই এসপি অফিসে। এখানে এসে চা খাই আর নিজের অফিসটা দেখি। এই দেখায় অনেক সুখ, বুকটা ভইরা যায়। তো স্যার যাই। বাইচা থাকলে আগামী মাসে দেখা হবে।
আপনি অবশ্যই বেঁচে থাকবেন এবং আবার দেখা হবে।
হিসাবরক্ষণ অফিসের দিকে তাকায় গোলাম রসুল। ভিড় কিছুটা কমেছে। চায়ের দাম পরিশোধ করে উঠল।
একটা বেঞ্চের একপাশটা খালি। একজন বলল, এখানে বসতে পারেন।
ধন্যবাদ বলে বসল গোলাম রসুল। একে একে সবার সাথে পরিচয় হলো। বেশ ক’জন তার সমমানের হলেও বেশির ভাগই নয়। এই পার্থক্যটা একেবারেই কাজ করছে না। সবাই হাসি তামাশায় মত্ত। যেন জীবনের সব সুখ এই কাঠের বেঞ্চে। কারো ভেতরে কোনো হতাশা আছে, দুঃখ-বেদনা আছে, এমনটা তার মনে হলো না। ভালো লাগল তার।
বিদায়ী কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে সবাই কাঠের বেঞ্চ ত্যাগ করতে থাকল।
এ মুহূর্তে কাঠের বেঞ্চ একদম ফাঁকা। নিবিড় দৃষ্টিতে দু’পাশে হাতলওয়ালা কাঠের বেঞ্চগুলো দেখতে থাকল। পরম মমতায় কাঠের বেঞ্চগুলো সবাইকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। গোলাম রসুলের মনে হতে থাকল, এই কাঠের বেঞ্চ আর ঈদের জামাত, একই সুতোয় বাধাÑ এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। মনের দূরত্ব নেইÑ সবটাই ভালোবাসায় মাখানো। হ


আরো সংবাদ



premium cement
ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মিজানুরের ইন্তেকাল থাইল্যান্ডের রাজা-রাণীর সাথেপ্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ গ্যাস বিতরণে সিস্টেম লস ২২ শতাংশ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে : নসরুল হামিদ গণকবরে প্রিয়জনদের খোঁজ কক্সবাজারে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, স্বজনদের হাসপাতাল ঘেরাও বঙ্গোপসাগরে ১২ নাবিকসহ কার্গো জাহাজডুবি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশকে ‘নেট সিকিউরিটি প্রোভাইডার’ হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি রাজশাহীতে টানা তাপদাহ থেকে বাঁচতে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন মুসল্লিরা শরীয়তপুরে তৃষ্ণার্ত মানুষের মাঝে পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ জামায়াতের এক শ্রেণিতে ৫৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী নয় : শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী

সকল