২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্মৃতির সোনালি শিখা যেমন দেখেছি তাকে

-

কবিকে প্রথম দেখেছি স্বপ্নযোগে। অবিশ্বাস্য হলেও বিষয়টি তেমনি। স্বপ্নটা দেখেছি বেশ ছোটবেলায়। মুখোমুখি সাক্ষাৎ ঘটার বেশ ক’বছর আগের কথা। তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র আমি। থাকি ফেনী জেলার সোনাগাজী। আমাদের বাড়িটি ছিল একেবারেই চরাঞ্চলের গ্রাম। পরে অবশ্য নদী খেয়ে ফেলে গ্রামটি। যেখানে নদী এবং নদীর জোয়ার ছিল অসম্ভব সুলভ। বর্ষায় প্লাবিত হতো সারা মাঠঘাট। বৃষ্টি আর বাঁধনহারা রোদ ছিল ভীষণ অবারিত। নানারকম বৃক্ষশোভিত ছায়াঘেরা গ্রামে পাখির কূজন ছিল মনভরানো। আকাশের কথা কী আর বলিÑ একদম অখণ্ড। সীমাহীন নীলের উদ্ভাস। কী বসন্ত! কী বর্ষা! কী হেমন্ত! হেমন্তের আকাশ ছিল গাঢ় নীলের বিছানা। উত্তর থেকে দক্ষিণ অথবা পূর্ব থেকে পশ্চিম যতদূর যায় দৃষ্টির উজান সর্বত্র শুধু নীলের ছড়াছড়ি। যেন আকাশ নিজেকে ছড়িয়ে দিত আকাশে আকাশে। শুধু বর্ষা ও শীত ঋতুতে খানিকটা ব্যতিক্রম! বর্ষায় মেঘের চাদরে ঢাকা আকাশ। শীতে কুয়াশার সাদা পাগড়ি যেন মুড়িয়ে রাখত শূন্যতা। মাঝে মাঝে সূর্যের মুখ দেখা যেত কিছুক্ষণের জন্য। বাদবাকি সবসময় একটি বিশাল কুয়াশার ডিম যেন আকাশের বুকে থাকত শূন্যতাজুড়ে। প্রকৃতির এসব লীলাময় ক্রিয়ার গভীর রহস্য কিভাবে যেন ছোটবেলাই আমার বুকের ভেতর ডানা ছড়িয়ে মনকে উড়ন্ত করে তুলেছে। উড়ন্ত মনকে আরো ওম দিয়েছে আল মাহমুদের কবিতা। তাঁর কিশোর কবিতা, ছড়া খুব করে পড়ছি তখন। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালেই কবিতা লেখার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছি। বসন্তকালের এক দুপুরেরই ঘটনা। আমাদের পুকুর পাড়ে একটি শিরিষ গাছ। নতুন পাতা জড়িয়ে ছড়িয়ে ছিল আশ্চর্যভাবে। দুপুরবেলার রোদ কচি সবুজ পাতায় রুপালি দোল খাচ্ছিল। এমন দৃশ্য দেখেই ইচ্ছের আগুন জ্বলে উঠল মনের ভেতর। ঘর থেকে খাতা আর কলম নিয়ে উঠে গেলাম গাছটিতে। ডালে বসেই লিখলাম দু’চার লাইন। তখনো গাছটির বিভিন্ন ডালে শালিক পাখির ওড়াউড়ি। এডাল থেকে ওডাল লাফিয়ে ছোটা। মাঝে মাঝে বুলবুলির আনাগোনা কী যে নান্দনিক। আমি নীরব! ভীষণ নীরবে খাতার বুকে মনের তাৎক্ষণিক অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের যন্ত্রণায় কাতর। আমার আশপাশ দিয়েও উড়ে যাচ্ছিল শালিক আর বুলবুলি। হয়তো আমাকে তাদের পক্ষে অনিরাপদ ভাবেনি। খানিক দূরে ঘুঘুর কণ্ঠও থেকে থেকে বেজে যাচ্ছিল। বসন্তের কোকিল তার মধুর কণ্ঠের সুর দুপুরজুড়ে এক অভাবনীয় আমেজ ছড়িয়ে দিলো। এর ভেতর আমার কবিতা নামের জগাখিচুড়ি কিছু লেখার কসরত। লিখলাম। কী লিখলাম আজ আর মনে নেই।
কিন্তু লেখার পর আমার ভেতর অন্যরকম একটি গোপন আনন্দ বিস্ময়করভাবে গোটা হৃদয়কে ভরিয়ে দিলো। সেই সাথে অদ্ভুত ধরনের স্বপ্ন ফিলমের দৃশ্যের মতো মনের পর্দায় যাওয়া আসার খেলা শুরু করল। ঠিক তখনই একটি কবিতা আমার স্মৃতি তুলে ধরল মনের কাছে। কবিতাটি মুখস্থ করেছি আরো আগে। বিশেষ করে কবিতার দুটো লাইন পরিবেশের সাথে এতটা খাপ খেলো বলাই বাহুল্যÑ ‘আমার কেবল ইচ্ছে জাগে নদীর ধারে থাকতে/বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে পাখির মতো ডাকতে।’ কবিতার শুরুটা এমনÑ আম্মা বলেন পড়রে সোনা আব্বা বলেন মন দে/পাঠে আমার মন বসে না কাঁঠালচাঁপার গন্ধে। কার কবিতা এটি বলার অপেক্ষা রাখে না। আল মাহমুদ এভাবে আমার ভেতর বাসা বেঁধেছিলেন। বকুল ডালের পরিবর্তে শিরিষ ডালে বসেছিলাম আমি। সেদিন থেকে বৃক্ষ ফুল পাখি নদী আকাশ আমার আত্মার আত্মীয় হয়ে গেল। রোদ বৃষ্টি কুয়াশা হয়ে গেল আমার ঘনিষ্ঠ ভাবনার বিষয়। সেই সাথে নির্জনতার প্রতি জেগে উঠল তুমুল পক্ষপাত।
পূর্ণিমা রাতে জোছনায় ভেসে যেত আমাদের গ্রাম। রাত কিছুটা বয়সী হলেই আমি ঘরের দরোজা খুলে চুপে চুপে উঠানে এসে দাঁড়াতাম। আকাশ ভরা জোছনার দুধসাদা বিস্তার। নীরব প্রকৃতির সমস্ত সীমানাজুড়ে শুয়ে থাকত পৃথিবীর প্রাচীন জোছনা। বিশাল আকাশে একাকী চাঁদ। মুগ্ধতার জমানো আবেগে চাঁদের দিকে চেয়ে থাকার আনন্দই আলাদা। এমন সময় মনে পড়েÑ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে কর্ণফুলীর কূলটায়/দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি ফেরেশতারা উল্টায়। কিংবাÑ নারকোলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল/ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠাণ্ডা ও গোল গাল।/ ছিটকিনিটা আস্তে খুলে পেরিয়ে গেলাম ঘর/ঝিমধরা ঐ মস্ত শহর কাঁপছিলো থরথর/ মিনারটাকে দেখতে লাগে দাঁড়িয়ে আছেন কেউ/পাথরঘাটার গির্জাটা কী লালপাথরের ঢেউ!
মনটি উতলা হবে না কার! এভাবে আল মাহমুদ বুকের ভতর গেঁথে গেল। মনের কাছে এক অন্যরকম নামÑ আল মাহমুদ।
এমনি জোছনাজ্বলা এক রাত্রির কথা। ৭ম শ্রেণীর ছাত্র তখন। উঠানে চাঁদের মুখী হয়ে চেয়ে আছি একা। দেখতে দেখতে রাত বেশ গভীর হয়ে উঠল। সময়ের দিকে খেয়াল ছিল না মোটেই। মধ্যরাত পেরিয়ে প্রায়। উঠানের পাশে মেহেদির ঝোপে আলো আঁধারির এক বিস্ময় রহস্য। এর ভেতর জোনাকির কিলবিল জ্বলা নেভার খেলা। ঠিক এ সময় মনে পড়লো আল মাহমুদের কবিতাÑ পাহাড়টাকে হাত বুলিয়ে লালদীঘিটার পার/এগিয়ে দেখি জোনাকিদের বসেছে দরবার। আমায় দেখে কলকলিয়ে দীঘির কালো জল/বললো এসো আমরা সবাই না ঘুমানোর দল।
দেখছি এসব। এর ভেতর একটি বাদুর অকস্মাৎ তার বিশাল ডানার ঝাপানি দিলো আমাকে। ভীষণ ভয়ে কেঁপে উঠল সারা শরীর। ভয়ের এক শীতল স্রোত আমার গোটা দেহে ছড়িয়ে পড়ল। দ্রুত ফিরে গেলাম ঘরে। চুপে শুয়ে গেলাম জায়গা মতো। বুক হাঁপরের মতো ধড়পড় ওঠানামা করছে। একসময় রাতের নিয়মে চোখ জুড়ে নেমে এলো ঘুম। এ ঘুমেই স্বপ্নে হাজির হলেন আল মাহমুদ।
ক্লিন সেভ করা সে সময়ের আল মাহমুদকেই দেখলাম। দেখলাম কিছুটা চেনা কিছুটা অচেনা মতো জায়গায় একটি হিজল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে। ডান হাতে ধরা একটি বই বুকের সাথে লাগানো। আমাকে ডাকলেন ইশারায়। কাছে যেতেই দেখলাম সোনালী কাবিন ধরে রেখেছেন বুকের সাথে। হাত খুলে আমাকে বইটি তুলে দিয়ে বললেনÑ নাও পড়ো বইটি।
আমার ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। স্বপ্নের ঘোরে আমি আচ্ছন্ন। আমার হাতে বইয়ের আমেজ লেগে আছে তখনো। বাকি রাত কেটে গেল অঘুমো। মনের ভেতর বইতে থাকে স্বপ্নের দৃশ্য। এই স্বপ্নটাও আমাকে কবিতার প্রতি বিস্ময়ভাবে কাতর করে তুলেছিল।
খুব ছোটবেলা থেকেই কবিতা মুখস্থ করা শুরু করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমদ, কুসুম কুমারী দাশ, বেগম সুফিয়া কামাল, জোতিন্দ্র মোহন বাগচী, কৃষ্ণকুমার মজুমদার, সুকুমার রায়Ñ এমন অনেক কবির কবিতা কণ্ঠস্থ করেছি। কবিতা সুর করে পড়ার এক ধরনের নেশা ছিল। সেই নেশা থেকেই বোধহয় কবিতাপ্রেম চিরজীবনের জন্য মনের গহিনে গেড়েছে বাসর।
স্বপ্নে দেখার পর আল মাহমুদ হয়ে গেলেন আমার প্রতিদিনের ভাবনা। পত্রিকার সাহিত্য পাতা, মাসিক ম্যাগাজিন, কোনো সাপ্তাহিক অথবা সাহিত্য সঙ্কলনে আল মাহমুদ নাম আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছে। এভাবে অদেখা আল মাহমুদ আমার কৈশোরিক কল্পনার এক বিশাল অংশ জুড়ে জেগে রইলেন। কিশোর মনে দাগ কাটার কাব্যিক ছোরা শানিত করলেন আল মাহমুদ। একদিন কবিতার দাবি নিয়ে আল মাহমুদের সামনে দাঁড়াব এমন কল্পনা সত্যিই কঠিন ছিল তখন। এমন কঠিন বিষয়টি অবাক করা সত্যে পরিণত হবে কে জানত। শুধু কবিতার দাবি নয়Ñ তাঁর সাথে সম্পর্ক এমন শেকলে জড়াল যা ছিল আত্মীয়তার ঊর্ধ্বের কোনো বন্ধন। যাকে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব বলেও সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। সত্যিকারার্থে তিনি যেমন ছিলেন একান্ত নিবিড় বন্ধুর মতো। তেমনি ছিলেন বাবার মতো। তবে সব কিছু ছাপিয়ে আমাদের সম্পর্কটা দাঁড়িয়েছিল কবিতার অবিনশ্বর সৌন্দর্যের মতো। ফলে আমাদের আলোচনার বিষয় হতো জীবন-জগৎ ও জগত রহস্যের যাবতীয় ঘেরাটোপ।
[চলবে]


আরো সংবাদ



premium cement