২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বিড়ম্বনা

-

গাড়ি করে ধানমন্ডির আট নম্বর ব্রিজ পার হওয়ার সময় লেকের ধারে কিছু উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে বসে থাকতে দেখে মিসেস অনামিকা চৌধুরীর মনে হলো, আজকাল প্রেম করা কত সহজ হয়ে গেছে। ডিজিটাল যুগ এখন। সবকিছু হাতের মুঠোয়, অথচ তাঁদের সময় প্রতিটি কাজের জন্য মা-বাবার কাছে জবাবদিহি করতে হতো। মনে পড়ে গেল তার জীবনের প্রথম প্রেমপত্র, অজানা এক নীল খামের চিঠির কথা। অনামিকা চৌধুরী কয়েক বছর পেছনে চলে গেল, এখনো ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে। ঘটনাটি ছিল এইরকম...
১৯৮১ সালের এক বিকেলে আকাশটা এমন থমথমে হয়ে আছে মনে হচ্ছে কারো সাথে রাগ করে আছে। হয়তো একটু পর রেগে কেঁদেই ফেলবে, তখন হয়তো অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হবে পৃথিবীর বুকে। অনামিকার মনটাও আজ আকাশের মতোই থমথমে হয়ে আছে। অজানা এক নীল খামের চিঠি অনামিকার এই মন খারাপের কারণ। ভালোই তো চলছিল ওর জীবনের ঘড়িটা। সমবয়সী চাচাতো ভাই আর ওর বন্ধুদের সাথে মাঠেঘাটে, জঙ্গলে ঘুরেফিরে, সেই সাথে মার্বেল, ক্রিকেট, ফুটবল, ডাঙ্গুলি, ঘুড়ি উড়ানো, কত রকমের খেলা করে। এমনকি নিজের বাসার পেয়ারা, বড়ই সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে খেয়ে, জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে জংলি ফুলের মধু পান করে, সেই সাথে ফড়িংয়ের লেজে সুতো বেঁধে উড়িয়ে খেলা করে ভালোই তো ছিল। অনেক সময় বর্ষাকালে বাড়ির উঠানে পানি জমলে সেই পানিতে কাগজের নৌকা বানিয়ে ছেড়েছে, এভাবেই মজার মজার খেলা করে অনামিকার দিনগুলো চলছিল। হয়তো কারো কুনজরে সেই মজার দিন আর বেশি দিন রইল না। অনামিকা কখনোই ভাবেনি, ও ওর চাচাতো ভাইদের চেয়ে আলাদা। কিন্তু এক নিমিষেই একটি নীল খামের চিঠি ওর জীবনের বাঁকটাকে ঘুরিয়ে দিলো এবং ওর ধারণা পাল্টিয়ে দিলো। চিঠিটি বুঝিয়ে দিলো ও ওর ভাইদের থেকে আলাদা এক সত্তা। কারণ ও মেয়ে আর ওরা ছেলে। ওরা যা করতে পারে, ও তা করতে পারে না। একসময় ওর উড়ন্ত ডানা দু’টি কেটে ফেলতে হলো সমাজের ভয়ে। ফিরে আসতে হলো ওই বিশাল আকাশের প্রান্তর ছেড়ে পাখির পিঞ্জরের মতো ঘরের এক কোণায়। একটি চিঠি ওকে বেঁধে ফেলল ঘরের চৌকাঠে আর দুরন্ত বাঘিনী ঘরে ফিরে হয়ে গেল মেনিবিড়াল। একদম চুপচাপ আর ঝিম মেরে গেল অনামিকা।
একদিন বিকেলে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে বাড়ির কাছেই মাঠে খেলতে গিয়েছিল চাচাতো ভাইদের সাথে। খেলা শেষ করে ঘরে পা রাখতেই মায়ের হুঙ্কার। অনামিকা, এদিকে আয়। অনামিকা মায়ের কাছে গেলে, মা কোনো ভণিতা না করেই সরাসরি অনামিকাকে প্রশ্ন করলেন, তুই কি কোনো ছেলেকে আমাদের বাসার ঠিকানা দিয়েছিস? অনামিকা মায়ের প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়ল। অনামিকা বলল মা, আমার জানামতে আমি কাউকে ঠিকানা দেইনি। মা বললেন, ঠিকানা যদি না দিস তবে এই ছেলে কি করে তোর নামে আমাদের ঠিকানায় চিঠি পাঠাল? অনামিকা মায়ের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। বলল, মা তুমি এসব কি বলছ? কোন ছেলে আমাকে চিঠি পাঠিয়েছে? বিশ্বাস করো মা, আমি কিছু জানি না। মা, নীল একটি খাম অনামিকার হাতে ধরিয়ে দিলেন। মা, চিঠিটি খুলেনি কারণ অনামিকাদের বাসার নিয়ম, কেউ কারো চিঠিপত্র কাউকে না জিজ্ঞেস করে খোলে না। অনামিকা নিজের ঘরে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটি খুলে পড়ল। চিঠির মধ্যে গোলাপের পাপড়ি দেয়া যার ফলে চিঠিটি খোলা মাত্রই ঝুরঝুর করে পাপড়িগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল আর একটা মিষ্টি সুবাস ঘরের মধ্যে ভরে গেল। অনামিকে চিঠিতে কি লেখা আছে তা পড়ল। চিঠিতে লেখা আছেÑ
‘হাই আমি মারুফ। আমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। তুমি হয়তো ভাবছ আমি তোমার ঠিকানা কোথায় পেলাম আর তোমাকে আমি কেন তুমি তুমি করে বলছি। এবার পয়েন্টে আসি, আমি তোমার ঠিকানা কাগজওয়ালার ঝুড়িতে (মানে ফেরিওয়ালা) একটি বই থেকে পেয়েছি, তবে বইটি অষ্টম শ্রেণীর একটি মেয়ের নাম, তার রোল, স্কুলের নাম লেখা ছিল। যেহেতু সে নতুন ক্লাসে উঠেছে তাই অষ্টম শ্রেণীর বইগুলো বিক্রি করে দিয়েছে আর আমি ভাগ্যক্রমে তোমার ঠিকানা পেয়ে গেলাম। হয়তো মেয়েটি তোমার বান্ধবী হতে পারে। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, আমি কেন তোমাকে তুমি বলছি? কারণ তুমি আমার চেয়ে ছোট। যাই হোক, তোমার নামটি এত সুন্দর, ‘অনামিকা’ তাই তোমাকে না দেখেই বুঝতে পারছি তুমি অনেক সুন্দর। সে জন্য প্রথমেই তোমার নামটির প্রেমে পড়ে গেছি। তাই সাহস নিয়ে তোমাকে চিঠি লিখেই ফেললাম। আশা করি তুমি আমাকে নিরাশ করবে না। আপাতত আমি আমার এক বন্ধুর ঠিকানা দিলাম। এই ঠিকানায় চিঠি দিও। আমি তোমার চিঠির অপেক্ষায় থাকব। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমার ওই বন্ধুকে কিছুই বলিনি। আমি তোমার অনামিকায় আংটি পরাতে চাই। তুমি চিঠি পাঠালেই আমি বুঝব, তুমি আমার সাথে সম্পর্ক করতে রাজি আছ, তা নাহলে আমি তোমাকে আর বিরক্ত করবো না। প্লিজ, কিছু একটা লিখে পাঠাও, আমার খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে দেখতে। অনেক অনেক ভালোবাসা তোমার জন্য।
ইতি, তোমারই মারুফ।’
অনামিকা পুরো চিঠি পড়ে কেঁদে ফেলল। অনামিকার মা, অনামিকার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ওর ঘরে এসে দেখলেন ও কাঁদছে। মা ওর কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখা মাত্রই অনামিকা তখন মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। মা বুঝলেন, অনামিকা কিছুই জানে না। মা চিঠিটি নিয়ে পড়ে দেখলেন ছেলেটি যে ঠিকানা দিয়েছে তা অনামিকার নানার বাড়ির কাছেই। মা অনামিকাকে বললেন, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, হাতমুখ ধুয়ে নাশতা খেয়ে পড়তে বস। আমি চিঠিটি নিয়ে গেলাম। তুই এগুলো মাথা থেকে একদম ঝেড়ে ফেল। অনামিকার কিছুই ভালো লাগছে না। অনামিকার মনে হলো ও হঠাৎ করেই অনেক বড় হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করল সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে, কিন্তু বারবার চিঠিটি ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। রাতে অনামিকার মামা ওদের বাসায় এলো। অনামিকা ওর মামাকে সব কথা বলে তাই কেঁদেকেটে ছেলেটির চিঠির কথা জানাল আর অনামিকার মা নিজেও তার ভাইকে বললেন, দেখ তো কি সাংঘাতিক ব্যাপার! চেনে না জানে না আর চিঠি পাঠিয়ে দিলো! ছেলেটির সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। একটু খোঁজ নিয়ে দেখিস তো, ছেলেটি নিজের ঠিকানা দেয়নি তবে এক বন্ধুর ঠিকানা দিয়েছে; তা আমাদের বাড়ির কাছে। অনামিকার মামা বললেন, বুবু, মাথা ঠাণ্ডা করো, এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করলে বরং হিতে বিপরীত হবে, তার চেয়ে পাত্তা না দিলে এখানেই ব্যাপারটা থেমে যাবে। তা ছাড়া অনামিকা এখন বড় হচ্ছে এরকম অনেক চিঠি আর ফোনকল আসবে। এসব পাত্তা দিলে বরং অশান্তি বাড়বে। এখন তো পত্রমিতালির যুগ, তাই পত্র দিয়ে বিরক্ত তো করবেই, তার চেয়ে সব কিছু স্বাভাবিকভাবে নিলেই হয়। আর মামা অনামিকাকে বললেন, এখন থেকে রাস্তাঘাটে খেলাধুলা করা যাবে না, বাসায় মায়ের কাজে সাহায্য করবে এবং অবসরে গল্পের বই পড়বে, সেলাই করবে তবে পড়াশোনার ক্ষতি করে নয়। বড় হচ্ছ তা বুঝতে হবে, অনামিকার মামার সাথে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল বটে, কিন্তু মনে মনে রাগ হলো, কী এমন বয়স হয়েছে যে, ও সবার সাথে খেলতে পারবে না। চিঠিটাই সব কিছুর জন্য দায়ী। মামা রাতে ডিনার করে চলে গেলে সবাই যার যার রুমে ঘুমাতে গেল, কিন্তু অনামিকার চোখে ঘুম এলো না। নিজেকে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দেখল, ও কি আসলেই অনেক বড় হয়ে গেছে! এ কথা ভেবে নিজেই লজ্জা পেল। সেদিন সারা রাত শুধু চিঠির কথা মনে হলো, সেই সাথে ছেলেটির কথা। যদিও ও ছেলেটির কিছুই জানে না, যতটুকু চিঠিতে লেখা ছিল সেটুকু ছাড়া। ছেলেটির হাতের লেখা খুব সুন্দর, মনে হচ্ছিল চিঠিটি আবার পড়তে পারলে ভালো হতো, কিন্তু তা সম্ভব নয়। চিঠিটা মায়ের কাছে। জীবনের প্রথম ভালোবাসার চিঠি পেয়ে অনামিকার কেমন যেন একটা কষ্ট কষ্ট অনুভূতি হচ্ছে বুকের ভেতর। ছেলেটিকে চেনে না জানে না তবুও কেন ছেলেটির একটি ছায়া ওর চোখের সামনে এসে ধরা দিচ্ছে, এ কেমন ভালোবাসার বিড়ম্বনা!
সেই অনামিকা এখন মিসেস চৌধুরী এবং দুই সন্তানের মা। তবুও অজানা-অচেনা একজনের ছায়া মাঝে মধ্যেই স্বপ্নে এসে দেখা দিয়ে চলে যায়, বাস্তবে যাকে দেখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। হ


আরো সংবাদ



premium cement