১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

লেখকের বেঁচে থাকা না থাকা ও মৃত্যুর বিষাদ

-

লেখক হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি মানসপটে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ঝলকে শিল্পিত ও নন্দিত উপায়ে মানুষকে উপহার দেন শব্দের বুননের এক নির্মল বিনোদন। উপহার দেন পরিবর্তনের আহ্বান। হতে পারেন তিনি একজন কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক কিংবা সমালোচকও হতে পারেন। এমনকি তিনি একজন আঁকিয়েও হতে পারেন। কেননা তিনি তার ক্যানভাসে লিখেন সহস্র শব্দের অবগুণ্ঠন। সবাই যেহেতু লেখেন সেহেতু সবাই লেখক গোষ্ঠীভুক্ত।
লেখকরা যেহেতু মানুষ। আর মানুষ মাত্রই মরণশীল। তাহলে একজন লেখক তো মরেই যাবেন। সেখানে বেঁচে থাকার প্রসঙ্গ আসে কী করে? প্রকৃত বিষয় হলো মানুষ শারীরিকভাবে মরে গেলেও কৃতী দিয়ে বেঁচে থাকেন পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে। আর একজন লেখক যেহেতু লেখালেখি করেন, সেহেতু সেটা তার কৃতী। সে হিসেবে তিনি বেঁচে থাকতে পারেন। তবে সেই লেখালেখিটা কেমন হবে তা জানা আবশ্যক। নইলে বস্তা বস্তা লেখা লিখলাম, কিন্তু তারপরও কালের গহ্বরে পড়ে থাকতে হতে পারে। তবে কী লাভ এই লেখার ছড়াছড়িতে। যদি না লেখাটা হয় এক অমর কীর্তি। আর যা একজন লেখককে দেবে অমরত্বের সুধা।
আমরা যারা অক্ষরজ্ঞান এবং চোখ, কান খোলা রেখে চলি, তারা অনেক লেখককেই জানি। এরকম লেখকদের তালিকা যদি করি তাহলে হোমার (হেরোডোটাসের মতে ৮৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ বিদ্যমান ছিলেন), সক্রেটিস (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭০-খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯), ভার্জিল (৭০ খ্রিষ্টপূর্ব-১৯ খ্রিষ্টপূর্ব), ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১৩১), শেখ সাদি (১২০১-১২৯২), হাফিজ শিরাজি (আনুমানিক চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ-১৩৮৯), উইলিয়াম শেক্সপিয়র (১৫৬৪-১৬১৬), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), স্যার মুহাম্মদ ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮), আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), পাবলো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩) প্রমুখদের মতো হাতেগোনা কিছু লেখককে পাই বা স্মৃতি সাড়া দেয়। তাহলে প্রশ্ন হলো, সেই আদিকাল থেকে আজ অবধি কী আর কোনো লেখক লেখেননি? আর যদি লিখেই থাকেন তবে তাদের নাম ইতিহাসে সেরকম অনুজ্জ্বল কেন? কেন তাদের খুঁজতে প্রয়োজন হাজার পাওয়ারের হ্যালোজিন বাতি? সচরাচর আমাদের আড্ডা, সভা-সেমিনার ইত্যাদিতে উচ্চারিত হয় না কেন সেই মহাজনদের নাম? নিশ্চয়ই কোনো প্রচ্ছন্ন কারণ আছে। আসুন সেই কারণ অনুসন্ধান করি!
সেই সৃষ্টিলগ্ন থেকে বর্তমান সময়ের বেশির ভাগ লেখকদের দৈন্যতা বলেন, মূর্খতা বলেন আর ক্ষীণদৃষ্টি বলেন, সব মিলিয়ে তারা উদ্দেশ্যহীন, অকেজো, মূল্যহীন, উচ্ছন্নে যাওয়ার উপাদান লিখে যাচ্ছেন অবিরত। তারা বুঝেনই না তাদের সাহিত্যের উদ্দেশ্য কী? কী বোঝাতে চাচ্ছেন তারা? কেনই বা মানুষ পড়বে তাদের লেখা? কোনো আদর্শ বা ইজমকে তারা প্রতিনিধিত্ব করতে চাচ্ছেন? সে আদর্শ বা ইজম কতটাই বা স্থায়ী, যৌক্তিক, মানবমুখী, গণমুখী, কল্যাণময় ও শান্তিময়? দেশ, জাতি, মানবতার জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না বরং হানাহানি, মারামারি ইত্যাদিতে সয়লাব হবে দেশ এমন রাজনৈতিক আদর্শ, ইজম বা মতাদর্শকে প্রতিনিধিত্ব করে লিখে চলেছেন অনেক জ্ঞানপাপী লেখক।
উপরে উল্লিখিত লেখকদের বেশির ভাগই কোনো না কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ছিলেন একেকজন সেই আদর্শের মুখপাত্র। তাহলে তারা কী করে বেঁচে থাকলেন আজ অবধি? কেননা, তারা যে আদর্শ বা ইজমগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করতে চেয়েছিলেন খুব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে সেই ইজমগুলোর ব্যাপ্তি ও কার্যকারিতা তারা জানতেন এবং নিজেদের ভেতর ধারণ করতেন। তারা জানতেন সেই ইজম বা আদর্শগুলোর সর্বজনীনতা। সেই আদর্শ বা মতাদর্শ কোনো কূপমণ্ডুকতাকে প্রশ্রয় দেয় না। সবাইকে ভালোবাসতে ও সমান অধিকার দিতে শেখায় এবং তাদের বলার বা প্রকাশভঙ্গি ছিল নান্দনিক, শিল্পিত, মনোহরি, আকর্ষণীয় ও গ্রহণীয়। ফলে তাদের দ্বারা উপস্থাপিত ইজম বা আদর্শ মানুষকে প্রভাবিত করেছিল। মানুষ সানন্দে গ্রহণ করেছিল। তারা সব ধর্ম বা আদর্শের লোকের কাছে ছিলেন গ্রহণীয় ও অনুকরণীয়।
শেখ সাদি বলেন, খৈয়াম বলেন কিংবা হাফিজ শিরাজি বলেন, তারা যেমন ছিলেন দার্শনিক; তেমনি ধারণ করতেন আধ্যাত্মিকতা। তাদের মূল সুর ছিল ইশকে ইলাহি। সহজেই অনুমেয় যে তারা আধ্যাত্মিকতার প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাদের লেখনিতে। কিন্তু কেন সারা বিশ্বের মানুষ আজকে তাদের লেখা পড়েন? কারণ ওই একটাই আধ্যাত্মিকতার যে ভাব তার প্রকাশভঙ্গি এতটাই নান্দনিক যে, দলমত নির্বিশেষে সবাই তা গ্রহণ করেছে। সেই লেখার মাধ্যমে অন্যরাও স্রষ্টার আরাধনা দিতে পারেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) সকালবেলা হাফিজের গজল পড়তেন আর নাচতেন। আল্লামা ইকবালও একজন দার্শনিক কবি, রাজনীতিক। তিনিও তার লেখনিতে মানবিক সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। একসময় জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ও সুকান্ত ভট্টাচার্যকে (১৯২৬-১৯৪৭) এড়িয়ে চলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেছিল অনেকে। কিন্তু কালের আবর্তনে সে এড়িয়ে চলা শক্তি লুপ্ত। পক্ষান্তরে জীবনানন্দ ও সুকান্তরা আজ কতটা দীপ্তিময়! মুহাম্মদ ইকবালও গোটা বিশ্বে সমাদৃত। আর যারা তাকে (ইকবাল) এড়িয়ে চলছেন, তারাও একদিন লুপ্ত হবেন। নিক্ষিপ্ত হবেন আস্তাকুঁড়ে।
পাবলো নেরুদাকে বলা হয় গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবি। তার কবিতার যে শব্দচয়ন, চিত্রকল্প, মোচড় তা সত্যিই বিস্ময়কর। তিনি তার কবিতায় মানুষ, মানবতা, প্রেম ইত্যাদিকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তিনি কমিউনিজমের ঘোর সমর্থক। কমিউনিস্ট রাজনীতির এক বিশাল নেতা ছিলেন। তিনিও জানতেন তার ইজম বা মতাদর্শ কতটা ব্যাপ্তিযোগ্য ও সর্বজনীন। এরকম যদি নাম নিয়ে আলোচনায় আনি, তবে যাদের নাম আলোচনার তালিকায় স্থান পেয়ে জ্বলজ্বল করবে। তাদের প্রায় সবারই একটি শক্তিশালী ইজম বা মতাদর্শ ছিল। সাম্যবাদী ধারণার বাহক ছিলেন বেশির ভাগ। শক্তিশালী ইজম বা মতাদর্শকে ধারণ ও লালন করতে না পারার কারণে উপযুক্ত লেখকরা ছাড়া অন্য লেখকরা হারিয়ে গেছেন কালের স্রোতে। মৃত্যু হয়েছে তাদের লেখকসত্তারও আত্মা বিদেহী হওয়ার সাথে সাথেই।
লেখকদের মৃত্যুবরণ করার যৌক্তিক কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সময়কে ধারণ না করা। সামসাময়িক সময়ের সব থেকে স্পর্শকাতর বিষয়গুলো কী কী? তা না জানা ও তার সমাধান কল্পে এমন সাহিত্য রচনা না করা যা হবে কালোত্তীর্ণ। পশ্চিমা প্রভুদের করায়ত্ত (শিল্প-সাহিত্যের ওপর আগ্রাসন) থেকে বেরিয়ে আসতে না পারা। আমরা আমাদের সাহিত্যে নিজেদের ধারণ করব। জাতিসত্তার মূল সঙ্কট উৎরাতে দেবো পথনির্দেশনা। ধার করেছিলাম উপন্যাস, ছোটগল্প ইত্যাদির ধারা। তাতে আমাদের সাহিত্য কতটুকু এগিয়েছে। আমরা কী পারি না নতুন কোনো টেন্ট বা ধারা চালু করতে যা দেখে শিল্প-সাহিত্যের দুনিয়া বিস্ময়ে অভিভূত হবে। কিন্তু না, ফেসবুকের কল্যাণে সময়গুলোকে অযথা ব্যয় করে হচ্ছি আত্মভোলা। বাংলা ভাষা আর সাহিত্যকে আর আমরা পারছি না বিশ্ব দরবারে মর্যাদার কোনো আসনে আসীন করতে।
সেই ১৯১৩ সাল। আমাদের এই বাংলা ভাষার সাহিত্য পেয়েছিল নোবেল। কী গৌরবান্বিত এক কাল ও অধ্যায় ছিল! ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যারা প্রাণ দিলো, তাদের সেই মর্যাদাবান ভাষার কী করুণ অবস্থা! কী শোচনীয় অবস্থা তার সাহিত্যের! অথচ ১৯১৩ সালের পর আর কোনো বাংলা গ্রন্থ হয়নি নোবেলের তালিকাভুক্ত। তা হলে এই ১০৬ বছরে বাংলা ভাষা কোন ধরনের লেখকদের জন্ম দিয়েছে। নাকি বাংলার সন্তানেরা সুস্থ অবস্থায় জন্ম নিয়ে পশ্চিমদিকের মধুর স্বাদ আস্বাদন করতে গিয়ে হয়েছে বিকলাঙ্গ। যার ফলে উচ্চলম্ফন প্রতিযোগিতায় লাফ দেয়ার আগেই শারীরিক অপ্রকৃতস্থার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। আরো হাজারো বছরে নোবেল তো দূরের কথা, ম্যানবুকারের তালিকায়ও অন্তর্ভুক্তি পাবে না যদি লেখকরা নিজেদেরকে না আবিষ্কার করতে পারেন। নিজেদের ব্যক্তিত্ববোধ না জাগ্রত করতে পারেন।
মহামারি ও ভয়ানক আকারে যে কুসংস্কৃতি এখন সাহিত্যাঙ্গন ও লেখকদের কলুষিত করছে এবং ধ্বংসের দোরগোড়ায় পৌঁছিয়ে দিচ্ছে তা হলো, তোষামোদির মাধ্যম হিসেবে সাহিত্যকে ব্যবহার করা। অমুক সংখ্যা, তমুক সংখ্যা করার মাধ্যমে সাহিত্যকে কতটা নিচে নামিয়েছে তা শুধু স্রোতের বিপরীতে চলা বোদ্ধারাই বোঝেন। নিজে একটি নামমাত্র সংগঠন দাঁড় করিয়ে সেখান থেকে কয়েকজনকে পদক দিয়ে তাদের ঋণী করে একাই ডজনখানেক পদক লেনদেন করেন। আর ফেসবুক তো আছে সেই বেহায়াপনা কাজকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। সস্তায় কেনা কোনো ক্রেস্ট বা পদক গ্রহণের সময় লেখকের নোবেলজয়ী অভিব্যক্তি। আর যারা সেই মহামূল্যবান (!) ক্রেস্ট বা পদক তুলে দিচ্ছেন তাদের ভঙ্গিও যেন সাহিত্যকে তারা বিশাল এক উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। আর একজন উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন (!) লেখককে মূল্যায়ন করতে পেরে তারা প্রকৃতই ধন্য। যেই পদক গ্রহণের ছবি পোস্ট করে লিখেনÑ “আমার ‘জরিনার ছ্যাকা’ গ্রন্থের জন্য ‘মদন-বলদ স্বর্ণপদক’ পেলাম।” আর ওমনি শুরু তেলমারা মন্তব্য। আর যিনি অতি চালাক গর্দভ পদকে ভূষিত হম্বিতম্বি লেখক, তিনি তো নিজেকে ভাবা শুরু করেন বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে। একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে। এভাবেই তৈরি হয় আধমরা কিছু লেখক। তারা সাহিত্যে কী আর অবদান রেখে কীর্তিমান হবেন।
এভাবে লেখক নিজেকে নিজেই নিঃশেষ করার আয়োজন সম্পন্ন করেন। মৃত্যুর পরও লেখককে বেঁচে থাকতে হলে তাকে সৎ ও সততার সাথে লিখে যেতে হবে। দাঁড়াতে হবে নিজের লেখনী শক্তির ওপর। এবং অপেক্ষা করতে হবে সাফল্যের। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement