হ্যান ক্যাং ও ‘দ্যা হোয়াইট বুক’
- বাপ্পা আজিজুল
- ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০
হ্যান ক্যাং দক্ষিণ কোরীয় কবি, লেখিকা ও ঔপন্যাসিক। লিখিয়ে পরিবারের সন্তান। বাবা ‘হ্যান সিউং অন’ একজন ঔপন্যাসিক। সহোদর ‘হ্যান ডং রিম’ও একজন গুণী লেখক। ২৭ নভেম্বর ১৯৭০-এ গোয়াংজু শহরে জন্ম। ১০ বছর বয়সে পরিবারের সাথে সিউলে থিতু হন। কোরীয় সাহিত্য নিয়ে পড়েছেন ‘ইয়োনসেই’ ইউনিভার্সিটিতে। এখন ‘সৃজনশীল সাহিত্য’ বিষয়ে অধ্যাপনা করছেন সিউল ইনস্টিটিউট অব আর্টসে। শৈশব থেকে লেখালেখির হাতেখড়ি হলেও প্রথম কবিতা প্রকাশ ১৯৯৫ সালে সিউলের জনপ্রিয় ত্রৈমাসিক ‘সাহিত্য ও সমাজ’ পত্রিকার শীত সংখ্যায়। পরের বছর ছোটগল্প ‘দ্যা স্কারলেট অ্যানকর’ ‘দৈনিক সিউল শিনমান’ সাহিত্য প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার জিতলে তিনি সবার নজর কাড়েন। প্রথম গল্পসঙ্কলন ‘অ্যা লাভ অব ইয়েশু’ (১৯৯৫) লিখে জিতে নেন ‘হ্যানকুক সেরা লিখিয়ে পুরস্কার’। এরপর শুধু বই প্রকাশ আর পদক পাওয়ার পুনরাবৃত্তি। ছয়টি উপন্যাস, গল্পসঙ্কলন, প্রবন্ধ ও কবিতা মিলিয়ে প্রকাশিত বই একডজন। দেশী-বিদেশী পুরস্কারও জুটেছে ভূরি ভূরি। ২০০৭ সালে তার প্রকাশিত উপন্যাস ‘দ্যা ভেজেটেরিয়ান’ একটি মাস্টারপিস। বইটি অনুবাদ করেন কানাডীয় লেখিকা ‘ডেবোরাহ স্মিথ’। ২০১৫ ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই প্রথম দক্ষিণ কোরীয় হিসেবে তিনি জিতে নেন ‘ম্যানবুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ২০১৬’। বইটি নিয়ে ফিল্ম ও নির্মাণ হয়েছে। যেখানে ইয়ং হি একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহবধূ। তার স্বামী অফিসের কর্মচারী। সাদামাটা জীবন বেশ চলছিল। বাদ সাধল যখন ইয়ং হি কিছু অস্বাভাবিক চিন্তা ও অভিজ্ঞতার শিকার হলো। তার আচরণ পাল্টে গেল, কেননা সে নিজেকে বৃক্ষজাতীয় কিছু একটা ভাবছে। মাংস খেতে অস্বীকার করল এবং ভেজেটেরিয়ান বনে গেল। এভাবেই ঘাত-প্রতিঘাত, মনের ভেতরের দ্রোহ, স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা, সামাজিক নিষেধাজ্ঞার মিথস্ক্রিয়ায় গল্পটি এগিয়েছে।
হ্যান ক্যাং লিখিয়ে পরিচয় ছাপিয়ে আরো নাম করেছেন আঁকিয়ে ও গাইয়ে হিসেবে। গানের ওপর প্রবন্ধ সঙ্কলন লিখেছেন ‘নিরালা গাওয়া গান’ (২০০৭), নিজের কথা, সুর ও কণ্ঠে রিলিজ করেছেন গানের সিডি। এত কিছু কেমনে সামলান? এর জবাবে হ্যান ক্যাং মুচকি হেসে বলেন, ‘এর কারণ মাইগ্রেন। মাইগ্রেনের ব্যথা আমাকে বিনয়ী হতে শিখিয়েছে। পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু করেছে। জীবনবোধ বদলে দিয়েছে।’ ‘দ্যা ভেজেটেরিয়ান’, ‘দ্যা হিউম্যান অ্যাক্টস’-এর ধারাবাহিকতায় তার সর্বশেষ যুক্ত পালক ‘দ্যা হোয়াইট বুক’ (২০১৬)। সাদার বন্দনা। অনেকটা আত্মজৈবনিক গদ্যকবিতা। কবির মৃত বড়বোনের স্মৃতিকাতরতা তাকে আগাগোড়া তাড়িয়ে নিয়েছে যে জন্মের পরে বেঁচেছিল মাত্র দুই ঘণ্টা। বইটি আবারও ইংরেজি তরজমা করেন ডেবোরাহ স্মিথ (২০১৭) এবং ২০১৮ তে যথারীতি দ্বিতীয়বারের মতো যৌথভাবে জিতে নেন ম্যানবুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ। ইংরেজি অনুবাদ বই সাদা ধবধবে আর্টকার্ডের প্রচ্ছদে ১২ ফর্মার নান্দনিক একটি কাজ। প্রকাশ করেছে পোর্টোবেলো বুকস। গুনতে হবে ৮.৯৯ ইউরো।
সাদা বলতে আমাদের চোখে ভাসে মেঘ, বরফ, দাঁত, দুধ, কাগজ কিংবা কাশফুল। কবি হ্যান ক্যাংও বোধের শুরুতে করেছিলেন এমন সাদাবস্তুর ফর্দ। যদিও শেষমেশ তার পরম্পরা হয়তো রক্ষা হয়নি। সাদা বলতে তার চোখে প্রথম ভেসে উঠেছে নবজাতককে পরিয়ে দেয়া কাপড়, মুড়িয়ে দেয়া কাঁথা, মারা যাওয়ার পর গায়ে জড়ানো কাফন, সাদা তুষারপাত উপেক্ষা করে সদ্যপ্রয়াত মেয়েকে বাবার দাফন। হ্যান ক্যাংয়ের জন্মের আগে তার মায়ের প্রথম দু’টি সন্তান মারা যায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই আজন্ম শুনে আসা বেদনাবিধুর এ গল্পগুলো তার অবচেতন মনে শক্ত অবস্থান নেয়। তাই অবদমিত আবেগগুলো আনমনে, কারণে অকারণে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সেই শোকাতুর আবেগ, সাদার ধ্যানের আক্ষরিক প্রতিফলন ‘দ্যা হোয়াইট বুক’। ৬৪টি কবিতাজুড়ে তিনি সেসময় প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তার বাইশ বছর বয়েসী মায়ের আর্তনাদ, একাকী বাড়িতে হঠাৎ তীব্র ব্যথায় ককিয়ে ওঠা, বাক্সপেটরা হাতড়ে নবজাতকের জন্য কাপড় সেলাই, একাকী নাড়ি কাটা, অতঃপর শিশুটিকে জড়িয়ে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে বেঁচে থাকার আকুতি তুলে ধরেছেন। নিজের জীবন বা পরিবেশ থেকে নেয়া উপাদান বলেই হয়তো কবি এখানে নিজের সব আবেগ ঢেলে দিয়ে বইটিকে কিছুটা এলিজি, কিছুটা নস্টালজিয়া কিংবা ফ্যান্টাসিতে টইটুম্বুর করে রেখেছেন। লিখেছেন ‘নিউবর্ন গাউন’, ‘মুন শেপড রাইস কেক’, ‘ব্রেস্ট মিল্ক’, ‘ক্লাউডস’, ‘হোয়াইট পিল’, ‘মুন’, ‘স্নো’, ‘সল্ট’ কিংবা ‘হোয়াইট বার্ডস’-এর মতো অসাধারণ বোধের কবিতা। সাদা পবিত্র ও পরিচ্ছন্নের প্রতীক হিসেবেই পরিগণিত, যা আমাদের জীবনের ক্লেদকে শুদ্ধ করে। যেমন হ্যান ক্যাং লিখেছেনÑ ‘সাদা অয়েন্টমেন্টের মতো যা ফোলা অথবা জ্বালাপোড়া কমায় কিংবা সাদা গজ যা ব্যান্ডেজ হিসেবে ক্ষতকে লুকিয়ে রাখে।’ এই বইয়ের আনাচে কানাচে এমনই সাদাবস্তুর স্তূতি ও বয়ান দেয়া আছে যা হৃদয়ের ক্ষতকে সারিয়ে তুলবে। মানসকে পরিশুদ্ধ করবে। নির্মল বোধের উন্মেষ ঘটাবে। সাদা কোনো রঙ নয় সাতরঙের সমাহার। তাই খালি চোখে দেখা সব সাদা নয়। সব সাদা শান্তি নয়। সাদা যেহেতু জীবনের অবিচ্ছেদ্য তাই জীবনের ভালোমন্দের ন্যায় সাদারও মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ আছে। মৃত্যুর রঙও যে সাদা। তাই হ্যান ক্যাংয়ের সাদা বন্দনা নিছক কিছু বস্তুকেন্দ্রিক বিকাশ ঘটেনি বরং তা জীবনের গভীর দর্শন খুঁজতে একটি অনবদ্য প্রার্থনাগীতি হয়ে উঠেছে। হ্যান ক্যাংয়ের বর্ণনাভঙ্গি সরল, নিটোল তার পরিবেশনা আর রয়েছে নান্দনিক দ্যোতনা। স্বল্পদৈর্ঘ্যরে একেকটি কবিতা হয়ে উঠেছে সেকুলার শ্লোক। পাঠকের জ্ঞাতার্থে ‘দ্যা হোয়াইট বুক’ থেকে একগুচ্ছ কবিতা দেয়া হলোÑ
স্তন্য
বাইশ বছর বয়েসী নারীটি বাড়িতে একাই আছে। শনিবার সকালে, বছরের প্রথম তুষারপাত তখনো ঘাস জড়িয়ে আছে। তার পঁচিশ বছর বয়েসী স্বামী গিয়েছে কন্যাটিকে পাহাড়ে দাফন করতে যে কিনা গতকাল জন্মেছিল। মহিলাটির ফোলা ফোলা চোখ তখনো ভালোভাবে খুলছে না। পুরো শরীরে গিঁটে গিঁটে ব্যথা, ফুলে অসার হয়ে গেছে। সহসা সে জীবনে প্রথমবার বুকে উষ্ণ প্রসবন অনুভব করল। উঠে বসল। আনাড়ি হাতে স্তন চাপতে লাগল। প্রথমে জলবৎ তরলং, তারপর হলদেটে, অবশেষে বেরিয়ে এলো সাদা স্তন্য।
নিচের পাটির দাঁত
বুবু ডাকটি শুনলে বাচ্চাদের নিচের পাটির দাঁতের কথা মনে পড়ে যায়। যেমন দু’টি ছোট্ট দাঁত আমার ছেলের মাড়িতে গজিয়েছিল। এখন ছেলে আমার ডাগর হয়েছে, সেই ছোট্টটি নেই। বারো বছরের ছেলেটির গায়ে লেপ টেনে দিয়ে আমি কান পেতে রই সন্তর্পনে। ধীর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনি। তারপর বিরান টেবিলে ফিরে আসি।
বিচ্ছেদ
মরে যেও না। দোহাই ঈশ্বরের! মরে যেও না।
আমি ঠোঁট নেড়ে বারবার কথাগুলো বিড়বিড় করি। তুমি কালো চোখ মেলে শুনেছিলে। বুলিহীন। আমি সর্বশক্তি দিয়ে সাদা কাগজটি ঠেসে ধরি। মরে যেও না। বেঁচে থাকো। এর চেয়ে লাগসই বিদায়ী বচন আর কী হয়?
ধুলো
এবং সে হরদম ভুলে যায়,
যে তার দেহখানি (আমাদের সবারই) ধুলোর গেহ,
বিচূর্ণ ছিল এবং অবিরত ধসে যাচ্ছে
আঙুলের ফাঁক গলে।
নৈঃশব্দ
দীর্ঘ অবসাদের দিন শেষে
এক চিলতে অবসর বড় দরকার।
যখন অবচেতন মনেই স্টোভের সামনে বসব,
আমার নৈঃশব্দে মেলে দেয়া সিটকে লাগা হাত
আনন্দে নেচে উঠবে ঈষৎ উষ্ণতায়। হ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা