১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মৃত্তিকার ছাইভস্ম ও কবি কালাম আজাদ

-

ষাটের দশকে মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে ঝঙ্কার তুলত যে ক’জন লেখকের কবিতা, কালাম আজাদ তাদের একজন। তিনি সরবে নীরবে কাব্যের ঝঙ্কারে জাগাতে চেয়েছেন তার পরিচিত জগৎকে। ‘মৃত্তিকার ছাইভস্ম’ তার কাব্য সমগ্রের প্রথম খণ্ড। ৪৮০ পৃষ্ঠার এ প্রকাশনায় কবির প্রকাশিত-অপ্রকাশিত নয়টি কাব্যগ্রন্থ সংযোজিত হয়েছে। বইটি প্রকাশের সাথে সাথে সাড়া জাগে কাব্যাঙ্গনে। বিশুদ্ধ সৌন্দর্যবোধের সাথে বইটিতে বিশেষ জীবনদৃষ্টি ও মানসধারা সম্মিলনের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে আছে। এখানেই একজন কবির কালজয়ী ও কালোত্তর সফলতা।
কালাম আজাদ তার গ্রন্থের কথামুখ লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘সহজ কবিতা লেখার বিড়ম্বিত প্রয়াস আমার পঞ্চাশ বছরের’। তার কবিতা সত্যিই সহজ ও সাবলীল। স্বভাবজাত, প্রতিভাধর ও নিরীক্ষাপ্রবণ কবি তার বয়সী প্রপঞ্চর একটি কবিতায় লেখেন, ‘দেখতে দেখতে রাজনীতিও পেশা হয়ে গেল, /দেখতে দেখতে শিক্ষা সেও পণ্য হয়ে গেল,/দেখতে দেখতে হলো শুধু পুঁজির আবাদ, / কাঁচামাল হয়ে গেল, কালাম আজাদ!।’
কবির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ও সফলতা হলো, তিনি যা বিশ্বাস করেন, কাব্যে তা প্রকাশ পেয়েছে। কাব্য আঙ্গিকের স্বাতন্ত্র্য ও বক্তব্যে তীব্রতা তার লেখায় নিজস্বতা ও মৌলিকত্ব এনে দিয়েছে।
কবি কালাম আজাদ গ্রামবাংলার মাটি ও মানুষকে নিয়ে ভাবেন। তাই তার লেখায় গ্রাম ও প্রকৃতি ফুটে উঠেছে নানা ব্যঞ্জনায়। কালের কসম কবিতায় তিনি লিখেছেন- মহাকাল কবিকে ভোলে না/ তাই গ্রিস লণ্ডভণ্ড খণ্ড খণ্ড/ হয় বারবার, যায় আলেকজান্ডার/অন্ধকার ছিঁড়েফুঁড়ে বের হয় হেলেন, হোমার।/ কবি তুমি, জেনে রাখো/শুনে রাখো ইতিহাস বলে/কবিতায় মহাকাল পায় নিজ দেহের আকার/তোমার কবিতা এই অকালেরই মহান উদ্ধার।/ তাইতো প্রার্থনা : /কবিরা তীর্থ করো আমাদের গ্রামে/তোমাকে কসম দিই কবিতার নামে। (মৃ.ছা. পৃষ্ঠা ২৮, গ্রন্থ : সম্পাদক সমীপে)
উষ্ঠা মারি কবিতায় বিগ্রস্ত সভ্যতার বিরুদ্ধে লেখকের সংক্ষুব্ধ মনোভাব ফুটে উঠেছে- উষ্ঠা মারি শিল্প, কল্প কবিতার মুখে/যদি না মানুষ হাসে জীবনের-যৌবনের সুখে।/ উষ্ঠা মারি রাজনীতি, অর্থনীতি দর্শনের পিঠে/ যদি না সমাজ গড়ে সখ্যতার সম্পন্ন কংক্রিটে।/ উষ্ঠা মারি সন্ন্যাসের শাস্ত্রের পাছায়/যদি না মানুষী প্রেমে মানুষ এগোতে পথ পায়/উষ্ঠা মারি শতাব্দীর বর্জ্য ব্যর্থতাকে/আগামীর স্বপ্ন সুখে বর্ণমালা নিলাম তোমাকে। (মৃ.ছা. পৃষ্ঠা ৮২, গ্রন্থ : শতাব্দীর বৈশাখে আমার বর্ণমালা)
সাম্য কবিতায় তার মনের ক্ষেদ প্রকাশ করেছেন এভাবেÑ ফুটবল মার্কা এই পৃথিবীতে/সকল মানুষ আজ অবধি/ফুটবল খেলার সুযোগ পেল না/ এ-ই আমার দুঃখ। (মৃ.ছা. পৃষ্ঠা ৯৪, গ্রন্থ : সুতদ্রা গোল্লায় যাও)
ঔপনিবেশিক স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কবি লেখেনÑ আমরা পরস্পর অতীন্দ্রিয় আত্মার আত্মীয়/আর স্বৈরাচার কারও বন্ধু কক্ষনো হয় না। (মৃ.ছা. পৃষ্ঠা ১০০, গ্রন্থ : সুতদ্রা গোল্লায় যাও)
স্মৃতির বেদনা বিমূর্ত হয়েছে তার কবিতায়Ñ আর ঘর বাঁধাবো না/ঘর জানি ভাঙাচর/স্মৃতির বেদনা (মৃ.ছা. পৃষ্ঠা ১০১, গ্রন্থ : সুতদ্রা গোল্লায় যাও)
একজন সফল শিক্ষক অধ্যক্ষ কালাম আজাদ তার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে হুকুম কবিতায় বলেন- পিতার হৃদয় আর ঔদ্ধত্য নিয়ে বলছি/ চুপ করো,/ ফেলে দাও অস্ত্র হাত থেকে/ বই নাও হাতে,/ নচেৎ ত্যাজ্য করে দেবো/ আর দেবো ত্রিকালের দুর্লঙ্ঘ্য অভিশাপ!
শিক্ষকের শুভ্রতার অহঙ্কারে বলছি/চুপ করো,/হিংসার বিষপাত্র ফেলে দাও/ফুল নাও হাতে/ নচেৎ আকাশবাতাস মাটি/নদী ও পানিকে বলে দেবো/তুমি এক নষ্ট দুরাচার/ কালের ঘৃণিত কুলাঙ্গার।
মৌন কবিতায় কবির অমোঘ উচ্চারণ- মৌন ছিলে মৌন ছিলে/গৌণ ছিলে কি?/ লজ্জাকাতর ছিলেই যদি/চোখ ঢেকেছো কি? হাসোনি তা বটে/নেচেছিলে প্রাণের দোলায়/ দেহের প্রতি তটে। (মৃ.ছা. পৃষ্ঠা ২৭৪, গ্রন্থ : সাদাসিধে পদ্য)
কবির বিশ্বাসে কোনো খাদ নেই। তার বক্তব্য ঋজু ও দ্ব্যর্থহীন। তার কবিতা আবেদনময়ী ও মূল্যবোধ সম্পন্ন। এতে রয়েছে রোমান্টিক কবি ভাবনা, প্রেম ও সৌন্দর্য, স্বদেশ-স্বজাতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভাষা-সংস্কৃতি, সত্য-সুন্দরে নিবেদিত কবিচিত্তের আত্মবিশ্লেষণ, দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের আর্তনাদ ও অনাহার ক্লিষ্টের করুণ পরিণতি। চৈতন্যের সবটুকু আলোড়ন দিয়ে তিনি অনুভব করেছেন জড়সভ্যতার ভণ্ডামি। তাই তার কাব্যচর্চাকে মানুষের কল্যাণের পথে উৎসর্গ করতে চেয়েছেন। কলমের রথ ছুটিয়েছেন শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে।
পাওয়ার নেপথ্যে কবিতায় লেখকের অসাধারণ কাব্যিক দ্যোতনা- একটি পাওয়ার মাঝে যে হায়/একটি চাওয়ার করুণ মরণ/পেয়েও হারা ক্ষুধার কারা/এই তো খেলার আশার জীবন। (মৃ.ছা. পৃষ্ঠা ৩২৬, গ্রন্থ : শুভ্রতা জ্বলে ওঠো)
শুভ্রতা জ্বলে ওঠো কবিতায় কবির নিসর্গ চেতনার পরিচ্ছন্ন পরিচয় মেলেÑ তুমিও কলের নষ্ট জল হয়ে গেলে/ভালোবাসা। (মৃ.ছা. পৃষ্ঠা ৩০৩, গ্রন্থ : শুভ্রতা জ্বলে ওঠো)
সুভদ্রা গোল্লায় যাও গ্রন্থে কবি খেদোক্তি করে লিখেছেন- পৃথিবীর সমস্ত রোগের ওষুধ/যুদ্ধের ভাণ্ডারে মজুদ।/সকল বুভুক্ষ মানুষের খাদ্য/যুদ্ধের তহবিলে জমাকৃত/আর শীতবস্ত্র,/যুদ্ধের গুদামে সংরক্ষিত।/এবং আপনাদের আর সৈন্যদের আবাসন ও রক্ষণে/ যতসব দরদালান এবং অট্টালিকা/ তার মূল্যে/ তিন তিনটা পৃথিবী আবাসিত হতে কি/পারত না?
শতাব্দীর বৈশাখে কবির কণ্ঠ নিঃসৃত ধ্বনি বিগলিত ধারায় প্রবাহিত হয়Ñ কার পাপে, কোন পাপে/আমার বৈশাখী শব্দমালা/বেঠায় সাঁতার কাটে-ঘোলাবদ্ধ জলে,/আমার ভায়ের কানে, বোনের হৃদয়ে/ তুলে না বৈশাখী ঝড় গতিস্মান/ নির্মিতির নন্দিত কৌশলে।
কার পাপে, বলো আজ পয়লা বৈশাখে/ বলো কার পাপে?/ জ্ঞানকে শত্রু ভাবে কারা?/ অক্ষরকে শত্রুজ্ঞানে দূরে ফেলে রাখে/ অজ্ঞতায়, মূর্খতায়-/শোষণের জর্জরিত যন্ত্রণার ঘোরে/পড়ে থাকে দূরে/ সৃষ্টির বাণীবাহী শতাব্দীর দুর্লভ বৈশাখে! বলো কার পাপে?
অভিসম্পাত করে কবি লিখেছেন- যারা পড়তে জানে অথচ/ কোন কিচ্ছু পড়ে না/ তারা মরুক/ আল্লাহর মর্কিতে মরুক।/যারা কিচ্ছু করে না/ কিচ্ছু গড়ে না/ এমনকি প্রতিবাদী যুদ্ধে লড়ে না/ তারা মরুক/ আল্লাহর মর্কিতে মরুক।
ঐতিহ্যসন্ধানী কালাম আজাদ হারানো ইতিহাস আর কল্পকাহিনীতে কবিতার উপজীব্য খুঁজেছেন। ঐতিহ্যের নিজস্ব ভাণ্ডার থেকে তার উপমা সম্ভার সংগ্রহ করে ভাবি কাব্যকারদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।
তুচ্ছ কথার গুচ্ছ বইয়ে কবি লিখেন- মানুষ কী আর সমান সমান হয়/আমি শুধু আমার মতো/ তোমার মতো নয়!
এতকিছুর পরও কবির হৃদয় অতৃপ্ত। তৃপ্তিপ্রয়াসী পিপাসিত কবিহৃদয়ে এখনো উত্তাল ঢেউয়ের গ্রোত। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টি অনবদ্য এবং কোনোটার সঙ্গে অন্যের সাথে একদম মিল পাওয়া যায় না। অনবদ্য সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন। শিশুদের কাছেও তিনি সমান জনপ্রিয়।
কালাম আজাদের রয়েছে সুস্পষ্ট জীবনদর্শন। তার কলম কেবল আনন্দের গীত গায় না- একই সাথে গায় জাগরণী সঙ্গীত। মানুষের ভেতরের ঘুমন্ত মানবতাকে জাগিয়ে তোলে। সৃষ্টিশীল অঙ্গনে তিনি চিরকালীন ও শাশ্বতকালীন। তাই তার লেখা সাহিত্য-শিল্পের বৈশ্বিক অঙ্গনে চির ও শাশ্বতরূপে ভাস্বরিত দেখতে পাই।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সফল শিক্ষক অধ্যক্ষ কালাম আজাদ একজন সুবক্তাও বটে। তার মাঝে অসাধারণ সৌন্দর্য, চৌকসতা ও দর্শনদীপ্তি লুকিয়ে রয়েছে। সভা-সমাবেশে সব সময় তিনি প্রাণবন্ত, সে আবেদন নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আমৃত্যু জীবন্ত থাকবে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement