২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

জাফরুল আহসানের কবিতা-ভুবন ‘জলের গভীরে বিস্মিত তোমার মুখ’

-

আমি কবি নই। খুব সাধারণ একজন পাঠক। কবিরা কবিতা লেখেন, আমাদের মতো সাধারণ পাঠক তা আনন্দের সাথে হাতে তুলে নিয়ে পড়ে কিংবা ব্যাকুল হয়ে শোনে। কবি জীবনকে দেখেন গভীরভাবে আর সেখান থেকে নিজের অভিব্যক্তিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেন। আমরা কবিদের লেখার বিশাল বিচিত্র দৃশ্যাবলি অন্তরের চোখ মেলে দেখি আর আমাদের মনের কোণে লুকিয়ে থাকা আনন্দগুলোকে, যন্ত্রণাগুলোকে, ইচ্ছাশক্তিগুলোকে একটু একটু করে জাগিয়ে তুলি। আমার কাছে কবিতা অমৃতময়, শান্তি, আনন্দ আর আবেগের উৎস; কেননা কবিরা প্রাণের কথা বলেন, প্রাণে প্রাণে প্রেরণা জুগিয়ে দেন।
আমি মূলত সত্তর দশকের কবিদের সহযাত্রী, সহপাঠী, বন্ধু। ঊনত্রিশে নভেম্বর কবি জাফরুল আহসানের জন্মদিনকে স্মরণ করে, শুভকামনা জানিয়ে আজ না হয় তাঁর কথাই বলি। একজন কবির কবিতার সামগ্রিক আলোচনা এত স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। আজ না হয় কবি জাফরুল আহসানের কবিতার সে দিকটা নিয়েই কথা বলি যেখানে সপ্তসুরের সাতটি সুরই বেজে উঠেছে রিমঝিমিয়ে। বলি তাঁর কবিতায় প্রেমের বৈচিত্র্যময় প্রকাশ ও বিচিত্র অনুরণন নিয়ে।
কবির হাতের লেখাটা চমৎকার, অতএব জীবনে কবিতার সাথে সাথে কত কিছুই যে লিখেছেন ! লিখেছেন পোস্টার, লিখেছেন বিজ্ঞপ্তি, লিখেছেন আঁকিবুঁকিও কিন্তু সবচেয়ে বেশি লিখেছেন যা তা হলো চিঠি; ক’জনকে তা না হয় নাই জানলাম। তবে সে গুলোও যে কবিতার মতোই আমি বোধ হয় তার কিছুটা হলেও জানি!
কবি জাফরুল আহসানের কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। আঁচল পেতে ধরলে শিউলি ফুলের মতো টুপটাপ প্রেম ঝরে পড়ে। কবিতার সুর ও লালিত্য থেকে প্রেমের চাদর গায়ে জড়িয়ে নেয়া যায়।
কাল কী সুন্দর রাত ছিল চিন্ময়ী। সারা রাত জেগে জেগে চাঁদে মেঘে নারকেল পাতায়
মাধবীলতার তলে খেলেছি বাসর,
সারারাত বউ বউ খেলা, আহা সে কি মাছরাঙা বউ
ডুবে যায় জলে।
কাল কী আশ্চর্য রাত ছিল সুখময়ী !
‘আশ্চর্য সুন্দর রাত’
অথবা...
অবাক বিস্ময়ে এক হাঁটু জল গিলে খায় রাজপথ
জলের গভীরে বিম্বিত তোমার মুখ
বলো তো কী করে জলে পা রাখি ?
‘বলো তো কী করে জলে পা রাখি’
কবি কল্পনায় ও বাস্তবে প্রেম করেছেন লুকিয়ে নয় সদম্ভে। লিখেছেনও মনের কপাট খুলে যেখানে নেই কোনো রাখঢাক, নেই লজ্জা ভয়ের বালাই, নেই সামলে নেয়ার দায়ও। দাম্ভিক প্রেমিক তাই কত কথাই যে বলেছেন...
কখনো দেখিনি আলোর শরীর তোমার মতন করে
ছুঁইনি কখনো পাখির পালক ঘরহীন কোনো ঘরে।
শুনিনি কখনো ঝিনুকে লুকানো মুক্তার চিৎকার
দেখেছি শুধুই আমার জন্য তোমার অহঙ্কার।
‘দেখা না দেখা’
কিংবা...
মেঘের আড়ালে আঁধার, কী ভাবে দেখবো তোমাকে?
তোমাকে দেখবো আলো আঁধারির বিদ্যুতালোকে !
বিদ্যুতালোকে মেঘের বসতি; তুমি মেঘ হলে
মেঘের চিবুক ধুয়ে দেবো আমি বৃষ্টির ছলে।
‘মেঘ : বৃষ্টি : রোদ’
কবি জাফরুল আহসানের কবি হৃদয় প্রেমময়। তাই দৃষ্টিপাতেই বৃষ্টিপাত! শরীরী আবেগ, উষ্ণতার আস্বাদ, ছুঁয়ে দেখার আবেগ কবিকে সম্মোহিত করেছে। সম্ভবত নদীর মতোই নারীকে কবিতার শরীরে বইয়ে দিয়ে জীবনের বিশাল ক্যানভাসজুড়ে প্রেমকে রাঙিয়ে তুলেছেন সপ্তরঙে...
উল্টে পাল্টে খেলছো কেমন মন জুড়ানির খেলা
স্বভাব দোষেই আগুন খেলায় নেই তো আমার হেলা।
‘খেলা’
চমৎকার একটি প্রেমিক হৃদয়ের ছোঁয়ায় কবিতা লেখেন কবি জাফরুল আহসান। প্রেমকে অনুভব করতে গিয়ে যেমন দেহ আলাদা হয়নি তেমনি প্রকৃতিও এসেছে প্রেমেরই হাত ধরে; প্রেমের অনুষঙ্গ হয়ে। কবি প্রেমকে রূপ-রঙ-সৌরভে ভরিয়ে দিয়েছেন প্রকৃতির নিটোল স্পর্শে...
এইখানে ঢেউ খেলা নদী ছিল, ছিল অরণ্যভূমি
জলের ওপর রঙধনু ছায়া ছিল আর ছিলে তুমি,
তুমি কি সে নদী, দু’কূল ভাঙা এক পল্লীবালিকা;
নদী নও তুমি, তুমি কি তবে গো চন্দ্রমল্লিকা!
‘নদী ও নারীর গল্প’
অথবা...
বিরহ প্রহরে আকাশ তোমার মেঘে ডাকা হলে,
প্রেমিকপাগল তোমাকে ভাসাবো আষাঢ়ের ঢলে।
আষাঢ়ের ঢলে জলকেলি হবে হৃদগঙ্গায়
আমরা দু’জন সোয়ারি এখন প্রেমের ভেলায়।
‘অসরাবতীর ছায়াবীথি তলে’
জাফরুল আহসানের কলমের জাদু প্রেমকে বিরহে, দুঃখে, বিষাদে মেখে উপস্থাপন করেছেন যেন প্রেমের নৌকার পাল আকাশে ঊর্ধ্বমুখী হয় অথচ বিষাদগাঙ ছলকে ছলকে ওঠে, কেঁপে কেঁপে, দুলে দুলে এগিয়ে যায়। কোথায় কতদূরে কবি বোধ হয় নিজেও জানতে চাননি কখনো কোনো দিন...
ধরতে গেলে দাওনি ধরা লুকিয়ে তুমি যেতে
সাত সাতটি পদ্ম দিয়েও পাইনি তোমায় ছুঁতে
আকাশ কুসুম তেমন কিছু চাইনি তোমার কাছে
নীল চাদোয়ার পাহাড়ঘেঁষা আকাশ আমার আছে।
‘স্বরূপ’
অথবা...
জটিল জীবনে জটলা পাকানো, দহনে পীড়নে হায়
সমীকরণের ফলাফল বুঝি এবাবেই ভেসে যায়।
দুঃসময়ের পানকৌড়ি এক ভ্রুকুটি নাচায়ে হাসে
নাওখানি তার থই থই জলে জলের গভীরে ভাসে।
‘মেয়েটি মানুষ ও দানব’
জাফরুল আহসানের প্রেমের অনুভব একান্তই নিজস্ব। তাঁর মনোগড়নে নিজের একটি স্বচ্ছন্দতা ও সারল্য আছে। অব্যক্তকে ব্যক্ত করার, ব্যর্থতাকে সার্থকতায় রূপ দিতে প্রতিনিয়তই তাঁর কলম এক ধরনের তাগিদ অনুভব করে। তাই তার প্রেম বয়স মানে না, মানে না শরীরের শাসন, মানে না সময় অসময়। তাই উচ্চকণ্ঠেই বলেন...
চোখে চোখ রেখে যদি ডাকো দেবো না তোমাকে সাড়া
দ্রাক্ষার রসে ভেজানো ওষ্ঠে তুমি যদি দাও নাড়া;
প্রকৃতির মতো নুয়ে পড়ে দ্যাখো হৃদয়ে ফল্গুধারা।
‘আর কিছু নয়’
কিংবা...
তোমার ঘরে চোর ঢুকেছে
শরীর কাঁপে কেমন তরো
আগলে ধরো আগলে ধরো
বুঝতে যদি নাই বা পারো।
‘নিষিদ্ধ জার্নাল’
কবি প্রেমিকার কাছে হৃদয়কে শর্তহীনভাবে সমর্পণ করে আছেন... ‘সাত সকালে তোমার কাছে হাত পেতেছি হৃদয় দেবে?’... ‘তুমি এসো আমি ফের হাঁটু গেড়ে বসি আরো একবার শুধু বলি ভালোবাসাবাসি। ’
আবার বলেন...
চাঁদের আলোয় ভাসছে তোমার অধর, চিবুক,
টোলপড়া গাল নিমেষেই হয়ে গেছে চাঁদমুখ।
তৃষিত এ চোখে চাঁদ নয় সখি তোমাকেই দেখি,
ভুল করে হায় তোমাকেই আজ চাঁদ বলে ডাকি।
‘তোমাকেই চাঁদ বলে ডাকি’
কবি প্রেমের নদীতে নৌকার বৈঠা চালান জোয়ারে কিংবা ভাটায়। প্রেমের আবেশেই জীবনের গল্প বলেন। কবির প্রেয়সী কখনো উষ্ণতার আবেশ নিয়ে কবির বাহুপাশে বন্দি হয়, কখনো ছলনায় কৌতুকময়ী হয়ে পড়ে, কখনো বুকের কপাট খুলে, হাতের বাঁধন ছিঁড়ে হারিয়ে যেতে চায়। কবি উতলা হয়ে ওঠেন, চঞ্চল অস্থির চিত্তে কেবল বলেন...
আমার প্রিয়া মান করে সে মন কেড়েছে
তার বিরহে হৃদয়জুড়ে শোক নেমেছে।
বলিস তারে আমি যে তার ঘরের মালি
হৃদয় জুড়ে কবির উঠোন রইলো খালি।
‘রেলগাড়িটা’
কিংবা...
তোমার চোখে কান্না ছিলো,
কান্নার ও কি দু’কান ছিলো?
নইলে কেনো শুনতে পেলো
ভালোবাসায় গলদ ছিলো?
‘ভালোবাসা’
কিংবা...
আমি দূরে গেলে স্রোতহীন হবে নদীর প্রবাহ
শূন্য শয্যা বুকে তুলে নেবে প্রণয়ের দাহ।
চাদরের ভাঁজে ঢেউ খেলা নদী স্মৃতি হয়ে যাবে
নদী স্মৃতি হলে, মরে গেলে নদী জল কই পাবে?
‘পিরিতি কথন ২’
জাফরুল আহসানের কবিতায় প্রেম সরল রেখায় বয়ে যায়। জীবনের খুব কাছ থেকে দেখা যায়; যেন জাদুর পরশে ডেকে ডেকে সন্মোহিত করে রাখে তার পরিপার্শ্বকে। কবির অন্তরের সত্য আড়াল হয় না, পাঠকের চোখের সামনে ভাসে ছবির মতো...
অভিমানী প্রিয়া কোথায় লুকাবে বেদনার জল
চোখের জমিনে ছড়ানো আমার প্রেমের কাজল
কেমনে বোঝাই এতো প্রেম এতো ভালোবাসাবাসি
লুকাতে পারি না, চুমুর দাবিতে ফিরে ফিরে আসি।
‘বেহুলা বধূ গো’
কবি জাফরুল আহসান শাশ্বত বাঙালি। যুগ যুগান্তরের কথকতা, ইতিহাস, মিথ, কল্পনা তার কবিতায় ফিরে ফরে এসেছে। কবির প্রেমিকা কখনো রাধিকা,পার্বতী, বেহুলা কখনো মেঘবতী, চিন্ময়ী, মৃন্ময়ী কখনো সোয়ারি নায়রি, নোলক পরা বউ কখনো শ্রাবণের মেঘ, রঙধনু, নদী, চাঁদ কখনো ষোড়শী কখনো অষ্টাদশী কখনো পঞ্চাশোর্ধ্ব রমণী এক। এ যেন কবির হাতে এঁকে যাওয়া অপরূপ প্রেমের ছবি, বিচিত্র রঙের প্রলেপে রাঙানো...
তোমাকে দিয়েছি শিমুল পলাশে রাঙানো ভোর
বলেছিলে তুমি ফাগুনে আগুন বাঁধো বাহুডোর।
চৈতালি হাওয়া কড়া নেড়ে যায় ঘোর সন্ধ্যায়
হৃদয় তোমার ষড়্্্্ঋতু এক বেলা অবেলায়।
‘বেলা অবেলায়’
কবি জাফরুল আহসানের মনে যে লালিত আবেগ, প্রেমের আনন্দ, বেদনা, দুঃখ, ক্রোধ অভিমানের অপার অভিব্যক্তি, বিচিত্র সুরের মূর্ছনা তা পাঠককে উতলা করে, চোখে জল এনে দেয়, মনে সাহস জোগায়, সুখের গল্প বুঝতে শেখায়। পাঠক কিংবা শ্রোতা নিজে যে কথা প্রকাশ করতে পারে না কবি যেন পাঠককে হাত ধরে ডেকে ডেকে বলে... দেখো তুমি ও আমার মতো মাতাল হয়েছিলে জানাতে পারোনি, তুমি ও আমার মতো অভিমান করেছিলে বলতে পারোনি, তুমি ও আমার মতো প্রকৃতি দেখেছো স্পর্শ করোনি; এসো আমার চোখে ভুবন দেখো।
... আমরা জাফরুল আহসানের কবিতায় প্রেমের ভুবনকেই নিজের চোখে দেখতে চাই। দেখতে চাই বারবার।

 


আরো সংবাদ



premium cement