১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নাগরী ভাষা সাধক এরহাসুজ্জামান

-

নীরবে চলে গেলেন আমৃত্যু সিলেটী নাগরী ভাষা সাধক অধ্যাপক এরহাসুজ্জামান। নাগরী স্যার নামে যিনি সমধিক খ্যাত। সিলেট সরকারি এমসি কলেজের সাবেক শিক অধ্যাপক এরহাসুজ্জামান গত মঙ্গলবার মাগরিবের নামাজের পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে শহরতলী শিবের বাজার এলাকায় রাজারগাঁও উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নামাজে জানাজা শেষে হাজারো জনতার অশ্রুসিক্ত নয়নে বাবুরাগাঁওয়ে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
এমন একজন বিখ্যাত ব্যক্তির মহাপ্রয়াণের ঘটনাটি মূলধারার গণমাধ্যমে তেমন গুরুত্ব পায়নি। আর তাই একজন প্রবীণ আফসোস করে বললেন, হায়রে জাতি চিনলি না তোর এই ভাষাসৈনিককে। চিনলি না জ্ঞানতাপস এই সূর্য সন্তানকে।
প্রখর মেধাবী এরহাসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বিসিএস শিা ক্যাডারে গণিতের শিক হিসেবে যোগ দেন সিলেট এমসি কলেজে। ১৯৭২ সালে তরুণ শিক হিসেবে যোগ দেয়া কলেজের অন্য সব শিকের মাঝে তিনি ছিলেন একটু ভিন্ন রকমের। নির্লোভ, নির্মোহ ও অন্তর্মুখী এক ব্যতিক্রমী মানুষ। অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতা-পরবর্তী সংগ্রামমুখর শিাঙ্গনে তিনি যেন এক নীরব সাধক। তার সাধনার বিষয়বস্তু ছিল সিলেটী নাগরী হরফ।
সেই ছোটবেলা থেকেই নাগরী নিয়ে তার ভাবনা ও সাধনার অন্ত নেই। বাবা মাওলানা নজাবত আলী ও মা সুরতুননেছা ভালো নাগরী জানতেন। অধ্যাপক এরহাসুজ্জামান মায়ের কাছ থেকেই মূলত নাগরী শিা লাভ করেন। কাসে শিার্থীদের তিনি অঙ্কের পাশাপাশি নাগরীও শেখাতেন। তাদের কাছে নাগরী লিপির ফজিলত বর্ণনা করতেন। শিার্থীদের নাগরী পুঁথি ও কবিতার বই পড়তে দিতেন। এভাবেই তিনি হয়ে উঠলেন নাগরী স্যার। একজন দ গণিত শিক হলেও অল্প দিনে নাগরী স্যার হিসেবেই তিনি অধিক পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করেন। আসলে নাগরী ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে তিনি আজীবন লড়ে গেছেন।
কর্মজীবনে অধ্যাপক এরহাসুজ্জামান ১৯৭২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এমসি কলেজে ছিলেন। এরপর চলে যান কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। সেখানে ছিলেন ২০০১ সাল পর্যন্ত। তারপর তিন বছর ছিলেন ময়মনসিংহের মুমিনুননেছা কলেজে। সবশেষে ছিলেন সুনামগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে। সেখান থেকেই ২০০৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন। এ ছাড়া শ্রীহট্ট সংস্কৃত কলেজের সূচনায় খণ্ডকালীন শিক ছিলেন তিনি।
অধ্যাপক এরহাসুজ্জামানের অনুরোধে সিলেট বন্ধু আমিনুর রশীদ চৌধুরী তার পত্রিকা যুগভেরীতে নাগরী পরিক্রমা নামে একটি পাতা বের করেন। খুব সাড়া জাগিয়েছিল পাতাটি। শহরের চৌহাট্টা এলাকায় নাগরী সমিতির জন্য আমিনুর রশিদ চৌধুরী তিন ডেসিমেল জায়গাও দান করেছিলেন। সেখান থেকে যেন সিলেট অঞ্চলের নাগরী লিপি ও পুঁথি গবেষণা হয়।
সিলেট ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রায় ৬০০ বছরব্যাপী নাগরী লিপির ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায়। সুফি-সাধকরা অনেক গান ও পুঁথি রচনা করেছেন নাগরী ভাষায়। এই লিপির মোট বর্ণসংখ্যা ৩৩টি। এর মধ্যে ২৮টি ব্যঞ্জন ও পাঁচটি স্বরবর্ণ। সিলেটী নাগরী হরফে লেখা সবচেয়ে প্রাচীন যে পুঁথিটি পাওয়া গেছে সেটি ১৫৪৯ সালে লেখা। লেখকের নাম গোলাম হুছন। পুঁথিটির নাম তালিব হুছন। এটি একটি সুফিশাস্ত্র। এ ছাড়া নাগরীতে লিখেছেন সৈয়দ শাহনূর, আরকুম শাহ্, শিতালং শাহ, মুন্সী সাদেক আলী, ইরফান আলী, নছিম আলী, বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম প্রমুখ।
সাংবাদিক ও গল্পকার সেলিম আউয়াল জানালেন, অধ্যাপক এরহাসুজ্জামান নাগরী ভাষা ও সাহিত্যের জন্য এককভাবে যে কাজ করে গেছেন তা অতুলনীয়। তিনি সব সময় সিলেটী ভাষায় কথা বলতেন। নাগরী ভাষা শেখার জন্য ছোট্ট বই ছেপেছিলেন। কারো সাথে দু’এক কথা হওয়ার পরই একটি নাগরী শেখার বই হাতে ধরিয়ে দিতেন। ১৯৭৮, ১৯৭৯-এর দিকে সিলেটের এমসি কলেজে বিজ্ঞানমেলা হতো। তখন কলেজের গণিত বিভাগের স্টলে দেখা যেত নাগরী লিপির ছড়াছড়ি।
তার মতে, ১৮৬০-৭০-এর দিকে সিলেটে নাগরী লিপির প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সিলেট নগরীর হাওয়াপাড়া নিবাসী মৌলভী আবদুল করিম ১৮৬০ সালে ইউরোপ সফর করে দেশে ফেরেন। নাগরী লিপির টাইপ বানিয়ে চালু করেন ছাপাখানা। সিলেট নগরীর বন্দরবাজারে প্রতিষ্ঠিত তার ছাপাখানার নাম ছিল ‘ইসলামিয়া ছাপাখানা’। সেই ছাপাখানায় প্রথম নাগরী পুঁথি ছাপানো হয়। সিলেট শহরে নাইওরপুল এলাকার সারদা প্রিন্টিং পাবলিশিং নামের আরেকটি ছাপাখানায় নাগরী হরফে পুঁথি ছাপা হতো।
নাগরী গবেষক মোস্তফা সেলিম জানান, নাগরী লিপি লালন ও চর্চায় আজীবন অবদান রাখার জন্য অধ্যাপক এরহাসুজ্জামানকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করেছে উৎস প্রকাশন এবং তিনি একটি প্রামাণ্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তার মতে, দারুণ উদ্যমে অধ্যয়ন ও গবেষণা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে নাগরী পাঠশালা। এর প্রবর্তক অধ্যাপক এরহাসুজ্জামান। এ ছাড়া নাগরী ভাষার ওপর পিএইচডি করেছেন দেশী-বিদেশী অনেকেই। সিলেট লিডিং ইউনিভার্সিটি এ লিপিবিষয়ক ইনস্টিটিউট চালু করেছে। বদরপুরে নাগরী লিপির অধ্যাপক আছেন, ড. মোসাব্বির ভূঁইয়া, যিনি আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাগরী লিপির ওপর পিএইচডি করেছেন। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যতীন্দ্রমোহন সংগ্রহশালায় নাগরী লিপির অনেক পাণ্ডুলিপি সংরতি আছে। ড. দেবারতি বাগচী পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ করছেন নাগরীর ওপর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অনুরাধা চন্দ নাগরী লিপি নিয়ে গবেষণার কাজে রত। ব্রিটেনের ড. সু লয়েড এবং জেমস উইলিয়াম লয়েড-দম্পতি নাগরী লিপি নিয়ে গবেষণা করছেন। ড. সু লয়েড প্রথম নাগরী লিপির ফন্ট উদ্ভাবন করেন, ‘সুরমা’, সিলেটের সুরমা নদীর নামানুসারে ফন্টের নাম রেখেছেন। এ ছাড়া আছেন রজার গুয়েন। তাকে তো সিলেটী মানুষেরা রাজা মিয়া নামে চেনে; নাগরী লিপির ওপর কাজ করছেন। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের বেশ ক’জন গবেষক রয়েছেন যারা নাগরী লিপি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। আগ্রহী না হয়ে উপায় কী, স্কটল্যান্ডের ককনি আর এ অঞ্চলের বাংলা ছাড়া, পৃথক দুটি বর্ণমালা প্রচলিত এমন ভাষা তো পৃথিবীতে নেই। আর স্বাতন্ত্র্য ও সাহিত্যমূল্যের দিক দিয়ে নাগরী এত বেশি এগিয়ে যে, গুরুত্বের দিক থেকে ককনির দ্বিতীয় বর্ণমালার সাথে এর তুলনা চলে না বলে গবেষকরা মনে করেন।


আরো সংবাদ



premium cement
ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক ব্যক্তিকে গলা কেটে হত্যা ইসরাইলকে পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাতের ব্যাপারে সতর্ক করলো আইআরজিসি সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ১২৮তম প্রয়াণ দিবসে স্মরণ সভা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের শূন্য পদ দ্রুত পূরণের নির্দেশ ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে ঝুলন্ত নারীর লাশ উদ্ধার মধুর প্রতিশোধে সিটিকে বিদায় করে সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদ রাজশাহীতে ভুয়া তিন সেনা সদস্য গ্রেফতার ডেঙ্গুতে আরো একজনের মৃত্যু, আক্রান্ত ২৩ চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণ, প্রতিদ্বন্দ্বী আ'লীগ নেতাকে ইসির শোকজ বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা চরফ্যাশনে স্কুল শিক্ষিকাকে কোপানো মামলার আসামি গ্রেফতার

সকল