২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মোহররম নজরুলের কবিতায়

-

আরবি দিনপঞ্জির প্রথম মাস মোহররম। মুসলিম জগতে এ মাসের ১০ তারিখ বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানে ভূষিত। কারণ এ মাসেরই ১০ তারিখে ঘটে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখজনক এবং শোকাবহ ঘটনা। যেটি আশুরা নামে অধিকতর পরিচিত। এ দিনটিই মোহররম মাসকে মহিমান্বিত করেছে।
আজ থেকে তেরো শ’ আটাত্তর বছর আগে মহানবী হজরত মোহাম্মদ সা:-এর দৌহিত্র, মহাবীর আলী রা:-এর ছোট ছেলে হজরত ইমাম হোসেন রা: বাহাত্তরজন নিকট আত্মীয় এবং ষাট হাজার বিশ্বস্ত অনুগামী সৈন্যসহ কুফার উদ্দেশে মদিনা থেকে যাত্রা শুরু করেন। পথে দিকভ্রান্ত হয়ে তারা পৌঁছে যান দাস্তকারবালায়।
সেখানে পৌঁছে তিনি মুয়াবিয়ার ছেলে এজিদের কাছে এ মর্মে পত্র প্রেরণ করেন যে, মুয়াবিয়া ও ইমাম হাসান রা:-এর মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল তা সে রক্ষা করবে কি না। ধূর্ত এজিদ এই পত্রের কোনো ন্যায়সঙ্গত উত্তর না দিয়ে ইমাম হোসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে। ফোরাত নদীর পশ্চিম তীরে ইমাম হোসেন তাঁবু ফেলে অবস্থান নেন। এজিদ সেখানে হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েন করে, যাতে ইমাম বাহিনী এক বিন্দু পানিও ফোরাত নদী থেকে না নিতে পারে। তিন দিন, তিন রাত এভাবে পানিবিহীন অবস্থায় কাটল। একে একে মহাপরাক্রমে বীররা অসীম সাহসে এ অসম যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হতে লাগলেন। ুধা-পিপাসায় সবাই কাতর শিশু ও মহিলারা ভয়ে আতঙ্কে অস্থির। সব সহ্যেরই একটা সীমা আছেÑ সে সীমাও যেন অতিক্রান্ত হয়ে এলো। ইমাম আর বসে থাকা সমীচীন মনে করলেন না।
দশই মোহররম সকালবেলা ইমাম হোসেন নিজেই যুদ্ধে গেলেন বিপুল বিক্রমে। তাঁর যুদ্ধ নৈপুণ্য দেখে এজিদ বাহিনীকে ত্রাসের সঞ্চার হলো। যেন রোজ কেয়ামত নেমে এলো যুদ্ধের ময়দানে। শত শত শত্রু নিধন করে জয়ী হলেন আলীজাদা ইমাম হোসেন। সঙ্গীদের কথা মনে পড়ল তাঁর। অশ্রুসিক্ত নয়নে ফোরাত নদীর তীর ধরে হাঁটতে লাগলেন তিনি। এক আঁজলা পানির জন্য ফোরাত নদীতে নামলেন শেষ নবী হজরত মোহাম্মদ সা:-এর আদরের নাতি ইমাম হোসেন। শত্রু এজিদের হিংস্র সৈন্যরা তখনো তার পিছু ছাড়েনি। তারা ক্রমাগত তীরবিদ্ধ করে তাঁকে সেখান থেকে বিতাড়িত করে দেয়। তিনি ফিরে আসেন নিজের তাঁবুর সামনে। কোলে তুলে নেন শিশু পুত্রকে। শত্রুরা তখনো তীর, বর্শা নিক্ষেপ করেই চলেছে। ছেলেকে ভেতরে দিয়ে একা বসে থাকেন তাঁবুর দুয়ারে। ইমামের এ অবস্থা দেখে এক মহিলা তাঁর হাতে এক পেয়ালা পানি তুলে দেন, তিনি পানি পান করতে গেলে শত্রুরা তাঁর মুখ লক্ষ্য করে বর্শা নিক্ষেপ করে। আর এ জীবনে পানি পান করা হলো না তাঁর। এজিদ প্রথম থেকেই এই ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করে যে, ইমাম বংশ ধ্বংস করবে পানি না দিয়ে।
ইমাম হোসেন দুই হাত তুলে মুনাজাত করলেন জীবিত এবং মৃত আত্মার শান্তি কামনায়। ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক মহানবীর যোগ্য উত্তরসূরি সত্য, ন্যায় এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ঘৃণ্য অর্থলোভী সীমারের হাতে শাহাদতবরণ করলেন। শহীদ হলেন তিনি। আর তখনই যেন আকাশ, পাতাল, অন্তরীক্ষ, অরণ্য, সাগর, পর্বত, বায়ু ভেদ করে চারিদিক হতে মর্মভেদী রব উচ্চারিত হতে থাকলোÑ হায় হোসেন! হায় হোসেন!! হায় হোসেন!!!
তাঁর এই জীবনাবসান একাধারে বেদনার এবং শিক্ষা গ্রহণের। তিনি জীবন দিয়ে শিখিয়ে গেলেনÑ কোনো অবস্থাতেই অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার। স্মরণাতীত কাল থেকে এ শিক্ষাই দিয়ে আসছে শোকাবহ মহররম।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মননে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল কারবালার বেদনাবিধুর ঘটনা। কত না প্রসঙ্গে তিনি এনেছেন শহীদী কারবালার কাহিনী। মহররম তাঁর হৃদয়কে করেছে বেদনার্ত, নয়নকে করেছে অশ্রু সজল। আবার একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য ইমাম হোসেন তাঁর কাছে মহানায়ক। মোহররমের শোককে তিনি শক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন। মোহররম তাঁর কাছে স্বাধীনতার প্রতীক। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বস্ব বিসর্জন দেয়ার অবিস্মরণীয় মহাকাব্য। তাই তো কবি বলেনÑ
‘দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা,
হাঁকে বীর, ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা।’
‘মোহর্রম’ কবিতা নজরুলের অমর সৃষ্টি যার কোনো দ্বিতীয় তুলনা হয় না। ইমাম হাসান, হোসেনের সাথে কবিতাটিতে অপরিসীম ব্যাপকতা নিয়ে এসেছেন হজরত আলী ও খাতুনে জান্নাত মা ফাতিমা রা: তাঁদের পরিবারের অন্যান্য সদস্য, প্রিয় অশ্ব দুল দুল।
কবিতার প্রারম্ভে শোককে দৃষ্টি গ্রাহ্য করতে ‘লাল’-এর বিচিত্র ব্যবহার লক্ষ্যণীয়Ñ
‘নীল সিয়া আসমান : লালে লাল দুনিয়া,
‘আম্মা! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া!’
‘কাঁদে কোন ক্রন্দসি কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আসু আনে সিমারেরও ছোরাতে!
প্রিয় হারানোর মর্ম জ্বালা, এবং পানির জন্য হাহাকারÑ
রণে যায় কসিম ঐ দু’ঘড়ির নওশা,
মেহেদির রঙটুকু মুছে গেল সহসা!...
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,
‘আম্মাগো, পানি দাও, ফেটে গেল ছাতিমা’!
সমগ্র কবিতাজুড়েই গভীর বেদনায় জারে জার হওয়া আর্তনাদ। তারই মধ্যে প্রতিজ্ঞাÑ
‘ফিরে, এলো আজ সেই মোহররম মাহিনা,
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না!’
মোহররমকে নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের আরেকটি কবিতা আছে ‘মোহর্রম’ নামে। বানানে সামান্য পার্থক্য থাকলেও কারবালার নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, বিশ্বাসঘাতকতা, উপমা, রূপকের ব্যবহারে আরো তীèভাবে তুলে এনেছেন কবি এই কবিতায়। বাঙলার মুসলিমদের ডেকে বলছেনÑ
‘ওরে বাঙলার মুসলিম, তোরা কাঁদ,
এনেছে এজিদী বিদ্বেষ পূর্ণ মোহর্রমের চাঁদ!...
এসেছে ‘সীমার’ এসেছে ‘কুফা’র বিশ্বাসঘাতকতা,
ত্যাগের ধর্মে এসেছে লোভের প্রবল নির্মমতা!
এজিদের নিষ্ঠুরতার বিস্তৃত বিবরণ দিতে দিতে কবি মহান আল্লার কাছে প্রশ্ন রাখছেনÑ
‘আল্লা! এরাও মুসলিম, এরা রসূলের উম্মত,
কেন পায়নি বা প্রেম আর ক্ষমা শান্তি ও রহমত?’
আল্লার দরবারে নজরুলের প্রার্থনা
‘শান্তি, শান্তি, আল্লা শান্তি দাও!
সর্বদ্বন্দ্বাতীত তুমি, নাও তব প্রেম পথে নাও!’
আবার প্রত্যক্ষ কবিতার পাশাপাশি কিছু কিছু কবিতায় ও গানে উদাহরণ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং উদ্ধৃতি হিসেবে কবি ব্যবহার করেছেন মোহররম প্রসঙ্গÑ ‘তরুণের গান কবিতায় কারবালা প্রসঙ্গ এসেছে এভাবেÑ
‘নব জীবনের ফোরাত কুলে তো কাঁদে কারবালা তৃষ্ণাতুর,
ঊর্ধ্বে শোষণ সূর্য, নিম্নে তপ্ত বালুকা। ব্যথা মরুর!
নজরুল ইসলামের সঙ্গীতে ফুটে উঠেছে মোহররমের অন্তর বিদীর্ণ করা হু হু কান্না। যা চিরকাল মানুষের মনকে শোকে-দুঃখে জারে জার করে তোলে। ধর্মীয় গণ্ডি অতিক্রম করে মর্মস্পর্শী সেই কাহিনী সবাইকে ছুঁয়ে যায়। তাই তো কবি লিখলেনÑ
‘মোহররমের চাঁদ এল ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়।
ওয়া হোসেনা, ওয়া হোসেনা তারই মাতম শোনা যায়।’
আরো লিখলেনÑ
‘এস শোকের সেই মোহর্রম কারবালা স্মৃতি লয়ে’
আমি বে-তাব বিশ্ব মুসলিম সেই শোকে রোজা রোয়ে!’
(এল শোকের সেই মোহর্রম)
ডাক দিলেম ‘ওগো মা ফাতেমা ছুটে আয়; বলে, কারণ
তোর দুলালের বুকে হানে ছুরি।
দিনের শেষ বাতি নিভিয়া যায় মাগো
বুঝি আঁধার হলো মদিনা পুরী।’
এবং ‘ফোরাতের পানিতে নেমে’ কী করছেন ফাতেমা দুলাল সে চিত্র ও এঁকেছেন মানবদরদি নজরুল।
‘ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে
অঝোর নয়নে রে।
দু’হাতে তুলিয়া পানি ফেলিয়া দিলেন অমনি
পড়িল কি মনে রে!’
ইমাম হোসেনের একে একে মনে পড়লÑ
‘দুধের ছাওয়াল’ আসগরের কথা, শাদির নওশা শহীদ কাসেমের কথা, ফোরাতের পানিতে সকিনার হাতের মেহেদি মোছার কথা, বীর আব্বাসের কথা যার দুই বাহুই শহীদ হয়েছিল কারবালার যুদ্ধে।
এ ছাড়া বহিছে সাহারায় শোকের ‘লু’ হাওয়া’ ‘মরুর ফুল ঝরিল অবেলাতে’ ‘হাতে হাত দিয়ে আগে চল’
‘পুবাল হাওয়া পশ্চিমে যাও’ ‘আমি যদি আরব হতাম’
‘খাতুনে-জান্নাত ফাতেমা জননী’, ‘ওরে ও মদিনা’ ইত্যাদি কবিতা ও গানে মোহররম প্রসঙ্গ এসেছে নানা অনুষঙ্গে।
তবে গদ্যে কাজী নজরুল ইসলাম এই প্রসঙ্গ নিয়ে যা লিখেছেন তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আরো প্রাসঙ্গিক। ১৯২২ সালের ২৯ আগস্ট ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় এই মর্মে যে ‘ধূমকেতুর’ ‘মোহররম সংখ্যা’ বের হবে। এর আগে কোনো পত্রিকার মোহররম সংখ্যা বের হয়েছে বলে জানা যায় না। যা হোক, নজরুল এ ব্যাপারে অগ্রগামী হয়ে রইলেন চিরকালের তরে। সেই পত্রিকা সংখ্যায় নজরুল লিখেছেন, তার গদ্য রচনা ‘মোহররম কথা ও মোহররম’।
‘মোহররম’ ঠাঁই পেয়েছে রুদ্রমঙ্গল কাব্যে। সেখান থেকে খানিকটা তুলে ধরছিÑ ‘ফিরে এসেছে আজ সেই মোহররমÑ সেই নিখিল মুসলিমের ক্রন্দন কাতরানির দিন। কিন্তু সত্য করে আজ কে কাঁদছে বলতে আর হে মুসলিম? আজ তোমার চোখে অশ্রু নেই। আজ ক্রন্দন স্মৃতি তোমার উৎসবে পরিণত। তোমার অশ্রু আজ ভণ্ডামি, ক্রন্দন আজ কৃত্রিম, কর্কশ চিৎকার। ‘হায় হাসান, হায় হোসেন’ বলে মিথ্যা বীভৎস চিৎকার করে আর মা ফাতেমার পুত্র শোকাতুর আত্মাকে পীড়িত করে তুল না।...
আল্লার পানে তাকাও, রাসূলের দিকে চেয়ে দেখ, মা ফাতেমা, হজরত আলীর মাতম শোন, কাসেমের সখিনার অতৃপ্তির আকুল কাঁদন রণরনি শোন, কবি শিশু আসগরের তীর বেঁধা কাঁচা কলিজার খুন খারাবির কথা স্মরণ কর, আর তোমার কর্তব্য নির্ধারণ কর, হে মুসলিম।’
‘মোহর্রম কথা’র নজরুল ইসলামের আফসোস আরো ঘোরতর। তিনি প্রশ্ন করেছেনÑ ‘‘আপনার নিজ হাতে ইমাম হাসান ও ইমাম হোসানের ‘তাজিয়া’ ও ‘কবর’ তৈরি করেন, আর পৌত্তলিকরা মৃন্ময় মূর্তি গড়ে পূজা করে। এই দুটি কাজে তফাৎ কি? মোট কথা, ইসলামি ‘শরিয়ত’ অনুসারে কি শিয়া, কি সুন্নি সব সম্প্রদায়ের মুসলমানের পক্ষে মোহররমে আসুদ আহাদ করা ঘোর পাপজনক।’’
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী নজরুল তার মানসলোকে অবিস্মরণীয় ব্যঞ্জনা নিয়ে বহুভাবে আলোড়িত করেছে মোহররমের শোকানল। যা আজো পাঠকের হৃদয়কে, অপার বেদনায় আচ্ছন্ন করে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement