২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

লেখার জীবন বইয়ের জীবন

-

সেই গত শতকের পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আরম্ভ করে আজ অবধি বই নিয়েই আমার যত কাজ-কারবার ও চিন্তাভাবনা। তবু সুদ কারিগর হতে পারলাম না।
বাংলা একাডেমির চাকরিতে ১৯৬১ সালের প্রথম দিকে যোগ দিলাম। বাংলায় অনার্সসহ এমএ ছাড়া আমার অতিরিক্ত যোগ্যতা ছিল না। অর্থাৎ লেখালেখির বা শিকতার অভিজ্ঞতা ছিল না। অল্পস্বল্প প্রকাশনার অভিজ্ঞতা ছিল। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র থাকা কালে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ম্যাগাজিন সম্পাদনা ও প্রকাশনার অভিজ্ঞতা ছিল। অন্যরা যেমন জিয়া হায়দার, হায়াত মাহমুদ নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজে শিক ছিলেন। জ্যোতি প্রকাশ দত্ত ছোটগল্প লিখতেন। যদিও এরা আমার যোগদানের বেশ কিছু দিন পর একাডেমিতে সহ-অধ্য পদে যোগদান করেছিলেন। তা ছাড়া এরা তিনজনই তরুণ কবি বা গল্প লেখক হিসেবে কিছুটা পরিচিতি লাভ করেছিলেন। বাংলা একাডেমিতে চাকরিরত থেকে তারা তো লেখালেখি চালিয়ে যেতে লাগলেন। আমার চেয়ে বয়সে বড়, যেমন আবু জাফর শামসুদ্দীন, গ্রন্থগারিক শামসুল হক, সরদার জয়েনউদ্দীনÑ সবাই উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখতেন। আমার স্ত্রী এমন অবস্থা মানতে পারছিলেন না। তিনি আমাকে কিছু একটা লেখার প্ররোচনা ও উৎসাহ দিচ্ছিলেন। এদিকে ১৯৬৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমির নিজস্ব ছাপাখানা স্থাপনের উদ্যোগের সাথে জড়িত ছিলাম অথচ আমি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ ছিলাম না। সে কারণে মুদ্রণযন্ত্র বিষয়ে জ্ঞানলাভের জন্য মুদ্রণ ও প্রকশনা বিষয়ক বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম এবং একাডেমির প্রধান গ্রন্থাগারিক শামসুল হককে এসব বই একাডেমির গ্রন্থাগারে সংগ্রহ করতে অনুরোধ করলে তিনি আমার প্রয়োজনীয় বই ক্রয়ের ব্যবস্থা করলেন। মুদ্রণযন্ত্র বিষয়ক বিভিন্ন বই পড়ে এ বিষয়ে কিছুটা জানতে পেরেছিলাম। তখন ছাপাখানার ইতিহাস রচনার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার হাতের লেখা খুব খারাপ থাকায় আমি ডিকটেশন দিতাম এবং আমার স্ত্রী লিখতেন। অনেকগুলো বই থেকে তথ্য নিয়ে ‘ছাপাখানার ইতিকথা’ বইটি লিখেছিলাম। লেখার সময় সরদার ফজলুল করিম ও শামসুল হকের পরামর্শ নিতাম। এর পাণ্ডুলিপি একাডেমিতে সংস্কৃতি বিভাগে সরদারের কাছে ১৯৬৮ সালে জমা দিলাম। তিনি পদ্ধতি গত নিয়ম মেনে বইটি গ্রহণ করলেন এবং কিছু দিনের মধ্যে প্রকাশন বিভাগে আমার কাছে দ্রুত ছেপে প্রকাশ করার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। বইয়ের কভার করার জন্য দায়িত্ব দিলাম সেকালের অন্যতম বিখ্যাত শিল্পী কালাম মাহমুদকে। বিভিন্ন বই থেকে যে সব ছবি সংগ্রহ করেছিলাম সেগুলো কপি মেশিনে কপি করে দিয়েছিলেন আমাদের বন্ধু মতলুব সোবহানি। সে সময় বাজারে কপি মেশিন ছিল না। সোবহানি কলেরা হাসপাতালে কাজ করতেন। সেখানে জেরক্স কপি মেশিন ছিল। তা না হলে হাতে আঁকতে হতো। সব কিছু করার পর অন্যের বইকে পেছনে রেখে নিজের বই ছেপে প্রকাশ করতে আমার খারাপ লাগছিল। সে কারণে আমার প্রথম বই প্রকাশ করতে অনেক বিলম্ব হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে তখনকার দিনের প্রথমত ১২৫০ কপি ছাপা হয়েছিল। প্রকাশিত হওয়ার পর নিয়ম মতো ১২.৫০% হারে রয়্যালটি পেয়েছিলাম।
ইতোমধ্যে আমরা কয়েকজন মিলে আরব্য উপন্যাস ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলাম। যতদূর মনে পড়ে ১৯৬৫ সালের দিকে আমরা অনুবাদ করেছিলাম, কিন্তু সেই পাণ্ডুলিপি অনুবাদ বিভাগ থেকে প্রকাশন বিভাগে এসেছিল পাঁচ-ছয় বছর পর। তখন আবার প্রকাশন বিভাগে টাকা ছিল না। কোনো দিন সেই আরব্য উপন্যাস বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ হয়েছে কিনা জানি না। তবে একটা কারণ যে সংস্কৃতি বিভাগ ও গবেষণা বিভাগে যেসব পাণ্ডুলিপি গ্রহণ করা হতো তখন লেখককে অগ্রিম হিসেবে কিছু দেয়া হতো। চুক্তি হতো যে প্রকাশের পর মূল্য নির্ধারণের পর রয়্যালটি বাবদ যা প্রাপ্য পরিশোধ করা হবে। অনুবাদ বিভাগ যেসব পাণ্ডুলিপি গ্রহণ করত সেগুলো মূল গ্রন্থের কত শব্দ অনুবাদ করা হয়েছে সেই হিসাব করে পারিশ্রমিক দিয়ে দিত। কপিরাইট একাডেমির হতো। ফলে অনুবাদের পর সেটি প্রকাশ হলো কিনা তা নিয়ে অনুবাদক মাথা ঘামাত না। তেমনি আমাদের অনূদিত আরব্য উপন্যাস পরে প্রকাশ হয়েছে কিনা খোঁজ নেয়া হয়নি।
ছাপাখানার ইতিকথা প্রকাশ করার কিছু দিন পর আমি গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হয়ে একাডেমি ছেড়ে চলে গেলাম ও গ্রন্থকেন্দ্রের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
১৯৭৮ সালে সরকার আমাকে যখন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদে নিয়োগ দিলো তখন প্রকাশকদের প থেকে কাকে পরিচালনা পরিষদের সদস্য করা যায় তখন আমি ইউপিএলের মহিউদ্দীনের নাম প্রস্তাব করেছিলাম। তখন থেকে তার সাথে বন্ধুত্ব। হাসান হাফিজুর রহমানের নাম সাহিত্যিক হিসেবে প্রস্তাব করেছিলাম। অপর সব সদস্য পদাধিকার বলে সদস্য হতেন। যেমনÑ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, জাতীয় গ্রন্থাগারের নির্বাহী পরিচালক, ইউনেসকো জাতীয় কমিশনের সচিব। মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন সভাপতি। মনজুরে মওলা যত দিন একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন, তিনি কখনো আমাদের পরিচালনা পরিষদের সভায় উপস্থিত হননি। মহিউদ্দীন আমাদের বন্ধু ছিলেন এবং আমি যত দিন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক ছিলাম তত দিন তিনি পরিচালনা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি যেমন আমাদের অফিসে সুযোগ পেলে চলে আসতেন, তেমনি আমিও তার অফিসে আড্ডা দিতে চলে যেতাম। তার আমদানি করা বই দেখতাম। পছন্দ হলে পড়ার জন্য নিয়ে আসতাম।
এমন একসময় ইন্দোনেশিয়ার বিখ্যাত সাহিত্যিক মোখতার লুবিসের একটি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ হাতে পড়ল। ইংরেজি নাম ছিল ‘ রোড উইথ নো এন্ড’ বইটি পেয়েছিলাম আমার মামা সৈয়দ আলী আহসানের সংগ্রহ শালা থেকে। মুখতার লুবিস নিজে তাকে বইটি স্বার করে দিয়েছিলেন। বইয়ের কাহিনী ইন্দোনেশিয়ার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথে বেশ মিল মনে হয়েছিল। আমার ইচ্ছা হলো অনুবাদ করার। আলী আহসানের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে লুবিসকে চিঠি লিখে তার অনুমতি নিয়ে অনুবাদ করলাম। আমার বন্ধু ইউপিএলের মহিউদ্দীন তখন বাংলা বই প্রকাশ করতে আরম্ভ করেছে। সে রয়্যালটির ভিত্তিতে প্রকাশ করতে রাজি হলো। অনূদিত বইয়ের নাম দিলাম ‘ভয়’। প্রতি বছর শেষে যত কপি বিক্রি হতো তার হিসাবের ভিত্তিতে মহিউদ্দীন আমাকে রয়্যালটি পরিশোধ করত।
ইউপিএল অফিস ছিল মতিঝিল কমার্শিয়াল এলাকায় আদমজি কোর্টের পেছনে বিমান অফিসের উল্টো দিকে রেড ক্রিসেন্ট বিল্ডিং ভবনে। একদিন সেখানে গিয়ে মহিউদ্দীনের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। চোখে পড়ল মাইকেল জ্যাকসন রচিত তার স্মৃতিকথা ‘মুনওয়াক’। দেখে সেটি পড়তে এনেছিলাম। পড়ে বেশ ভালো লাগল। কথাটা মহিউদ্দীনকে বলতে সে বলল, অনুবাদ করে দিন না কেন’। আমি বললাম, পারিশ্রমিক দিলে করে দেবো, তবে লেখকের অনুমতি আপনাকে আনতে হবে। সে রাজি হলে আমি অনুবাদ করে দিলাম। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সহকারী পরিচালক বদিউদ্দিন নাজির কিছুটা সম্পাদনা করে দিলো। সে তখন মহিউদ্দীনের অফিসে আমার অনুমতি নিয়ে খণ্ডকালীন কাজ করতে আরম্ভ করেছে। যদিও সরকারি বা আধা-সরকারি চাকরি করে অন্য কোথাও কাজ করার নিয়ম ছিল না। যা হোক ইউপিএল থেকে ‘মাইকেল জ্যাকসনের আমার কথা’ নামে বইটি প্রকাশিত হলো। অনুবাদক হিসেবে যে পারিশ্রমিক পাওয়ার কথা তা আমি পেয়েছিলাম। চাকরিকালীন অবস্থায় এই তিনটি মাত্র বই প্রকাশিত হয়েছিল।
সুদীর্ঘ তিরিশ বছর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন দু’টি সংস্থায় চাকরি করে ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে অবসর গ্রহণ করলাম। অবসরে যাওয়ার কিছু পূর্বে এমন একসময় তখন গণতান্ত্রিক সরকার কেবল যাত্রা আরম্ভ করেছে। সেই বছরের কোনো একসময় জাপানে এসিসিইউর সম্পাদনা পরিষদের সভায় যোগ দেয়ার জন্য ইউনেসকো জাতীয় কমিশনের মাধ্যমে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। আমন্ত্রণ পেলেইতো হলো না। যদিও যাতায়াত থাকা খাওয়া সব খরচ জাপানের এসিসিইউর কিন্তু সংস্থা প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতির অনুমতি লাগবে। সংস্থা প্রধান যত বড় বা যত ছোট মাপের অফিসার হোন না কেন অথবা একদিনের জন্য বা এক বছরের জন্য যেতে হোক না কেন। এটাই ছিল নিয়ম। নিয়ম মতো মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে আবেদন করলাম। সচিব পুটআপ লিখে শাখায় বা সেকশন অফিসারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আর যায় কোথায় সেকশন অফিসার আমার বস হয়ে গেলেন। তিনি এখন নথিতে বিস্তারিত বিবরণ লিখে তার উপরের অফিসার উপসচিবের কাছে পাঠাবেন। উপসচিব পাঠাবেন যুগ্মসচিবের কাছে। তারপর তিনি, যদি তার দয়া হয়, সচিবের নিকট পাঠাবেন। সচিব পাঠাবেন মন্ত্রীর কাছে। অনেক সময় এ পর্যন্ত নথি আসতে পারে না। পারলেও এমন বিলম্বে আসবে যেকোনো কাজে লাগবে না। যা হোক চাকরি জীবনের শেষ সুযোগ জাপানে যাওয়ার। আমি লেগে রইলাম নথির পেছনে। এরপর আবার রাষ্ট্রপতির সচিবালয় আছে। সেখানে বসে আছেন ছোট বড় আরো কয়েকজন সচিব। নথিকে যেতে হবে তাদের অনুমতি নিয়ে। সেখানে বড় সচিব ভাগ্যক্রমে দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন। ফলে রাষ্ট্রপতির অনুমতি পেলাম ও জাপানে যেতে পারলাম মাত্র এক সপ্তাহের জন্য। সেবার জাপান রেডিও থেকে আমার একটা ইনটারভিউ নিয়েছিল। তা ছাড়া টয়োটা ফাউন্ডেশনের একজন কর্মকর্তার সাথে পরিচয় হয়েছিল। তিনি আমাকে একটা কাজের ভার দিলেন। কিছু জাপানি সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ করিয়ে প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। বইগুলো অবশ্য ইংরেজি থেকে করতে হবে। কারণ সেগুলো ইতোমধ্যে ইউনেসকোর সহায়তায় ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। টয়োটা ফাউন্ডেশন সাহায্য করছে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতে। প্রথম বই জাফর তালুকদারকে দিয়ে এবং দ্বিতীয় বই অনুবাদ করিয়েছিলাম আমার বন্ধু নুরুল হুদাকে দিয়ে। ইতোমধ্যে আমি অবসরে গেলাম তখন নিজে অনুবাদ করলাম। অমি অনুবাদ করলাম ‘স্বজন’, ‘মাকিওকা চারবোন’ ও ‘কোকোরো’। অবসরকালে এই বইগুলোর অনুবাদের পারিশ্রমিক ছিল আমার এক মাত্র আয়। কারণ অবসরে যাওয়ার পর মনে হলো সব সরকারি আমলাতন্ত্র আমার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি কোনো পেনশন বা গ্রাচুটি কিছুই পেলাম না। ভাবখানা এমন যে, আমি যেন জোর করে চাকরি করেছি, সবটাই নাকি বে-আইনি। আল্লাহর মেহেরবানি এই দুর্দিনে টয়োটা ফাউন্ডেশনের অনুবাদ কাজ পেয়েছিলাম। বইগুলো নিজেই প্রকাশ করেছিলাম এবং বিক্রির দায়িত্ব দিয়েছিলাম বন্ধুবর হাবিবুর রহমানের একাডেমিক পাবলিশার্সের ওপর। এমন করে ১৯৯২ সাল থেকে ২০০২ পর্যন্ত দশ বছর অতিক্রান্ত হলো। এর মাঝে আমার আমেরিকান বন্ধু আইভান ক্যাটস তার ওবোর ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে চিনুয়া আচিবির ‘থিংস ফল এপার্ট’, ইন্দোনেশিয়ার মুখতার লুবিসের ‘টয়লাইট ইন জাকার্তা’ (জাকার্তায় গোধূলি) বইয়ের কপিরাইট সংগ্রহ করে অনুবাদের পারিশ্রমিক ও প্রকাশনার খরচ দিয়েছিল। সে আরো দু’টি বই অনুবাদ করিয়ে প্রকাশ করতে সাহায্য করেছিল।
২০০২ সালে বিএনপি দ্বিতীয়বার মতায় এলে গ্রন্থকেন্দ্রে মাহমুদ শফি নামে একজন সাহিত্যিক পরিচালক হয়ে এলেন। তিনি একদিন আমাকে তার অফিসে আমন্ত্রণ করলেন। প্রায় দশ বছর পর আমার পুরাতন অফিসে এলাম। তিনি অনুরোধ করলেন ‘বই’ পত্রিকায় লেখা দিতে। দীর্ঘ দশটি বছর আমলারা পালাক্রমে এই সংস্থার প্রধান হয়ে এসেছেন। চলে গিয়েছেন। কিন্তু কোনো দিন কোনো আমলা পরিচালক আমাকে স্মরণ করেননি। যদিও তারা জানতেন তাদের পূর্বে আমি এই প্রতিষ্ঠানে সবচেয় দীর্ঘকাল প্রধান ছিলামÑ ১৯৭৮ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত।
২০০২ সালের ডিসেম্বর বা ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত ঢাকা বইমেলায় ২০০৩ সালকে গ্রন্থ বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল। সেবারের মেলায় আয়োজিত এক দিনের কোনো আলোচনা সভায় আমাকে সভাপতি বা প্রধান অতিথি করা হয়েছিল। জানি না কী কারণে দশ বছর পর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র তথা সরকার আমাকে একটু সম্মান দিতে চেষ্টা করছিল। তখন অনেকে মনে করল আমার সঙ্গে বিএনপির ওপর মহলের ভালো সম্পর্ক আছে। ইতপূর্বে আমি যখন অবসরে যাই তখন বিএনপি মতায় ছিল, তখন কিন্তু সে কথা কেউ বলেনি বা মনে করেনি। ইতিমধ্যে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার বিষয়ে আমার কিছু লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থবর্ষের করণীয় কী তা নিয়ে একটা লেখা সম্ভবত ইনকিলাব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই লেখাটি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সেখানে প্রস্তাব করেছিলাম, যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি আগামী নববর্ষে (১৪ এপ্রিল ২০১৩) প্রিয়জনকে কিছু বই উপহার দিয়ে নববর্ষ রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করেন তাহলে নববর্ষে প্রিয়জনকে বই উপহার দেয়া সামাজিক রেওয়াজে পরিণত হবে। তখন কামাল সিদ্দিকী ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সচিব। আমার প্রস্তাব তার বেশ ভালো লাগল। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে প্রস্তাবটি অনুমোদন করিয়ে বাস্তবায়িত করার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে লেখা ছিল ‘জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের প্রাক্তন পরিচালক ফজলে রাব্বির প্রস্তাব’। মন্ত্রণালয়ে আমার প্রস্তাব নিয়ে সভা হয়েছিল কিন্তু আমাকে সেখানে ডাকা হয়নি। দু-একজন প্রকাশককে সেই সভায় ডাকা হয়েছিল, তারা আমাকে বলেছিল। যা হোক সেবার ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের আয়োজন করা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর প থেকে এবং সেই অনুষ্ঠানে অন্যান্য প্রকাশক ও লেখকদের সাথে আমিও দাওয়াত পেয়েছিলাম। তখন আমি ও ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী একসাথে সেই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান চৌধুরী। তিনি আমাকে দেখে বললেন, ‘এই যে আসুন, এই অনুষ্ঠান তো আপনার অনুষ্ঠান’। এর কিছু দিন পর গ্রন্থকেন্দ্রের কর্মকর্তা সুহিতা বলল যে এ্যাডর্ন প্রকাশনার সৈয়দ জাকির হোসেন আমার একটি বই প্রকাশ করতে চাচ্ছেন। তারপর জাকির আমার সাথে দেখা করে আমার যেকোনো একটি বই প্রকাশ করার প্রস্তাব দেয়। সে দুই হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে আমাকে বলল একটা পাণ্ডুলিপি দিতে। আমি তখন গ্রন্থাগার ও প্রকাশনা বিষয়ক আমার যে সব লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলোকে একত্রে সঙ্কলিত করে নাম দিলাম ‘বাংলাদেশের গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার’। আমার পেশাভিত্তিক দ্বিতীয় বই প্রকাশ করলেন এ্যাডর্ন প্রকাশন। বইটি এ্যাডর্ন প্রকাশ করেছিল ২০০৩ সালে। কপি সংখ্যা ছিল নাকি ৫০০। সেই ৫০০ কপি বই ২০১৫ সাল পর্যন্ত নিঃশ্বেস হয়নি অর্থাৎ দ্বিতীয় মুদ্রণ হয়েছে বলে শুনিনি। ফলে আমি আর কোনো রয়্যালটি পাইনি। ইতিমধ্যে বাংলাএকাডেমি আমার ‘ছাপাখানার ইতিকথা’ দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করল ২০০২ সালে। শিশু একাডেমি প্রকাশ করল ‘বৃই জীবন’ এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশ করেছিল ‘আহমাদ দিদাতের রচনাবলী’ অনুবাদ। সরকারি বা আধা সরকারি প্রকাশনার সুবিধা এই যে, সেখানে বই প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে রয়্যালটির টাকা সবটাই পাওয়া যায়।
২০০৪ সাল কানাডায় বেড়াতে এসে প্রায় নয় মাস ছিলাম। কানাডাকে নানাভাবে দেখেছিলাম। দেশে ফিরে লিখেছিলাম ‘মোহময় কানাডা’। কেন জানি না আগ্রহ নিয়ে বইটি প্রকাশ করল ঝিঙেফুল প্রকাশনার গিয়াসউদ্দীন খসরু। সেও কোনো চুক্তি করেনি। তবে রয়্যালটির বদলে বই দিয়েছে। সে আমার কোকোরো নামে আরেকটি জাপানি বইয়ের আনুবাদ প্রকাশ করেছিল।
২০০৯ সালে মাইকেল জ্যাকসনের আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি নতুন করে আলোচনার মধ্যমণি হলে সূচিপত্র প্রকাশনার সাইদ বারী এসে বলল, সে আমার অনূদিত মাইকেল জ্যাকসনের মুনওয়াক বা আমার কথা নতুন করে প্রকাশ করতে ইচ্ছুক। আমি ইউপিএলকে প্রশ্ন করলাম বইটি তারা আর প্রকাশ করবে কি না। তারা আমাকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিলো যে তারা ছাপবে না, আমি ইচ্ছা করলে অন্য যেকোনো প্রকাশকের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারি। বইটি কিছু সম্পাদনা ও সংযোজনা করে দিলাম। সাইদ বারী সেটি বেশ সুন্দর করে ২০১০ সালে প্রকাশ করল। সে কিন্তু কোনো চুক্তি করল না। পরের বছর দেখলাম বইয়ের প্রিন্টার্স লাইনে লেখা তৃতীয় মুদ্রণ। ভাবলাম এতগুলো মুদ্রণ যখন মাত্র এক বছরে হয়েছে, নিশ্চয় দুই হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। ভাবলাম রয়্যালটি বাবদ কিছু টাকা পাবো। বললাম রয়্যালটি বাবদ যা হোক কিছু দিতে। কোনো টাকা তো সে দিলোই না। সে অসন্তুষ্ট হলো। আমি নাকি টাকা চেয়ে তাকে অপমান করেছি।
ইতিমধ্যে আমার দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হাসান হাফিজ অনুরোধ করল স্মৃতি কথা লিখে দিতে। লিখতে আরম্ভ করলাম। সেটি ‘স্মৃতিতে বাংলা একাডেমি’ নামে আমার দেশ পত্রিকায় ধরাবাহিকভাবে ছাপা হলো। তখন অনেকে পড়ে ভালো বলেছে তবে এও বলেছে, আমি ওটা আমার দেশে ছাপাচ্ছি কেন। বাংলা একাডেমি পর্ব যখন শেষ হলো তখন মনে হলো লেখাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ হওয়া আবশ্যক। কিন্তু আমি এখন অবসরপ্রাপ্ত। আমার বই কে ছাপবে? আমার পুরাতন কর্মত্রে গ্রন্থকেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা নাজিরাকে বললাম একজন প্রকাশক ঠিক করে দিতে। সে বলল, ‘স্যার, আজকাল কোনো প্রকাশক প্রকাশনায় বিনিয়োগ করে না। লেখকদের অর্থে তারা বই প্রকাশ করে। সেই েেত্র আমি যদি সাহায্য করতে পারি তাহলে প্রকাশক পাওয়া যেতে পারে। আপনাকে শ’দুয়েক বই কিনে নিতে হবে’। আমি রাজি হলাম। নাজিরা যোগাযোগ করিয়ে দিলো জাগৃতি প্রকাশনীর দীপনের সাথে। দীপন ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বইমেলার সময় ‘স্মৃতিতে বাংলা একাডেমি’ প্রকাশ করল। বইটি বাঙালির আবেগের সাথে জড়িত। সেখানে তো আমার কথা না, একাডেমির কথা রয়েছে। অথচ সে বইটার একটা রিভিউ প্রকাশ করাল না। প্রায় এক বছর পর আমি যখন বিদেশে তখন অনুজ প্রতিম বন্ধু সাজ্জাদ কাদির নিজ উদ্যোগে একটি রিভিউ করেছিলেন। প্রকাশকের কোনো উদ্যোগ বা চেষ্টা ছিল না। আমার এক ভক্ত ইউএম আশেক আমার এই বইটার জন্য ৩০ হাজার টাকা দিয়েছিল যা আমি জাগৃতিকে দিয়েছি, যার বিনিময়ে সে সমমূল্যের বই দিয়েছিল। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রকাশিত ‘বই’ পত্রিকায় বোধহয় একটা রিভিউ ছাপা হয়েছিল। বাংলাদেশের সব সমস্যা শনিচক্রের মতো। এর শুরু ও শেষ কোথায় কেউ বলতে পারবে না। বাংলাদেশের গ্রন্থজগতের সব ধারায় অর্থাৎ লেখক হিসেবে, প্রকাশক হিসেবে, বিক্রেতা হিসেবে, রিভিউয়ার হিসেবে, গ্রন্থগারিক হিসেবে, গ্রন্থোন্নয়ন কর্মী হিসেবে (২০১৫) আমার চেয়ে অভিজ্ঞ আর কেউ বেচে অছেন বলে আমার মনে হয় না। কিছু দিন পর আমি কানাডায় চলে এলাম। কানাডা থেকেই এক এক করে পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে ইমেলে আশেকের নিকট পাঠিয়ে দিতে লাগলাম আর সে অন্বেষা গবেষণা কেন্দ্র থেকে ‘গ্রন্থকেন্দ্রের দিনগুলো’, ‘মেধাহীন মেধা’, ‘বরণীয় মানুষ স্মরণীয় বই’, ‘ভ্রমণে স্বদেশ ও বিদেশ’ নামে চারটি বই প্রকাশ করেছে। আশা করি ভবিষ্যতেও প্রকাশ করবে এবং কালক্রমে অন্বেষা গবেষণা কেন্দ্র প্রকৃত প্রকাশকে পরিণত হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement
গাজা ইস্যুতে ইউরোপের নীতির সমালোচনায় অ্যামনেস্টি আজ রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর গাজা যুদ্ধ নিয়ে প্রতিবাদ : নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৩৩ জন গ্রেফতার বিপজ্জনক মাত্রার অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতি থেকে বাঁচবেন কিভাবে বিয়ের বাজার শেষে বাড়ি ফেরা হলো না চাচা-ভাতিজির প্রধানমন্ত্রী আজ থাইল্যান্ড সফরে যাচ্ছেন ভারতীয় ৩ সংস্থার মশলায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান সাবেক শিবির নেতা সুমনের পিতার মৃত্যুতে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের শোক গণকবরে লাশ খুঁজছেন শত শত ফিলিস্তিনি মা ভারতের লোকসভা নির্বাচনে আলোচনায় নেতাদের ভাই-বোন ও সন্তান সংখ্যা চীনে শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যার শঙ্কা, ঝুঁকিতে ১৩ কোটি মানুষ

সকল