আমাদের আগামী এবং তরুণ কবিরা
- মতিন বৈরাগী
- ১৩ জুলাই ২০১৮, ০০:০০
চিরস্থায়ী বলে এ পৃথিবীতে কিছু নেই। সময়ের দূর বা নিকট আছে। বস্তুময় পৃথিবীর ধর্মই রূপান্তর। রূপান্তরের মাধ্যমে পুরাতন বাতিল হয়, নতুন আসে। যা কিছু আজকের কাল তা গত এবং আবেগ প্রশমিত হলে তা ইতিহাসের প্রতœ। মানুষ তার কৃতী ও কীর্তিকে চিরস্থায়ী রূপ দিতে চায় । প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে আবেগই মৌলিক, কেবল নিজেকে টিকিয়ে রাখার এক বাসনা। একটা স্মৃতির মন্দিরও একদিন অস্তিত্বহীন হয়ে যায়, অথচ আবেগটা ছিল টিকে থাকবারÑ থাকেনি। নির্মাণ আর সৃষ্টিকে রবীন্দ্রনাথ রেখেছিলেন দুই বিপরীত মেরুতে। সাহিত্য সৃজনধর্মী। এবং নির্দোষ। কিন্তু মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব বলেÑ মানুষ উৎপাদনশীল প্রাণী। শারীরিক প্রয়োজন মেটানো ছাড়াও অন্য উদ্দেশ্যেও সে নানা জিনিস গড়ে; শিল্পসাহিত্য তারই ফল, তার ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয় তার মানবিক সত্তা। রবীন্দ্রনাথ ‘নির্মাণ আর ‘সৃষ্টিকে’ আলাদা করেননি।
কবিতা নিয়ে প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি দার্শনিক নন্দনতত্ত্ববিদ এবং ভাষাতাত্ত্বিক যত আলোচনা করেছেন অন্য কোনো শিল্পে তা দৃশ্যমান নয়। কবিতা অধিবিদ্যা নয়--অধিবিদ্যক বিষয় থাকে। তাই কবিতা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা তত্ত্বালোচনা সমান এবং সমান্তরাল; সময়ের ফাঁদে জঞ্জালও বটে। কবিতা যেমন সত্য বলে না তেমনি মিথ্যেও বলে না। জীবনানন্দ দাশের ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার’,‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’, বিষ্ণুদের ‘কাল রজনীতে ঝড় হয়ে গেছে রজনীগন্ধা বনে’, আল মাহমুদের ‘গাঙের ঢেউয়ের মত বলো কন্যা কবুল কবুল’, শামসুর রাহমানের ‘আমি উড়ে গেলাম সূর্যের ঠোঁটে’ বাকবচনহীন প্রার্থনার মতো দালির আঁকা ঘড়ি, বা পিকাসোর ত্রিমাত্রিক নারী এ সবই হলো আপেক্ষিক মিথ্যের উদাহরণ। একজন বোদ্ধাসত্তা যখন এই আপেক্ষিক মিথ্যা বোঝে, তখন তা নান্দনিক রস নিয়ে উপস্থিত হয়।
কান্ট মনে করতেন ‘শব্দ শৃঙ্খলা প্রতিভার আলোকিত অনুশাসন, ছন্দশাস্ত্র কলাশাস্ত্র’। আর রবীন্দ্রনাথের মতে ‘আমরা যে মূর্তি গড়িতেছি, ছবি আঁকিতেছি, কবিতা লিখেতিছি, পাথরের মন্দির নির্মাণ করিতেছি, দেশ-বিদেশে চিরকাল ধরিয়া অবিশ্রাম এই যে একটা চেষ্টা চলিতেছে, উহা আর কিছুই নয়, মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অমরতা প্রার্থনা করিতেছি’।
‘বাংলা আধুনিক সাহিত্যের চরিত্র মূলত ইংরেজ শাসকদের ঔপনিবেশিক শাসনের আশু প্রয়োজনে প্রবর্তিত ও পরিচালিত ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার প্রত্যক্ষ ফসল হিসেবেই সূত্রপাত হয়েছিল ঊনবিংশ শতকে। ইংরেজদের কাছে আমরা পরাজিত না হলে সংস্কৃত সাহিত্য ভারতচন্দ্র, কৃত্তিবাস, কাশীরাম, রামপ্রসাদ, মুকুন্দরাজ, বৈষ্ণবপদাবলী ও লোকসাহিত্যের ধারা বহন করে আধুনিকতায় যুক্ত হতে আরো পিছিয়ে থাকত এবং পুঁথিসাহিত্যে ঘুরপাক খেতো’। বঙ্কিম মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ এবং এরা প্রাক-আধুনিক কালের কবি বা কথাসাহিত্যিক এবং ৩০-এর পরের কবিরা আধুনিকতার যাত্রায় শামিল হলে মধ্যযুগীয় চর্যা যুগের অবসান ঘটে। ‘আধুনিক শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন রঙ্গলাল’ সে সময়ে মোহিতলালকে কাব্যজগতে আধুনিকতার পুরোধা মনে করা হতো’
পরিচিত শব্দে কবিকে আনতে হয় অপরিচিতের দ্যোতনা। বসন্তে যেমন পুরনো পাতার জায়গায় নতুন পাতা এসে গাছকে সুশোভিত করে তেমনি কবির ব্যবহারে পুরনো শব্দও এক অসাধারণ মহীমায় ব্যবহৃত শব্দ নতুন অর্থে দ্যোতিত হয়ে থাকে। হোরেসও এই মত প্রকাশ করে গেছেন খ্রিষ্টজন্মের আগে। বাস্তবে অন্যের হৃদয়ে সাড়া জাগাতে গেলে কবিকেই প্রথম তার প্রকাশভাষায় আলোড়িত হতে হয়, বিষয়ের সঙ্গে প্রকাশের যথাযথ উপায় ও ভাবনাকে সম্প্রসারিত করতে হয়। একজন তখনই কবি যখন তার ভাষাটি হয়ে ওঠে অন্যের থেকে আলাদা এবং টেক্সটগুলোর অন্তঃক্রিয়া সমগ্র অনুভূতিক্রিয়ায় জারিত হয়ে মানবিক ও কল্যাণমুখী সুরকে ঝঙ্কৃত করে । যখন তার হৃদয়াবেগ এবং কল্পনা একটা চেতনায় সম্পৃক্ত থাকে। নিছক বায়োলজিক্যাল ক্রিয়া দ্বারা ভাষার ক্যারিকেচারকে নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করেননি। যদিও তিনি এমন মত প্রকাশ করে গেছেন ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য নেই, সাহিত্য সাহিত্যের উদ্দেশ্য’। কিন্তু এই কথাটার ব্যাখ্যা হুবহু তা-ই নয় যা বলা আছে, সাহিত্য প্রসঙ্গে তার প্রবন্ধে স্পষ্ট করেছেন, এই বলার মূলরূপটি আমরা খুঁজে পাই। প্রাচীনকালের খ্যাতিমান দার্শনিকেরাও সাহিত্য নিছক সাহিত্য বলে মনে করেননি। শুরুতে সাহিত্যে কোনো শ্রেণিচেতনা ছিল না, সমাজ ভাগ হওয়ার আগ পর্যন্ত সাহিত্য মানবজীবনের উদ্দীপনা ও যূথবদ্ধকর্মপ্রেরণা হয়ে কাজ করেছে। ক্রমে শ্রেণিবিভাজন এসেছে, পরিবারপ্রথা থেকে গোষ্ঠিপ্রথা এবং নানা রূপান্তরে প্রভু ও দাসে সমাজ ভাগ হয়ে গেছে। উৎপাদনে নতুন মাত্রার উপস্থিতি ঘটেছে। শিল্পসাহিত্য সেই জীবনলগ্নতা হারিয়ে প্রভুর তুষ্টিতে তোষামোদে তৃপ্তিতে জোগান হয়েছে। হোরেস যখন বলেন কবির কাজ ‘মানবজীবন ও মানবচরিত্রকে আদর্শরূপে গ্রহণ’, তখন দৈনন্দিন ভাষারও পৃথকীকরণ ঘটে এবং নতুন অর্থকে তৈরি করতে হয়। ভাষার কোনো শ্রেণিচেতনা নেই। ভাষা ব্যবহারে উচ্চ নি¤œ ও ইতর ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষকেই বিভক্ত করে। কবির কাজ এই বিভক্তিরোধে ভাষার এমন ব্যবহার সিদ্ধ করা, যা সামগ্রিক এবং যা সবার দিকের চিন্তায়ক হয়ে সবাইকেই একই রূপে শনাক্ত করতে পারে।
অনেকেই দশক হিসেবে কবিকে চিহ্নিত করতে চান না। কারণ হিসেবে তারা বলেন, কবি হলো চিরকালীন যুগোত্তীর্ণ। বাস্তবে সাহিত্যে চিরকালীন বলে কিছু নেই কথাটা এ রকমই নন্দনতত্ত্ববিদ বামগর্টেনের। মানুষ সময়ের বাইরে যেতে পারে না। একজন কবি লেখেন তার সময়ে তার সমাজে দাঁড়িয়ে, সঙ্গত কারণে যা কিছু বিশেষ কিছুর অনুভূতি থেকে তৈরি হয় সেটা তার কালের আবার সমাজ পরিবর্তনের তার পরিবর্তন ঘটে, পরিবর্তন ঘটে রুচি ও অভ্যাসের। সে কারণে সাহিত্যে দশক একটা দর্শক হিসেবেও কাজ করে। এ জন্যই প্রত্যেকটি সৃষ্টির কাল সৃষ্টিতে উল্লেখ থাকা বাঞ্ছনীয়। গবেষকদের মতে, সাত থেকে দশ বছর অন্তর একটি চক্রাকার গতি পর্যায়ক্রমে ফিরে আসে চন্দ্রকলার মতো। আর লম্বা সময়ের হিসেবে ৫০ বছর অন্তর এই রকম আবর্তন গতি দেখা যায়। সমাজে নানা ভাঙন নানা পরিবর্তন এই লম্বা সময়ে ঘটে। ফলে একজন কবির কাব্যজীবনে বহু সময়ের বহুলবর্ণাঢ্যতা আমরা লক্ষ করি। আর পরবর্তী সময়ে তার আবেদন আর তেমন স্ফূর্তিতে থাকে না। তত্ত্ববিদ জেমসনের মতে, অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে ১৮৪৭, ১৮৪৭-এর সঙ্কট থেকে ১৮৯০ এবং ১৮৯০ থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এবং পরবর্তী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেকে বর্তমান সময়। এক একটি দীর্ঘ ঢেউয়ের সাথে সৃষ্টিতে সে যুগের বৈশিষ্ট্যগুলো প্রতিফলিত হয়েছে। চতুর্থ পর্বের ঢেউ এ পর্বটি তৃতীয় প্রযুক্তিগত বিপ্লবের প্রতিনিধি। জেমসন বাজার ধনতন্ত্র,একচেটিয়া ধনতন্ত্র ও বহুজাতিক ধনতন্ত্রের যুগের সাংস্কৃতিক রূপ বলতে গিয়ে আখ্যায়িত করেছেন বাস্তবতাবাদ, আধুনিকতাবাদের সময়কাল। সুতরাং একজন সৃজনশীল মানুষ কবি কিংবা শিল্পী কিংবা কথাশিল্পী কিংবা অভিনয় শিল্পী কেউই কোনো পর্যায়ে এই সময় কালকে অস্বীকার করে তার মেধাশক্তির বিকাশ ঘটাতে পারেন না।
দীর্ঘপথ পরিক্রমায় বাংলা কবিতা যে অভিজ্ঞতা আর্জন করেছে, বিশ^সাহিত্য পরিসরে তা নিতান্ত ফেলনার নয়। প্রতিটি দশকে এই অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত হচ্ছেন তরুণ কবিরা। মূলত তারাই কাব্যস্ফুলিঙ্গ। প্রবীণদের অনেক পুরনো ধারণাও তারা ভেঙে দিচ্ছেন। প্রবীণ কেবল তাদেরকে অভিজ্ঞতার আহঙ্কারই দিচ্ছেন না, নিচ্ছেনও। সব অভিজ্ঞতাই এভাবে বাতিল ও পুনর বাতিলের মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করে। আবার যারা যুক্ত হচ্ছেন তাদের মধ্যের কেউ কেউ টিকে থাকছেন, অনেকেই মধ্য পথে হারাচ্ছেন । ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে সমাজ রাষ্ট্রের গতিময় বিবর্তন। তবে এটা সত্যÑ প্রত্যেকটি দশকে যদি তরুণ কবিদের কিছু না কিছু আবির্ভাব ঘটত তাহলে কাব্যভুবন গতিহীন আবদ্ধ পাকে আটকে যেত। সে কারণে কি সমাজে, কি রাজনীতিতে, কি জীবনচক্রপ্রণালীতে তরুণেরা যে হইচই করে তা কখনো উগ্রতা বলে বিবেচনা পায় প্রবীণদের কাছে, তার পরও সময়ে তার পলির স্থিতি আমরা দেখি সামগ্রিক সৃষ্টিতে। কারণ, মানবসমাজ স্থবির নয়। আমাদের কাব্যভুবনে নতুনরা পজিটিভ কন্ট্রিবিউশনও করছেন। অনেক তরুণ কবি কবিতায় এমন সব বিষয় উপস্থিত করছেন এবং এমনভাবে করছেন যে অভ্যাসগত চিন্তাটাই নাড়া খাচ্ছে। তারা কেবল ভাঙছেন না নতুন ঐতিহ্য তৈরিতেও পারঙ্গমতা দেখাচ্ছেন। আমি প্রথম দশকের কয়েকজন কবির কবিতা একটু মন লাগিয়ে পড়বার সুযোগ নিয়েছিলাম। এরা হলেন জুননু রাইন, মাজুল হাসান, জাহিদ সোহাগ, মামুন রশীদ, পিয়াস মজিদ, অতনু তিয়াস, আফরোজা সোমা, ফজলুল হক তুহিন, মুজিব ইরম, চাণক্য বাড়ই, আন্দালিব, আপন মাহমুদ, চন্দন চৌধুরী, জাহানারা পারভীন, তুষার কবির, বীরেন মুখার্জি, অনু ইসলাম, মোশাররফ মাতুব্বর, সায়েম অনিন্দ, কবির মুকুল প্রদীপ, ক্যামেলিয়া আহমদ, অয়ন্ত ইমরুল, শাওন আসগর প্রমুখ। আরো অনেকের লেখা সুযোগ পেলে পড়ি। তাদের নিয়ে নিজের কথা বলব কোনো এক সময়।
এদের কারো কারো শক্তিতে আস্থা রাখার মতো, কেউ কেউ হতবাকও করে কাব্যভাষায় গঠনে নির্মাণে নতুন আস্বাদ এনে দিচ্ছেন। কেউ কেউ উপমা উৎপ্রেক্ষার সংযত প্রয়োগ এবং ঐতিহ্যের নবরূপায়ন ঈর্ষা করার মতো। কবিতার জন্য সব সময়ই দরকার নতুন স্বরব্যঞ্জনার, কেবল উপমা, উৎপ্রেক্ষা আর মিথের আয়োজন কবিতাকে ভারী করে, নতুনদের কারো কারো কবিতায় তার প্রবণতা আছে, কিন্তু আমি বিশ^াস করি এরা সৃষ্টিকে বিশ^পরিসরের সাথে যুক্ত করেই লিখবে, যেমন লিখেছিল ৩০-কে অতিক্রম করে ৪০, যেমন ৪০-কে অতিক্রম করেছিল ৫০ এবং একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনল ৬০ নতুন স্বপ্ন গড়ে। এমনি প্রতিটি দশকে তরুণেরাই জগদ্দল ভাঙে, নতুন ভাষায় রাঙায় কাব্যভূমি। যেমন মাজুল বলেনÑ ‘পাগল মাত্রই উচ্চতর ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্র। খড়িমাটি সহযোগে ওকে রাস্তা রাঙাতে দাও।’ রাইন বলেনÑ ‘ধর, আমাদের মনে পড়াগুলো দূরে গেল।/গেল ফুল ফুটতে, ফসল ফলাতে’ এমনি আরো উজ্জ্বল পঙ্ক্তি রয়ে গেলো উল্লিখিত অন্য কবিদের। হ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা